Ajker Patrika

ক্ষমা করবেন জ্যোতিকাবালা

কামরুল হাসান
আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০: ০৭
ক্ষমা করবেন জ্যোতিকাবালা

সীমাবিহারের ভান্তে প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষুর জন্য বসে আছি অনেকক্ষণ। তিনি কোথায় গেছেন কেউ বলতে পারছেন না আবার ফোনও ধরছেন না। আমার সঙ্গে কক্সবাজারের সাংবাদিক আবদুল কুদ্দুস রানা। তিনি কয়েকজনের কাছে খোঁজ-খবর নিয়ে জানতে পারলেন বের হওয়ার সময় ভান্তে ফোনও সঙ্গে নেননি। আমরা এসেছি বৌদ্ধবিহারে হামলার এক বছর পূর্ণ হওয়ার ফলোআপ করতে। স্বাভাবিকভাবেই হালনাগাদ তথ্যের জন্য প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষুর সঙ্গে কথা বলাটা জরুরি। রানা খুবই বিরক্ত, কিন্তু আমার মুখের দিকে চেয়ে কিছু বলতে পারছেন না।

অবশেষে আমাদের ক্লান্ত অপেক্ষায় ক্ষান্ত দিয়ে প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু এলেন ঘণ্টা দেড়েক পরে, মলিন মুখে। মনে হলো তিনি কোনো কিছু নিয়ে বেশ ঝামেলায় আছেন। কী নিয়ে তিনি অত ব্যস্ত জানতে চাইলে এক বৃদ্ধার কথা বললেন, যিনি দুই দিন আগে মারা গেছেন। এরপর সেই করুণ মৃত্যুর কাহিনি শুনতে আমাদের নিয়ে গেলেন বৃদ্ধার বাড়িতে, বিহার থেকে পায়ে হাঁটা দূরত্বে।

বৃদ্ধার নাম জ্যোতিকাবালা বড়ুয়া। তাঁর মৃত্যুর ঘটনা শরৎ বাবুর ‘মহেশ’ গল্পকে মনে করিয়ে দেয়। সেই গল্পে জমিদারের জমিতে ঘাস খাওয়ার অপরাধে দরিদ্র গফুরের ‘মহেশ’কে শাস্তি পেতে হয়েছিল। মহেশের মৃত্যুর পর রাতের অন্ধকারে গফুর আর তাঁর আদরের মেয়ে আমিনা সৃষ্টিকর্তার কাছে জমিদারের বিরুদ্ধে নালিশ দিতে দিতে গ্রাম ছাড়েন। বলেন, ‘যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেওয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয়নি, তার কসুর তুমি যেন কখনো মাফ করো না।’  

কক্সবাজারের জ্যোতিকাবালা অবশ্য অতটা সাহস দেখাতে পারেননি। তার আদরের গাভিটি ঘাস খেতে ঢুকেছিল রামুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবনের আঙিনায়। এই অপরাধে রাতভর গাভিটিকে আটকে রাখা হয়। জ্যোতিকাবালাকেও গালমন্দ করা হয়। লজ্জায়, অপমানে নীল জ্যোতিকাবালা ঘটনার পরপর চলে যান সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে। গফুরের মতো প্রিয় গাভির জন্য কোনো অপমান তাঁকে আর স্পর্শ করতে হয়নি।

সেই নির্বাহী কর্মকর্তা হয়তো ভেবেছিলেন, হতদরিদ্র বিধবা নারীর অপমানে সমাজের কোনো তাল ভঙ্গ হবে না। কিন্তু রামুর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ সেই অপমান নিজের করে নেয়। এরপর ‘আপাত নিরীহ’ এই ঘটনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করে। জ্যোতিকাবালার মৃত্যুকে ‘প্ররোচিত’ দাবি করে বিচার চায়। তাদের সঙ্গী হয় অন্য সম্প্রদায়ের মানুষও।

রামু উপজেলার মেরংলোয়া গ্রামে কেন্দ্রীয় সীমাবিহারের পাশেই দরিদ্র জ্যোতিকাবালার বাড়ি। স্বামী বাঁশিমোহন বড়ুয়া অনেক আগেই মারা গেছেন। এরপর তিন মেয়েকে নিয়ে শুরু তাঁর সংগ্রামের জীবন। বড় মেয়ে বিয়ে করে সংসারী হন। মেজ মেয়ে আরজু পরিবারের হাল ধরতে শহরে পোশাক কারখানায় কাজ নেন। ছোট মেয়ে পপি তখন রামু কলেজে প্রথম বর্ষে পড়তেন। চারজনের এই পরিবারে আর ছিল সন্তানসম গাভিটি। পরিবারের ভার বহনে এর ভূমিকাও কম ছিল না।

আরজু বললেন, গাভিটি দূর থেকে মায়ের উপস্থিতি বুঝতে পারত। আর মা দিনের বেশির ভাগ সময় কাটাতেন গাভির সঙ্গে। নিজে না খেলেও তাকে না খাইয়ে রাখতেন না। গাভির ওপরই মেয়েদের ভবিষ্যৎ সঁপে দিয়েছিলেন জ্যোতিকাবালা।

আরজু আমাদের বলেছিলেন, সেদিন বিকেলে (৩ জানুয়ারি ২০১৩) হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যায় গাভিটি। কোথাও খুঁজে না পেয়ে মা পাগলপ্রায়। পরদিন সকালে জানতে পারেন, আগের দিন বিকেলে গাভিটি উপজেলা পরিষদের আবাসিক আঙিনায় ঢুকে পড়েছিল। এই অপরাধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গাভিটি আটকে রাখেন। খবর পেয়ে ছোট মেয়ে পপিকে নিয়ে জ্যোতিকাবালা যান গাভিটি ছাড়াতে।

পপি আমাদের বললেন, ‘আমাদের দেখেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন নির্বাহী কর্মকর্তা। বললেন, এক হাজার টাকা না দিলে গরু দেব না। খোঁয়াড়ে দেব। তোকেও (জ্যোতিকাবালাকে) পুলিশে দেব। না হলে গরু জবাই করে লোকজনকে খাওয়াব।’ এক হাজার টাকার কথা শুনে মা অনেক মিনতি করেন। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। খালি হাতে ফিরে আসেন জ্যোতিকাবালা। ‘ইউএনওর বাড়ি থেকে বের হয়ে শহীদ মিনারের কাছে এসে মায়ের জ্ঞান হারানোর উপক্রম হয়। কোনোমতে ধরে বাড়িতে আনি। সেদিন সারা দিন মা কিছু খাননি। গরু ফেরত না পাওয়ার আশঙ্কা আর সরকারি কর্মকর্তার গালমন্দ শুনে নিভৃতে কাঁদতে থাকেন। বিকেলের দিকে কিছুটা সুস্থ হলে গাভিটি ছাড়িয়ে আনেন।’ এরপর থেকে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরদিন তাঁকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়, রাত সাড়ে ১১টার দিকে মারা যান।

জ্যোতিকাবালা ছিলেন উচ্চরক্তচাপের রোগী। ঘটনার পর থেকে দুশ্চিন্তায় তাঁর রক্তচাপ বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে সেটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। রামু থেকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেওয়া পর সেখানকার চিকিৎসকেরা তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতালে নিতে বলেছিলেন। কিন্তু অনটনের কারণে মেয়েরা তাঁকে নিতে পারেননি। পরের দিন নেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছিল। কিন্তু পরের দিনের সূর্যোদয় আর দেখা হয়নি জ্যোতিকাবালার।

জ্যোতিকাবালার শবযাত্রায় এসে এসব ঘটনা শুনে ক্ষোভে ফেটে পড়ে স্থানীয় লোকজন। ৬ জানুয়ারি (২০১৩) মিছিল করে তারা ইউএনওর কার্যালয় ঘেরাও করে। মিছিলে সব সম্প্রদায়ের লোকজনই ছিল। শুধু ছিলেন না কোনো রাজনৈতিক নেতা। ছেলে-বুড়ো সবার এই মিছিল পুলিশের বাধার মুখেও পড়ে।

কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে তাঁর সঙ্গে কথা বলা বা বক্তব্য শোনা সাংবাদিকতার খুব সাধারণ একটা নিয়ম। সেই নিয়মে ইউএনওর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। আমার প্রশ্ন ছিল, ‘আবাসিক এলাকায় গরু ঢুকে কোনো ক্ষতি করলে খোঁয়াড়ে দেওয়ার বিধান আছে। কিন্তু বৃদ্ধাকে গালমন্দ করলেন কেন?’ প্রশ্ন শুনেই তেতে ওঠেন নির্বাহী কর্মকর্তা। বলেন, ‘কে বলেছে গালাগাল করেছি। বাজে কথা বলতে আসবেন না।’

পরের প্রশ্ন ছিল, তাহলে এ ঘটনা নিয়ে মিছিল হলো কেন? জবাবে সেই প্রচলিত উত্তর, ‘এখানকার কিছু লোক চাইছে না আমি থাকি। তারা এসব করেছে।’

তবে তখনকার রামু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গাজী মো. সাখাওয়াত হোসেন আমাদের বলেছিলেন, নির্বাহী কর্মকর্তা বৃদ্ধাকে বকাঝকা করেছিলেন। সেটা তিনিও জানতেন।

জ্যোতিকাবালার মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারের কেউ এ নিয়ে কোথাও কোনো অভিযোগ জানাতে যাননি। নিরুপায়ের যে চিরন্তন ভরসা, তাতেই মা হারানোর সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছিলেন দুই বোন। আরজু আমাদের বললেন, ‘আমরা কোনো বিচার চাইনে স্যার, আমাদের বিচারের জন্য তো ভগবান আছেন। তিনি সব দেখেন, যা করার তিনিই করবেন।’ তাঁর দুচোখ টলমল।

আরজুর কথা শুনে নোটবুক পকেটে ঢুকিয়ে গাড়িতে উঠতেই মনে পড়ে গেল মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই কথা–‘ঈশ্বর থাকেন ওই ভদ্রপল্লিতে’। জ্যোতিকাবালার পরিবার ‘কি তাহাকে খুঁজিয়া পাইবে?’

আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

আমিনুল ইসলাম নন, শিক্ষা উপদেষ্টা হচ্ছেন অধ্যাপক আবরার

গণপিটুনিতে নিহত জামায়াত কর্মী নেজাম ও তাঁর বাহিনী গুলি ছোঁড়ে, মিলেছে বিদেশি পিস্তল: পুলিশ

উপদেষ্টা হচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আমিনুল ইসলাম

বসুন্ধরায় ছিনতাইকারী সন্দেহে ২ বিদেশি নাগরিককে মারধর

বিএনপির দুই পেশাজীবী সংগঠনের কমিটি বিলুপ্ত

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত