‘নিখোঁজ’ লিয়াকতের সম্পদ ভাগাভাগি হচ্ছে না

নাজমুল হাসান সাগর, ঢাকা
প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮: ১৮
আপডেট : ১২ জানুয়ারি ২০২৩, ১২: ২১

বাইরে থেকে ফটকে প্রচণ্ড আঘাতের শব্দে ঘুম ভাঙে বাড়ির কেয়ারটেকারের। তখনো ভোর। ঘুম ঘুম চোখে ফটকের কাছে গিয়ে দেখেন, সাদাপোশাকে অস্ত্রধারী পাঁচ-সাতজন বাইরে দাঁড়িয়ে। নির্দেশ পেয়ে ফটক খুললে অস্ত্রের মুখে সিঁড়ি বেয়ে ওপরের একটি ফ্ল্যাটের সামনে নিয়ে তাঁকে দিয়ে কলবেল বাজানো হলো। দরজা খুলতেই তাঁরা ভেতরে ঢুকে একজনকে খুঁজতে লাগলেন। অল্প সময়ে একটি ঘরে কাঙ্ক্ষিত সেই ব্যক্তিকে পেয়েও গেলেন। দু-তিনজন তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রথমে পিছমোড়া করে দুই হাত বাঁধলেন। তারপর কালো টুপিতে ঢেকে দিলেন চোখ-মুখ। দ্রুত ঘটে যাওয়া এ ঘটনায় ওই ব্যক্তি প্রতিরোধের কোনো সুযোগই পেলেন না। টেনেহিঁচড়ে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে বাইরে থাকা গাড়িতে তুলে নিয়ে গেলেন।

রাজধানীর লালমাটিয়ার একটি বাড়িতে ২০০৮ সালের ২৫ নভেম্বর ভোরের ঘটনা এটি। গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিটি হলেন যুবলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় নেতা ও বিগত চারদলীয় জোট সরকার ঘোষিত শীর্ষ ২৩ সন্ত্রাসীর অন্যতম লিয়াকত হোসেন। তাঁকে বলা হতো রাজধানীর অপরাধ-জগতের ‘ফাইভ স্টার’ গ্রুপের নেতা। এরপর আর কোনো খোঁজ নেই তাঁর। স্ত্রীর বড় বোনের ফ্ল্যাট থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার এমন বর্ণনাই দিলেন তাঁর এক স্বজন। বললেন, এরপর ১৪ বছর ধরে তাঁরা অপেক্ষায়। বেঁচে আছেন, নাকি নেই–এমন দোটানায় কাটছে দিন।

লিয়াকতের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার ভান্ডারিকান্দি গ্রামে। সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম। ছয় ভাই, এক বোনের মধ্যে তিনি সেজ। বাবা ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। চাচা প্রখ্যাত সাংবাদিক ও বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর। এসএসসি পাসের পর ঢাকায় এসে কলেজে ভর্তি হন। সখ্য হয় তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা ও পরবর্তীকালে গডফাদার হিসেবে পরিচিতি পাওয়া হেমায়েতউল্লাহ আওরঙ্গের সঙ্গে। ঢাকা কলেজের ছাত্র না হয়েও ছাত্রাবাসের কক্ষ দখল করে থাকতেন ছাত্রলীগের রাজনীতি করা লিয়াকত। এক ভাই ছাড়া তাঁর পুরো পরিবারই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত।

লিয়াকতের খোঁজে তাঁর স্ত্রী ও পরিবার নানা মহলে-দপ্তরে ছোটাছুটি করেন। সংবাদ সম্মেলনও করেন। একসময় নীরব হয়ে যান তাঁরা। লিয়াকতের পরিবারের খবর জানতে সম্প্রতি এই প্রতিবেদক যান তাঁর একমাত্র বোনের ভাড়া বাসায়। ভাইয়ের প্রসঙ্গ তুলতেই আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলেন যুব মহিলা লীগের এই নেত্রী। বললেন, ভাইয়ের স্ত্রীর সঙ্গে তাঁদের তেমন যোগাযোগ নেই। জরুরি দরকার হলে কালেভদ্রে বড় ভাইকে ফোন করেন। উত্তরার প্লটসহ লিয়াকতের রেখে যাওয়া সম্পদ আর পৈতৃক সম্পত্তির ভাগাভাগি নিয়েই মূলত কথা হয়। কথা শেষ হলেই ফোন বন্ধ করে দেন। নিঃসন্তান লিয়াকতের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী যেমন তাঁর স্ত্রী, তেমনি তাঁরাও। কিন্তু তিনি আসেন না। ফোনও ধরেন না।

লিয়াকতের এক ভাই তাঁদের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন কয়েক দফায়। এক ভাই ইউনিয়ন কৃষক লীগের সভাপতি। সবার ছোট ভাই যুবলীগের নেতা। মেজ ভাই প্রবাসী। আর বড় ভাই সরকারি চাকরিজীবী। লিয়াকতের বোন স্মৃতিকাতর হয়ে বলতে থাকেন, ঢাকায় এসেই তাঁর ভাই ছাত্রলীগে জড়িয়ে পড়েন। দীর্ঘ দুই দশক সংগঠনকে সংগঠিত করেন। আশির দশকের শুরুতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান। এরশাদের শাসনের পুরো সময়ই তিনি ছিলেন কারাগারে। মুক্তি পাওয়ার পর যুবলীগের সঙ্গে জড়িত হন। বিএনপি তাঁকে বিভিন্ন সময়, বিভিন্নভাবে দলে ভেড়াতে চাইলেও গুম হওয়ার আগপর্যন্ত যুবলীগেই ছিলেন।

জানা যায়, একসময় ইস্কাটনে প্রতিবন্ধী স্কুলের পাশে বাড়ি দখল করে একটি ক্লাবঘর বানান লিয়াকত। সেখান থেকেই চালাতেন তাঁর সব কর্মকাণ্ড। পরে অফিস করেন বাংলামোটরের হেলেনা টাওয়ারে। থাকতেন ইস্কাটনের একটি অ্যাপার্টমেন্টে। ঠিকাদারির পাশাপাশি চাঁদাবাজি, একসময় জড়ান সোনা চোরাচালানের সঙ্গেও। বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে টোকাই সাগরের সঙ্গে বিরোধের জেরে মুরগি মিলন, পিচ্চি হান্নানদের নিয়ে গড়ে তোলেন ফাইভ স্টার গ্রুপ। সঙ্গে ছিলেন মগবাজারের আরমান। প্রতিপক্ষ সুব্রত বাইন, টোকাই সাগরদের সেভেন স্টার গ্রুপ। সেই বিরোধে ২০০০ সালের ১৮ মে ঢাকার জজকোর্ট এলাকায় খুন হন মুরগি মিলন। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে বিব্রত হয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সব রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে লিয়াকতকে নিষিদ্ধ করা হয়। ২০০০ সালের ২০ অক্টোবর রমনা থানার পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। মুক্তি পান ২০০১-এর নির্বাচনের কিছুদিন আগে। নির্বাচনে জিতে বিএনপি ক্ষমতায় এসে লিয়াকত, তাঁর ভাই কামরুল হাসান হান্নানসহ ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশ করে। ধরিয়ে দিতে পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। পালিয়ে যান ভারতে। একসময় কলকাতায় গ্রেপ্তার হন। ২০০২ সালের ১৯ নভেম্বর জামিনে মুক্তি পান। ২০০৩ সালে দেশে ফেরার পর গ্রেপ্তার হয়ে পাঁচ বছর কারাগারে ছিলেন। উচ্চ আদালতে রিট করে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে মুক্তি পান।

লিয়াকতের বোন বলেন, লিয়াকতের খোঁজ পেতে তাঁরা র‍্যাবসহ নানা জায়গায় যোগাযোগ করেন, কিন্তু খোঁজ পাননি। এক ব্যক্তিকে ৪০ লাখ টাকাও দেওয়া হয়ছিল। কিন্তু টাকা নিয়ে তিনি ফোন বন্ধ করে দেন। একবার খবর পেলেন, লিয়াকতকে মেরে রাঙামাটিতে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর সত্যতা পাননি। কথাগুলো বলছিলেন ধরা গলায়।

লিয়াকতের সন্ধানে তৎপরতা থেমে যাওয়া প্রসঙ্গে লিয়াকতের বোন বললেন, ‘হুট করেই লিয়াকত ভাইয়ের স্ত্রী চুপ হয়ে গেলেন। তাঁকে কেউ ফোন করে এ নিয়ে বাড়াবাড়ি না করতে বলেছিলেন। এরপর তিনি চুপ মেরে যান। কারও ফোন ধরতেন না।’ ভাইকে সন্ত্রাসী মানতে নারাজ তিনি। জোর দিয়ে বললেন, ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে বিএনপি তাঁকে শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকাভুক্ত করেছে। এলাকার মানুষ তাঁকে ভালোবাসত। সন্ত্রাসী হলে কেন ভালোবাসবে। কথায় কথায় জানালেন, গত ডিসেম্বরে ভান্ডারিকান্দি ইউনিয়নে ১০ শয্যার একটি মা ও শিশু কল্যাণ হাসপাতাল করা হয়েছে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত হোসেন মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র।’ তিনি বললেন, ‘কেন তাঁকে (লিয়াকত) গুম করা হলো—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি সব সময়, কিন্তু পাই না। এই একটা প্রশ্নই বুকে চাপা কষ্ট হয়ে জমে আছে।’

আরও পড়ুন:

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

সরকারি চাকরিজীবীরা সম্পদের হিসাব না দিলে যেসব শাস্তির মুখোমুখি হতে পারেন

ভারতের পাল্টা আক্রমণে দিশেহারা অস্ট্রেলিয়া

ঢাকা কলেজে সংঘর্ষকালে বোমা বিস্ফোরণে ছিটকে পড়েন সেনাসদস্য—ভাইরাল ভিডিওটির প্রকৃত ঘটনা

ঐশ্বরিয়ার বিচ্ছেদের খবরে মুখ খুললেন অমিতাভ

লক্ষ্মীপুরে জামায়াত নেতাকে অতিথি করায় মাহফিল বন্ধ করে দেওয়ার অভিযোগ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত