রিমন রহমান, রাজশাহী ও অর্চি হক, ঢাকা
অ্যাপে গ্রাহক হয়ে বিদেশি সিনেমার টিকিট কিনে রাখলেই লভ্যাংশ। যত টিকিট তত লাভ। টাকায় নয়, বিনিয়োগ-লাভের সব হিসাব মার্কিন ডলারে। অ্যাপে জমা রাখা ডলার লাভ-আসলে এক মাসেই বেড়ে দ্বিগুণ থেকে ৩৬০ গুণ পর্যন্ত হচ্ছিল। এভাবে অ্যাপে কেউ লাখ, কেউবা হাজার হাজার ডলারের মালিক বনে গিয়েছিলেন। রাতে নিজেকে বড়লোক দেখে ঘুমালেও সকালে উঠে সবার চোখ ছানাবড়া। কারণ, হিসাবের খাতা শূন্য। ভোজবাজির মতো সব গায়েব।
দ্রুত ধনী হওয়ার লোভে এই অ্যাপে বিনিয়োগ করা কয়েক হাজার মানুষ এখন দিশেহারা। তাঁদের বিনিয়োগের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া এই অ্যাপটির নাম ‘ই-মুভি প্ল্যান’। গুগল প্লে স্টোরের এই অ্যাপের সঙ্গে যুক্ত বিদেশিসহ দেশি একটি প্রতারক চক্র।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত ই-মুভি প্ল্যানের হাজার হাজার বিনিয়োগকারী রয়েছে। বেকার তরুণ-তরুণীরাই এর বড় ইউজার (গ্রাহক)। তাঁদের মাধ্যমে কিশোর, বৃদ্ধসহ সব বয়সী মানুষ এই অ্যাপে অ্যাকাউন্ট খুলে ইউজার হয়েছিলেন। বাদ ছিলেন না সরকারি চাকরিজীবীরাও। কিছুদিন গ্রাহকেরা এই অ্যাপ থেকে টাকাও তুলেছেন। তা দেখে নতুন নতুন ইউজার লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এখন অ্যাপ থেকে টাকা তোলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন তাঁরা। তবে এ নিয়ে কেউ এখনো থানায় অভিযোগ করেননি।
গতকাল মঙ্গলবার গুগল প্লেতে গিয়ে দেখা যায়, ই-মুভি প্ল্যান নামে কোনো অ্যাপ নেই। তবে ই-মুভিপ্ল্যান প্লাস নামে একটি অ্যাপ ডাউনলোড করা যাচ্ছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘ই-মুভির বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। এটা আমাদের অথরাইজড সাইট নয়। তাই আমাদের ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগও নেই। তাদের বিষয়টি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দেখবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলী গ্রামের এক যুবক গত বছরের অক্টোবরে ই-মুভি প্ল্যানে প্রথমে ৬০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন। অ্যাপে দেওয়া মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নম্বরে টাকা দেওয়ার পর ই-মুভি প্ল্যানের অ্যাকাউন্টে তা ডলারে রূপান্তরিত হয়। সেই ডলার দিয়ে তিনি সিনেমার টিকিট কিনতে থাকেন। অ্যাকাউন্টে থাকা ডলারের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে লভ্যাংশ। ডলারে আসা লভ্যাংশও তোলেন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। রাতারাতি বদলে যায় তাঁর অবস্থা। দামি মোটরসাইকেল কেনেন। একতলার বাড়ির ছাদ ঢালাই দিয়ে দোতলার কাজ শুরু করেন। তাঁর এমন উন্নতির কারণ জেনে ওই অ্যাপে বিনিয়োগ করেন এলাকার অসংখ্য মানুষ।
প্রেমতলীর এই যুবক জানান, সর্বনিম্ন ২ হাজার টাকা বিনিয়োগ করা যেত ই-মুভি প্ল্যানে। গত সোমবার রাতেও ই-মুভি প্ল্যানে তাঁর ১ লাখ ৯১ হাজার ৭৪৫ ডলার (প্রায় ২ কোটি টাকা) ছিল। গতকাল সকালে সব শূন্য। তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে যারা অল্প বিনিয়োগ করেছে, তাদের টাকা উঠে গেছে। কিন্তু শেষ দিকে লোভে পড়ে যাঁরা চার-পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন, তাঁরা আসল টাকা তুলতে পারেননি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রেমতলী গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষ এই অ্যাপে বিনিয়োগ করেছেন। এলাকাবাসী জানেন, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য রুহুল আমিন নয়ন বলেন, ‘অনেক ভালো ভালো মানুষ এতে টাকা ঢুকিয়েছিলেন। সবার টাকা গেছে! এখন লজ্জায় স্বীকার করছেন না। আমি ২ হাজার টাকা দিয়ে অ্যাকাউন্ট করেছিলাম।’
ভুক্তভোগীরা জানান, জেলায় জেলায় নিযুক্ত ই-মুভি প্ল্যানের এজেন্টরা এটি চীনা প্রতিষ্ঠান বলে মানুষকে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কেউ একটি অ্যাকাউন্ট খোলার পর কাউকে রেফার করলে ওই তথ্যও নিজের অ্যাপে দেখাত। এরপর তার নিচে যতজন ই-মুভি প্ল্যানে যুক্ত হতো, তাদের লভ্যাংশের একটা অংশও প্রথমজন পেতেন। কারও কারও নিচে ২ হাজারের বেশি ইউজার হয়ে গিয়েছিল। সম্প্রতি অ্যাপ থেকে টাকা তোলার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে আবার টাকা তোলা যাবে। কিন্তু তা হয়নি।
প্রতারিত ব্যক্তিরা জানান, ঢাকার উত্তরার সাইফুল নামের এক ব্যক্তি ই-মুভি প্ল্যানের এজেন্ট। রাজশাহীর এজেন্টের নাম আজমল হুদা মানিক। নওগাঁর এজেন্ট লিজা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের তোফায়েল। এই এজেন্টদের নগদ টাকা দিলে তাঁরাই অ্যাপে ডলার দিতে পারতেন।
নোয়াখালীর ভুক্তভোগী মোহাম্মদ সিজান জানান, আজিজুর রহমান নামের এজেন্টের মাধ্যমে মাসখানেক আগে ২১২ ডলার বিনিয়োগ করার পরপরই তাঁকে নিষিদ্ধ করা হয়। এজেন্ট আজিজুরও লাপাত্তা।
রাজশাহীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাই-টেক পার্কের জেবিডি আইটির প্রতিষ্ঠাতা ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বিক্রম কুমার বলেন, ‘এভাবে ডিজিটালি প্রতারণা হচ্ছে। এ ব্যাপারে মানুষকে সতর্ক হতে হবে।’
ভুক্তভোগীরা জানান, বিদেশি প্রতারকেরা সব সময় টেলিগ্রাম গ্রুপে যুক্ত থেকে বার্তা দিতেন। ইউজারদের কাছে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্য করতে গত ৭ জানুয়ারি পাঁচ তারকা হোটেল ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টে সারা দেশের এজেন্ট ও বড় বড় বিনিয়োগকারীকে নিয়ে সম্মেলন করা হয়। এতে চার চীনা নাগরিক এসেছিলেন। এদের তিনজন পুরুষ ও একজন নারী। সেখানে নিজেদের ই-মুভির ভাইস প্রেসিডেন্ট পরিচয় দিয়ে কথা বলেছিলেন ব্রায়ান জন ও মিস্টার মাইকেল নামের দুজন। এই মাইকেল মাঝে মাঝে বিভিন্ন বার্তা নিয়ে ই-মুভি প্ল্যানের ভেরিফায়েড অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে লাইভে আসতেন।
ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার যোগাযোগ করা হলে একজন কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে জানান, সিঙ্গাপুরের একটি ব্যবসায়িক গ্রুপের পরিচয়ে ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করে ই-মুভি প্ল্যানের নামে তাদের একটি হল বুক করা হয়েছিল। ব্যবসায়িক নীতির কারণে রিজেন্সির ওই কর্মকর্তা এর বেশি জানাতে অস্বীকৃতি জানান।
ভুক্তভোগীরা জানান, এমডি কৃষ্ণা নামের একটি টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে ইউজারদের সঙ্গে কথা বলতেন নিজেকে ই-মুভির পরিচালক পরিচয় দেওয়া একজন। তাঁর টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্টটি হংকংয়ের +৮৫২৬০৯১৭৩৯৬ নম্বর দিয়ে খোলা। এলিস নামের একজন সহকারী এবং মু লি জি নামের আরেকজন কথা বলতেন। আগামী ২৪ মার্চ রাজশাহী শহরের একটি তিন তারকা হোটেলে তাঁদের উপস্থিতিতে সম্মেলনের কথা জানানো হয়েছিল।
ই-মুভি প্ল্যানের রাজশাহীর এজেন্ট আজমল হুদা মানিকের অফিস শহরের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের শিরোইল কলোনি সাড়ে ৩ নম্বর গলির ৫১৩ নম্বর ভাড়া বাড়িতে। গতকাল সকালে ওই অফিসের অবস্থান জানতে চাইলে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের কর্মী মো. তন্ময়ের প্রশ্ন, ‘অনলাইনে কাজ করে ওই মানিক? ধরা খাইছেন?’ তিনি জানান, মানিক এখানে অফিস করার পর কাউন্সিলরের কার্যালয়ে তাঁর বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ এসেছিল।
মানিকের অফিসের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সেটি তালাবদ্ধ। কিছুক্ষণ পর তাঁকে খুঁজতে মোটরসাইকেলে চড়ে এলেন কয়েকজন যুবক। তাঁদের একজন মোবাইলে কাউকে বলছিলেন, ‘আমাকে সাত দিন আগে পামপট্টি মেরে ই-মুভিতে ঢুকিয়ে দিল মামা! আমি ১২ হাজার টাকা দিয়েছি। আমাকে এমনভাবে মুরগি বানালো মামা!’
কথা বলে জানা গেল, ওই যুবকের নাম হিমেল। বাড়ি শহরের উপশহরে। সঙ্গে আসা ফাহিম ও রিংকুও ই-মুভিতে বিনিয়োগ করেছেন। তাই এজেন্ট মানিককে ধরতে এসেছেন। তাঁর মোবাইল নম্বরও বন্ধ। সোমবার রাতে মানিক টেলিগ্রাম গ্রুপে এক বার্তায় বলেছেন, নিজের ডলার নিয়েই তিনি বিপাকে পড়েছেন। তাঁকে যেন কেউ ফোন করে বিরক্ত না করেন।
বিষয়টি জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করে মানিকের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। ই-মুভির এই প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত কয়েকটি হংকংয়ের মোবাইল নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। টেলিগ্রামে বার্তা পাঠানো হলেও কেউ সাড়া দেননি।
প্রতারণার শিকার এক তরুণ জানান, ই-মুভিতে তাঁর প্রায় ২ লাখ ডলার জমা হয়েছিল। কিন্তু টাকা ওঠানো যাচ্ছিল না দেখে তিনি কাস্টমার সার্ভিসের গ্রুপে যোগাযোগ করেন। গ্রুপটি পরিচালনা করা হতো হংকংয়ের +৮৫২৬৭৩৫৭৬২১ নম্বর থেকে। কিন্তু উত্তর মেলেনি। পরে মু লি জি নামের টেলিগ্রাম আইডি থেকে জানানো হয়, তাঁর ই-মুভিতে যত ডলার আছে তার ৩০ শতাংশ ১৫ ফেব্রুয়ারির আগে ডিপোজিট করলে তিনি তাঁর সব ডলার ভাঙাতে পারবেন। নির্ধারিত সময়ে ডিপোজিট না করলে বাংলাদেশ সরকার সব ডলার বাজেয়াপ্ত করবে।
জানতে চাইলে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক এস এ এম রফিকুন্নবী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ই-মুভি প্ল্যান নামে কোনো অ্যাপের কথা আমাদের জানা নেই। কিসের কে ডলার বাজেয়াপ্ত করবে? এটা পুরোপুরি প্রতারণার ফাঁদ।’
বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘সব ভাঁওতাবাজি। প্রতারিত কেউ অভিযোগ করলে এখানকার এজেন্টদের খুঁজে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল) মুহাম্মদ সাঈদ আলী বলেন, ‘আমরা ই-মুভি প্ল্যানের নামে কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে বা যে অভিযোগ উঠছে সেগুলোর সত্যতা পেলে বিটিআরসিকে সাইটটি বন্ধ করতে বলব।’ তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা অভিযুক্ত ৩৩১টি ওয়েবসাইট বন্ধ করিয়েছি। আরও ৬৯টি ওয়েবসাইটের নাম গোয়েন্দা সংস্থাকে তদন্তের জন্য দেওয়া হয়েছে।’
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম শোভন বলেন, ‘ই-কমার্সের নামে এ ধরনের ব্যবসা করা হলে আমরা সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিই। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান না হলে কিছু করার এখতিয়ার আসলে আমাদের নেই।’
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাসিম পারভেজ বলেন, ‘আমরা নিজেরা কোনো সাইট বন্ধ করি না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অথবা কোনো সংস্থা আমাদের কাছে সুপারিশ করলে আমরা সেটা বন্ধ করতে পারি। ই-মুভি প্ল্যান বন্ধের বিষয়ে যদি কোনো সুপারিশ আসে, তাহলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’
অ্যাপে গ্রাহক হয়ে বিদেশি সিনেমার টিকিট কিনে রাখলেই লভ্যাংশ। যত টিকিট তত লাভ। টাকায় নয়, বিনিয়োগ-লাভের সব হিসাব মার্কিন ডলারে। অ্যাপে জমা রাখা ডলার লাভ-আসলে এক মাসেই বেড়ে দ্বিগুণ থেকে ৩৬০ গুণ পর্যন্ত হচ্ছিল। এভাবে অ্যাপে কেউ লাখ, কেউবা হাজার হাজার ডলারের মালিক বনে গিয়েছিলেন। রাতে নিজেকে বড়লোক দেখে ঘুমালেও সকালে উঠে সবার চোখ ছানাবড়া। কারণ, হিসাবের খাতা শূন্য। ভোজবাজির মতো সব গায়েব।
দ্রুত ধনী হওয়ার লোভে এই অ্যাপে বিনিয়োগ করা কয়েক হাজার মানুষ এখন দিশেহারা। তাঁদের বিনিয়োগের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া এই অ্যাপটির নাম ‘ই-মুভি প্ল্যান’। গুগল প্লে স্টোরের এই অ্যাপের সঙ্গে যুক্ত বিদেশিসহ দেশি একটি প্রতারক চক্র।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত ই-মুভি প্ল্যানের হাজার হাজার বিনিয়োগকারী রয়েছে। বেকার তরুণ-তরুণীরাই এর বড় ইউজার (গ্রাহক)। তাঁদের মাধ্যমে কিশোর, বৃদ্ধসহ সব বয়সী মানুষ এই অ্যাপে অ্যাকাউন্ট খুলে ইউজার হয়েছিলেন। বাদ ছিলেন না সরকারি চাকরিজীবীরাও। কিছুদিন গ্রাহকেরা এই অ্যাপ থেকে টাকাও তুলেছেন। তা দেখে নতুন নতুন ইউজার লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এখন অ্যাপ থেকে টাকা তোলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন তাঁরা। তবে এ নিয়ে কেউ এখনো থানায় অভিযোগ করেননি।
গতকাল মঙ্গলবার গুগল প্লেতে গিয়ে দেখা যায়, ই-মুভি প্ল্যান নামে কোনো অ্যাপ নেই। তবে ই-মুভিপ্ল্যান প্লাস নামে একটি অ্যাপ ডাউনলোড করা যাচ্ছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ‘ই-মুভির বিষয়ে আমরা কিছু জানি না। এটা আমাদের অথরাইজড সাইট নয়। তাই আমাদের ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগও নেই। তাদের বিষয়টি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দেখবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার প্রেমতলী গ্রামের এক যুবক গত বছরের অক্টোবরে ই-মুভি প্ল্যানে প্রথমে ৬০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন। অ্যাপে দেওয়া মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নম্বরে টাকা দেওয়ার পর ই-মুভি প্ল্যানের অ্যাকাউন্টে তা ডলারে রূপান্তরিত হয়। সেই ডলার দিয়ে তিনি সিনেমার টিকিট কিনতে থাকেন। অ্যাকাউন্টে থাকা ডলারের সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে লভ্যাংশ। ডলারে আসা লভ্যাংশও তোলেন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে। রাতারাতি বদলে যায় তাঁর অবস্থা। দামি মোটরসাইকেল কেনেন। একতলার বাড়ির ছাদ ঢালাই দিয়ে দোতলার কাজ শুরু করেন। তাঁর এমন উন্নতির কারণ জেনে ওই অ্যাপে বিনিয়োগ করেন এলাকার অসংখ্য মানুষ।
প্রেমতলীর এই যুবক জানান, সর্বনিম্ন ২ হাজার টাকা বিনিয়োগ করা যেত ই-মুভি প্ল্যানে। গত সোমবার রাতেও ই-মুভি প্ল্যানে তাঁর ১ লাখ ৯১ হাজার ৭৪৫ ডলার (প্রায় ২ কোটি টাকা) ছিল। গতকাল সকালে সব শূন্য। তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে যারা অল্প বিনিয়োগ করেছে, তাদের টাকা উঠে গেছে। কিন্তু শেষ দিকে লোভে পড়ে যাঁরা চার-পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন, তাঁরা আসল টাকা তুলতে পারেননি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রেমতলী গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষ এই অ্যাপে বিনিয়োগ করেছেন। এলাকাবাসী জানেন, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য রুহুল আমিন নয়ন বলেন, ‘অনেক ভালো ভালো মানুষ এতে টাকা ঢুকিয়েছিলেন। সবার টাকা গেছে! এখন লজ্জায় স্বীকার করছেন না। আমি ২ হাজার টাকা দিয়ে অ্যাকাউন্ট করেছিলাম।’
ভুক্তভোগীরা জানান, জেলায় জেলায় নিযুক্ত ই-মুভি প্ল্যানের এজেন্টরা এটি চীনা প্রতিষ্ঠান বলে মানুষকে বিনিয়োগে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কেউ একটি অ্যাকাউন্ট খোলার পর কাউকে রেফার করলে ওই তথ্যও নিজের অ্যাপে দেখাত। এরপর তার নিচে যতজন ই-মুভি প্ল্যানে যুক্ত হতো, তাদের লভ্যাংশের একটা অংশও প্রথমজন পেতেন। কারও কারও নিচে ২ হাজারের বেশি ইউজার হয়ে গিয়েছিল। সম্প্রতি অ্যাপ থেকে টাকা তোলার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে আবার টাকা তোলা যাবে। কিন্তু তা হয়নি।
প্রতারিত ব্যক্তিরা জানান, ঢাকার উত্তরার সাইফুল নামের এক ব্যক্তি ই-মুভি প্ল্যানের এজেন্ট। রাজশাহীর এজেন্টের নাম আজমল হুদা মানিক। নওগাঁর এজেন্ট লিজা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের তোফায়েল। এই এজেন্টদের নগদ টাকা দিলে তাঁরাই অ্যাপে ডলার দিতে পারতেন।
নোয়াখালীর ভুক্তভোগী মোহাম্মদ সিজান জানান, আজিজুর রহমান নামের এজেন্টের মাধ্যমে মাসখানেক আগে ২১২ ডলার বিনিয়োগ করার পরপরই তাঁকে নিষিদ্ধ করা হয়। এজেন্ট আজিজুরও লাপাত্তা।
রাজশাহীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাই-টেক পার্কের জেবিডি আইটির প্রতিষ্ঠাতা ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বিক্রম কুমার বলেন, ‘এভাবে ডিজিটালি প্রতারণা হচ্ছে। এ ব্যাপারে মানুষকে সতর্ক হতে হবে।’
ভুক্তভোগীরা জানান, বিদেশি প্রতারকেরা সব সময় টেলিগ্রাম গ্রুপে যুক্ত থেকে বার্তা দিতেন। ইউজারদের কাছে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্য করতে গত ৭ জানুয়ারি পাঁচ তারকা হোটেল ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টে সারা দেশের এজেন্ট ও বড় বড় বিনিয়োগকারীকে নিয়ে সম্মেলন করা হয়। এতে চার চীনা নাগরিক এসেছিলেন। এদের তিনজন পুরুষ ও একজন নারী। সেখানে নিজেদের ই-মুভির ভাইস প্রেসিডেন্ট পরিচয় দিয়ে কথা বলেছিলেন ব্রায়ান জন ও মিস্টার মাইকেল নামের দুজন। এই মাইকেল মাঝে মাঝে বিভিন্ন বার্তা নিয়ে ই-মুভি প্ল্যানের ভেরিফায়েড অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে লাইভে আসতেন।
ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টের সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার যোগাযোগ করা হলে একজন কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে জানান, সিঙ্গাপুরের একটি ব্যবসায়িক গ্রুপের পরিচয়ে ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ করে ই-মুভি প্ল্যানের নামে তাদের একটি হল বুক করা হয়েছিল। ব্যবসায়িক নীতির কারণে রিজেন্সির ওই কর্মকর্তা এর বেশি জানাতে অস্বীকৃতি জানান।
ভুক্তভোগীরা জানান, এমডি কৃষ্ণা নামের একটি টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে ইউজারদের সঙ্গে কথা বলতেন নিজেকে ই-মুভির পরিচালক পরিচয় দেওয়া একজন। তাঁর টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্টটি হংকংয়ের +৮৫২৬০৯১৭৩৯৬ নম্বর দিয়ে খোলা। এলিস নামের একজন সহকারী এবং মু লি জি নামের আরেকজন কথা বলতেন। আগামী ২৪ মার্চ রাজশাহী শহরের একটি তিন তারকা হোটেলে তাঁদের উপস্থিতিতে সম্মেলনের কথা জানানো হয়েছিল।
ই-মুভি প্ল্যানের রাজশাহীর এজেন্ট আজমল হুদা মানিকের অফিস শহরের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের শিরোইল কলোনি সাড়ে ৩ নম্বর গলির ৫১৩ নম্বর ভাড়া বাড়িতে। গতকাল সকালে ওই অফিসের অবস্থান জানতে চাইলে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের কর্মী মো. তন্ময়ের প্রশ্ন, ‘অনলাইনে কাজ করে ওই মানিক? ধরা খাইছেন?’ তিনি জানান, মানিক এখানে অফিস করার পর কাউন্সিলরের কার্যালয়ে তাঁর বিরুদ্ধে একটি লিখিত অভিযোগ এসেছিল।
মানিকের অফিসের সামনে গিয়ে দেখা যায়, সেটি তালাবদ্ধ। কিছুক্ষণ পর তাঁকে খুঁজতে মোটরসাইকেলে চড়ে এলেন কয়েকজন যুবক। তাঁদের একজন মোবাইলে কাউকে বলছিলেন, ‘আমাকে সাত দিন আগে পামপট্টি মেরে ই-মুভিতে ঢুকিয়ে দিল মামা! আমি ১২ হাজার টাকা দিয়েছি। আমাকে এমনভাবে মুরগি বানালো মামা!’
কথা বলে জানা গেল, ওই যুবকের নাম হিমেল। বাড়ি শহরের উপশহরে। সঙ্গে আসা ফাহিম ও রিংকুও ই-মুভিতে বিনিয়োগ করেছেন। তাই এজেন্ট মানিককে ধরতে এসেছেন। তাঁর মোবাইল নম্বরও বন্ধ। সোমবার রাতে মানিক টেলিগ্রাম গ্রুপে এক বার্তায় বলেছেন, নিজের ডলার নিয়েই তিনি বিপাকে পড়েছেন। তাঁকে যেন কেউ ফোন করে বিরক্ত না করেন।
বিষয়টি জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করে মানিকের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। ই-মুভির এই প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত কয়েকটি হংকংয়ের মোবাইল নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সংযোগ পাওয়া যায়নি। টেলিগ্রামে বার্তা পাঠানো হলেও কেউ সাড়া দেননি।
প্রতারণার শিকার এক তরুণ জানান, ই-মুভিতে তাঁর প্রায় ২ লাখ ডলার জমা হয়েছিল। কিন্তু টাকা ওঠানো যাচ্ছিল না দেখে তিনি কাস্টমার সার্ভিসের গ্রুপে যোগাযোগ করেন। গ্রুপটি পরিচালনা করা হতো হংকংয়ের +৮৫২৬৭৩৫৭৬২১ নম্বর থেকে। কিন্তু উত্তর মেলেনি। পরে মু লি জি নামের টেলিগ্রাম আইডি থেকে জানানো হয়, তাঁর ই-মুভিতে যত ডলার আছে তার ৩০ শতাংশ ১৫ ফেব্রুয়ারির আগে ডিপোজিট করলে তিনি তাঁর সব ডলার ভাঙাতে পারবেন। নির্ধারিত সময়ে ডিপোজিট না করলে বাংলাদেশ সরকার সব ডলার বাজেয়াপ্ত করবে।
জানতে চাইলে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক এস এ এম রফিকুন্নবী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ই-মুভি প্ল্যান নামে কোনো অ্যাপের কথা আমাদের জানা নেই। কিসের কে ডলার বাজেয়াপ্ত করবে? এটা পুরোপুরি প্রতারণার ফাঁদ।’
বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘সব ভাঁওতাবাজি। প্রতারিত কেউ অভিযোগ করলে এখানকার এজেন্টদের খুঁজে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল) মুহাম্মদ সাঈদ আলী বলেন, ‘আমরা ই-মুভি প্ল্যানের নামে কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে বা যে অভিযোগ উঠছে সেগুলোর সত্যতা পেলে বিটিআরসিকে সাইটটি বন্ধ করতে বলব।’ তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি আমরা অভিযুক্ত ৩৩১টি ওয়েবসাইট বন্ধ করিয়েছি। আরও ৬৯টি ওয়েবসাইটের নাম গোয়েন্দা সংস্থাকে তদন্তের জন্য দেওয়া হয়েছে।’
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম শোভন বলেন, ‘ই-কমার্সের নামে এ ধরনের ব্যবসা করা হলে আমরা সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিই। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান না হলে কিছু করার এখতিয়ার আসলে আমাদের নেই।’
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাসিম পারভেজ বলেন, ‘আমরা নিজেরা কোনো সাইট বন্ধ করি না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অথবা কোনো সংস্থা আমাদের কাছে সুপারিশ করলে আমরা সেটা বন্ধ করতে পারি। ই-মুভি প্ল্যান বন্ধের বিষয়ে যদি কোনো সুপারিশ আসে, তাহলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।’
রাজধানীর বিমানবন্দরে শরীরে বিশেষ কৌশলে গাঁজা নিয়ে এসে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে তিনজন কিশোর। তাঁরা বর্তমানে কিশোর সংশোধনাগারের রয়েছে।
১৫ দিন আগেপরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে সিঙ্গাপুরে যান দুই ভাই উজ্জ্বল মিয়া ও মো. ঝন্টু। সেখানে থাকা অবস্থায় মুঠোফোনে ভাবির সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ান ছোট ভাই মো. ঝন্টু। পরে দেশে ফিরে ভাবিকে বিয়ে করার জন্য আপন বড় ভাই উজ্জ্বল মিয়াকে খুন করে ছোট ভাই।
১৫ দিন আগেরাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় গত দুই মাসে দুই অটোরিকশা চালককে হত্যা করে রিকশা ছিনিয়ে নেওয়া ঘটনা ঘটেছে। পৃথক এই দুই ঘটনায় তদন্তে নেমে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
১৫ দিন আগেপাবনার পদ্মা নদী থেকে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ১২ বছরের এক কিশোর এবং ২২ বছরের এক তরুণীর অর্ধগলিত দুইটি মরদেহ উদ্ধার করেছে নাজিরগঞ্জ নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি। উদ্ধারের দুইদিনেও কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। রোববার সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নাজিরগঞ্জ নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সাইদুর রহমান।
১৯ দিন আগে