বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ক কি ধর্ষণ? আইন কী বলে

সুলতান মাহমুদ, ঢাকা
প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০২৩, ২১: ৫১
আপডেট : ১২ নভেম্বর ২০২৩, ১২: ৪০

পারভেজ (ছদ্মনাম) ও রুনা (ছদ্মনাম) দুজনে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং উভয়ের বয়স ১৮ বছরের বেশি। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুবাদে তাঁদের মধ্যে প্রথমে বন্ধুত্ব এবং পরে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সম্পর্কের একপর্যায়ে উভয়ে বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। কিন্তু পরে রুনা যখন বিয়ের চাপ দিতে থাকেন তখন নানা অজুহাতে এড়িয়ে যেতে থাকেন পারভেজ। এর মধ্যে শারীরিক সম্পর্কও অব্যাহত থাকে। একপর্যায়ে সম্পর্কে অবনতি হয়। পারভেজ রুনাকে বিয়ে করবে না বলে জানিয়ে দেন, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। পরে রুনা থানায় গিয়ে পারভেজের বিরুদ্ধে ‘বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ’–এর অভিযোগে মামলা করেন। এখন পারভেজকে কি ধর্ষক বলা যাবে? বাংলাদেশের আইন কী বলে? 

বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের বিষয়টি ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে আমাদের শুরুতেই দেখতে হবে বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞায় কী আছে। কেননা এখানে ‘ধর্ষণ’কে প্রধান অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। 

ধর্ষণের সংজ্ঞা
দণ্ডবিধি ১৮৬০–এর ৩৭৫ ধারায় ‘ধর্ষণ’কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী, পাঁচটি অবস্থায় শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য করা হয়েছে—

এক. নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে

দুই. নারীর সম্মতি ছাড়া

তিন. নারীর সম্মতি আদায়, তবে তা মৃত্যু কিংবা জখমের ভয় দেখিয়ে

চার. নারীর সম্মতি নিয়েই, কিন্তু পুরুষটি জানেন যে, তিনি ওই নারীর স্বামী নন এবং ওই নারী তাঁকে এমন একজন পুরুষ বলে ভুল করছেন যে পুরুষটির সঙ্গে তাঁর আইনসংগতভাবে বিয়ে হয়েছে বা বিবাহিত বলে তিনি বিশ্বাস করেন। 

পাঁচ. নারীর সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া—তবে সেই নারীর বয়স যদি হয় ১৪ বছরের কম। 

এখন, বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের বিষয়টি বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিয়ের প্রলোভনে নারীর সম্মতি আদায় করেন, যা ৩৭৫ ধারায় ধর্ষণের সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত নয়। 

মূলত, ৩৭৫ ধারায় প্রদত্ত সংজ্ঞার বিশ্লেষণে স্পষ্ট যে, বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন ‘ধর্ষণ’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত হবে না। 

অন্যদিকে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন, ২০২০ এর ২ (ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, ‘ধর্ষণ’ অর্থ ধারা ৯–এর বিধান সাপেক্ষে, Penal Code, ১৮৬০ (Act XLV of ১৮৬০) এর Section ৩৭৫ এ সংজ্ঞায়িত ‘rape’। 

অর্থাৎ দণ্ডবিধি, ১৮৬০–এর ৩৭৫ ধারায় প্রদত্ত ধর্ষণের সংজ্ঞা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। 

বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০২০ এর ৯ (১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তিনি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন। 

এই আইনের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ছাড়া ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তাঁর সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাঁর সম্মতি আদায় করে, অথবা ১৬ বছরের কম বয়সের কোনো নারীর সঙ্গে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ছাড়া শারীরিক সম্পর্ক করেন, তা হলে তিনি ওই নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবে। 

এই ধারায়ও সম্মতি নিয়ে দৈহিক সম্পর্ক হলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না। তবে বয়স হতে হবে ১৬ বছরের বেশি। 

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান মনে করেন, ‘নারীর সম্মতি ছাড়া হলে সেটি রেপ (ধর্ষণ)। বয়স যাই হোক। প্রশ্ন হচ্ছে, নারীর বয়স ১৬ বা ১৮ বছরের বেশি হলে তখন সেটি ধর্ষণ হবে কি না। এখানে প্রশ্ন থাকে সম্মতি কীভাবে আদায় করা হয়েছে।’ 

বিয়ের প্রলোভনে শারীরিক সম্পর্ক ধর্ষণ হবে কি না জানতে চাইলে এই আইনজীবী বলেন, ‘বিয়ের প্রলোভনে এটি (শারীরিক সম্পর্ক) কোনো রেপ (ধর্ষণ) হয় না। যদি এমন হয়, প্রাপ্তবয়স্ক (বয়স ১৬ বা ১৮ বছরের বেশি হলে) একজন নারী ও প্রাপ্তবয়স্ক একজন পুরুষ উভয়ে সম্মতিতে সম্পর্কে জড়িয়েছেন। তাঁদের বিয়ের প্রতিশ্রুতি থাকতেও পারে, আবার নাও থাকতে পারে। তখন সেটি কখনোই ধর্ষণ না।’ 

তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো অনেক মামলায় দেখি, একজন নারী বিবাহিত এবং তাঁর বাচ্চা আছে, তিনি আবার বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের মামলা করেন।’ আইনজীবী ইশরাত প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘যে নারী এরই মধ্যে বিবাহিত তাঁকে আবার বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেয় কীভাবে? তাঁকে তো বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া সম্ভব না। কেননা তিনি অলরেডি ম্যারিড।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘এই ধরনের মামলাগুলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অপব্যবহার। এ নিয়ে কিছু মানুষ সুবিধা নেয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারা যারা আসলেই প্রকৃত ভিকটিম (ক্ষতিগ্রস্ত)। কারণ, এই ধরনের মামলা হলে আদালতে মামলার জট বাড়ে, তখন প্রকৃত ভুক্তভোগীরা বিচার পান না।’ 

অধিকতর ব্যাখ্যায় আইনজীবী ইশরাত বলেন, ‘বিয়ের প্রলোভন বললেই তো হবে না। এমনও তো হতে পারে, একটি ছেলেকে একটি মেয়ে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেয়, পরে মেয়েটি যদি তার কমিটমেন্ট (ওয়াদা) না রাখতে পারে, তাহলে ছেলেটি কি মেয়েটির বিরুদ্ধে রেপ কেস (ধর্ষণ মামলা) করতে পারবে যে, আমাকে বিয়ে করল না কেন? সম্পর্কে জড়িয়েছিল কেন? সেটা তো সম্ভব না। তাহলে এটাও রেপ হবে না।’ 

অন্যদিকে, দণ্ডবিধি ১৮৬০–এর ৪৯৩ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি কোনো নারীকে প্রতারণামূলকভাবে আইনসম্মত বিয়ের বিশ্বাসে প্ররোচিত করে, কিন্তু আদৌ ওই বিয়ে আইনসম্মতভাবে না হয় এবং ওই নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে, তবে অপরাধী সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবে। 

এই ধারাটি মূলত বিয়ে বলবৎ আছে বিশ্বাস করিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অতএব, এই ধারায় বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে বা ভবিষ্যতে বিয়ে করার আশ্বাস দিয়ে দৈহিক সম্পর্ক করলে তা অপরাধ হবে না। 

ধর্ষণ মামলা কোথায় হবে
ধর্ষণের অভিযোগ থানায় করতে হবে। পুলিশ ধর্ষণের অভিযোগ এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করে তদন্ত শেষে আদালতে প্রতিবেদন দেবে। যদি থানা–পুলিশ অভিযোগ না নেয়, তাহলে ভুক্তভোগী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মামলা করতে পারেন। ট্রাইব্যুনাল পুলিশকে মামলা এফআইআর হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দিতে পারেন বা তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন। 

তবে এই মামলা তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশকে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যদি এমন হয়, ধর্ষণের ঘটনার ১৫ দিন বা ১ মাস বা তারও পরে ভুক্তভোগী থানায় বা আদালতে ধর্ষণের মামলা করেন। তখন প্রমাণের জন্য অনেক সময়ই প্রয়োজনীয় আলামত বা সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। তখন মামলায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাদী পক্ষ হেরে যান। আসামি খালাস পান। 

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একাধিক রায়ে বলা আছে, ১৬ বছরের ঊর্ধ্বে কোনো নারীর সম্মতিতে তাঁর সঙ্গে কারও শারীরিক সম্পর্ক হলে সেটিকে ধর্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। এসব রায়ে আদালত বিয়ের প্রলোভন ধর্ষণের অভিযোগও খারিজ করেছেন। 

ভারতের উচ্চ আদালতও বলেছেন, কোনো নারী স্বেচ্ছায় দীর্ঘদিন ধরে কারও সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখার পর ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগ আনতে পারবেন না। 

 ২০১৭ সালে বোম্বে হাইকোর্ট একটি মামলায় পর্যবেক্ষণ দেন, প্রাপ্তবয়স্ক নারীদের ক্ষেত্রে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা যাবে না। মামলার রায়ে বোম্বে হাইকোর্টের বিচারপতি মৃদুলা ভাটকার বলেন, ‘দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক যদি সেই মুহূর্তে উভয়ের সম্মতিতেই হয়ে থাকে, তা হলে তা কীভাবে ধর্ষণ হবে?’ তিনি বলেন, ‘নিজেদের ইচ্ছাতেই প্রেমিক–প্রেমিকা অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকেন। পরে আবার অনেকেই এটাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ তোলেন। এটা হওয়া উচিত নয়।’ 

বিচারপতি বলেন, ‘সমাজ এখন আগের চেয়ে অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। অতীতে বিয়ের আগে কোনো মেয়ে বা ছেলে শারীরিক সম্পর্ক রাখতেন না। সেটা সমাজের চোখে অপরাধ ছিল। কিন্তু এখনকার যুবসমাজ অনেক বেশি খোলা মনের। নিজেদের ইচ্ছাতেই তাঁরা প্রেমিক বা প্রেমিকার সঙ্গে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে থাকেন।’ 

আবার অনেকেই বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শারীরিক সম্পর্ক করেন। এটা হওয়া উচিত নয়। কারণ, বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্কের পরিণাম কী হতে পারে, তা একজন শিক্ষিত ও প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে অবশ্যই জানবেন। তাই সব ক্ষেত্রেই এমন ঘটনাকে ধর্ষণের পর্যায়ে ফেলা উচিত হবে না। যোগ করেন বিচারপতি। 

বিচারপতি আরও বলেন, ‘এর মানে যদিও এই নয় যে, প্রাপ্তবয়স্ক এবং শিক্ষিত মেয়েদের আনা সব অভিযোগকে আগে থেকেই খারিজ করা হবে। কোনটা ধর্ষণ আর কোনটা ধর্ষণ নয়, তা অবশ্যই পরিস্থিতির বিচারে স্থির করা হবে।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত