১২ লাখ চালক বিআরটিএর হাতে জিম্মি

তৌফিকুল ইসলাম, ঢাকা
প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৮: ০০

মিরপুর বিআরটিএর কার্যালয় চত্বরে মানুষের জটলা। সেই জটলায় পাওয়া গেল বেসরকারি চাকরিজীবী আতিকুল ইসলামকে। গত বছর স্মার্ট কার্ড ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ছবি ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়েছিলেন তিনি, কার্ড আর পাননি। অস্থায়ী অনুমতির যে কাগজ তাঁর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে, দফায় দফায় তার মেয়াদ বাড়িয়েছে বিআরটিএ। কিন্তু তারা বলতে পারেনি কবে সেই লাইসেন্স তিনি পাবেন।

কথা বলার সময় সামনের লোকদের ইঙ্গিত করে আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘ওই যে আরও যেসব লোকজনকে দেখছেন, সবার একই দশা। কেউ চাকরিপ্রার্থী, কেউ বিদেশগামী, কেউ সাধারণ মানুষ। মাসের পর মাস তাঁরা ঘুরছেন কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে; কিন্তু কোনো জবাব পাচ্ছেন না।’ আতিকুলের সঙ্গে কথা বলার সময় এগিয়ে আসেন আরও কয়েকজন, তাঁদের প্রচণ্ড ক্ষোভ। একবাক্যে সবাই বিআরটিএর দায়িত্বহীনতাকেই দুষছেন।

এভাবে কত মানুষ স্মার্ট কার্ড লাইসেন্সের জন্য ঘুরছেন? তার একটা হিসাব পাওয়া গেল বিআরটিএ থেকে। তারা জানাল, ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্সের স্বাভাবিক সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর জট তৈরি হয়। সেই জটে আটকে পড়েছে ১২ লাখ ৪৫ হাজার মানুষের ভাগ্য। অর্থাৎ লাইসেন্স না পেয়ে ঘোরা মানুষের সংখ্যা এটিই।

জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চলা এই প্রতিষ্ঠানের এমন বেহাল দশা নিয়ে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ততটা চিন্তিত নন। এ জন্য কিছু যুক্তিও খাড়া করে রেখেছেন। চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এই কাজের ওপেন টেন্ডার হয়েছে। একটি টেন্ডারে ছয় মাস লাগে। সেই টেন্ডার তিনবার বাতিল হয়েছে। এতে ছয় মাস করে পিছিয়ে গেছে। এখানে বিআরটিএর কী করার আছে? আবার নতুন যারা কাজ পেয়েছে করোনার কারণে তাদেরও দেরি হচ্ছে, এটাই বাস্তবতা।’

স্মার্ট কার্ড লাইসেন্স বলে যে কার্ড দেওয়া হতো, সেই কাজটা এত দিন করছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটি। তাদের সঙ্গে বিআরটিএর চুক্তি শেষ হচ্ছে। এরপর বিআরটিএ চেয়েছিল টাইগার আইটিকে দিয়েই লাইসেন্স সরবরাহ করার। কিন্তু ২০১৯ সালের মাঝামাঝি নির্বাচন কমিশনের (ইসি) স্মার্ট কার্ড মুদ্রণসংক্রান্ত প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে ওবারথুর ও টাইগার আইটিকে সাড়ে নয় বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করে বিশ্বব্যাংক। এ অবস্থায় টাইগার আইটির সঙ্গে বাড়তি কার্ডের জন্য আর চুক্তি করেনি বিআরটিএ।

এরপর তারা উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করে। তাতে তিনটি প্রতিষ্ঠান যোগ্য হয়। এগুলো হচ্ছে ফ্রান্সের সেল্প কার্ডস সলুশন, ভারতের মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স এবং মালয়েশিয়ার পার্সিতাকান ক্যাসেলামাতান ন্যাসিওনাল। এর মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টারের সঙ্গে ২০২০ সালের ২৯ জুলাই পাঁচ বছরের চুক্তি করে বিআরটিএর।

মাদ্রাজ সিকিউরিটির চুক্তিতে বলা হয়েছে, চুক্তির পাঁচ বছরে ৪০ লাখ স্মার্ট কার্ড দেবে তারা। জরুরি প্রয়োজনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিআরটিএর চাহিদা পূরণ করতে হবে। প্রতি আট ঘণ্টায় ছয় হাজার ড্রাইভিং লাইসেন্স দেবে।

বিআরটিএ সূত্র জানায়, মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার কাজ পাওয়ার পর মাত্র আট হাজার স্মার্ট ডাইভিং লাইসেন্স দিয়েছে গ্রাহকদের। যদিও চুক্তি অনুযায়ী দিনে ৮-৯ হাজার কার্ড ছাপানোর কথা ছিল।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী  আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে লাইসেন্স দ্রুত দেওয়ার কথা বলে আসছি; কিন্তু আমাদের কথা শোনে না বিআরটিএ। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ঠিক সময়ে লাইসেন্স না দেওয়ার দায় বিআরটিএর। তারা এমন প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিল কেন?’

বর্তমানে মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার কিছু স্মার্ট কার্ড দেওয়া শুরু করেছে। তবে চুক্তির ১৩ মাস পেরিয়ে গেলেও পুরোদমে কাজ শুরু করতে পারেনি তারা। ঠিকাদারের কাজের ধীরগতির পেছনে বিআরটিএর তৎপরতা নিয়েও প্রশ্ন করেছেন অনেকে।

বিআরটিএর পরিচালক রোড সেফটি শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রাব্বানী আজকের পত্রিকাকে বলেন, দ্রুত লাইসেন্স দিতে আমরাও চেষ্টা করছি, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও চেষ্টা করছে। তবে করোনার কারণে লোকবল নিয়োগ, অন্যান্য কাজ খুব একটা এগোতে পারেনি।

ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন, সময়মতো লাইসেন্স না পাওয়া বিআরটিএর প্রশাসনিক ব্যর্থতা। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের হয়রানি ও ক্ষতির দায় তাদের নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার চেষ্টার কারণে এই দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা দরকার।

জানতে চাইলে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিআরটিএ বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানিকে লাইসেন্সের কাজ দিয়েছে। যেসব কোম্পানি কাজ পাচ্ছে, তারা ভালোভাবে কাজ করতে পারছে না। এতে ভোগান্তি বাড়ছে লাইসেন্সপ্রত্যাশী সাধারণ মানুষের। আমরা মনে করি, সে ক্ষেত্রে বিআরটিএর অবহেলা আছে। দুই বছর ধরে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি নিয়ে বিআরটিএকে আমরা বলে আসছি; কিন্তু তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। সরকারের এদিকে নজর দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত