আকিজের দখলে শীতলক্ষ্যাপাড়

মো. আসাদুজ্জামান, গাজীপুর
প্রকাশ : ১৩ নভেম্বর ২০২৩, ১০: ১৮

উত্তরে গাছপালাবেষ্টিত সবুজ গ্রাম, দক্ষিণে বয়ে গেছে শীতলক্ষ্যার স্বচ্ছ জলধারা। নদী থেকে গ্রামের মাঝের কিছু অংশ ধূসর। মূলত বালু ভরাট করে এই ভূমিকে ধূসর রং দিয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান আকিজ বশির গ্রুপ।

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার লতিফপুর মৌজায় স্থানীয়দের কাছ থেকে কেনা ৩২ বিঘা জমিতে সেখানে একটি ওয়্যারহাউস নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে আকিজ পার্টিকেল বোর্ড মিলস লিমিটেড। কিন্তু পরিবেশবিদদের আপত্তিটা অন্য জায়গায়; তা হলো, এই ওয়্যারহাউসের মালপত্র পরিবহনে ক্রেন স্থাপন ও জেটি নির্মাণের জন্য নদীর তীরভূমি (ফোরশোর) দখল করে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এখন সেখানে বালু ভরাট করে তোলা হচ্ছে পিলার, চলছে বেসিন তৈরির কাজ।

প্রতিষ্ঠানটির দাবি, তাদের এই তীরভূমি ব্যবহার ও বালু ভরাটের অনুমতি দিয়েছে স্বয়ং বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। পরিবেশবিদ ও নদী গবেষকেরা প্রশ্ন তুলেছেন, বিআইডব্লিউটিএ তীরভূমি এভাবে ব্যবহারের অনুমতি কীভাবে দিতে পারে?

বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মো. মনির হোসেন বলেন, বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩, পোর্ট আইন, ১৯০৮ অনুযায়ী, কেউ তীরভূমিতে স্থায়ী-অস্থায়ী স্থাপনা করতে পারবে না এবং ভরাটও করা যাবে না। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী নদীর পাড় জনগণের সম্পদ। এটি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দখল করতে পারে না। যদি আকিজ পার্টিকেল বোর্ড মিলস লিমিটেড জমি কিনে থাকে, সেই জমির মধ্যে তারা তাদের কাজ করতে পারে, এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু কোনোভাবে নদী বা নদীতীর দখল বা ভরাট করতে পারবে না। এ মুহূর্তে আমাদের যে দাবি, নদীর পাড় দিয়ে যেন সাধারণ জনগণ হাঁটতে পারে, চলতে পারে, এটা নিশ্চিত করতে হবে। নদীতীর চিহ্নিত করার আগে এখানে সব কাজ বন্ধ রাখতে হবে। আর বিআইডব্লিউটিএ যদি নদীতীর ভরাটের অনুমতি দিয়ে থাকে, তাহলে তাদেরকেও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।

সরেজমিনে দেখা যায়, শীতলক্ষ্যাতীরে আকিজ পার্টিকেল বোর্ড মিলস লিমিটেড নিজস্ব ৩২ বিঘা জমিতে বালু ভরাটের পাশাপাশি নদীর তীরভূমিতেও বালু ভরাট করেছে।

তারা ৭৫ ফুট তীরভূমি বালু দিয়ে ভরাট করছে, আরও ৭৫ ফুট তীরভূমি বেসিন তৈরি করার জন্য সরাসরি ড্রেজার দিয়ে নদী থেকে বালু উত্তোলন করছে। সেই বালু দিয়ে নদীতীর ও পাশের কৃষিজমি ভরাট করছে। পাশেই গোহালট দিয়ে নদীতে নোঙর করা বড় বড় নৌকা থেকে বিভিন্ন প্রজাতির কাঠ কাভার্ড ভ্যানে তুলে অন্যত্র নেওয়া হচ্ছে। এ জন্যও পাশের দস্যু নারায়ণপুর-লতিফপুর সড়ক থেকে নদীর জলধারা পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে।

আরও দেখা যায়, তীরভূমির বালু ভরাট করা জায়গায় বড় বড় পিলার করার জন্য বেস ঢালাইয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। জোত জমির পরে নদীর সীমানায় আরসিসি ঢালাই দিয়ে আলাদা করা হয়েছে। তীরভূমির মধ্যে প্রথমে মাটি দিয়ে আয়তাকার বাঁধ দিয়ে পলিথিন বিছিয়ে তাতে নদী থেকে সরাসরি ড্রেজার দিয়ে বালু তুলে ভরাট করা হচ্ছে।

আকিজ পার্টিকেল বোর্ড মিলস লিমিটেড নদী থেকে বালু উত্তোলন, কৃষিজমি ভরাট করলেও জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে নেয়নি পূর্বানুমতি। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকেও নেয়নি কোনো ছাড়পত্র। এই অবস্থায় সম্প্রতি সেখানে অভিযান চালিয়ে কাজ বন্ধ করে দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। শুধু তা-ই নয়, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ভঙ্গের কারণে ওই প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ টাকা জরিমানাও করা হয়েছে।

এ বিষয়ে গাজীপুর জেলা প্রশাসক আবুল ফাতেহ মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এ-সংক্রান্ত বিষয়ে আমরা অভিযোগ পেয়েছি। কাপাসিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এরই মধ্যে সেখানে অভিযান চালিয়ে বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন ভঙ্গের কারণে ওই প্রতিষ্ঠানকে এক লাখ টাকা জরিমানা করে আদায় করেছে। আমরা আপাতত এই কাজ বন্ধ করার নির্দেশনা দিয়েছি। পরে কাপাসিয়া ও শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং বিআইডব্লিউটিএ প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সরেজমিন পরিদর্শন করে এ ব্যাপারে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

আকিজ পার্টিকেল বোর্ড মিলস লিমিটেড লতিফপুরে শীতলক্ষ্যাতীরে স্থাপনা নির্মাণের জন্য কোনো পরিবেশ ছাড়পত্র নেয়নি বলে জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের গাজীপুরের উপপরিচালক মো. নয়ন মিয়া। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) মো. মাসুদ হাসান পাটোয়ারী আজকের পত্রিকাকে বলেন, কোনো স্থাপনা করতে গেলে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয়। কেউ যদি না নিয়ে থাকে, তাহলে কোনো অভিযোগ পেলেই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নদীর তীরভূমি ভরাটের বিষয়ে জানতে চাইলে আকিজ পার্টিকেল বোর্ড মিলস লিমিটেডের প্রকল্প ব্যবস্থাপক সজিব হোসেন বলেন, ‘আমরা এ কাজের জন্য বন বিভাগ ও বিআইডব্লিউটিএর কাছ থেকে অনুমতিপত্র নিয়েছি। সে অনুযায়ী আমরা এখানে তাদের নির্দেশনা ও শর্ত মেনে কাজ করছি। এ জন্য ইতিমধ্যে স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে ৩২ বিঘা জমি ক্রয় করে বালু ভরাটের মাধ্যমে তার উন্নয়ন করছি।’

প্রকল্প পরিচালকের কথার সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লতিফপুর মৌজায় একটি ওয়্যারহাউস করার জন্য শীতলক্ষ্যার তীরভূমি ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে বিআইডব্লিউটিএ কাছে আবেদন করেছিল আকিজ পার্টিকেল বোর্ড মিলস লিমিটেড। গত আগস্ট মাসে বিআইডব্লিউটিএ কিছু শর্ত ও নির্দেশনা সাপেক্ষে তাদের অনুমতি দেয়।

অনুমতির বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (সম্পত্তি ও আইন) এ কে এম আরিফ হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি আমার নজরে এসেছে। কীভাবে কী অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তা সরেজমিনে না দেখে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। শিগগির এ বিষয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

বিআইডব্লিউটিএর পরিচালক (বন্দর) সাইফুল ইসলাম বলেন, নদীতীর দখল করে কীভাবে? কাউকে নদীতীর দখলের অনুমতি দেওয়া হয়নি। নদীতীর কেউ দখল করতে পারবে না। এ বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে নদীতীরে বালু ভরাটের ঘটনায় ক্ষুব্ধ স্থানীয়দের কেউ কেউ। গোসিঙ্গা ইউনিয়নের লতিফপুর গ্রামের প্রয়াত গিয়াস উদ্দিনের মেয়ে কারিমা আক্তারের দাবি, বালু ভরাটের সময় তাঁর কিছু জমিও বেদখল হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘রাতের আঁধারে বালু দিয়ে ভরাট করে আমার জমি দখলে নিয়েছে। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছি। কিন্তু তাতে কোনো সমাধান হয়নি। ইতিমধ্যে আমার জায়গায় বালু ভরাট করার পর কংক্রিটের সীমানাপ্রাচীর নির্মাণকাজ করছে।’

লতিফপুর গ্রামের আরেক বাসিন্দা সুমন মিয়া বলেন, ‘এক রাতেই আমার বাবার জমিতে বালু ভরাট হয়ে যায়। এরপর শ্রীপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করি। ঘটনার কয়েক মাস চলে গেলেও কোনো সমাধান হয়নি। নিজের জমিতে আজ যেতে পারছি না মোর্শেদ আর জামশেদের ভয়ে। এ ছাড়া আমি চাকরির কারণে দূরে থাকি। এখন আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছি।  তাদের সঙ্গে শক্তি, টাকা—কোনোটা দিয়েই পারব না।’

 [প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন আজকের পত্রিকার শ্রীপুর প্রতিনিধি]

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত