আ. লীগ নেতা টিপু হত্যাকাণ্ড: দীর্ঘ বিরোধের বদলা

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ২৬ মার্চ ২০২২, ০৪: ৪৩
আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২২, ১৩: ১৬

মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপুর হত্যাকাণ্ডকে বিরোধের বদলা মনে করছে পুলিশ। তাদের ধারণা, যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিল্কি হত্যার প্রতিশোধ নিতেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তবে নিহত টিপুর স্ত্রী সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম ডলি বলেছেন, রাজনৈতিক কোন্দলের কারণেই টিপু খুন হয়েছেন।

গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ১৫ মিনিটে রাজধানীর শাহজাহানপুরে আমতলা মসজিদ এলাকায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। মাথায় হেলমেট ও মুখে মাস্ক পরা এক দুর্বৃত্ত টিপুকে বহন করা মাইক্রোবাস লক্ষ্য করে ১১টি গুলি ছোড়ে। গুলিতে টিপু নিহত ও গাড়িচালক মুন্না আহত হন। এ সময় যানজটে আটকা পড়ে রিকশা আরোহী কলেজছাত্রী সামিয়া আফরিন প্রীতিও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে নৃশংস এ ঘটনা ঘটে।

রাস্তায় প্রকাশ্যে এভাবে খুনের ঘটনা নিয়ে গতকাল দিনভর আলোচনা ছিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, হত্যার রহস্য উন্মোচনে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। খুনের ঘটনায় জড়িতরা দ্রুত আইনের আওতায় আসবে, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক বিবৃতিতে এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত সব অপরাধীকে গ্রেপ্তার এবং বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছেন।

টিপু গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় একই গাড়িতে ছিলেন তাঁর বন্ধু মিজানুর রহমান মেরাজ। তাঁরা মতিঝিল এজিবি কলোনির ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গ্র্যান্ড সুলতান নামের রেস্তোরাঁ থেকে শাহজাহানপুরের বাসায় ফিরছিলেন। মেরাজ জানান, মাইক্রোবাসে চালকসহ চারজন ছিলেন। তাঁদের মধ্যে গাড়ির সামনে আসনে বসে ছিলেন টিপু। পেছনে ছিলেন বন্ধু মেরাজ ও টিপুর ছেলে জহুরুল ইসলাম মিছিল। রাত ১০টা ১৫ মিনিটের দিকে গাড়িটি উত্তর শাহজাহানপুরে মানামা ভবনের সামনে জ্যামে আটকা পড়ে। হঠাৎ এক যুবক টিপুকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে শুরু করেন। দেড় মিনিট ধরে যুবকটি একটানা গুলি ছুড়ে পালিয়ে যান। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর টিপু আর কোনো কথা বলতে পারেননি। তিনি গাড়ির আসনেই ঢলে পড়েন। মেরাজ বলেন, গাড়ির দরজার কাচের ওপর দিয়ে গুলি ছোড়া হয়। সেই গুলি কাচ ভেদ করে টিপুকে বিদ্ধ করে। একটি গুলি গাড়িচালক মুন্নার হাতে লাগে। তখন মুন্না এক হাতে গাড়ি চালিয়ে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের সামনে যান। পরে সেখান থেকে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।

পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেছেন, টিপুর মতো একই কায়দায় ২০১৩ সালের ২৯ জুলাই গুলশানের রাস্তায় যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক মিল্কি খুন হন। এই খুনের মামলায় টিপুর নাম আসে। এরপর র‍্যাব তাঁকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু পরে অভিযোগপত্র থেকে তাঁর নাম বাদ দেন মামলার তদন্তকারী ও র‍্যাব-১-এর সহকারী পুলিশ সুপার মো. কাজেমুর রশীদ। এরপর তিনি কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন।

র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আজকের পত্রিকাকে বলেন, এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে বেশ কিছু তথ্য-উপাত্ত তাঁরা সংগ্রহ করেছেন। ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা সিসিটিভি ফুটেজ ও আলামত বিশ্লেষণ করছেন। প্রাথমিকভাবে তাঁরা মনে করছেন, পুরোনো হত্যার বদলা নিতেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

টিপু খুনের কারণ জানতে চাইলে তাঁর স্ত্রী ফারহানা ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, মতিঝিল এলাকার আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক কোন্দল, ফুটপাতে দোকান বসিয়ে বাণিজ্য—এসব নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি পক্ষের সঙ্গে তাঁদের বিরোধ চলছিল। সেখান থেকেই এ ঘটনা ঘটতে পারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টিপুর ঘনিষ্ঠ থানা যুবলীগের একাধিক নেতা বলেছেন, কিছুদিন ধরে রাজধানীর শাহজাহানপুর, মতিঝিল, পল্টন, কমলাপুর এলাকায় চাঁদাবাজি, ডিশ ব্যবসা ও টেন্ডারের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সোহেল শাহরিয়ারের সঙ্গে টিপুর বিরোধ চলছিল। ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী জাফর আহম্মেদ মানিকের সেকেন্ড ইন কমান্ড হলেন এই সোহেল। ‘শটগান সোহেল’ নামে পরিচিত এই সন্ত্রাসী টিপু খুনে জড়িত থাকতে পারেন।

টিপু খুনের ঘটনায় গতকাল তাঁর স্ত্রী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে শাহজাহানপুর থানায় মামলা করেন। সেই মামলায় তিনি কারও নাম উল্লেখ করেননি। এজাহারে ঘটনার বিবরণ দিয়ে বাদী বলেছেন, সন্ত্রাসীরা তাঁর স্বামীকে পরিকল্পিতভাবে খুন করেছেন।

মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ পরিদর্শক আব্দুল আহাদ বলেন, বেশ কয়েকটি বিষয় সামনে রেখে তদন্ত চলছে। খুব দ্রুতই ঘটনার রহস্য উদ্‌ঘাটন এবং আসামি গ্রেপ্তার করা হবে।

টিপুর ঘনিষ্ঠরা বলেছেন, জাহিদুল ইসলাম টিপুর গ্রামের বাড়ি ফেনী সদর উপজেলার শর্শদি ইউনিয়নের ফতেহপুর মিঝি গ্রামে। তাঁর বাবার নাম মমিনুল ইসলাম। তিনি পুলিশের এসআই ছিলেন। কয়েক বছর আগে তাঁর বাবা মারা যান। মা ৮০ বছর বয়সী শরিফা বেগম গ্রামের বাড়িতে থাকেন। বাবার চাকরির সুবাদে তাঁরা দীর্ঘদিন জামালপুরে ছিলেন। এরপর ঢাকায় এসে মতিঝিলে এজিবি কলোনিতে থাকতে শুরু করেন।

মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলেন, এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় টিপু ছাত্রলীগ করতেন। পরে যুবলীগ হয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। আওয়ামী লীগে আসার পর মতিঝিলে পুরাতন ৩৩ (নতুন ১০) ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্বে ছিলেন। ২০০৪ সালে তিনি বৃহত্তর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্বে ছিলেন। এরপর আওয়ামী লীগের কোনো কমিটিতে ছিলেন না।

মতিঝিলের এজিবি কলোনির মডেল সার্কুলার রোডে গ্র্যান্ড সুলতান নামে তাঁর একটি রেস্তোরাঁ রয়েছে। পাশেই কাঁচাবাজারে রয়েছে একাধিক দোকানঘর। মতিঝিল কলোনির জায়গা দখল করে একটি ব্যায়ামাগারও করেছিলেন তিনি। পরে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। এজিবি কলোনির পাশে সড়ক দখল করে শতাধিক দোকান তুলে বাজারও তৈরি করেন তিনি। এসব নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে অনেক দিন ধরে বিরোধ চলে আসছিল।

আওয়ামী লীগের নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু ও সামিয়া আফরিন জামাল প্রীতির মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জান্নাতুন নাইম।

টিপুর সুরতহাল প্রতিবেদনে বলা হয়, গলার বাঁ পাশে একটি, বুকের বাঁ পাশের ওপরের দিকে একটি, পেটের মধ্যস্থলে একটি, বুকের বাঁ পাশের বগলের কাছাকাছি একটি, বাঁ কাঁধের ওপরে ও নিচে দুটি, পিঠের বাঁ পাশে কোমর বরাবর ওপরে চারটি, পিঠের ডান পাশে একটি, ডান নিতম্বে তিনটি গোলাকার ক্ষতচিহ্ন রয়েছে।

জানাজা শেষে টিপুকে তাঁর গ্রামের বাড়ি ফেনীর ফতেহপুর মিঝি গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত