শাহরিয়ার হাসান, মধুখালী (ফরিদপুর) থেকে ফিরে
গ্রামের ভেতর দিয়ে পাকা রাস্তাটি গিয়ে মিশেছে গড়াই নদে। নদীর দুই পাড়ের সৌন্দর্যের মতোই মনকাড়া ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার ডুমাইন নামের এই গ্রাম। সবুজে ঘেরা গ্রামটিতে নজর কাড়বে রাস্তার দুই পাশে নতুন নতুন আধা পাকা বাড়ি, দালান। একতলা, দোতলা বাড়িগুলোর কোনোটায় বাহারি রং। তবে বাড়িগুলোতে কোনো পুরুষ থাকেন না। কারণ, পুলিশের অভিযানে ধরা পড়ার আতঙ্ক–তাঁদের পেশা যে মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতানো।
ঢাকা ও ফরিদপুর জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, ডুমাইন গ্রামের অন্তত ৩০০ যুবকের পেশা প্রতারণা। কয়েক বছর ধরে তাঁরা প্রতারণা করছেন। তাঁরা মূলত মোবাইল ব্যাংকিংয়ে সেবা নেওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেন। এসব টাকাতেই ছাপরাঘর ভেঙে করেছেন দালান, আধা পাকা বাড়ি। একসময়ের ভ্যানচালক এখন চড়ছেন নতুন দামি মোটরসাইকেলে। এলাকায় এই প্রতারকদের পরিচিতি বিকাশ প্রতারক বা টোপ পার্টি। কিছু মানুষ হঠাৎ ধনী হওয়ায় দিন দিন এ পথে আনছে নতুনদের।
আজকের পত্রিকার অনুসন্ধানে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে ফরিদপুরের মধুখালী ও ভাঙ্গা উপজেলা এবং সংলগ্ন মাগুরা ও রাজবাড়ী জেলার কিছু গ্রামজুড়ে এই প্রতারকদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। তবে শুরুটা ১৪-১৫ বছর আগে মধুখালীর ডুমাইন ইউনিয়নের ডুমাইন গ্রাম থেকেই। গ্রামটির মিঠুন নামের এক যুবক মোবাইলে রিচার্জ প্রতারণার মাধ্যমে এর সূচনা করেন। যথিষ্ঠীরের ছেলে মিঠুন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এক কর্মকর্তাকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে প্রথম ২০১২ সালে গ্রেপ্তার হন। এরপরই অভিনব এই প্রতারণা আলোচনায় আসে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলছে, মিঠুন এ পর্যন্ত বিভিন্ন মামলায় অন্তত সাতবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁর কাছে শুরুতে দীক্ষা নিয়েছেন গ্রামের সৌখিন, হান্নান, সোহাগসহ কয়েকজন যুবক। তাঁদের অবস্থার পরিবর্তন দেখে ধীরে ধীরে গ্রামজুড়ে যুবকদের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে।
স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, নদীর পাড়ে কলাবাগান ও একটি মেহগনিবাগানে বানানো অস্থায়ী চালাঘরে সন্ধ্যা হলে বসেন যুবকেরা। দলে দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা মোবাইল অপারেটর কোম্পানির কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধি সেজে ফোন দেন গ্রাহকদের। কথার মারপ্যাঁচে গ্রাহকদের বিভ্রান্ত করে বিকাশসহ মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবের পাসওয়ার্ড অথবা ক্রেডিট কার্ডের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নেন। পরে সেগুলো দিয়ে গ্রাহকের অজান্তেই হিসাব থেকে টাকা হাতিয়ে নেন। এই পেশায় জড়িত ব্যক্তিদের বাড়ির চারপাশে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে; যাতে পুলিশ এলে দেখে পালাতে পারেন। কেউ কেউ বাড়ির চিলেকোঠায় ছোট এসি কক্ষে বসে করেন প্রতারণা।
মধুখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, গত দুই বছরে অনেক শিক্ষিত সচেতন মানুষও এদের ফাঁদে পড়েছেন বলে শুনেছেন। তাঁদের মধ্যে চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, আমলা, এমনকি পুলিশ কর্মকর্তাও রয়েছেন।
১৭ মে মধুখালী থানায় গিয়ে দেখা যায়, ইমোতে প্রতারণার শিকার হয়ে ৪০ হাজার টাকা খোয়ানো মধ্যবয়সী ব্যক্তি থানায় এসেছেন অভিযোগ দিতে।
ঢাকার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও ফরিদপুর জেলা পুলিশের সূত্র জানায়, বিকাশ প্রতারণা নিয়ে ডুমাইন গ্রামের বিভিন্নজনের নামে অন্তত ২১টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে দুটি মানি লন্ডারিংয়ের। প্রতিটি মামলাতেই ঘুরেফিরে একই ব্যক্তিদের নাম। দেশের যেকোনো প্রান্তের ডিজিটাল প্রতারণার অভিযোগের তদন্ত শেষ পর্যন্ত এই গ্রামেই যাচ্ছে।
জানতে চাইলে ফরিদপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. শাহজাহান আজকের পত্রিকাকে বলেন, এই চক্র এতই বিস্তৃত যে কয়েক বছর ধরে গ্রেপ্তার করেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। তবে পুলিশও হাল ছাড়েনি।
যেভাবে পাতে প্রতারণার ফাঁদ
মধুখালী থানার পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুরু হয়েছিল মোবাইল রিচার্জ প্রতারণার মাধ্যমে। তখন প্রতারকেরা মানুষকে ভুলিয়ে তাদের সিমে টাকা ভরাতেন। কিন্তু সিমে থাকা হাজার হাজার টাকা নগদ করতে না পারায় পাতা হয় অন্য ফাঁদ। পুরস্কার পাওয়ার তথ্য জানিয়ে সেটা নিতে সামান্য কিছু টাকা লাগবে দাবি করে কুরিয়ার সার্ভিস বা ডাকযোগে টাকা নেওয়া হতো। তখনো প্রতারণা গ্রামে বিস্তৃত হয়নি। তবে ২০১১ সালে দেশে মোবাইলে অর্থ লেনদেনের প্রথম প্ল্যাটফর্ম বিকাশ চালু হলে প্রতারণায় ঝুঁকে পড়েন আরও কিছু তরুণ। তাঁদের আর্থিক অবস্থা রমরমা হলে লোভ ছড়িয়ে পড়ে অনেকের মধ্যে।
একসময় জড়িয়ে পড়েন গ্রামের অধিকাংশ মানুষ। ছলেবলে ওটিপি জেনে টাকা হাতাতে থাকেন। এই প্রতারণার বিরুদ্ধে তৎপরতায় প্রতারকেরা শুরু করেছে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি।
ডুমাইন পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী মোতালেব আজকের পত্রিকাকে বলেন, টাকার জোরে প্রতারকদের রাজত্ব সর্বত্র। তাঁদের পাড়ার আরিফুল অষ্টম শ্রেণি পাস করে পড়াশোনা ছেড়ে দুই বছর ধরে এই প্রতারণায় নেমেছেন। আরিফুলের বাবা কিছুদিন আগেও ভ্যান চালাতেন, এখন কয়েক মাস পরপর জমি কেনেন।
গডফাদার নেই, শহরে শহরে চক্রের সদস্য
ফরিদপুর জেলা পুলিশ ও সিআইডির কাছে থাকা তালিকায় ডুমাইন ইউনিয়নের অন্তত তিনজন সন্দেহভাজনের নাম রয়েছে। তাঁরা এই ডিজিটাল প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত। জানা গেছে, এই প্রতারকদের কোনো গডফাদার নেই। ৮-১০ জনের ছোট ছোট দল হয়ে এ কাজ করছে।
মধুখালী থানার ওসি বলেন, তালিকার চেয়ে বাস্তবে প্রতারকদের সংখ্যা অনেক বেশি।
প্রতারণা পেশা থেকে ফিরে আসার দাবি করা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডুমাইন গ্রামের এক যুবক বলেন, ছোট ছোট দলগুলো চার ধাপে কাজটি করে। দু-তিনজন বিভিন্ন শহরের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দেওয়া দোকান থেকে টাকা যাওয়া মোবাইল নম্বরের তালিকা পাঠান। পরের ধাপে দু-একজন এসব নম্বরে টোপ ফেলে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেন। পরে কয়েক হাত ঘুরে অন্য শহর থেকে ওই টাকা ওঠান। তাঁর দাবি, একজন দিনে ৩০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত প্রতারণা করেন।
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের সদ্য বদলি হওয়া বিশেষ পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, এসব মামলার তদন্তে তাঁরা অনেক হিসাবে দিনে লাখ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছেন; যা অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল সিআইডির কাছে।
জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ
গত মঙ্গলবার ডুমাইন ইউনিয়নে গিয়ে জানা গেল, দোপপাড়া, নিশ্চিন্তপুর, শিয়ালপাড়া, পশ্চিমপাড়া ও ডুমাইন গ্রামের যুবক ও মধ্যবয়সী পুরুষদের নামে প্রতারণার অভিযোগ বেশি। বিভিন্ন মামলায় নাম থাকা ব্যক্তিদের বাড়িতে গিয়ে কাউকেই পাওয়া যায়নি। জানা গেল, গ্রামের নাট্টু চৌধুরী ও তাঁর তিন ছেলে, টিটু, ইকবাল শেখ, আবদুল কাদের শেখ, আরিফুল, লিটন, ইসমাইল, রতন বাবু, মালেক, মানিক, মল্লিক ও ফিরোজ হঠাৎ বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তবে তাঁদের কেউ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোননি, প্রকাশ্য কোনো পেশাও নেই।
স্থানীয় কয়েকজনের অভিযোগ, ডুমাইন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক ও বর্তমান চেয়ারম্যান ও সদস্যরা এই অপরাধীদের মদদ দেন।
পুলিশ বলছে, আতিয়ার নামের সদ্য সাবেক এক ইউপি সদস্য প্রতারক চক্রের সদস্যদের জামিন ও মামলার দিকটি দেখেন। বিনিময়ে মাস গেলে মোটা অঙ্কের টাকা নেন।
ডুমাইন ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটির সদস্য শাহ্ আসাদুজ্জামান তপনের বিরুদ্ধেও প্রতারকদের মদদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অন্য একটি মামলায় তিনি কারাগারে থাকায় অভিযোগের বিষয়ে তাঁর বক্তব্য নেওয়া যায়নি।
গ্রামের কয়েকজনের অভিযোগ, পুলিশের কিছু অসাধু সদস্য ও গ্রাম পুলিশ প্রতারকদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নেন। তাই পুলিশের অভিযানের খবর প্রতারকেরা আগেই জেনে পালিয়ে যায়।
ইউনিয়নেই কোনো এজেন্ট নেই
অবাক করা বিষয় হলো, ডিজিটাল প্রতারণার ঘাঁটি ডুমাইন ইউনিয়নেই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কোনো এজেন্টের দোকান নেই। মোবাইলে রিচার্জ করার দোকানও নেই। এই সুবিধা নিতে যেতে হবে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে মধুখালী উপজেলা সদরে। তবে সেখানেও জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে মোবাইল ব্যাংকিং করতে হয়।
আব্দুল মালেক নামের ডুমাইন গ্রামের এক ব্যবসায়ী বলেন, প্রতারকদের কারণে গ্রামের নাম বললে মানুষ আড়চোখে তাকায়।
থানা-পুলিশ যা বলছে
মধুখালী থানা সূত্র বলছে, এই প্রতারণা নির্মূলে তারা এক যুগ ধরে চেষ্টা চালাচ্ছে। ২০২০ সালের ১৮ জানুয়ারি ৯৫ জনকে আত্মসমর্পণও করিয়েছিল পুলিশ। বিভিন্ন অভিযানে ১৫০ জনের বেশি প্রতারককে একাধিকবার আটকও করা হয়েছে। কিন্তু প্রতারণা বন্ধ হয়নি।
মধুখালী থানার ওসি শহিদুল ইসলাম বলেন, ডুমাইন গ্রামের শেষ মাথায় নদ। এর ওপর পারে মাগুরা জেলা। গ্রামে পুলিশ ঢুকলেই প্রতারকেরা নদ পেরিয়ে মাগুরায় চলে যায়।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক আজকের পত্রিকাকে বলেন, এমন প্রান্তিক পর্যায়ে থানাগুলোতে এ ধরনের মামলা তদন্ত করতে যে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি প্রয়োজন, তা স্থানীয় পুলিশের নেই। তাই অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো সঠিক সিদ্ধান্তও নেওয়া যায় না। তাই মামলার অভিযোগপত্রও দুর্বল হয়। আবার পুলিশ যদি প্রতারকদের কাছ থেকে সুবিধা নেয়, তাহলে তারা উৎসাহী হয়। তিনি বলেন, নিজে সচেতন হলেই প্রতারকের ফাঁদ এড়ানো সম্ভব।
গ্রামের ভেতর দিয়ে পাকা রাস্তাটি গিয়ে মিশেছে গড়াই নদে। নদীর দুই পাড়ের সৌন্দর্যের মতোই মনকাড়া ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলার ডুমাইন নামের এই গ্রাম। সবুজে ঘেরা গ্রামটিতে নজর কাড়বে রাস্তার দুই পাশে নতুন নতুন আধা পাকা বাড়ি, দালান। একতলা, দোতলা বাড়িগুলোর কোনোটায় বাহারি রং। তবে বাড়িগুলোতে কোনো পুরুষ থাকেন না। কারণ, পুলিশের অভিযানে ধরা পড়ার আতঙ্ক–তাঁদের পেশা যে মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অর্থ হাতানো।
ঢাকা ও ফরিদপুর জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, ডুমাইন গ্রামের অন্তত ৩০০ যুবকের পেশা প্রতারণা। কয়েক বছর ধরে তাঁরা প্রতারণা করছেন। তাঁরা মূলত মোবাইল ব্যাংকিংয়ে সেবা নেওয়া ব্যক্তিদের সঙ্গে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেন। এসব টাকাতেই ছাপরাঘর ভেঙে করেছেন দালান, আধা পাকা বাড়ি। একসময়ের ভ্যানচালক এখন চড়ছেন নতুন দামি মোটরসাইকেলে। এলাকায় এই প্রতারকদের পরিচিতি বিকাশ প্রতারক বা টোপ পার্টি। কিছু মানুষ হঠাৎ ধনী হওয়ায় দিন দিন এ পথে আনছে নতুনদের।
আজকের পত্রিকার অনুসন্ধানে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে ফরিদপুরের মধুখালী ও ভাঙ্গা উপজেলা এবং সংলগ্ন মাগুরা ও রাজবাড়ী জেলার কিছু গ্রামজুড়ে এই প্রতারকদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। তবে শুরুটা ১৪-১৫ বছর আগে মধুখালীর ডুমাইন ইউনিয়নের ডুমাইন গ্রাম থেকেই। গ্রামটির মিঠুন নামের এক যুবক মোবাইলে রিচার্জ প্রতারণার মাধ্যমে এর সূচনা করেন। যথিষ্ঠীরের ছেলে মিঠুন পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এক কর্মকর্তাকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে প্রথম ২০১২ সালে গ্রেপ্তার হন। এরপরই অভিনব এই প্রতারণা আলোচনায় আসে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র বলছে, মিঠুন এ পর্যন্ত বিভিন্ন মামলায় অন্তত সাতবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁর কাছে শুরুতে দীক্ষা নিয়েছেন গ্রামের সৌখিন, হান্নান, সোহাগসহ কয়েকজন যুবক। তাঁদের অবস্থার পরিবর্তন দেখে ধীরে ধীরে গ্রামজুড়ে যুবকদের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে।
স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, নদীর পাড়ে কলাবাগান ও একটি মেহগনিবাগানে বানানো অস্থায়ী চালাঘরে সন্ধ্যা হলে বসেন যুবকেরা। দলে দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা মোবাইল অপারেটর কোম্পানির কাস্টমার কেয়ার প্রতিনিধি সেজে ফোন দেন গ্রাহকদের। কথার মারপ্যাঁচে গ্রাহকদের বিভ্রান্ত করে বিকাশসহ মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবের পাসওয়ার্ড অথবা ক্রেডিট কার্ডের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে নেন। পরে সেগুলো দিয়ে গ্রাহকের অজান্তেই হিসাব থেকে টাকা হাতিয়ে নেন। এই পেশায় জড়িত ব্যক্তিদের বাড়ির চারপাশে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে; যাতে পুলিশ এলে দেখে পালাতে পারেন। কেউ কেউ বাড়ির চিলেকোঠায় ছোট এসি কক্ষে বসে করেন প্রতারণা।
মধুখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শহিদুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, গত দুই বছরে অনেক শিক্ষিত সচেতন মানুষও এদের ফাঁদে পড়েছেন বলে শুনেছেন। তাঁদের মধ্যে চিকিৎসক, ব্যবসায়ী, আমলা, এমনকি পুলিশ কর্মকর্তাও রয়েছেন।
১৭ মে মধুখালী থানায় গিয়ে দেখা যায়, ইমোতে প্রতারণার শিকার হয়ে ৪০ হাজার টাকা খোয়ানো মধ্যবয়সী ব্যক্তি থানায় এসেছেন অভিযোগ দিতে।
ঢাকার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও ফরিদপুর জেলা পুলিশের সূত্র জানায়, বিকাশ প্রতারণা নিয়ে ডুমাইন গ্রামের বিভিন্নজনের নামে অন্তত ২১টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে দুটি মানি লন্ডারিংয়ের। প্রতিটি মামলাতেই ঘুরেফিরে একই ব্যক্তিদের নাম। দেশের যেকোনো প্রান্তের ডিজিটাল প্রতারণার অভিযোগের তদন্ত শেষ পর্যন্ত এই গ্রামেই যাচ্ছে।
জানতে চাইলে ফরিদপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. শাহজাহান আজকের পত্রিকাকে বলেন, এই চক্র এতই বিস্তৃত যে কয়েক বছর ধরে গ্রেপ্তার করেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। তবে পুলিশও হাল ছাড়েনি।
যেভাবে পাতে প্রতারণার ফাঁদ
মধুখালী থানার পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুরু হয়েছিল মোবাইল রিচার্জ প্রতারণার মাধ্যমে। তখন প্রতারকেরা মানুষকে ভুলিয়ে তাদের সিমে টাকা ভরাতেন। কিন্তু সিমে থাকা হাজার হাজার টাকা নগদ করতে না পারায় পাতা হয় অন্য ফাঁদ। পুরস্কার পাওয়ার তথ্য জানিয়ে সেটা নিতে সামান্য কিছু টাকা লাগবে দাবি করে কুরিয়ার সার্ভিস বা ডাকযোগে টাকা নেওয়া হতো। তখনো প্রতারণা গ্রামে বিস্তৃত হয়নি। তবে ২০১১ সালে দেশে মোবাইলে অর্থ লেনদেনের প্রথম প্ল্যাটফর্ম বিকাশ চালু হলে প্রতারণায় ঝুঁকে পড়েন আরও কিছু তরুণ। তাঁদের আর্থিক অবস্থা রমরমা হলে লোভ ছড়িয়ে পড়ে অনেকের মধ্যে।
একসময় জড়িয়ে পড়েন গ্রামের অধিকাংশ মানুষ। ছলেবলে ওটিপি জেনে টাকা হাতাতে থাকেন। এই প্রতারণার বিরুদ্ধে তৎপরতায় প্রতারকেরা শুরু করেছে ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি।
ডুমাইন পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী মোতালেব আজকের পত্রিকাকে বলেন, টাকার জোরে প্রতারকদের রাজত্ব সর্বত্র। তাঁদের পাড়ার আরিফুল অষ্টম শ্রেণি পাস করে পড়াশোনা ছেড়ে দুই বছর ধরে এই প্রতারণায় নেমেছেন। আরিফুলের বাবা কিছুদিন আগেও ভ্যান চালাতেন, এখন কয়েক মাস পরপর জমি কেনেন।
গডফাদার নেই, শহরে শহরে চক্রের সদস্য
ফরিদপুর জেলা পুলিশ ও সিআইডির কাছে থাকা তালিকায় ডুমাইন ইউনিয়নের অন্তত তিনজন সন্দেহভাজনের নাম রয়েছে। তাঁরা এই ডিজিটাল প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত। জানা গেছে, এই প্রতারকদের কোনো গডফাদার নেই। ৮-১০ জনের ছোট ছোট দল হয়ে এ কাজ করছে।
মধুখালী থানার ওসি বলেন, তালিকার চেয়ে বাস্তবে প্রতারকদের সংখ্যা অনেক বেশি।
প্রতারণা পেশা থেকে ফিরে আসার দাবি করা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডুমাইন গ্রামের এক যুবক বলেন, ছোট ছোট দলগুলো চার ধাপে কাজটি করে। দু-তিনজন বিভিন্ন শহরের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দেওয়া দোকান থেকে টাকা যাওয়া মোবাইল নম্বরের তালিকা পাঠান। পরের ধাপে দু-একজন এসব নম্বরে টোপ ফেলে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেন। পরে কয়েক হাত ঘুরে অন্য শহর থেকে ওই টাকা ওঠান। তাঁর দাবি, একজন দিনে ৩০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত প্রতারণা করেন।
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের সদ্য বদলি হওয়া বিশেষ পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলাম বলেছিলেন, এসব মামলার তদন্তে তাঁরা অনেক হিসাবে দিনে লাখ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য পেয়েছেন; যা অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল সিআইডির কাছে।
জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ
গত মঙ্গলবার ডুমাইন ইউনিয়নে গিয়ে জানা গেল, দোপপাড়া, নিশ্চিন্তপুর, শিয়ালপাড়া, পশ্চিমপাড়া ও ডুমাইন গ্রামের যুবক ও মধ্যবয়সী পুরুষদের নামে প্রতারণার অভিযোগ বেশি। বিভিন্ন মামলায় নাম থাকা ব্যক্তিদের বাড়িতে গিয়ে কাউকেই পাওয়া যায়নি। জানা গেল, গ্রামের নাট্টু চৌধুরী ও তাঁর তিন ছেলে, টিটু, ইকবাল শেখ, আবদুল কাদের শেখ, আরিফুল, লিটন, ইসমাইল, রতন বাবু, মালেক, মানিক, মল্লিক ও ফিরোজ হঠাৎ বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তবে তাঁদের কেউ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোননি, প্রকাশ্য কোনো পেশাও নেই।
স্থানীয় কয়েকজনের অভিযোগ, ডুমাইন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক ও বর্তমান চেয়ারম্যান ও সদস্যরা এই অপরাধীদের মদদ দেন।
পুলিশ বলছে, আতিয়ার নামের সদ্য সাবেক এক ইউপি সদস্য প্রতারক চক্রের সদস্যদের জামিন ও মামলার দিকটি দেখেন। বিনিময়ে মাস গেলে মোটা অঙ্কের টাকা নেন।
ডুমাইন ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটির সদস্য শাহ্ আসাদুজ্জামান তপনের বিরুদ্ধেও প্রতারকদের মদদ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অন্য একটি মামলায় তিনি কারাগারে থাকায় অভিযোগের বিষয়ে তাঁর বক্তব্য নেওয়া যায়নি।
গ্রামের কয়েকজনের অভিযোগ, পুলিশের কিছু অসাধু সদস্য ও গ্রাম পুলিশ প্রতারকদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নেন। তাই পুলিশের অভিযানের খবর প্রতারকেরা আগেই জেনে পালিয়ে যায়।
ইউনিয়নেই কোনো এজেন্ট নেই
অবাক করা বিষয় হলো, ডিজিটাল প্রতারণার ঘাঁটি ডুমাইন ইউনিয়নেই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের কোনো এজেন্টের দোকান নেই। মোবাইলে রিচার্জ করার দোকানও নেই। এই সুবিধা নিতে যেতে হবে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে মধুখালী উপজেলা সদরে। তবে সেখানেও জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে মোবাইল ব্যাংকিং করতে হয়।
আব্দুল মালেক নামের ডুমাইন গ্রামের এক ব্যবসায়ী বলেন, প্রতারকদের কারণে গ্রামের নাম বললে মানুষ আড়চোখে তাকায়।
থানা-পুলিশ যা বলছে
মধুখালী থানা সূত্র বলছে, এই প্রতারণা নির্মূলে তারা এক যুগ ধরে চেষ্টা চালাচ্ছে। ২০২০ সালের ১৮ জানুয়ারি ৯৫ জনকে আত্মসমর্পণও করিয়েছিল পুলিশ। বিভিন্ন অভিযানে ১৫০ জনের বেশি প্রতারককে একাধিকবার আটকও করা হয়েছে। কিন্তু প্রতারণা বন্ধ হয়নি।
মধুখালী থানার ওসি শহিদুল ইসলাম বলেন, ডুমাইন গ্রামের শেষ মাথায় নদ। এর ওপর পারে মাগুরা জেলা। গ্রামে পুলিশ ঢুকলেই প্রতারকেরা নদ পেরিয়ে মাগুরায় চলে যায়।
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক আজকের পত্রিকাকে বলেন, এমন প্রান্তিক পর্যায়ে থানাগুলোতে এ ধরনের মামলা তদন্ত করতে যে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি প্রয়োজন, তা স্থানীয় পুলিশের নেই। তাই অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো সঠিক সিদ্ধান্তও নেওয়া যায় না। তাই মামলার অভিযোগপত্রও দুর্বল হয়। আবার পুলিশ যদি প্রতারকদের কাছ থেকে সুবিধা নেয়, তাহলে তারা উৎসাহী হয়। তিনি বলেন, নিজে সচেতন হলেই প্রতারকের ফাঁদ এড়ানো সম্ভব।
রাজধানীর বিমানবন্দরে শরীরে বিশেষ কৌশলে গাঁজা নিয়ে এসে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে তিনজন কিশোর। তাঁরা বর্তমানে কিশোর সংশোধনাগারের রয়েছে।
১৪ দিন আগেপরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে সিঙ্গাপুরে যান দুই ভাই উজ্জ্বল মিয়া ও মো. ঝন্টু। সেখানে থাকা অবস্থায় মুঠোফোনে ভাবির সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ান ছোট ভাই মো. ঝন্টু। পরে দেশে ফিরে ভাবিকে বিয়ে করার জন্য আপন বড় ভাই উজ্জ্বল মিয়াকে খুন করে ছোট ভাই।
১৪ দিন আগেরাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় গত দুই মাসে দুই অটোরিকশা চালককে হত্যা করে রিকশা ছিনিয়ে নেওয়া ঘটনা ঘটেছে। পৃথক এই দুই ঘটনায় তদন্তে নেমে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
১৫ দিন আগেপাবনার পদ্মা নদী থেকে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ১২ বছরের এক কিশোর এবং ২২ বছরের এক তরুণীর অর্ধগলিত দুইটি মরদেহ উদ্ধার করেছে নাজিরগঞ্জ নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি। উদ্ধারের দুইদিনেও কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। রোববার সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নাজিরগঞ্জ নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সাইদুর রহমান।
১৮ দিন আগে