জাপানে গণপরিবহনে নারীদের উত্ত্যক্তের ভিডিওর বড় বাণিজ্য

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ১৫ জুন ২০২৩, ২০: ২৭
আপডেট : ১৫ জুন ২০২৩, ২০: ৫৬

ট্রেনে করে স্কুলে যাওয়ার সময় তাকাকো (ছদ্মনাম) আবিষ্কার করলেন, ভিড়ের মধ্যে কেউ তাকে স্পর্শ করেই সটকে পড়ল। এমন অভিজ্ঞতায় বড় ধাক্কা খায় তাকাকো (১৫)। স্কুলের সময়টা কাটল অত্যন্ত বিমর্ষ অবস্থায়। জীবনে প্রথমবার শারীরিক হেনস্তার শিকার হলো সে। কিন্তু এখানে শেষ হলো না। পরদিন আবার ঘটল একই ঘটনা। এভাবে চলল প্রায় বছরখানেক। দিনের পর দিন এভাবে চলতে থাকায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়ল তাকাকো। 

বিপর্যস্ত তাকাকো একদিন ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয় নিয়ে একজন নিপীড়কের হাত ধরে ফেলে। সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকারে করে। ভিড়ের মধ্যে ধরা পড়ে অপরাধী। তাকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয়। তবে আদালতে কেবল মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়। অথচ এর আগেও একই ধরনের অপরাধে সে দণ্ডিত ছিল। 

জাপানসহ পূর্ব এশিয়ার দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং এবং চীনের বাণিজ্যিক প্রদেশগুলোতে গণপরিবহনে নারীদের হয়রানি একটা সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো এটি রীতিমতো টাকা কামানোর মাধ্যম হয়ে উঠেছে! 

বিশেষ করে সকালবেলা যখন গণপরিবহনে কর্মজীবী মানুষের ভিড় অত্যন্ত বেশি থাকে তখনই ঘটে এসব ঘটনা। এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িতরা ট্রেনে কোনো নারীকে অনুসরণ করে। সুযোগ বুঝে ভিড়ের মধ্যে ওই নারীর স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেয়। গোপনে অনুসরণ করা থেকে গায়ে স্পর্শ করার পুরো ঘটনার ভিডিও ধারণ করা হয়। সেই ভিডিও বিক্রি হয় অনলাইন প্ল্যাটফর্মে। বেশ কয়েকটি অনলাইন গ্রুপে প্রায় প্রকাশ্যেই বিক্রি হয় এসব ভিডিও। বিবিসি আই বছরব্যাপী অনুসন্ধান চালিয়ে রোমহর্ষক এ চিত্র তুলে এনেছে। 

চিকান ওয়েবসাইট
গণপরিবহনে নারীদের হেনস্তার ভিডিও ক্লিপ বিক্রি হয় অনলাইনে ১ ডলারের কিছু কমে। বিবিসির অনুসন্ধানে এমন অনেক ওয়েবসাইটের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—ডিংবুজু (আমার আর তর সইছে না), চিহান, জিশে ইত্যাদি। ৪ হাজার সদস্যের একটি টেলিগ্রাম গ্রুপের সন্ধান পায় অনুসন্ধানী দলটি। ভিডিও ক্লিপ কেনা–বেচার পাশাপাশি গণপরিবহনে কীভাবে নারীদের হেনস্তা করতে হবে—এ ব্যাপারে নানা পরামর্শও পাওয়া যায় এই গ্রুপে। এমনকি কোথায় নারীদের হেনস্তা করা হবে—সেটির লাইভ আপডেট পাওয়া যায়। অনুসন্ধানী দলটির কাছে একজন নারী অভিযোগ করেন, আংকেল কুই নামে এক ব্যক্তি তাঁকে উত্ত্যক্ত করেন। একপর্যায়ে একটি ক্লু পাওয়া যায়, এই আংকেল কুই চিকান ওয়েবসাইট এবং ভিডিও ব্যবসার পেছনে রয়েছে। 

বিশ্বব্যাপী বড় বাজার
এ ধরনের অপকর্মে জড়িত একটি গ্রুপের একজন অ্যাডমিন বিবিসিকে জানায়, প্রতি মাসে প্রায় ১০০ ভিডিও আপলোড করা হয় তাদের তিনটি ওয়েবসাইটে। প্রায় ১০ হাজার গ্রাহক আছে, যাদের বেশির ভাগই চীনের অধিবাসী। অ্যাডমিন জানান, প্রতিদিন পাঁচ থেকে ১০ হাজার ইউয়ানের ব্যবসা আছে তাদের যা প্রায় ১ হাজার ডলারের বেশি। 

নাটের গুরুর সন্ধানে
চক্রের মূল হোতাদের খুঁজে বের করতে বিবিসির সাংবাদিক একজন সংগীতশিল্পীর ছদ্মবেশে টেলিগ্রাম গ্রুপের নকটিস নামে একজন অ্যাডমিনের সঙ্গে পরিচিত হোন। বাস্তবে সাক্ষাৎ হওয়ার পর জানতে পারেন, তিনি জাপানে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকের শিক্ষার্থী। তার এক বন্ধু লুপাসও ওই গ্রুপের একজন অ্যাডমিন। তাদের দায়িত্ব হলো, ওয়েবসাইটে ভিডিও আপলোড করা, ওয়েবসাইট পরিচালনা করা। এ থেকে প্রায় মোট আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ কমিশন পায় তারা। 

কিছুদিন পর জানা যায়, ডিংবুজু ওয়েবসাইটের প্রধান মাওমি, তিনি চীন থেকে পুরো কাজের দিকনির্দেশনা দেন। আরও জানা যায়, আংকেল কুই একক কোনো ব্যক্তি নয়। গ্রুপ দেখভালের জন্য এ রকম একাধিক লোক আছে। 

কে এই মাওমি
নকটিস এবং লুপাসের থেকে জানা যায়, চীনে জন্ম নেওয়া মাওমি ছোটবেলায় সুপারম্যান এবং অ্যানিমে ভিডিও দেখত। ১৪ বছর বয়সে প্রথম যৌন নিপীড়নের ভিডিও দেখে। ধীরে ধীরে এতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। অত্যন্ত অল্প বয়স থেকেই সে ওয়েবসাইটে এসব ভিডিওর ব্যবসা শুরু করে। চীনে ধরা পড়ার ভয়ে মাওমি জাপানে চলে আসে। জাপানিদের আচার–আচরণ রপ্ত করে। অনুসন্ধানের একপর্যায়ে মাওমির ব্যাংক কার্ড থেকে জানা যায়, তার প্রকৃত নাম তাং জহুরান। সে কয়েকটি ওয়েবসাইট দেখভাল করে। তবে বিবিসির অনুসন্ধানী দল পরিচয় প্রকাশ করলে তাং জহুরান পুরো ব্যাপারটি অস্বীকার করে। 

চিকান ক্লাব
জাপানের ইয়োকোহামায় জনমানবহীন এক এলাকার একটি দোকান। দোকানের সামনের অংশটি জাপানের মেট্রো স্টেশনের মতো। দোকানটিকে সাজানো হয়েছে ট্রেনের কামরার মতো করে। ভেতরে ট্রেনে ব্যবহৃত মিষ্টি ঘ্রাণের পরিষ্কারক, ওপরে ঝুলছে হাতল। রয়েছে সাউন্ড সিস্টেম, যেখানে বিভিন্ন স্টেশনে বিরতির ঘোষণা দেওয়া হয়। এমনকি ক্লাবের মেম্বারশিপ কার্ডও গণপরিবহনের টিকিটের মতোই। এখানে টাকার বিনিময়ে বিশেষ ভিডিও দেখতে আসেন লোকেরা। তাঁরা যাতে ট্রেনের মতো একটি আবহ পায় সে জন্যই এমন ব্যবস্থা। টাকা দিয়ে বিকৃত খেয়াল বা ফ্যান্টাসি উপভোগ করা যায় লাইভে। যারা এর গ্রাহক তাদের সাধারণত ‘চিকান’ নামে ডাকা হয়। 

দোকানের মালিক হাশুদা সুহেই বিবিসির অনুসন্ধানী দলটিকে জানায়, জাপানে এভাবে বিকৃত খেয়াল মেটানোর বিষয়টি খুব সাধারণ। এ ধরনের মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা যেন বাস্তবে কোনো নারীকে ধর্ষণ বা হেনস্তা না করে, সে লক্ষ্যেই জাপানে এ ধরনের ক্লাব গড়ে উঠেছে। বৈধভাবেই চলছে এসব ক্লাব। 

এরূপ কদর্য মানসিকতার এমন মহামারি কেন—এই প্রশ্নের জবাবে জাপানে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ সাইতো বিবিসিকে জানান, ব্যাপারটা হাশুদা যেভাবে ভাবছেন অতটা সরল নয়। শিকারের ওপর কর্তৃত্ব ফলানো এবং তার মানহানি থেকে অধিকাংশ চিকান আনন্দ পায়। তারা শিকারদের কখনোই তাদের সমান তো নয়ই, বস্তু হিসেবে বিবেচনা করে। 

এ ছাড়া জাপানের সমাজ এখনো অত্যন্ত রক্ষণশীল। নারীদের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি বিপজ্জনক রকমের পুরুষতান্ত্রিক। সাধারণত নারীরা নিপীড়নের ব্যাপারে মুখ খোলে না। আর এই নিপীড়কেরা নারীদের এই মৌনতার সুযোগ নেয়। প্রতিবাদকারী নারীদের অনেককেই হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়। জাপানের আদালতও এ ধরনের মামলায় গুরুদণ্ড দেয় না। 

ব্যাপক সচেতনতা কার্যক্রম
পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় এ ধরনের অপকর্মে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনার জন্য বাড়ছে সচেতনতা। কিন্তু মূল আসামিদের ক্রমাগত রূপ বদলানো এবং তথ্যপ্রযুক্তিকে দক্ষ হওয়ার কারণে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। গণপরিবহন বা মেট্রো স্টেশনের নারীদের হয়রানি বন্ধে প্রচারণা চলছে। স্কুল কলেজগুলোতেও চলছে সচেতনতা কার্যক্রম। সম্প্রতি জাপান এ ধরনের অপরাধের কঠোর শাস্তির বিধান করেছে। পাশাপাশি যৌনতায় সম্মতির বয়স ১৩ থেকে বাড়িয়ে ১৬ বছর করার বিষয়ে পার্লামেন্টে ঐকমত্য হয়েছে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত