মাদ্রাসাছাত্রকে ইস্ত্রির ছ্যাঁকায় ঝলসে দিয়ে ৯ দিন লুকিয়ে রাখলেন বড় হুজুর

হোমনা (কুমিল্লা) প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৮: ৫৯
আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৯: ৩৭

কুমিল্লার হোমনায় এক মাদ্রাসাছাত্রের শরীরে গরম ইস্ত্রির ছ্যাঁকা দিয়ে ঝলসে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, ওই ছাত্রকে ৯ দিন একটি গোপন কক্ষে আটকে রেখে চিকিৎসা দিচ্ছিলেন অভিযুক্ত মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক (বড় হুজুর)। অবশেষে গতকাল সোমবার ভুক্তভোগীর মা ছেলের জন্য রান্না করা খাবার নিয়ে মাদ্রাসায় গেলে বিষয়টি জানতে পারেন। 

এ ঘটনায় সোমবার রাতে ভুক্তভোগী ছাত্রের মা হোমনা থানায় ওই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক ও তিন শিক্ষার্থীসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এরপরই পুলিশ নির্যাতনে সহযোগিতাকারী একজন শিক্ষককে গ্রেপ্তার করে। তবে প্রধান অভিযুক্ত বড় হুজুর ও তিন শিক্ষার্থী পলাতক রয়েছেন।

১৬ সেপ্টেম্বর (শনিবার) রাত সাড়ে ১১টার দিকে উপজেলার নয়াকান্দি মমতাজিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানায় এ নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। বর্তমানে ওই শিক্ষার্থী ঢাকায় শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি রয়েছেন।

হোমনা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আব্দুস  ছালাম সিকদার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দেখে মনে হয়েছে ১০-১২ দিন আগেই পুড়েছে। পোড়া দুই নিতম্বেই গভীর ঘা হয়ে যাওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য মঙ্গলবার তাঁকে ঢাকা শেখ হাসিনা বার্নে পাঠানো হয়েছে।’

ভুক্তভোগী ওই ছাত্রের নাম আব্দুল কাইয়ুম (১৮)। তিনি ওই মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের ছাত্র। আব্দুল কাইয়ুম ইতিমধ্যে ২৭ পাড়া কোরআন হেফজ করেছেন। তিনি উপজেলার চান্দেরচর গ্রামের বাহরাইন প্রবাসী আব্দুল কাদির ও হাফেজা বেগম দম্পতির সন্তান।

এ ঘটনায় অভিযুক্তরা হলেন ওই মাদ্রাসার মুহতামিম (বড় হুজুর) মো. সাইফুল ইসলাম হাবিব (২৮)। তিনি উপজেলার নয়াকন্দি গ্রামের রেনু মিয়ার ছেলে। নির্যাতনে সহযোগী শিক্ষক মো. আতিকুল ইসলাম (২৮)। তিনি মুরাদনগর উপজেলার বাঙ্গরা বাজার থানার শ্রীকাইল গ্রামের শহিদ মিয়ার ছেলে। আরও তিন কিশোর শিক্ষার্থী।

এ ঘটনায় শিক্ষক মো. আতিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

এদিকে আজ মঙ্গলবার জরুরি সভা ডেকে প্রধান অভিযুক্ত ওই শিক্ষক সাইফুল ইসলাম হাবিবকে মাদ্রাসা থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটির সভাপতি মতিউর রহমান। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, জরুরি সভা ডেকে ওই রেজুলেশনের মাধ্যমে ওই শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়েছে। ঘটনাটি আমরা আগে জানতাম না। এত দিন বিষয়টি তারা লুকিয়ে রেখেছিল। জানার পরই এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

মাদ্রাসা সূত্রে জানা যায়, ওই মাদ্রাসাটি ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে ওই মাদ্রাসায় ২৮০ শিক্ষার্থী ও ৯ জন শিক্ষক রয়েছেন। কোনো নিবন্ধন ছাড়াই ১৩ বছর ধরে এ মাদ্রাসায় রিভিশন বিভাগ, হেফজ বিভাগ, নাজেরা বিভাগ ও নূরানী বিভাগসহ চারটি বিভাগে ছাত্রদের শিক্ষাদান চলছে। 

স্থানীয় বাসিন্দা ও ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ১৬ সেপ্টেম্বর সহপাঠীদের সঙ্গে দুষ্টুমি করার সময় পরনের লুঙ্গি খুলে যায় আবদুল কাইয়ুমের। এ বিষয়টি মুহতামিম সাইফুল ইসলামকে জানালে রাত প্রায় সাড়ে ১১টার দিকে গ্রেপ্তার শিক্ষক আতিকুল ইসলামসহ আরও তিন শিক্ষার্থীর সহযোগিতায় আবদুল কাইয়ুমকে গরম ইস্ত্রির ছ্যাঁকা দিয়ে নির্যাতন করেন। গত ১০ দিন আবদুল কাইয়ুমকে একটি বদ্ধ ঘরে একাকী আটকে রেখে, চিকিৎসা দিয়ে আসছিলেন সাইফুল ইসলাম। কিন্তু মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের ভয়ভীতি দেখানোয় কেউ এত দিন মুখ খোলেনি। এখনো ভয়ে কেউ কিছু বলছে না। 

গভীর পোড়া ক্ষতের কারণে ঠিকমতো চলাফেরাও করতে পারছিলেন না কাইয়ুম। গতকাল সোমবার বিকেলে কাইয়ুমের মা হাফেজা বেগম ছেলের জন্য খাবার নিয়ে মাদ্রাসায় গেলে প্রথমে তাঁকে সাক্ষাৎ করতে দেওয়া হয়নি। পরে অনেক চেষ্টার পরে তাঁকে দেখতে দেওয়া হয়।

নির্যাতনের শিকার আব্দুল কাইয়ুম আজকের পত্রিকাকে জানান, ওই দিন তিনি অন্য সহপাঠীদের সঙ্গে খেলাচ্ছলে দুষ্টুমি করছিলেন। এক ফাঁকে তার পরনের লুঙ্গি খুলে যায়। এ ঘটনাটিই অন্য শিক্ষার্থীরা মুহতামিমকে জানায়। এর শাস্তি হিসেবে রাতে সাইফুল ইসলাম তাঁকে অফিসে নিয়ে আরেক শিক্ষক আতিকুল ও আরও তিন শিক্ষার্থীর সহযোগিতায় তাঁর নিতম্ব এবং পায়ের তলায় গরম ইস্ত্রি লাগিয়ে ছ্যাঁকা দিয়ে ঝলসে দেয়। অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করলেও সবাই ঘুমিয়ে থাকায় কেউ চিৎকার শুনতে পায়নি। পরে তাঁর এ শাস্তির বিষয়টি কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকিও দেওয়া হয়।

ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর মা হাফেজা বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সোমবার সকালে আমার ছেলের জন্য খাবার নিয়ে মাদ্রাসায় গেলে সে আমাকে দেখে কাঁদতে থাকে এবং বাড়িতে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যায়। ছেলের মানসিক অবস্থা বুঝে তাকে বাড়ি নিয়ে যাই। বাড়িতে গিয়ে আমাকে সে তার জখমের জায়গা দেখিয়ে পুরো ঘটনা বলে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘ছেলে ইস্ত্রির ছ্যাঁকায় গুরুতর জখম দেখে তাৎক্ষণিক তাকে হোমনা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করি। তারা আমার ছেলের প্রতি নিষ্ঠুর ও অমানবিক আচরণ করেছে। বিষয়টি আমার প্রবাসী স্বামী এবং এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের জানিয়ে হোমনা থানায় অভিযোগ করেছি।’ 

এ বিষয়ে হোমনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ক্ষেমালিকা চাকমা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘গতকাল সোমবার বিকেলেই খবর পাই যে, নয়াকান্দি মমতাজিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসার ‘বড় হুজুর’ এক শিক্ষার্থীর নিতম্বে গরম ইস্ত্রির ছ্যাঁকা দিয়েছেন। সন্ধ্যায় সেখানে গিয়ে খোঁজখবর নিয়েছি। ওই শিক্ষার্থীকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছি। সেই ইস্ত্রি মেশিন এবং মাদ্রাসার সিসিটিভির হার্ডডিস্ক খুলে নিয়ে আসা হয়েছে। এগুলো থানায় জমা আছে।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনার বিষয়ে জেনে মাদ্রাসা কমিটিকেও বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে বলেছি।’

এ বিষয়ে হোমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জয়নাল আবেদীন আজকের পত্রিকাকে বলেন, মাদ্রাসার এক শিক্ষার্থীকে ইস্ত্রির ছ্যাঁকা দিয়ে নির্যাতনের অভিযোগে দুই শিক্ষকসহ ৫ জনের নামে মামলা করেছে ভুক্তভোগীর মা। এর মধ্যে একজন শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রধান অভিযুক্ত শিক্ষক ও তিন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত