দেবিদ্বার (কুমিল্লা) প্রতিনিধি
অভাবের সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনবে ছেলে। সেই আশায় একমাত্র ছেলে ইয়াকুব হাসানকে ২০১৯ সালের মে মাসে দালালদের মাধ্যমে টুরিস্ট ভিসায় লিবিয়ায় পাঠান শাহিনুর বেগম। সেখানে বেনগাজিতে একটি তেলের কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন ইয়াকুব। বাংলাদেশি টাকায় প্রতি মাসে ৩৫ হাজার টাকা বেতন পেতেন।
ইয়াকুবের বাবা আবুল খায়ের আগে থেকেই লিবিয়ায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। বাবা আর ছেলে লিবিয়ায় কাজ করে যে টাকা আয় করতেন এতে প্রথম দুই বছর সংসারে বেশ সচ্ছলতা এসেছিল। পরে ইয়াকুব আরও বেশি টাকা উপার্জনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। সেই স্বপ্ন যে দুঃস্বপ্ন হবে কে জানত! ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে মাফিয়াদের হাতে পড়েন ইয়াকুব। এরপরের গল্পটি অত্যন্ত করুণ!
একমাত্র ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিতে বলেছিলেন স্বজনেরা। মাফিয়ারা তাঁকে মেরে ফেলেছে, আর জীবিত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই— শাহিনুর বেগমকে এসবই বলছিলেন প্রতিবেশীরা।
কিন্তু আশা ছাড়েননি মা। গত ছয় মাসে ছেলের সন্ধান পেতে দালালদের প্রায় ২০ লাখ টাকা দিয়েছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। পরে সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আশায় সম্পূর্ণ অপরিচিত দেশ লিবিয়ায় যাত্রা করেন শাহিনুর। শাহিনুর বেগম দেবিদ্বার উপজেলার জাফরগঞ্জ ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামের লিবিয়া প্রবাসী আবুল খায়েরের স্ত্রী। অবশেষে ছেলেকে উদ্ধার করেই বাড়ি ফিরেছেন তিনি।
সোমবার লিবিয়ার অভিযান নিয়ে শাহিনুর বেগম সাংবাদিকদের বলেন, ‘ছেলের সন্ধান না পেয়ে আমার স্বামী দুইবার স্ট্রোক করেছে। তার অবস্থাও খুবই খারাপ হয়ে যায়। দেশে এ খবরে আমার এক একটা দিন মনে হচ্ছিল, আমি জাহান্নামের কোন আজাবে পড়ে আছি। পাগলের মতো এদিক সেদিক ছুটেছি। পাড়া-প্রতিবেশীরাও ছেলেকে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিতে বলে। পরে আমি নিজেই সিদ্ধান্ত নিই, ছেলেকে যেকোনো মূল্যে উদ্ধার করতেই হবে। আমি নিজেই লিবিয়ায় যাব। মেয়ের জামাইয়ের সহযোগিতায় পাসপোর্ট, ভিসা, টিকিট করি। গরু ছাগল ও জমিজমা বিক্রি করে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা জোগাড় করেছি। ৯ জানুয়ারি আমার ফ্লাইট হয়। আমি প্রথমে দুবাই যাই, সেখানে একদিন থেকে পরের দিন মিসরে যাই, মিসরে ২৪ ঘণ্টা যাত্রা বিরতির পর লিবিয়ার বেনগাজিতে স্বামীর কাছে পৌঁছাই।’
শাহিনুর বলেন, ‘ভাষা জানতাম না, প্রথমে সেখানে বাংলা ভাষা যারা জানেন আমি এমন কয়েকজনকে খুঁজে বের করি। তাঁদের আমি সব ঘটনা খুলে বলি, তাঁরা আমাকে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা করে দেন। পরে আমি দূতাবাস ও আইওএমের কর্মকর্তাদের সব খুলে বলি, তাঁরা সব শুনে আমাকে সাহায্য করেন। আইওএম কর্মকর্তারা লিবিয়া সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইয়াকুবকে উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। একপর্যায়ে তাঁরা ফোনে আমার সঙ্গে আমার ছেলের কথা বলিয়ে দেন। ফোনে ছেলের কণ্ঠ শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। আমার ছেলেও ওপাশ থেকে কান্না করতে থাকে। ছেলেকে দেখার জন্য বুক ফাটা আর্তনাদ হচ্ছিল আমার। কিন্তু লিবিয়ায় আমাদের দেখা হয়নি। ছেলে তখন ত্রিপোলিতে ছিল, আর আমি বেনগাজিতে।’
আইওএম ও বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতায় শাহিনুর বেগম ৮ মার্চ বেনগাজি থেকে এবং ইয়াকুব ১৬ মার্চ ত্রিপোলি থেকে ঢাকায় ফেরেন। লিবিয়া থেকে ফেরার পর তাঁদের রাখা হয় আশকোনার হজ ক্যাম্পে। ছয় মাস ধরে লিবিয়ায় মাফিয়াদের হাতে বন্দী ছেলেকে উদ্ধার করে গত ২১ মার্চ শাহিনুর ও ইয়াকুব ফেরেন গ্রামের বাড়ি দেবিদ্বারে।
মাফিয়াদের হাতে বন্দী থাকার সময়কার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে ইয়াকুব হাসান বলেন, ‘জাহাঙ্গীর নামের একজনের পরামর্শে অবৈধভাবে ২০২১ সালের শুরুর দিকে সাগরপথে ইতালি যাওয়ার পরিকল্পনা করি। ইতালি যাওয়ার জন্য রফিক নামের এক দালালকে ৪ লাখ টাকা দিই। প্রথমে গাড়িতে করে বেনগাজি থেকে ত্রিপোলিতে নেওয়া হয় আমাকে। সেখান থেকে রাত ১১টার দিকে নৌকাযোগে আমাদের গন্তব্য হয় ইতালির লাম্পিদুসা দ্বীপ। আমার সঙ্গে নৌকাতে ৩০০ যাত্রী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ১৫০ জন বাঙালি। নৌকার মাঝির ওয়ারলেস চালু থাকায় যাত্রার শুরুতেই আমাদের নৌকা লিবিয়ার কোস্টগার্ডের কাছে ধরা পড়ে। এ দিন সব মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার মানুষকে আটক করা হয়। যাদের পরিচিত লোকজন ছিল তাদের ঘাট থেকে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আমিসহ অন্যদের জেলে পাঠানো হয়।’
ইয়াকুব বলেন, ‘জেলে আমাদের খুব অত্যাচার নির্যাতন করা হয়েছে। খাওয়ার জন্য একটা রুটি আর পানি দিত। ২২ দিন জেলে থাকার পর কোস্টগার্ডকে ৪ লাখ টাকা দিয়ে আমি ছাড়া পাই।’
এই ঘটনার প্রায় আট মাস পর আবার ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেন ইয়াকুব। এবার তাঁর বিপদ আরও বেড়ে যায়। এ সময় মাফিয়ারা তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। ইয়াকুব বলেন, ‘মাফিয়ারা আমাদের মোবাইল, টাকা, কাপড়চোপড় সবকিছু নিয়ে নেয়। তারা আমাদের জিম্মি করে। কবরের মতো ছোট একটি ঘরে আমাদের সাত দিন রাখা হয়। ঘরটিতে কোনো আলো-বাতাস ছিল না। শুধু অন্ধকার। সপ্তাহে দুতিন দিন পর পর খাবার দেওয়া হতো। আমাদের প্রতিদিন একবার ঘর থেকে বের করে তারা মারত। হাতের কাছে যা পেত তা দিয়েই মারত। কিছু দালালের মাধ্যমে তারা সবার পরিবারকে জিম্মি করার বিষয়টি জানায়। সেখান থেকে বের করে আমাদের গরু জবাই করা হয় এমন এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কিছুদিন রেখে আরেকটি জায়গায় নেওয়া হয়। সেখানে প্রায় ৩০০ জনকে একটি রুমে রাখা হয়। প্রতিদিন এখানে অনেক মানুষ অসুস্থ হয়ে মারা যায়। দীর্ঘদিন খাবার না পেয়ে অনেকের পেটের সমস্যা হয়েছিল। অনেকের শরীরে ঘা হয়েছিল, শরীর থেকে পুঁজ পড়ছিল। আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ঘা হয়। তারা কোনো চিকিৎসা বা ওষুধ দিত না।’
বাঙালিদের ওপর অনেক বেশি অত্যাচার হয়েছে উল্লেখ করে ইয়াকুব বলেন, ‘আমাদের যেখানে রাখা হয় সেখানে সাতজন বাংলাদেশি আমাদের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। তাদের একজনের নাম সুজন। বাকিদের নাম মনে নেই। তারাও মাফিয়াদের হাতে অনেক আগে ধরা পড়েছিল। তবে তারা মাফিয়াদের কিছুটা বিশ্বস্ত। এই সাতজন আমাদের নিয়মিত মারত। কোনো কথা ছাড়াই হাতের কাছে যা পেত তা দিয়েই মারত। তাদের কোনো মায়া-দয়া নেই। তারাই আমাদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে। আমাদের ৩০০ জনের জন্য প্রতিদিন ৩০০টি রুটি দেওয়া হতো। এই সাতজন ৩০টি রুটি রেখে বাকি ২৭০টি রুটি আমাদের দিত। আমরা সেগুলো ভাগ করে খেতাম।’
সেখান থেকে বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করার ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে ইয়াকুব বলেন, ‘আমাদের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা একজনকে অনেক অনুরোধ করে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার ফোনটি নিই। আমি শুধু বাবাকে জায়গার নাম বলি এবং কাউকে আর কোনো টাকা না দেওয়ার জন্য বলি। কারণ সব টাকা দালালেরা খেয়ে ফেলে। বাবার সঙ্গে আমার ১৭ সেকেন্ড কথা হয়েছিল। গত ফেব্রুয়ারিতে একদিন একজন এসে আমার ও আমার বাবার নাম বলেন। আমি তখন তাঁর সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমার ছবি তুলে নেন। সেদিন খুব খুশি হই, কারণ বুঝতে পারছিলাম এবার ছাড়া পাব।’
শাহিনুর বেগম বলেন, ‘ছেলেকে ফিরে পেতে অনেক কেঁদেছি আর আল্লাহর কাছে ছেলের প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছি। গরু-ছাগল, জমিজমা বিক্রি করে, বন্ধক রেখে ছেলের মুক্তির জন্য টাকা পাঠিয়েছি। সব টাকা দালালেরা খেয়ে ফেলেছে। ছেলেকে আর কোথাও যেতে দেব না। সরকার যদি আমাদের টাকাগুলো দালালদের কাছ থেকে উদ্ধার করে দেয়, আমাদের খুব উপকার হবে। আমি আইওএমের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। তারা আমার ছেলেকে উদ্ধার করে দিয়েছে।’
অবৈধভাবে টুরিস্ট ভিসায় ছেলেকে পাঠানোর কারণ জানতে চাইলে শাহিনুর বলেন, ‘অনেক অভাবে ছিলাম। আর বৈধভাবে পাঠানো সম্ভব ছিল না। কষ্টে থাকলেও অবৈধভাবে সাগর পথে যেন কেউ ইতালি না যায়!’
অভিবাসী সম্পর্কিত পড়ুন:
অভাবের সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনবে ছেলে। সেই আশায় একমাত্র ছেলে ইয়াকুব হাসানকে ২০১৯ সালের মে মাসে দালালদের মাধ্যমে টুরিস্ট ভিসায় লিবিয়ায় পাঠান শাহিনুর বেগম। সেখানে বেনগাজিতে একটি তেলের কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন ইয়াকুব। বাংলাদেশি টাকায় প্রতি মাসে ৩৫ হাজার টাকা বেতন পেতেন।
ইয়াকুবের বাবা আবুল খায়ের আগে থেকেই লিবিয়ায় রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। বাবা আর ছেলে লিবিয়ায় কাজ করে যে টাকা আয় করতেন এতে প্রথম দুই বছর সংসারে বেশ সচ্ছলতা এসেছিল। পরে ইয়াকুব আরও বেশি টাকা উপার্জনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। সেই স্বপ্ন যে দুঃস্বপ্ন হবে কে জানত! ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে মাফিয়াদের হাতে পড়েন ইয়াকুব। এরপরের গল্পটি অত্যন্ত করুণ!
একমাত্র ছেলেকে ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিতে বলেছিলেন স্বজনেরা। মাফিয়ারা তাঁকে মেরে ফেলেছে, আর জীবিত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই— শাহিনুর বেগমকে এসবই বলছিলেন প্রতিবেশীরা।
কিন্তু আশা ছাড়েননি মা। গত ছয় মাসে ছেলের সন্ধান পেতে দালালদের প্রায় ২০ লাখ টাকা দিয়েছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। পরে সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আশায় সম্পূর্ণ অপরিচিত দেশ লিবিয়ায় যাত্রা করেন শাহিনুর। শাহিনুর বেগম দেবিদ্বার উপজেলার জাফরগঞ্জ ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামের লিবিয়া প্রবাসী আবুল খায়েরের স্ত্রী। অবশেষে ছেলেকে উদ্ধার করেই বাড়ি ফিরেছেন তিনি।
সোমবার লিবিয়ার অভিযান নিয়ে শাহিনুর বেগম সাংবাদিকদের বলেন, ‘ছেলের সন্ধান না পেয়ে আমার স্বামী দুইবার স্ট্রোক করেছে। তার অবস্থাও খুবই খারাপ হয়ে যায়। দেশে এ খবরে আমার এক একটা দিন মনে হচ্ছিল, আমি জাহান্নামের কোন আজাবে পড়ে আছি। পাগলের মতো এদিক সেদিক ছুটেছি। পাড়া-প্রতিবেশীরাও ছেলেকে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিতে বলে। পরে আমি নিজেই সিদ্ধান্ত নিই, ছেলেকে যেকোনো মূল্যে উদ্ধার করতেই হবে। আমি নিজেই লিবিয়ায় যাব। মেয়ের জামাইয়ের সহযোগিতায় পাসপোর্ট, ভিসা, টিকিট করি। গরু ছাগল ও জমিজমা বিক্রি করে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা জোগাড় করেছি। ৯ জানুয়ারি আমার ফ্লাইট হয়। আমি প্রথমে দুবাই যাই, সেখানে একদিন থেকে পরের দিন মিসরে যাই, মিসরে ২৪ ঘণ্টা যাত্রা বিরতির পর লিবিয়ার বেনগাজিতে স্বামীর কাছে পৌঁছাই।’
শাহিনুর বলেন, ‘ভাষা জানতাম না, প্রথমে সেখানে বাংলা ভাষা যারা জানেন আমি এমন কয়েকজনকে খুঁজে বের করি। তাঁদের আমি সব ঘটনা খুলে বলি, তাঁরা আমাকে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যবস্থা করে দেন। পরে আমি দূতাবাস ও আইওএমের কর্মকর্তাদের সব খুলে বলি, তাঁরা সব শুনে আমাকে সাহায্য করেন। আইওএম কর্মকর্তারা লিবিয়া সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইয়াকুবকে উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। একপর্যায়ে তাঁরা ফোনে আমার সঙ্গে আমার ছেলের কথা বলিয়ে দেন। ফোনে ছেলের কণ্ঠ শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। আমার ছেলেও ওপাশ থেকে কান্না করতে থাকে। ছেলেকে দেখার জন্য বুক ফাটা আর্তনাদ হচ্ছিল আমার। কিন্তু লিবিয়ায় আমাদের দেখা হয়নি। ছেলে তখন ত্রিপোলিতে ছিল, আর আমি বেনগাজিতে।’
আইওএম ও বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতায় শাহিনুর বেগম ৮ মার্চ বেনগাজি থেকে এবং ইয়াকুব ১৬ মার্চ ত্রিপোলি থেকে ঢাকায় ফেরেন। লিবিয়া থেকে ফেরার পর তাঁদের রাখা হয় আশকোনার হজ ক্যাম্পে। ছয় মাস ধরে লিবিয়ায় মাফিয়াদের হাতে বন্দী ছেলেকে উদ্ধার করে গত ২১ মার্চ শাহিনুর ও ইয়াকুব ফেরেন গ্রামের বাড়ি দেবিদ্বারে।
মাফিয়াদের হাতে বন্দী থাকার সময়কার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে ইয়াকুব হাসান বলেন, ‘জাহাঙ্গীর নামের একজনের পরামর্শে অবৈধভাবে ২০২১ সালের শুরুর দিকে সাগরপথে ইতালি যাওয়ার পরিকল্পনা করি। ইতালি যাওয়ার জন্য রফিক নামের এক দালালকে ৪ লাখ টাকা দিই। প্রথমে গাড়িতে করে বেনগাজি থেকে ত্রিপোলিতে নেওয়া হয় আমাকে। সেখান থেকে রাত ১১টার দিকে নৌকাযোগে আমাদের গন্তব্য হয় ইতালির লাম্পিদুসা দ্বীপ। আমার সঙ্গে নৌকাতে ৩০০ যাত্রী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ১৫০ জন বাঙালি। নৌকার মাঝির ওয়ারলেস চালু থাকায় যাত্রার শুরুতেই আমাদের নৌকা লিবিয়ার কোস্টগার্ডের কাছে ধরা পড়ে। এ দিন সব মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার মানুষকে আটক করা হয়। যাদের পরিচিত লোকজন ছিল তাদের ঘাট থেকে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আমিসহ অন্যদের জেলে পাঠানো হয়।’
ইয়াকুব বলেন, ‘জেলে আমাদের খুব অত্যাচার নির্যাতন করা হয়েছে। খাওয়ার জন্য একটা রুটি আর পানি দিত। ২২ দিন জেলে থাকার পর কোস্টগার্ডকে ৪ লাখ টাকা দিয়ে আমি ছাড়া পাই।’
এই ঘটনার প্রায় আট মাস পর আবার ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেন ইয়াকুব। এবার তাঁর বিপদ আরও বেড়ে যায়। এ সময় মাফিয়ারা তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। ইয়াকুব বলেন, ‘মাফিয়ারা আমাদের মোবাইল, টাকা, কাপড়চোপড় সবকিছু নিয়ে নেয়। তারা আমাদের জিম্মি করে। কবরের মতো ছোট একটি ঘরে আমাদের সাত দিন রাখা হয়। ঘরটিতে কোনো আলো-বাতাস ছিল না। শুধু অন্ধকার। সপ্তাহে দুতিন দিন পর পর খাবার দেওয়া হতো। আমাদের প্রতিদিন একবার ঘর থেকে বের করে তারা মারত। হাতের কাছে যা পেত তা দিয়েই মারত। কিছু দালালের মাধ্যমে তারা সবার পরিবারকে জিম্মি করার বিষয়টি জানায়। সেখান থেকে বের করে আমাদের গরু জবাই করা হয় এমন এক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কিছুদিন রেখে আরেকটি জায়গায় নেওয়া হয়। সেখানে প্রায় ৩০০ জনকে একটি রুমে রাখা হয়। প্রতিদিন এখানে অনেক মানুষ অসুস্থ হয়ে মারা যায়। দীর্ঘদিন খাবার না পেয়ে অনেকের পেটের সমস্যা হয়েছিল। অনেকের শরীরে ঘা হয়েছিল, শরীর থেকে পুঁজ পড়ছিল। আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ঘা হয়। তারা কোনো চিকিৎসা বা ওষুধ দিত না।’
বাঙালিদের ওপর অনেক বেশি অত্যাচার হয়েছে উল্লেখ করে ইয়াকুব বলেন, ‘আমাদের যেখানে রাখা হয় সেখানে সাতজন বাংলাদেশি আমাদের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। তাদের একজনের নাম সুজন। বাকিদের নাম মনে নেই। তারাও মাফিয়াদের হাতে অনেক আগে ধরা পড়েছিল। তবে তারা মাফিয়াদের কিছুটা বিশ্বস্ত। এই সাতজন আমাদের নিয়মিত মারত। কোনো কথা ছাড়াই হাতের কাছে যা পেত তা দিয়েই মারত। তাদের কোনো মায়া-দয়া নেই। তারাই আমাদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে। আমাদের ৩০০ জনের জন্য প্রতিদিন ৩০০টি রুটি দেওয়া হতো। এই সাতজন ৩০টি রুটি রেখে বাকি ২৭০টি রুটি আমাদের দিত। আমরা সেগুলো ভাগ করে খেতাম।’
সেখান থেকে বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করার ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে ইয়াকুব বলেন, ‘আমাদের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা একজনকে অনেক অনুরোধ করে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার ফোনটি নিই। আমি শুধু বাবাকে জায়গার নাম বলি এবং কাউকে আর কোনো টাকা না দেওয়ার জন্য বলি। কারণ সব টাকা দালালেরা খেয়ে ফেলে। বাবার সঙ্গে আমার ১৭ সেকেন্ড কথা হয়েছিল। গত ফেব্রুয়ারিতে একদিন একজন এসে আমার ও আমার বাবার নাম বলেন। আমি তখন তাঁর সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমার ছবি তুলে নেন। সেদিন খুব খুশি হই, কারণ বুঝতে পারছিলাম এবার ছাড়া পাব।’
শাহিনুর বেগম বলেন, ‘ছেলেকে ফিরে পেতে অনেক কেঁদেছি আর আল্লাহর কাছে ছেলের প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছি। গরু-ছাগল, জমিজমা বিক্রি করে, বন্ধক রেখে ছেলের মুক্তির জন্য টাকা পাঠিয়েছি। সব টাকা দালালেরা খেয়ে ফেলেছে। ছেলেকে আর কোথাও যেতে দেব না। সরকার যদি আমাদের টাকাগুলো দালালদের কাছ থেকে উদ্ধার করে দেয়, আমাদের খুব উপকার হবে। আমি আইওএমের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। তারা আমার ছেলেকে উদ্ধার করে দিয়েছে।’
অবৈধভাবে টুরিস্ট ভিসায় ছেলেকে পাঠানোর কারণ জানতে চাইলে শাহিনুর বলেন, ‘অনেক অভাবে ছিলাম। আর বৈধভাবে পাঠানো সম্ভব ছিল না। কষ্টে থাকলেও অবৈধভাবে সাগর পথে যেন কেউ ইতালি না যায়!’
অভিবাসী সম্পর্কিত পড়ুন:
রাজধানীর বিমানবন্দরে শরীরে বিশেষ কৌশলে গাঁজা নিয়ে এসে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে তিনজন কিশোর। তাঁরা বর্তমানে কিশোর সংশোধনাগারের রয়েছে।
১৫ দিন আগেপরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে সিঙ্গাপুরে যান দুই ভাই উজ্জ্বল মিয়া ও মো. ঝন্টু। সেখানে থাকা অবস্থায় মুঠোফোনে ভাবির সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ান ছোট ভাই মো. ঝন্টু। পরে দেশে ফিরে ভাবিকে বিয়ে করার জন্য আপন বড় ভাই উজ্জ্বল মিয়াকে খুন করে ছোট ভাই।
১৫ দিন আগেরাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় গত দুই মাসে দুই অটোরিকশা চালককে হত্যা করে রিকশা ছিনিয়ে নেওয়া ঘটনা ঘটেছে। পৃথক এই দুই ঘটনায় তদন্তে নেমে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
১৫ দিন আগেপাবনার পদ্মা নদী থেকে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ১২ বছরের এক কিশোর এবং ২২ বছরের এক তরুণীর অর্ধগলিত দুইটি মরদেহ উদ্ধার করেছে নাজিরগঞ্জ নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি। উদ্ধারের দুইদিনেও কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। রোববার সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নাজিরগঞ্জ নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সাইদুর রহমান।
১৯ দিন আগে