Ajker Patrika

ফারদিন হত্যা: আলোচনায় স্থানীয় ইউপি মেম্বার ও দুই নারী

আমানুর রহমান রনি, ঢাকা
আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০২২, ১৪: ১০
ফারদিন হত্যা: আলোচনায় স্থানীয় ইউপি মেম্বার ও দুই নারী

বুয়েটছাত্র ফারদিন নূর পরশ (২৪) হত্যাকাণ্ডের পর রূপগঞ্জের চনপাড়া বস্তি, স্থানীয় এক ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বার ও দুজন নারীর নাম দফায় দফায় আলোচনায় আসছে। দুই নারী হলেন–মনু বেগম (৫০) ও ময়না বেগম (৪৫)। তারা দুজনই মাদক ব্যবসায়ী। স্থানীয় কায়েত ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার বজলুর রহমান বজলুর অনুসারী।

গত সোমবার চনপাড়ায় গিয়ে ময়নাকে পাওয়া গেলেও মনুর দেখা মেলেনি। অভিযোগ রয়েছে মনুর বাড়িতে ফারদিনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তবে অনুসন্ধানে হত্যার বিষয়ে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী না পাওয়া গেলেও ঘটনার দিন রাতে ওই বাড়িতে হট্টগোলের শব্দ পেয়েছে প্রতিবেশীরা।

মনু বেগম ৮ নম্বর ব্লকের রাস্তার পাশের একটি বাসায় থাকেন। তাঁর স্বামীর নাম জুলহাস, তিনি ঢাকায় দৈনিক মজুরিতে বিভিন্ন কাজ করেন। তাঁর একমেয়ে ও প্রতিবন্ধী এক ছেলে রয়েছে। মেয়ের বস্তিতেই বিয়ে হয়েছে। তিনি সংসার করছেন। 

মনুর বাড়িটি ইটের উঁচু সীমানা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। ৮ নম্বর ব্লকের প্রধান সড়কের মাঝামাঝি ছোট সরু গলির ভেতরে তাঁর বাড়ি। তাঁর বাড়ির আকাশি রঙের লোহার গেটটি বন্ধ করে দিলে আর কিছু দেখা যায় না। গেটের ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি দিয়েও তেমন কিছু দেখা যায়নি। প্রতিবেশীরাও তাঁর বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চায় না। তবে তাঁর বাসায় মাদক ব্যবসা ও অপরিচিত মানুষের আড্ডার কথা জানিয়েছেন সবাই।

মনুর বাড়িতে ৪ নভেম্বর দিবাগত রাতে কোনো হট্টগোল হয়েছিল কিনা জানতে চাইলে তাঁর এক প্রতিবেশী অটোচালক বলেন, ‘মনুর বাড়িতে প্রতি রাতেই মানুষ আসে। বিভিন্ন এলাকা থেকে ছেলে মেয়েরা আসে, আড্ডা দেয়। সে রাজনীতি করে, এ জন্য লোকজন আসে। প্রতিদিন রাতেই তাঁর বাসায় শব্দ পাই, তবে সেগুলো কিসের শব্দ তা বলতে পারব না।’

সিটি শাহীন ৮ নভেম্বর দুপুরে বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ার পর মনুও বাড়িতে তালা দিয়ে পালিয়ে যায়। বস্তির সবাই তার মাদক ব্যবসার কথা জানে।

অপর নারী ময়না বেগম বস্তির ৬ নম্বর ব্লকে থাকেন। তাঁর বিরুদ্ধে ইয়াবা বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। তিনি নিজেই আজকের পত্রিকার কাছে ইয়াবা বিক্রির কথা স্বীকার করেছেন। ময়না বেগম বলেন, ‘আমি নিজের ইচ্ছায় মাদক ব্যবসা করি না। আমাকে জোর করে বজলু মেম্বার মাদক বিক্রি করায়। আমি তাঁর ভয়ে একবার পালিয়েছিলাম, সে ধরে এনে আমাকে মারধর করেছে। রায়হান, শাহীন আমাকে রাস্তায় ফেলে মেরেছে। মাদক ব্যবসা না করলে এলাকা ছেড়ে দিতে বলেছে।’ 

চনপাড়া বস্তিতে মাদক ব্যবসা, হত্যা, বাড়ি দখলে নেপথ্যে স্থানীয় কায়েত ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের বজলুর রহমান বজলু মেম্বারের নাম আসছে বারবার। বজলু মেম্বার এক সময় বস্তিতে ছোট্ট একটি দোকানে চালের ব্যবসা করতেন। তাঁর তিন মেয়ে ও দুই মেয়ের জামাই মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন।

সিটি শাহীন, রায়হান, শাওন, রাজা, সাব্বির এরা সবাই বজলুর অনুসারী। তাদের সবার বিরুদ্ধে মাদক মামলা রয়েছে। বস্তিতে জায়গা দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন প্রত্যেকে। তাদের দৃশ্যমান কোনো পেশা নেই। তবে সবাই একাধিক বাড়ির মালিক। এসব বাড়ি ভাড়া দেন তারা।

বজলুর স্ত্রী শিরিন বস্তিতে ক্ষমতাবান। ঘটনার পর বজলু পলাতক। তবে তাঁর স্ত্রী বাসিন্দাদের মুখ না খুলতে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। একটি এনজিওর অফিস দখল করে বস্তিতে নিজের অফিস বানিয়েছে বজলু মেম্বার। অনেকে সেটিকে টর্চার সেল বলেন।

রূপগঞ্জের চনপাড়া বস্তি

হাসিনা বেগম নামে এক নারী বলেন, ‘ঘর করতে দেবে বলে আমার কাছ থেকে জোর করে এক লাখ টাকা নিয়ে যায় বজলু। তারপর আর ঘর করতে দেয়নি।’

রূপগঞ্জের শীতলক্ষ্যার তীর ঘেসে কায়েত ইউনিয়ন। স্বাধীনতার পর রাজধানীর ভাসমান মানুষদের সেখানে নিয়ে পুনর্বাসন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তান থেকে ফেরত আসা কিছু বাঙালি পরিবারও সেখানে নেওয়া হয়। শুরুতে তিন হাজার পরিবারকে ঘর করার জন্য ১২ / ১৬ হাত করে জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়। স্থানের নাম অনুসারে এই পুনর্বাসন কেন্দ্রের নাম করণ হয় ‘চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র’। এখন সেখানে ৯টি ব্লকে সাত হাজার পরিবার বসবাস করেন। ভোটার ২২ হাজারেরও বেশি। এর গঠন প্রকৃতি, ঘনবসতি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে পুনর্বাসন কেন্দ্রটি এখন ‘চনপাড়া বস্তি’ নামে পরিচিত।

বস্তিতে কারও নামে বরাদ্দ হওয়া জায়গা বিক্রির সুযোগ নেই। তবে অনেকেই স্ট্যাম্পে লিখিত দিয়ে পজিশন বিক্রি করে চলে গেছেন অথবা ভয়ভীতি দেখিয়ে কিছু পরিবারকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এরপর এসব ঘর দখল করে নিয়েছে প্রভাশালী একটি চক্র। প্রভাবশালীরা দখল করে বহুতল ভবন তৈরি করেছে।

সরেজমিনে বস্তিতে ঘুরে মাদক ও অপরাধীদের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের প্রমাণ মিলছে। শত শত ভুক্তভোগী মানুষ অপরাধীদের বিভিন্ন অপরাধের কথা বলেছেন।

আজকের পত্রিকার অনুসন্ধানে জানা গেছে, চনপাড়া বস্তিতে প্রভাবশালী দুইটি গ্রুপ সক্রিয়। একটি গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছেন কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের (চনপাড়া) মেম্বার বজলুর রহমান বজলু। তাঁর অনুসারী রাশেদুল ইসলাম শাহীন ওরফে সিটি শাহীন, ফাহাদ আহমেদ শাওন, রাজু আহমেদ রাজা, রায়হান, রবিন, রিপন, সাব্বির, তালুকদার মুজাহিদ ও সায়েম। এদের মধ্যে গত সপ্তাহে সিটি শাহীন র‍্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন। বাকিদের মধ্যে রায়হানসহ কয়েকজন র‍্যাব হেফাজতে রয়েছেন। এরা সবাই বজলু মেম্বারের ঘনিষ্ঠ এবং মাদক ব্যবসায়ী বলে পিরিচত। শাওন বজলু মেম্বারের আপন ভাতিজি জামাই, রিপন নিজের মেয়ে জামাই। তারা প্রত্যেকেই বস্তিতে দোতলা-তিনতলা বাড়ি করেছেন।

অপর গ্রুপটির নেতৃত্বে রয়েছে জয়নাল আবেদীন। তার অনুসারীরা হলো–রাব্বি, জয়, বিজয়, মাজেদ, হাসিবসহ আরও অনেকে। 

তবে বর্তমানে বজলু মেম্বারের গ্রুপটি বেশি সক্রিয়। জয়নালকে তারা কোণঠাসা করে বস্তি ছাড়া করেছে। সরেজমিনে বস্তিতে ঘুরে দেখা গেছে, এখনো বস্তির ছোট ছোট গলি ও বাড়ির পেছনে মাদক বিক্রি চলছে। তবে র‍্যাবের ক্রমাগত অভিযানে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা আটক। আবার কেউ বস্তি থেকে পালিয়েছে। এতে তাদের অপকর্মের বিষয়ে মুখ খুলেছে সাধারণ বাসিন্দারা।

এ বিষয়ে বজলু মেম্বারের কাছে বক্তব্যের জন্য তাঁর অফিস ও বাসায় গিয়ে পাওয়া যায়নি। তাঁর দুটি নম্বরে ফোন দিয়ে তা বন্ধ পাওয়া যায়।

সম্প্রতি বস্তিটিতে অভিযান চালিয়েছে র‍্যাব। সংস্থার মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ফারদিন হত্যার সঙ্গে চনপাড়ার যেসব অপরাধীরা জড়িত ছিল, তাদের ইতিমধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। বস্তির সকল অপরাধের বিষয় আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে।’

এই সম্পর্কিত আরও পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী হলেন ক্যালিফোর্নিয়ার পরিবহন বিশেষজ্ঞ

‘তল্লাশির’ জন্য উসকানি দিয়েছে গুলশানের ওই বাসার সাবেক কেয়ারটেকার: প্রেস উইং

প্রধান উপদেষ্টার আরও দুই বিশেষ সহকারী নিয়োগ

খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা মাসুদ আহমেদের সব পদ স্থগিত

টিআইএন নেওয়ার পরে কিন্তু ঘুমাইতে পারবেন না: এনবিআর চেয়ারম্যান

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত