অজানা খুনি, রাষ্ট্র যেখানে দোসর

পরাগ মাঝি
প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২৪, ১৪: ০৩
আপডেট : ২৮ জুন ২০২৪, ১৮: ৪৭

রাষ্ট্রশক্তির গহিনে চলে অন্তর্ঘাতের খেলা। সেই খেলায় ভর দিয়ে বিশ্বব্যাপী গড়ে ওঠে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের নেটওয়ার্ক। এই চক্রের পাঁকে পড়ে কেউ খুনি, কেউ ডাকাত, কেউ ধর্ষক ও লুটেরা হয়। মানবতার সেখানে কোনো ঠাঁই নেই, পাগলামিই হয়ে ওঠে মুখ্য। দুনিয়াজুড়ে বেড়ে ওঠা এমন ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী ও তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে আজকের পত্রিকার এই সিরিজ প্রতিবেদন। তবে বলে রাখা ভালো, এটা কোনো মৌলিক রচনা নয়, সংকলনমাত্র। প্রকাশিত হবে প্রতি শুক্রবার দুপুরে, আজ তারই প্রথম কিস্তি।

নিজেদের অস্তিত্বের প্রয়োজনে কখনো কখনো ভয়ঙ্কর খুনেও গোপন মদদ দিয়ে থাকেন রাষ্ট্রপ্রধান বা রাষ্ট্রনায়কেরা। ইতিহাসে তার বহু নজির আছে। আজ থেকে ১৩৬ বছর আগে এমনই এক ঘটনা ঘটেছিল লন্ডনে। সেই সময়ের মহাপ্রতাপশালী ব্রিটিশ রানি ভিক্টোরিয়ার পরিবারের ষড়যন্ত্রে খুন হয়েছিল এক শিশুসহ অনেক নারী। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই নারীদের সবাই ছিলেন যৌনকর্মী।

রানি ভিক্টোরিয়ার নাতি ছিলেন প্রিন্স আলবার্ট ভেক্টর। রাজপুত বলে কথা—দেখতে যেমন সুদর্শন, চলাফেরায় তেমনি স্মার্ট। সেই অভিজাত যুবকের সঙ্গে গোপন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে হোয়াইট চ্যাপেল এলাকার এক যৌনকর্মীর। সেই সম্পর্ক গভীর হতেই এক কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। রাজপরিবারের ভেতরেও চাউর হয় সেই খবর। রাজপরিবার সিদ্ধান্ত নেয়, যে করেই হোক—দুনিয়া থেকে সব প্রমাণ মুছে ফেলতে হবে। এরপর ভাড়া করা হয় এক ভয়ঙ্কর খুনিকে, যিনি একের পর এক খুন করতে থাকেন। যারা এ ঘটনার ছিটেফোঁটাও জানত, তাদেরও দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ধীরে ধীরে প্রায় সব প্রমাণ মুছে যায়। 

কিন্তু সেই যে কথায় আছে—ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। ৮৮ বছর পরে সেই কলে বাতাস লাগে। ব্রিটিশ লেখক স্টিফেন নাইট ১৯৭৬ সালে ‘জ্যাক দ্য রিপার: দ্য ফাইনাল সলিউশন’ নামে একটি বই লেখেন। তাতে তিনি বলেন, নৃশংস এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে ব্রিটিশ রাজপরিবারের হাত ছিল। তাদের গোপন নির্দেশে যৌনকর্মী ও তাঁর শিশুটিকে হত্যা করা হয়। আরও যারা বিষয়টি সম্পর্কে জানত, তাদেরও সরিয়ে দেওয়া হয়। যদিও স্টিফেনের এই দাবি অনেকে উড়িয়ে দেন।

স্টিফেন নাইট বলেছিলেন, যাঁকে দিয়ে এই খুনগুলো করানো হয়েছিল, তাঁর নাম জ্যাক দ্য রিপার। পৃথিবীর কেউই তাঁকে কখনো খুঁজে পায়নি। কেন খুঁজে পাওয়া যায়নি, সেই রহস্যেরও কোনো কিনারা হয়নি। 

জ্যাক দ্য রিপারের প্রথম খুনের ঘটনাটি ঘটেছিল ১৮৮৮ সালের ৩১ আগস্ট। পূর্ব লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেল এলাকায় তখন মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। পথের দুপাশে গড়ে ওঠা পাব, নাইট ক্লাবগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। খদ্দের সামলে সুনসান রাস্তা ধরে একা হেঁটে যাচ্ছিলেন সেই যৌনকর্মী। তাঁর ক্লান্ত পায়ের ছোট ছোট ছাপ আর পাদুকা থেকে ভেসে আসা আওয়াজ রাতের নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তিনি জানতেন না, আলো-আঁধারি আর কুয়াশার আড়াল থেকে তাঁকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে হেঁটে আসছে আরেকটি ছায়ামূর্তি; শিকার হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় সাবধানী ক্ষুধার্ত এক বাঘ। সারা শরীর ঢেকে রাখা ছায়ামূর্তিটি ঠিক যখন পেছনে চলে এল, তখনই তার অস্তিত্ব টের পেলেন মেয়েটি। ভাবলেন, তবে কি শেষ রাতেও আরেকটি খদ্দের জুটে গেল! 

 সন্দেহ আর ভয়ে হাঁটা থামিয়ে একবার পেছনে ঘুরে তাকাতেই ছায়ামূর্তির দুই হাত তাঁর গলায় চেপে বসল; নিস্তেজ হয়ে এল শরীর। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। এরপর সেই অচেতন শরীরের ওপর চেপে বসল ছায়ামূর্তিটি। শরীরের ভাঁজ থেকে বের করে আনল ১২ ইঞ্চি লম্বা একটি ছুরি! রক্তে ভেসে গেল গলিপথ। কয়েক মিনিটের মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থলে এল। তারা মেয়েটির ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করল। পরিচয়ও মিলে গেল—মেয়েটি পেশায় যৌনকর্মী।
 
এরপর এল দ্বিতীয় শিকারের পালা, তারপর তৃতীয়—এভাবে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে কালো ইতিহাসের পাতায় নাম লেখালেন জ্যাক দ্য রিপার। বিশ্বজুড়ে পরিচিত হলেন ‘সিরিয়াল কিলার’ নামে। প্রচলিত ছিল, অন্তত পাঁচজন নারী তাঁর শিকারে পরিণত হয়। যদিও কেউ কেউ মনে করেন, রিপারের শিকারে পরিণত হওয়া নারীর সংখ্যা আসলে ১১ জনের বেশি। 

জ্যাক দ্য রিপারের শিকারে পরিণত হওয়া প্রথম নারী ছিলেন ম্যারি অ্যান নিকোলস। ১৮৮৮ সালের ৩১ আগস্ট দিবাগত রাত ৩টা ৪০ মিনিটে যখন পুলিশ তাঁর লাশ খুঁজে পায়, তখন ছুরির আঘাতে শরীর এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গিয়েছিল। গলার মাংসপেশিও ছিল বিচ্ছিন্ন। নির্মমভাবে চিড়ে ফেলা হয়েছিল তাঁর তলপেট থেকে শরীরের নিচের অংশ। নাড়িভুঁড়িও বেরিয়ে এসেছিল। এতগুলো খুনে জ্যাক দ্য রিপার সময় নিয়েছিলেন মাত্র তিন মাস। এর পরই তিনি হাওয়ায় মিশে যান। কেউ তাঁকে আর খুঁজে পায়নি। 

জ্যাকের হাতে খুন হওয়া ম্যারি অ্যান নিকোলস ছাড়াও অন্য যাঁদের নাম জানা যায় তাঁরা হলেন: অ্যানি চ্যাপম্যান, এলিজাবেথ স্ট্রাইড, ক্যাথারিন অ্যাডোজ এবং ম্যারি জ্যান ক্যালি। এই নারীদের সবাই ছিলেন যৌনকর্মী। তাঁর সবাই ছিলেন হোয়াইট চ্যাপেল এলাকায়। প্রায় একই রকম পদ্ধতিতে সবাইকে খুন করেছিলেন জ্যাক। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, পুলিশ যখন লাশ খুঁজে পায়, তখন তাঁদের সবার ক্ষেত্রেই শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি অঙ্গ ছিল অনুপস্থিত; বিশেষ করে কিডনি ও জরায়ু। কেন সবাইকে এভাবে খুন করা হলো, তা কেউই জানতে পারেনি। 

বলার অপেক্ষা রাখে না, ভিক্টোরিয়ান যুগের এই হত্যাকাণ্ডগুলো নিয়ে লন্ডনের মতো বড় শহরে মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। লন্ডনের গণ্ডি পেরিয়ে বিষয়টি নিয়ে হইচই পড়েছিল সারা দুনিয়ায়। এরপর লোকদেখানো হলেও হত্যাকারীকে ধরার জন্য আদাজল খেয়ে মাঠে নেমেছিল পুলিশ। ‘স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড’ নামে পরিচিত বিশ্বের প্রাচীনতম মেট্রোপলিটন পুলিশের বয়স তখন ৫৯ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তারাও কোনো কূলকিনারা করতে পারছিল না। সবচেয়ে হতাশাজনক ব্যাপার ছিল, পুলিশ সেই অপরাধীকে কোনো দিন শনাক্তই করতে পারেনি। হত্যাকারীকে চিহ্নিত ও গ্রেপ্তার করতে না পারা নিয়ে লন্ডনের ঘরে ঘরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল। 

 পাঠক, এটুকু পড়ে আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন, জ্যাক দ্য রিপারকে চিহ্নিত করাই না গেল, তাঁর নাম প্রকাশ্যে এল কী করে? এবার সেটা বলি, আসলে সংবাদপত্রের মাধ্যমেই সন্দেহভাজন খুনির নামটি প্রথম চাউর হয়েছিল। শুরুর দিকে সবাই যখন খুনির পরিচয় জানতে উন্মুখ, তখন অনেকে পুলিশ ও সংবাদপত্রের কাছে উড়োচিঠি লিখে নিজেকে খুনি দাবি করতেন। এমনই একজন নিজেকে খুনি দাবি করে একটি পত্রিকার কাছে চিঠি লিখেছিলেন। আর চিঠির নিচে ‘জ্যাক দ্য রিপার’ বলে সই করেন। ওই চিঠিতে হত্যাকাণ্ডের যে বিবরণ ছিল, তার সঙ্গে নামের যথার্থতা পাওয়ায় ‘জ্যাক দ্য রিপার’ নামেই পরিচিতি পান সন্দেহভাজন খুনি। যদিও সেই চিঠি পরে জাল প্রমাণিত হয়েছিল। 

১৩৬ বছর আগের সেই ঘটনার কোনো কূলকিনারা না হওয়ায় রহস্য এখনো জীবন্ত। আজকের দিনেও মানুষ জ্যাক দ্য রিপারের পরিচয় খুঁজে বেড়ায়। এ কারণেই হয়তো খুনের প্রায় ১০০ বছর পর মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই জ্যাক দ্য রিপারের একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রোফাইল তৈরি করে। যেন তারা সেই সময়ের রেকর্ডগুলো দেখে অপরাধীকে শনাক্ত করতে পারে। ওই সময় খুনের পর জ্যাক দ্য রিপারের প্রকৃত পরিচয় জানতে দুই হাজারের বেশি মানুষকে জেরা করেছিল পুলিশ। সন্দেহের তালিকায় ছিল তিন শতাধিক, আর গ্রেপ্তার হয়েছিল অন্তত ৮০ জন। 

জ্যাক দ্য রিপার হিসেবে যাঁকে সবচেয়ে বেশি সন্দেহ করা হয়েছিল, তিনি হলেন ফ্রান্সিস টাম্বলিটি নামের এক আমেরিকান তরুণ। ১৮৮৮ সালের প্রথম হত্যাকাণ্ডটির দুই মাস আগে তিনি ইংল্যান্ডে এসেছিলেন। তাঁর জীবনবৃত্তান্তের সঙ্গে তুলনা করে অনেকেই তাঁকে জ্যাক দ্য রিপার বলে সাব্যস্ত করেন। কারণ, হোয়াইট চ্যাপেলের কাছেই টাম্বলিটি বসবাস করতেন। ওই এলাকা সম্পর্কে তাঁর ভালো জানাশোনাও ছিল। পাশাপাশি একজন চিকিৎসা সহকারী হিসেবেও তিনি প্রশিক্ষিত ছিলেন। মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খুঁজে বের করা এবং সেগুলো দ্রুত অপসারণে বিশেষ দক্ষ ছিলেন তিনি। টাম্বলিটি তাঁর স্ত্রীকে ত্যাগ করেছিলেন। কারণ, তিনি জানতে পেরেছিলেন, তাঁর স্ত্রীও যৌনকর্মী। ফলে নারীদের প্রতি তাঁর প্রবল ঘৃণা ছিল। অনুমান করা হয়, সেই ক্ষোভ থেকেই তিনি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠেন। 

জ্যাক দ্য রিপারকে নিয়ে গল্প, কবিতা আর উপন্যাস কম লেখা হয়নি। তাঁকে নিয়ে সিনেমাও হয়েছে। ২০১৫ সালে জ্যাক দ্য রিপারের নামে একটি জাদুঘর করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র জন বিগস। পরে বিক্ষোভের মুখে সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়। ২০০৬ সালে বিবিসির এক ম্যাগাজিনে জ্যাক দ্য রিপারকে ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। 

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, জ্যাক দ্য রিপার আসলে কে ছিলেন, তা খুঁজে বের করার সব প্রমাণই পৃথিবী থেকে মুছে গেছে। সন্দেহভাজন খুনি এবং সাক্ষীদের কেউই আর বেঁচে নেই, যে কারণে জ্যাক দ্য রিপারের আসল পরিচয় কোনো দিনই জানবে না পৃথিবী। নিস্তব্ধ রাতের খুনের মতোই নিভৃতে হারিয়ে গেল ইতিহাসের এক ভয়ঙ্কর সিরিয়াল কিলারের পরিচয়।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত