Ajker Patrika

সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

দুই ভিসির ‘অনিয়মের পথে’ নতুন ভিসি

  • বিধি লঙ্ঘন করে ডিন ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নিয়োগের অভিযোগ
  • ডিন, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়োগের সুযোগ নেই: ইউজিসি।
  • নিয়োগে অনিয়মের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না বর্তমান ভিসি।
ইয়াহ্ইয়া মারুফ, সিলেট 
আপডেট : ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৮: ০২
সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: সংগৃহীত
সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: সংগৃহীত

সিলেট মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (এসএমইউ) প্রথম উপাচার্য ডা. মোর্শেদ আহমদ চৌধুরী ও দ্বিতীয় উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেন নিয়োগে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে অভিযুক্ত। তাঁদের দেখানো পথেই হাঁটছেন তৃতীয় ও বর্তমান ভিসি ডা. ইসমাঈল হোসেন পাটোয়ারী। অবৈধভাবে ও অনিয়মের মাধ্যমে নিয়োগ করা লোকজন নিয়েই তিনি কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বরাদ্দ করা পদসংখ্যার বিপরীতে অতিরিক্ত নিয়োগ দিয়ে নানা সমালোচনার মুখে পড়েন প্রথম উপাচার্য ডা. মোর্শেদ আহমদ চৌধুরী। নিয়োগ-বাণিজ্যের গুরুতর অভিযোগ মাথায় নিয়ে মেয়াদ পূর্ণ করেই বিদায় নেন তিনি। ২০২৩ সালের ৪ জানুয়ারি দ্বিতীয় উপাচার্য হিসেবে যোগ দেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চক্ষু চিকিৎসক এ এইচ এম এনায়েত হোসেন।

অভিযোগ রয়েছে, এনায়েত হোসেন যোগদানের পর ২৩৯ জন কর্মকর্তার বেতন-ভাতা বন্ধ করলেও এসব কর্মকর্তার স্বাক্ষরেই চলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কর্মকাণ্ড। পরে ওই ২৩৯ জনের মধ্য থেকে উপাচার্য তাঁর পছন্দ অনুসারে সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, হিসাবরক্ষক ও ক্যাশিয়ার এবং ২৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী অস্থায়ী ভিত্তিতে পুনরায় নিয়োগ দেন।

গুরুত্বপূর্ণ রেজিস্ট্রার দপ্তর, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরে যাঁদের দিয়ে কাজ করানো হয়, তাঁরা দুই বছর ধরে সরকারি বেতন পাচ্ছেন না। কিন্তু তাঁরা বিকল্প উপায়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন সরকারি অর্থ। ২০২৪ সালের শুরু থেকে দীর্ঘদিনের বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধ ও চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে আন্দোলনরত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

এরই মধ্যে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দাবিতে যোগ হয় উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের পদত্যাগ। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে কোনো ধরনের ছুটি ছাড়া টানা তিন মাস ক্যাম্পাসে আসেননি উপাচার্য এনায়েত।

বিধি লঙ্ঘন করে ডিন, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নিয়োগ

নানা ভাবে সমঝোতার চেষ্টা করেন তৎকালীন উপাচার্য এনায়েত। শেষরক্ষা হবে না ভেবে উপাচার্য পদ টিকিয়ে রাখতে হঠাৎ ঢাকায় সিন্ডিকেট সভা ডেকে বিএনপিপন্থী দুজন চিকিৎসককে তড়িঘড়ি করে নিয়োগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও এসএমইউ আইন ২০১৮ অমান্য করে নিজের গদি রক্ষায় ডিন হিসেবে অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হিসেবে ডা. মো. জিয়াউর রহমান চৌধুরীকে নিয়োগ দেন।

তাঁদের মধ্যে ডা. নাজমুল ডক্টর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) সিলেট জেলা সভাপতি ও নর্থ ইস্ট মেডিকেল কলেজের নেফ্রোলজি বিভাগের অধ্যাপক। ডা. জিয়া ড্যাব ওসমানী মেডিকেল শাখার সাধারণ সম্পাদক ও কলেজটি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ।

ডা. নাজমুলের নিয়োগে বলা হয়েছে- এসএমইউ আইন ২০১৮ এর ধারা ২৩ এর উপধারা ৫ অনুযায়ী ১০ম সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ডিন হিসেবে মনোনয়ন প্রদান করা হয়েছে। অথচ, বিশ্ববিদ্যালয় আইনে সিন্ডিকেটকে ডিন বা পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নিয়োগের কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।

আর ২৩ নম্বর ধারার ৫ নম্বর উপধারায় বলা আছে, ‘প্রত্যেক অনুষদের একজন করিয়া ডিন থাকিবে এবং তিনি ভাইস চ্যান্সেলরের তত্ত্বাবধানে অনুষদ সম্পর্কিত সংবিধি, বিধি ও প্রবিধান যথাযথভাবে পালনের জন্য দায়ী থাকিবেন।’ একই ধারার ৬ নম্বর উপধারায় ‘প্রত্যেক অনুষদের ডিন সংশ্লিষ্ট অনুষদের অন্তর্ভুক্ত সকল বিভাগের শিক্ষকদের দ্বারা নির্বাচিত হইবেন’ উল্লেখ রয়েছে।

একই দিনে একইভাবে ‘পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক’ হিসেবে ডা. মো. জিয়াউর রহমান চৌধুরীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে; যা ইউজিসি ও এসএমইউ আইন পরিপন্থী। বিএনপিপন্থী এই চিকিৎসক গত ১৫ বছর কোনো পদোন্নতি পাননি। ফলে ক্ষমতার পালাবদলের পর তিনি সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মনোনীত হন। অধ্যক্ষ হওয়ার জন্য অধ্যাপক বাধ্যতামূলক হওয়ায় তাঁকে চলতি দায়িত্ব পরিচালনার জন্য সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে।

এদিকে এই নিয়োগের পাশাপাশি অস্থায়ী ক্যাম্পাসে ঢুকতে না পেরে সাবেক উপাচার্য এনায়েত হোসেন ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত ডিন অফিসে কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সবশেষে টিকতে না পেরে পদত্যাগ করেন ডা. এনায়েত হোসেন। তারপর উপাচার্য ছাড়াই কেটে যায় বেশ কিছুদিন।

চলতি বছরের মার্চের শুরুতে যোগদান করেন জামায়াতপন্থী হিসেবে পরিচিত ডা. ইসমাঈল হোসেন পাটোয়ারী। কিন্তু তিনি যোগদানের পরও আগের নিয়মেই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় উপাচার্য ও ট্রেজারার ছাড়া বৈধ কোনো কর্মকর্তা নেই। কিন্তু আগের উপাচার্যের সেই অদৃশ্য খাত থেকে বেতন-ভাতা দিয়ে কাজ করানো লোকজন পুষছেন বর্তমান উপাচার্যও।

ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেট সভাসহ গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড সম্পন্ন হলেও নিয়োগে অনিয়ম বা বেতনহীন কর্মীদের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেননি।

এ ব্যাপারে জানতে সাবেক উপাচার্য ডা. এ এইচ এম এনায়েত হোসেনের মোবাইল ফোনে একাধিকার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। খুদে বার্তা পাঠালেও সাড়া দেননি। মোবাইল ফোন বন্ধ করে অন্যজনের মাধ্যমে এই প্রতিবেদককে ফোন করে সংবাদ প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেন।

এসএমইউর নবনিযুক্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক ডা. মো. জিয়াউর রহমান চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‌‘আমি অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করতেছি। এখানে কোনো আর্থিক ইয়া...নাই। বিনে পয়সায় দায়িত্ব পালন করছি ওসমানী প্রিন্সিপাল হিসেবে। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত মোতাবেক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আইন মেনে হইছে কি না, এটা ভিসি মহোদয় ভালো বলতে পারবেন।’

মেডিসিন, সার্জারি, বেসিক সায়েন্স ও প্যারা-ক্লিনিক্যাল সায়েন্স, ডেন্টাল, নার্সিং ও মেডিকেল টেকনোলজি অনুষদের নবনিযুক্ত ডিন অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‌‘আমি ক্রাইসিস মোমেন্টে এসে দায়িত্ব নিয়েছি। এটা সিন্ডিকেটে ডিসিশন নিছে। এর আগেও যত ডিন, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আসল—সব সিন্ডিকেটে ডিসিশন নিছে।’

নবনিযুক্ত উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. ইসমাইল হোসেন পাটোয়ারি বলেন, ‘ডিন এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেটের মিটিংয়ে ঠিক হয়েছিল। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক রেগুলার হয়নি এ জন্য ওসমানীর প্রিন্সিপালকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা ডিসিশন নিয়েছিলেন। কোথাও সমস্যা হলে আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখব।’

এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন আজকের পত্রিকা'কে বলেন, ‘যে আইন আছে, তাতে শিক্ষকদের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে ডিন নিয়োগ হবে। আমাদের আইনের মধ্যেই কাজ করতে হবে। ডিন, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এই ধরনের নিয়োগ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হওয়ার সুযোগ নেই। এটা যদি হয়ে থাকে, তাহলে সেটা খারাপ হয়েছে। আগের ভিসিরা ইউনিভার্সিটিকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য যেভাবে যে সব কাজ করার কথা ছিল, তাঁরা সেভাবে করেননি। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।’

আরও খবর পড়ুন:

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত