বছরজুড়ে বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক দুর্যোগ

অনলাইন ডেস্ক
Thumbnail image

প্রাকৃতিক নানা বিপর্যয়ে কেটেছে বিদায়ী ২০২২ সাল। দাবদাহ, দাবানল, বন্যা, খরা, অতি বৃষ্টি, বায়ুদূষণ, তুষারপাতসহ প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগের ভেতর দিয়ে গেল পুরো বছর। এসবের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবকে দায়ী করছেন আবহাওয়াবিদেরা।

এ বছর স্মরণকালের ভয়াবহ দাবদাহ ও দাবানল দেখেছে বিশ্ব। দাবানলের শিকার হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি, পর্তুগাল, গ্রিস, তুরস্ক, আলজেরিয়াসহ আরও অনেক দেশ। এসব দুর্যোগে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, পুড়েছে লাখ লাখ হেক্টর জমি।

এ বছরই যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তাপমাত্রা রেকর্ড ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। গত ১৯ জুলাই যুক্তরাজ্যের লিংকনশায়ারের কনিংসবিতে দেশটির ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৪০ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়।

যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো তাপমাত্রা রেকর্ড ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে।কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল অবধি বয়ে গেছে দাবদাহ। সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড হয়েছে কানাডায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই এলাকাগুলোতে রেকর্ডভাঙা গরম দেখা যাচ্ছে। কর্মকর্তারা জানান, গত ২৯ জুন কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার লেটন এলাকায় সর্বোচ্চ ৪৭ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১১৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট) তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। এটি কানাডার ইতিহাসের সর্বোচ্চ।

রেকর্ড তাপমাত্রায় নাকাল হয়েছে জাপানও। রাজধানী টোকিওতে তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়, যা টোকিওতে ১৮৭৫ সালের পর সর্বোচ্চ। রাজধানীর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় ইসেসাকি শহরে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। জুন মাসে রেকর্ড করা এটাই জাপানের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় অনেক মানুষ।

পাকিস্তানে বন্যায় প্রায় দেড় হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়। আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, উনিশ শতকের শিল্পবিপ্লবের পর ভারী কলকারখানা হু হু করে বেড়েছে। এরপর থেকে বৈশ্বিক উষ্ণতা এরই মধ্যে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। চলতি শতাব্দীতে তা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে ধরে রাখা না গেলে পৃথিবীর অনেক নিচু দেশ বা অঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে। ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন অংশে সম্প্রতি তাপপ্রবাহ, দাবদাহ, বন্যা, অতিবৃষ্টি, খরার মতো যেসব দুর্যোগ চলছে, তার জন্য অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ মোটাদাগে দায়ী।

দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন বা ‘কপ ২৬’-এর সমন্বয়ক ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ অলোক শর্মা বলেন, ‘বিশ্ব বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি বুঝিয়ে বলার কিছু বাকি আছে বলে আমার মনে হয় না। বিশ্বে যা ঘটছে, তা তো প্রতিনিয়ত আমরা দেখছি।’ 

ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের জলবায়ু বিজ্ঞানী জোয়েরি রোজেলজ জানান, আগামী দশকেই বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি বাড়তে পারে। ফলে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ প্রতি পাঁচ বছরে একবার তীব্র দাবদাহের শিকার হবে। আর তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি বাড়লে এর ভুক্তভোগী হবে বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি মানুষ। বিশ্বজুড়ে হিট স্ট্রোকে মৃত্যু হতে পারে অন্তত ৫০ লাখ মানুষের। এ ছাড়া হারিয়ে যেতে পারে বিশ্বের ৯৯ শতাংশ প্রবাল, বিলীন হতে পারে ১০টি মেরুদণ্ডী প্রাণীর মধ্যে একটি।

পূর্ব আফগানিস্তানে ভূমিকম্পে সহস্রাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়। পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষেরা যখন তীব্র গরমে ভুগছিল আরেক প্রান্তে ছিল অতি বৃষ্টি ও বন্যা। এশিয়ার দেশ পাকিস্তান ও চীন অতি বৃষ্টি ও বন্যার সম্মুখীন হয়েছিল। পাকিস্তানে প্রায় দেড় হাজার মানুষের মৃত্যু হয় বন্যায়। দেশটির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ জানায়, বন্যায় ১ হাজার ৪৮৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, যার মধ্যে ৫৩০টি শিশু। গৃহহীন হয়ে পড়েছে কয়েক লাখ মানুষ।

বাংলাদেশেও চলতি বছর বিশেষ করে উত্তর–পূর্বাঞ্চলে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। অক্টোবরে আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ায় এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায় ৫০০ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে ১৪ লাখের বেশি মানুষ।

বছরের শেষ সময়ে এসে যুক্তরাষ্ট্র ভুগছে তুষারঝড়ে। তুষারঝড়ে দেশটিতে এখন পর্যন্ত ৬২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তুষারঝড়ে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নিউইয়র্কের বাফেলো শহর। সেখানে অন্তত ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে শহরটির এরি কাউন্টিতে।

ব্রাজিলে বন্যা ও ভূমিধস।যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া দপ্তর ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস (এনডব্লিউএস) জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানার এলক পার্কের তাপমাত্রা মাইনাস ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমেছে। 

আফগানিস্তানে বন্যায় নিহত অন্তত ১৮২ 
আফগানিস্তান আগস্টজুড়ে সময়ের ভারী বৃষ্টিপাতে বন্যা এবং ভূমিধসে কমপক্ষে ১৮২ জন আফগান প্রাণ হারিয়েছে। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুই মাসেরও কম সময় আগে ভূমিকম্পের কারণে দেশটির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। সেই দুর্যোগ সামলে ওঠার আগেই বন্যার আঘাত আসে। 

ভারতে বন্যায় নিহত ১৯২ 
সিএনএনের তথ্য অনুসারে, ভারতে জুন থেকে সেপ্টেম্বর বর্ষাকাল থাকে। আগের বছরের মতো এবারও গড় বৃষ্টিপাতের চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টি হয়েছে। টাইমস অব ইন্ডিয়ার তথ্য অনুসারে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে ছিল উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম। সেখানে বন্যা এবং ভূমিধসে কমপক্ষে ১৯২ জন মারা গেছে। 

ইন্দোনেশিয়ায় ভূমিকম্পে ব্যাপক প্রাণহানি হয়।খরায় পূর্ব আফ্রিকায় ২০০ জনেরও বেশি প্রাণহানি
পূর্ব আফ্রিকার বেশির ভাগ অংশই এই ভয়ানক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেছে। এবারের বিপর্যয়কে জাতিসংঘ ‘চল্লিশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ খরা’ বলে অভিহিত করেছে। এই খরা লাখ লাখ মানুষকে অনাহারের ঝুঁকিতে ফেলেছে। রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, পরিসংখ্যান বলছে, শুধু উত্তর-পূর্ব উগান্ডায় ক্ষুধায় মৃত্যুর সংখ্যা ২০০-এর বেশি। অনেকের ধারণা, খরার কারণে প্রতি ৩৬ সেকেন্ডে একজনের প্রাণহানি ঘটেছে। ইউরোপীয় কমিশন বলছে, নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় ফসলের উৎপাদন অর্ধেক হয়ে গেছে। ভয়াবহ অপুষ্টি সমস্যা ২০২৩ সাল পর্যন্ত বজায় থাকবে। 

ব্রাজিলে বন্যায় মৃত্যু অন্তত ২৩৩ 
নতুন বছরের মাত্র দুই মাস পেরোতেই ব্রাজিলের পেট্রোপলিস শহরে প্রবল বৃষ্টিপাত হয়। বিবিসির তথ্য অনুসারে, বন্যার পানি এবং কাদা পাহাড়ি শহরের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে। এতে কমপক্ষে ২৩৩ জনের প্রাণহানি ঘটে। এককালে ব্রাজিলের সম্রাটদের গ্রীষ্মকালীন অবকাশ কেন্দ্র ছিল এই পেট্রোপলিস। সেটি এখন ধ্বংসস্তূপ। উদ্ধারকাজ শেষ করতে কর্তৃপক্ষের গত কয়েক মাস লেগে গিয়েছিল। 

ক্রান্তীয় ঝড় মেগি আঘাতে ফিলিপাইনে মৃত্যু ২১৪ 
গত ১০ এপ্রিল গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঝড় মেগি আঘাত হানে ফিলিপাইনে। অবশ্য চলতি বছর দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে আঘাত হানা একমাত্র বড় ঝড় নয় এটি। বছরে গড়ে ২০টি ঝড় মোকাবিলা করতে হয় দেশটিকে। তবে মেগি এ বছরের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ঝড় ছিল। দেশটির প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝুঁকি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের হিসাবে, এ ঝড়ে কমপক্ষে ২১৪ জন প্রাণ হারান। 

নাইজেরিয়ায় ভয়াবহ বন্যায় ৫০০ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। ইন্দোনেশিয়ায় ভূমিকম্পে নিহত ৩৩৪ 
গত ২১ নভেম্বর পশ্চিম ইন্দোনেশিয়ার সিয়ানজুর শহর ৫ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল। এতে প্রাণ হারান কমপক্ষে ৩৩৪ জন। প্রশান্ত মহাসাগরীয় ‘রিং অব ফায়ার’ এর মধ্যে অবস্থানের কারণে ইন্দোনেশিয়ায় ঘন ঘন ভূমিকম্প আঘাত হানে হয়। এই অঞ্চলে টেকটোনিক প্লেটগুলোর সংঘর্ষ খুবই সাধারণ ঘটনা। 

দক্ষিণ আফ্রিকায় বন্যায় নিহত ৪৬১ 
এপ্রিলের শুরুতে ভারী বর্ষণের কারণে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানের কিছু অংশসহ ইস্টার্ন কেপে ভয়ানক বিপর্যয় নেমে আসে। দেশের তৃতীয় সর্বাধিক জনবহুল শহর এটি। বন্যা ও ভূমিধসের কারণে আনুমানিক ৪৬১ জনের মৃত্যু। দুর্যোগের মাস পেরিয়ে গেলেও ৭০ জনেরও বেশি এখনো নিখোঁজ। হাজার হাজার মানুষ স্থায়ী আবাস ফিরে পাননি। 

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দেখা দিয়েছে খরা।নাইজেরিয়ায় বন্যায় অন্তত ৬১২ জন নিহত
নাইজেরিয়ার এবার বর্ষাকাল ছিল জুন থেকে নভেম্বর। দেশটির সরকারি কর্মকর্তাদের মতে, এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ছিল এ বছর। বন্যার কারণে সারা দেশে কমপক্ষে ৬১২ জন মারা গেছেন। ১৪ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত। ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশনের প্রতিবেদন অনুসারে, নাইজেরিয়া এবং পশ্চিম আফ্রিকা অঞ্চলে বন্যার পেছনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা অন্য অঞ্চলগুলোর চেয়ে ৮০ গুণ বেশি। 

আফগানিস্তানে ভূমিকম্পে নিহত ১০৩৬ 
গত ২১ জুন পূর্ব আফগানিস্তানে ৫ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। এতে ভয়ানক ভূমিধস দেখা দেয়। হাজার হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। জাতিসংঘের হিসাবে, প্রাণ হারান আনুমানিক ১ হাজার ৩৬ জন। কয়েক দশকের মধ্যে আফগানিস্তানে এটিই ছিল সবচেয়ে মারাত্মক ভূমিকম্প। তালেবানের হাতে কাবুলের পতনের পর সামাজিক অস্থিরতা ও ক্ষুধা মোকাবিলা করতে হিমশিম খাচ্ছে আফগানিস্তানের মানুষ। এর মধ্যে এমন ভূমিকম্প দেশটির অর্থনীতি পাঁজর ভেঙে দিয়েছে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত