সব সংকট কাটিয়ে ভালো থাকুক আমাদের অরণ্য

ইশতিয়াক হাসান
প্রকাশ : ২১ মার্চ ২০২৪, ১২: ৫৪
আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৪, ১২: ৫৮

বছর তিনেক আগের কথা। বান্দরবানের রুমা উপজেলা। কেওক্রাডংয়ের পাদদেশে দার্জিলিং পাড়া। সেখানে গিয়ে আস্তানা গেড়েছি মেঘলা দিদিদের কটেজে। বাড়ির পেছনে ছোট্ট একটি পাহাড়ে হয়েছে আদার চাষ। সকালে ঘুম ভাঙার পর সেখানে ওঠে সামনে তাকাতেই চোখে পড়ল কেওক্রাডং ফেরত পর্যটকেরা হেঁটে ফিরছেন পাড়ার মাঝের মাঠ ধরে। তারপরই চোখ গেল উল্টো দিকে। আর তাতেই চমকালাম। মাঝারি উচ্চতার পাহাড়টায় ঘন গাছপালার সারি। কোনো কোনোটি হয়তো শত বর্ষের সীমানা পেরিয়েছে। এর পাশে একটু দূরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক পাহাড়েও গাছপালার ঠাসবুনোট।

পরে দার্জিলিং পাড়ার মানুষদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম জঙ্গলে ঠাসা পাহাড় দুটি বন্যপ্রাণীর আড্ডাখানা। মায়া হরিণ আছে সেখানে। আর আছে মাথা গরম ভালুকেরা।

আজ ২১ মার্চ, আন্তর্জাতিক বন দিবস। তাই চলুন আরও কয়েকটি অরণ্যের গল্প শুনি। কাপ্তাইয়ে বন বিভাগের রাম পাহাড় বিট অফিস থেকে চমৎকার দেখা যায় সীতা পাহাড়ের অরণ্য। ২০০৬-৭ সালের দিকে প্রথম যখন সেখানে যাই তখনই কর্ণফুলীর ওপাশের সীতা পাহাড়ের অংশটা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। প্রাচীন সব গাছপালা, লতা-গুল্ম মিলে এমন একে দেখে মনে হচ্ছিল কল্পরাজ্য থেকে ওঠে আসা প্রাগৈতিহাসিক কোনো অরণ্য। কেন যেন ঘুরে-ফিরে স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের বিখ্যাত বই লস্ট ওয়ার্ল্ডের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।

সীতা পাহাড়ের অরণ্যে ডানা মেলা এক শিকারি ইগলকে দেখে ভাবছিলাম লস্ট ওয়ার্ল্ড বা হারানো পৃথিবীর টেরোড্যাকটিলের কথা। পরদিন ভোরে সীতা পাহাড়ের ওপরে গাছের ডালে খেলা করা হনুমানগুলিকে হাতের আঙুলের চেয়ে বড় দেখাচ্ছিল না কোনোমতেই। পরে অবশ্য আরও বেশ কয়েক বার গিয়েছি কাপ্তাইয়ে। উঠেছি সীতা পাহাড়ের চূড়ায়ও।

বান্দরবানের অরণ্যে আকাশচুম্বী সব বৃক্ষ। ছবি: ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সমনে পড়ে কালেঙ্গার জঙ্গলে গিয়ে শ ফুটি সব গাছে কালো বিশালাকায় কাঠবিড়ালিদের মেলা কিংবা বড় মোদকের আগে হঠাৎ পৌঁছে যাওয়া নেই নীরব এলাকার কথা, যেখানে নদীর দু-ধারে কেবলই ছিল উঁচু সব বৃক্ষরাজির রাজত্ব। লাঠিটিলার গহিন অরণ্যের আকাশ ঢেকে দেওয়া সেই সব মায়াবী গাছপালার কথাও ভুলতে পারি না। আজ বিশেষ এই দিনটিতে ভাবি, কেমন আছে প্রিয় সেই অরণ্যগুলো।

বাঘের খোঁজে বান্দরবানের গহিনে, হাতির খোঁজে রাঙামাটির কাসালং, চিতার খোঁজে কাপ্তাই মুখ খাল—কত জঙ্গলে যে চষে বেরিয়েছি। যেখানেই গিয়েছি পেয়ে বসেছে হতাশা, চোখের কোণে অজান্তেই জমা হয়েছে জল। কাসালংয়ের মাইনির বন বাংলোতে গিয়ে দেখি চারপাশে বনের ছিটেফোঁটা নেই। অথচ এনায়েত মাওলা ষাট-সত্তর বছর আগে মাইনির ধারেই চিতা বাঘ-বাঘ শিকার করেছেন। সাঙ্গুর দিকে যাওয়ার সময় ২০১১ সালে রেমাক্রির ধারে একটা পাহাড় দেখিয়ে আমাদের মধ্যবয়স্ক মারমা গাইড বলছিলেন, তাঁর বালক বয়সে লুকিয়ে সেখানে বাঘ দেখার গল্প। মধুপুরে গিয়ে মনে পড়েছে ১৯৫০ সালের আশপাশে এদিকেও ছিল বাঘের রাজত্ব। চিতা বাঘ ছিল ওখানে মুক্তিযুদ্ধের আশপাশের সময়। ভাওয়াল-মধুপুরের অরণ্যের অবস্থাও মোটেই ভালো নয় এখন।

সিলেটের বনগুলোতে গিয়েও মন খারাপ হতো পুরোনো দিনের কথা ভেবে। আবদুর রহমান চৌধুরী সুনামগঞ্জের লাউর এলাকায় ও খাসিয়া পাহাড়ে বাঘ-হাতির যে রাজ্যের কথা বলে গিয়েছেন তা কোথায় হারাল! তখন সেখানে ছিল গভীর বনানী। নানির মুখে শোনা গোয়াল থেকে বাঘ গরু নিয়ে যাওয়ার গল্প কিংবা নানার বাড়ির কাছে দুই ভাইয়ের খালি হাতে বাঘ শিকারের ঘটনা, সাতছড়িতে চিতা বাঘের গাড়ির কাচে থাবা চালানোর সেই সব ঘটনা মনে পড়লেও অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ-অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে শরীরে।

রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ ধরে ভ্রমণ করার সময় দেখা মিলেছিল এই পাহাড়ি অরণ্যের।টেকনাফ গেলে আবার মনে পড়ে ধীরাজ ভট্টাচার্যের যখন পুলিশ ছিলামের সেই গহিন অরণ্যে ভরপুর, বাঘ ডাকা টেকনাফের বর্ণনার কথা। আমার দাদির ওসি বাবার পোস্টিং সূত্রে প্রায় নব্বই-পঁচানব্বই বছর আগে ছিলেন কক্সবাজার, টেকনাফ, হ্নীলার মতো জায়গাগুলোতে। দাদিরা বাঘের ডাক শুনতে পেতেন রাতে। কোয়ার্টার ঘেরা ছিল উঁচু পাচিলে।

তবে তখন বুঝতে পারিনি সামনে আরও খারাপ দিন আসছে। যত দিন গড়াচ্ছে তত বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। কয়েকটা উদাহরণই যথেষ্ট। কির্সতং-রুংরাংয়ের মায়ায় পড়েছেন অনেক অরণ্যপ্রেমীই। যে ধনেশ পাখির নামে রুংরাং-র নাম সেখানে এখন ধনেশ পাখির দেখা পাওয়া ভার। ক্রিসতংও হারিয়েছে আগের আদিম চেহারা। বছর তিনেক আগে কেওক্রাডং গিয়ে শুনেছিলাম ধনেশ পাখির ঠোঁট বিক্রির খবর।

কেওক্রাডংয়ে যাওয়ার পথে দার্জিলিং পাড়ার উল্টো পাশে অরণ্যে ঢাকা এক পাহাড়।রাঙামাটি-বান্দরবানের গহিনে গাছ কাটার খবরও কানে আসে। কখনো সংবাদমাধ্যমে, কখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এক সময় খুব সমৃদ্ধ এক বন ছিল কক্সবাজারের টেকনাফ গেম রিজার্ভ। বিশেষ করে রোহিঙ্গারা আসার পর এই অরণ্যের করুণ হাল হয়েছে। কক্সবাজার জেলার অনেক অরণ্যই এখন রোহিঙ্গা-সংকটে সঙিন অবস্থায় আছে।

অথচ বন আর বন্যপ্রাণী মানুষের কম উপকার তো করে না। আমাদের ছেড়ে দেওয়া কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে গাছ। পৃথিবীর কার্বন-ডাই-অক্সাইডের বড় সংরক্ষণাগার এই অরণ্য। শুধুমাত্র গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অরণ্যগুলোতেই ২ হাজার ৫০০ কোটি টন সংরক্ষিত আছে কোনো না কোনোভাবে। গাছপালা আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনও সরবরাহ করে।

বান্দরবানের অরণ্যে। বেশ কয়েক বছর আগের তোলা।ছায়া দিয়ে বনের গাছপালা আমাদের শীতলতা দেয়। এ ছাড়া ট্রান্সপিরেশন নামের একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চারপাশের বাতাসের তাপমাত্রা দ্রুত সময়ের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। শিকড়ের মাধ্যমে পানি সংগ্রহ করে গাছ। তারপর পাতার মাধ্যমে কিছু পানি বাতাসে ছেড়ে দেয়। এভাবে উত্তপ্ত পরিবেশ শীতল হয়।

মাটি থেকে পানি নিয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ছেড়ে দেয় গাছ। তাই বড়সড় জায়গা নিয়ে বিস্তৃত জঙ্গলগুলো নিজেদের একটা ক্ষুদ্র জলবায়ু এলাকা তৈরির পাশাপাশি আবহাওয়াতে ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন. দক্ষিণ আমেরিকার আমাজনের জঙ্গল শুধু এর ভেতরে ও আশপাশে বৃষ্টিপাত ঘটাতে ভূমিকা রাখে তা নয়, এমনকি উত্তর আমেরিকার বিশাল সমতলভূমিতেও বৃষ্টি ঝরতে পারে এর প্রভাবে।

হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের সাতছড়ির অরণ্য।কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ করার পাশাপাশি কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড এবং সালফার ডাই অক্সাইড থেকে বাতাসকে পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে বন। সাহায্য করে ভূমিক্ষয় রোধেও।

আরও অনেক উপকারিতাই আছে বন ও এর গাছপালার। সেগুলো না হয় তোলা থাকল অন্য কোনো দিনের জন্য।

মৌলভীবাজারের জুড়ি উপজেলায় অবস্থিত আশ্চর্য সুন্দর এক বন লাঠিটিলা।কিন্তু এত সব উপকারিতার বিনিময়ে বনকে আমরা কিছুই দিতে পারিনি। বরং নানাভাবে ক্ষতিই করে গিয়েছি। আগে আমাদের চমৎকার গ্রামীণ বন ছিল। এসব বনে মেছো বিড়াল, খাটাশ বা গন্ধগোকুল, বন বিড়াল, শিয়ালসহ বিভিন্ন প্রাণীর আড্ডাখানা। কিন্তু এখন খুব কম গ্রামেই এ ধরনের বন বা বাগান আছে। তাই গ্রামের আশপাশে বাস করা প্রাণীরাও আছে বড় বিপদে। লোকালয়ে এসে মানুষের পিটুনিতে নিয়মিত মেছো বিড়াল, বন বিড়াল মারা পড়ার সংবাদ শুনে কেঁদে উঠে মন।

এক শীতের সকালে আদপুরের জঙ্গলের এক ছড়া পেরোচ্ছেন এক বনপ্রহরী।এখন মনে হচ্ছে, বন দিবসের নিরাশার কথা বেশি হয়ে গিয়েছে। আশার কথাও আছে। ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকেই এখন গাছের চারা লাগাচ্ছেন। তেমনি বন্যপ্রাণী ও অরণ্য নিয়ে কাজ করছে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। তারা কোনো জায়গায় বন্যপ্রাণী ধরা পড়লে সেগুলো উদ্ধার করে বন বিভাগের সহায়তায় অরণ্যে ও নিরাপদ পরিবেশে মুক্ত করছে। তেমনি সাম্প্রতিক সময়ে কোনো কোনো জায়গায় হাতিসহ আহত বা অসুস্থ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর চিকিৎসা দিয়েছে বন বিভাগ এমন খবরও পড়েছি। আবার স্থানীয়রাও সচেতন হচ্ছেন। এই তো গত মঙ্গলবার মেহেরপুর উপজেলায় একটা মেছো বিড়াল আটকা পড়েছিল হাঁসের খামারে। সেটিকে খাঁচায় আটকে ফেলা হলেও মেরে ফেলা হয়নি, বন বিভাগের সহায়তায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

সাজাকের পাহাড়ি অরণ্য।বন দিবসে দেশের অরণ্য আর বন্যপ্রাণীদের জন্য শুভকামনা। আশা করি, আবার রুংরাংয়ে মহানন্দে বিশাল ডানা ছড়িয়ে উড়ে বেড়াবে ধনেশ, অরণ্যচারী পথ হারাবেন কির্সতংয়ের দিনেই রাত নামা বনে কিংবা সাঙ্গু-মাতামুহুরিতে নিরাপদে থাকবে শতবর্ষী গাছেরা।

সূত্র: বনের উপকারিতার কিছু তথ্য ট্রি হাগার ডট কম ও ব্লগ ডট টেনট্রি ডট কম থেকে নেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত