ঢাকার যানজট নিরসনে বিশেষজ্ঞদের ৬ তরিকা

সৌগত বসু, ঢাকা
প্রকাশ : ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৮: ০৭
আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ২০: ৩৪
Thumbnail image

যানজটের শহর ঢাকা। গত দুই মাসে রাজধানীর যানজট পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। চলমান পরিস্থিতিতে যানজট নিরসনে নতুন পরিকল্পনা নিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ জন্য বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুই বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এই বিশেষজ্ঞরা মূল সড়ক থেকে অবৈধ রিকশা সরানোসহ ছয়টি সুপারিশ করেছেন। সরকার এখন এসব সুপারিশের ভিত্তিতে পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে।

জানা যায়, গত ১৬ সেপ্টেম্বর বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন ও অধ্যাপক হাদিউজ্জামান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তাঁর সরকারি বাসভবনে দেখা করেন। সেখানে যানজট সমস্যা নিরসনে করণীয় নিয়ে ৪০ মিনিট আলোচনা করেন তাঁরা। এর আগে থেকেই প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়নবিষয়ক) লে. জেনারেল (অব.) আব্দুল হাফিজ দুবার বুয়েট ক্যাম্পাসে এই দুই অধ্যাপকের সঙ্গে দেখা করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে যানজট নিরসনে ছয় দফা সুপারিশ দিয়েছেন বুয়েটের দুই অধ্যাপক।

ঢাকার যানজট নিরসনে বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের দেওয়া সুপারিশ হচ্ছে—

  • মূল সড়ক থেকে অবৈধ রিকশা (ব্যাটারি ও প্যাডেলচালিত) সরাতে হবে।
  • ছোট যেসব ইন্টারসেকশন (মোড়) আছে, সেখানে সিগন্যালের সময় সর্বোচ্চ দুই মিনিট আর বড় ইন্টারসেকশনে সিগন্যাল সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিটের বেশি দেওয়া যাবে না।
  • ছোট ইন্টারসেকশনের ৫০ মিটার ও বড় ইন্টারসেকশনের ১০০ মিটারের মধ্যে কোনো গাড়ি পার্ক করা, যাত্রী ওঠানামা, থামানো যাবে না।
  • ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও দুই সিটি করপোরেশন থেকে নির্ধারিত বাস স্টপেজ ছাড়া যাত্রী ওঠানামা করা যাবে না এবং এসব স্টপেজে একটার পাশে আরেকটা বাস দাঁড়ানো যাবে না।
  • পুলিশের সাধারণ কার্যক্রম ৫ আগস্টের আগে যেমন ছিল, সেই অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
  • ঢাকা শহরে ট্রাফিক পুলিশের যে আটটি বিভাগ রয়েছে, এই বিভাগগুলোর প্রতিটিতে একটি করে মোবাইল টিম কাজ করবে। এই মোবাইল টিমে প্রশিক্ষিত একজন ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ার, একজন ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা, ডিটিসিএ ও সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা থাকবেন। তাঁদের কাজ হবে ঘুরে ঘুরে সমস্যা দেখা ও সেগুলো সমাধানে কাজ করা।

এবিষয়ে বুয়েটের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান আজকের পত্রিকাকে গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, গত দেড় মাসে ঢাকার আশপাশে থেকে ছয় থেকে সাত লাখ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ঢাকায় প্রবেশ করেছে। ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা পুরোপুরি অবৈধ। এগুলোর যে চার্জিং স্টেশন আছে, সেগুলোও সরাতে হবে। ঢাকার ট্রাফিক সিগন্যালে সাধারণত দেখা যায়, একটি সিগন্যাল প্রায় ১০ থেকে ১৫ মিনিট ছেড়ে দেওয়া হয়েছে; এটা অবৈজ্ঞানিক।

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নে টাকা খরচ হবে না। এটা তাৎক্ষণিক সমাধান। এগুলোতে প্রধান উপদেষ্টা খুশি হয়েছেন। তিনি পুলিশকে এসব বিষয় নিয়ে কাজ করতে বলেছেন। আগামী এক মাসের মধ্যে একটা করিডর নিয়ে কাজ শুরু হবে। এই করিডর হবে হাইকোর্ট থেকে শুরু করে মহাখালী হয়ে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত। পাইলট প্রকল্পে সিগন্যাল নিয়ে কাজ করা হবে কারওয়ান বাজার মোড়ে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বুয়েটের অধ্যাপকদের সুপারিশের ভিত্তিতে এক মাসের মধ্যে পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে। এই প্রকল্পের শুরুতে হাইকোর্ট মোড় থেকে কাকরাইল, কারওয়ান বাজার, মহাখালী, বিমানবন্দর হয়ে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত কাজ করা হবে। সোনারগাঁও হোটেলের মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যাল কার্যকর করা হবে। এই ট্রাফিক সিগন্যাল তৈরি করা হবে বুয়েট থেকেই। কারণ, প্রধান উপদেষ্টা ট্রাফিক সিগন্যাল দেশেই তৈরি করার কথা জানিয়েছেন। তিনি বুয়েটের দুই অধ্যাপককে বুয়েট থেকেই সিগন্যাল বানানোর কথা বলেন।

বুয়েট জানিয়েছে, তারা এটা তৈরি করতে পারবে। এ জন্য হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার তৈরির কাজ শুরু করেছে বুয়েট। এখানে খরচ কম হবে আর দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব সিগন্যাল তৈরির জন্য বুয়েট প্রতিটি সিগন্যাল বানানো, ইনস্টল করার জন্য সাড়ে ১০ লাখ টাকা ও মাসে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দেড় লাখ টাকা চেয়েছে।

এদিকে বিশেষজ্ঞদের দেওয়া সুপারিশ বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে গত ২৯ সেপ্টেম্বর বুয়েট, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি), ডিটিসিএ ও সিটি করপোরেশনের একটি দল প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এই দলে ১৮ জন সদস্য ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলমসহ সাতজন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী মিজানুর রহমানসহ দুজন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মো. মাইনুল হাসানসহ চারজন, ডিটিসিএর প্রধান নির্বাহী নীলিমা আক্তারসহ তিনজন সদস্য ছিলেন।

ডিএমপির ট্রাফিক সূত্রে জানা যায়, ১০ অক্টোবর থেকে কারওয়ান বাজারে বুয়েটের তৈরি সিগন্যাল নিয়ে কাজ শুরু হবে। এই সিগন্যাল এইআইভিত্তিক (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) নয়। এখানে চাইলে সময় নির্ধারণ করা যাবে, যেটি ট্রাফিক পুলিশ রিমোট ব্যবহার করেই করতে পারবে।

এ বিষয়ে ডিএমপি (ট্রাফিক) অতিরিক্ত কমিশনার খোন্দকার নজমুল হাসান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা ছয়টি সুপারিশ নিয়ে কাজ করছি। এর মধ্যে প্রথম চারটি সুপারিশ নিয়ে ইতিমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। বাকি দুটি সুপারিশ নিয়ে কাজ চলছে। ট্রাফিক সিগন্যাল নিয়ে পাইলট প্রকল্প চালু হলে কাজ শুরু হবে। আর মোবাইল টিম গঠন প্রক্রিয়াধীন।’

ডিটিসিএর বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পের পরিচালক ধ্রুব আলম আজকের পত্রিকাকে জানান, তাঁরাও চান, এই সুপারিশগুলো নিয়ে কাজ করতে। যদি ঠিকভাবে সমন্বয় করে কাজ হয়, তবে যানজট সমস্যার সমাধান হবে।

ট্রাফিক সিগন্যালে আগে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো দেশের বাইরে থেকে আনা। এগুলোর খরচ অনেক বেশি, আবার নষ্ট হলে সেগুলো ঠিক করতে অনেক অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এভাবে সিগন্যালগুলো অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। এখন বুয়েটে যেগুলো তৈরি করা হবে, তাতে খরচ অনেক কম পড়বে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এগুলোর আয়ুষ্কাল হয়তো বাইরের মতো হবে না। তবে নষ্ট হলে দ্রুত ঠিক করা যাবে।

বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পিক আওয়ারে ঢাকায় অটোমেটেড সিগন্যাল কাজ করবে না। যারা অতীতে এসব সিগন্যাল এনে কাজ করেছে, সেটা আসলে বিজ্ঞানের সঙ্গে যায় না। কারণ, গাড়ির সংখ্যা যখন বেশি হবে, তখন ম্যানুয়ালি কাজ করতে হবে। পৃথিবীর অনেক বড় শহরে পিক আওয়ারে হ্যান্ড সিগন্যাল ব্যবহার হয়। পাইলট প্রকল্পে সিগন্যাল দুভাবে কাজ করবে—একটি ম্যানুয়াল এবং আরেকটি অটোমেটেড।

ঢাকার গণপরিবহনের মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর হলো মেট্রোরেল। তবে এটি সুদূরপ্রসারী প্রকল্প। একটি মেট্রোরেল হয়েছে, আরও দুটি মেট্রোরেল ২০২৭ সালের মধ্যে হওয়ার কথা। বাকি সব জায়গায় বাস চলাচল করে। এ জন্য বাস রুটকে ঢেলে সাজানোর কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।

অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, সরকারকে একটি কোম্পানি গঠন করতে হবে। ঢাকা শহরে এই কোম্পানির বাইরে কোনো বাস চলতে পারবে না। এখন বেসরকারি যেসব বাস রয়েছে, তারা হয় এই কোম্পানির কাছে বাস দিয়ে অংশীজন হবে, নয়তো কোম্পানির কাছে বাস বিক্রি করে দেবে। প্রাথমিকভাবে এসব বাস উন্নত করা হবে। এই কোম্পানির আওতায় চলা সব বাসের মান হবে মেট্রোরেলের বগির মতো।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত