Ajker Patrika

ঐতিহ্যে ভরা, দেশের সেরা

রিমন রহমান, রাজশাহী
আপডেট : ০৭ জুলাই ২০২২, ০৯: ০৮
ঐতিহ্যে ভরা, দেশের সেরা

আলমারির ভেতরে পুরোনো সাদা-কালো একটা ছবি পাওয়া গেছে। ছবিতে ২০ জনের মতো নারী-পুরুষ। কাউকে চেনা যাচ্ছে না। প্রধান শিক্ষক তৌহিদ আরা ছবিটা নিয়ে বসে আছেন। কত দিন আগের ছবি হতে পারে, তা নিয়েই বসে বসে চিন্তা করছেন।

গত মঙ্গলবার সকালে রাজশাহীর সরকারি প্রমথনাথ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কক্ষে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা গেল। স্কুলমাঠে পুরোনো ভবনের সামনেই তোলা ছবিটা প্রধান শিক্ষক দেখালেন। বললেন, ‘ছবিটা আলমারির ভেতরেই ছিল। পুরোনো কাগজপত্র খুঁজতে গিয়ে হঠাৎ পাওয়া গেছে। ছবির মানুষগুলো কারা, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। ইনারা হয়তো এই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। মেয়েরা কী সুন্দর শাড়ি পরে আছে!’

ছবির মানুষগুলোকে এখন চেনা না-ই যেতে পারে। স্কুলটি যে প্রতিষ্ঠিত সেই ১৮৬৮ সালে। নাটোরের দিঘাপতিয়ার রাজা প্রমথনাথ রায়ের দানের ৬ হাজার রুপিতে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন স্কুলটির নামকরণ হয় ‘রাজা পিএন রায় বালিকা বিদ্যালয়’। প্রথমে প্রাথমিক এবং পরে নিম্নমাধ্যমিক হয় স্কুলটি। ১৯২৮ সালে হয় উচ্চমাধ্যমিক। তখন এর নাম হয় ‘পিএন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়’।

১৯৬০ সালে সরকারীকরণ হলে নামের আগে ‘সরকারি’ শব্দটিও যুক্ত হয়। কিন্তু যিনি অর্থ দিয়ে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করিয়েছিলেন, তাঁর নামটি এত দিন ব্যবহার হতো সংক্ষিপ্ত ‘পিএন’ হিসেবে। সরকারি নির্দেশনায় ১৫৪ বছর পর গত এপ্রিলে পিএনের পূর্ণাঙ্গ রূপ ব্যবহার শুরু হয়েছে। এখন স্কুলটির নাম ‘সরকারি প্রমথনাথ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, রাজশাহী।’

ঐতিহ্যে ভরা রাজশাহীর এই স্কুলটি এবার দেশসেরা স্কুল নির্বাচিত হয়েছে। জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ-২০২২-এর জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিদ্যালয়) নির্বাচিত হয় স্কুলটি। গত ২১ জুন ঢাকায় শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল প্রধান শিক্ষক তৌহিদ আরার হাতে এই সনদ তুলে দেন। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি অনুষ্ঠানে সংযুক্ত ছিলেন।

দেশসেরা হতে স্কুলটিকে থানা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়েও শ্রেষ্ঠ হতে হয়। জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা, শিক্ষকের অনুপাত, পাস করা ছাত্রীর সংখ্যা, শিক্ষকদের যোগ্যতার মানের গড়, ভৌত অবকাঠামোগত সুবিধা, প্রশাসনিক ও আর্থিক শৃঙ্খলা; শিক্ষার পরিবেশ, অ্যাসেম্বলি ও জাতীয় দিবস উদ্‌যাপন; গ্রন্থাগার, বিজ্ঞানাগার, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পঠন-পাঠনের নিয়মানুবর্তিতাসহ ১৪টি বিষয়ের ওপর মার্কিং করা হয়। সর্বক্ষেত্রে পূর্ণ নম্বর পেয়েই শ্রেষ্ঠ হয়েছে রাজশাহীর এই স্কুল।

জাতীয় পর্যায়ে শ্রেষ্ঠত্বের বিচার করতে প্রতিযোগী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ২০১৮ ও ২০১৯ সালের জেএসসি এবং ২০২০ ও ২০২১ সালের এসএসসির ফল চাওয়া হয়েছিল। সবখানেই প্রমথনাথ স্কুলের পাসের হার ছিল শতভাগ। এই বছর দেশের ৬২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন কারিকুলামে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠদান শুরু হয়েছে। এই পাইলটিং কারিকুলামেও রাজশাহী থেকে একমাত্র প্রমথনাথ স্কুলকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। এখন স্কুলটিতে তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১ হাজার ৭০১ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। শিক্ষক ৫০ জন। সকাল সোয়া ৭টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ‘প্রভাতী’ এবং দুপুর সোয়া ১২টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ‘দিবা’ শাখার ক্লাস চলে এখানে। কথাশিল্পী সেলিনা হোসেনের মতো নামীদামি অনেক নারী পড়াশোনা করেছেন এই স্কুলে।

স্কুলটির ভেতরে ঢুকলে মন জুড়াবে যে কারও। ১৮৬৮ সালে নির্মিত দোতলা একাডেমিক ভবনটি দৃষ্টি কাড়বে একটু আলাদাভাবেই। পরবর্তীকালে নির্মিত নতুন ভবনও দৃষ্টি এড়াবে না। চারপাশে ভবন, মাঝে মাঠটি যেন বাড়ির আঙিনা। মাঠের চারপাশে ফুলগাছ। শ্রেণিকক্ষের বারান্দাগুলোতেও টবে টবে ফুল আর পাতাবাহারের গাছ। টিফিনের অবসরে শিক্ষার্থীদের একটু বসার জন্য পার্কের মতো চমৎকার একটা জায়গাও করা হয়েছে ভেতরেই। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘ছায়াবীথি’। শহীদ মিনার, গ্রন্থাগার, বিজ্ঞানাগার, স্বাস্থ্যসম্মত ওয়াশরুম, বাইরে হাত ধোয়ার বেসিন, সুপেয় পানি এবং স্যানিটেশনেরও ব্যবস্থা আছে।

তৌহিদ আরা স্কুলটির প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ২০১৭ সালের শুরুতে। তিনি স্কুলটির ঐতিহ্য আরও ফুটিয়ে তুলতে কাজ শুরু করেন। এর স্বীকৃতিও মিলল। তৌহিদ আরা বলেন, তিনি স্কুল প্রাঙ্গণকে সাজিয়ে রাখা, সঠিক শিক্ষাদান এবং শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে কাজ করছেন। তিনি শিক্ষকদের নিয়ে বিভিন্ন মনিটরিং কমিটি করে এ কাজগুলো করছেন। এর সুফলও পাওয়া যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরাও প্রাণবন্তভাবে শিক্ষা পাচ্ছে।

তৌহিদ আরা বলেন, ‘এখন আমার ইচ্ছে, এখানে যেন একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিটা চালু হয়। তাহলে তৃতীয় শ্রেণিতে ঢুকে শিক্ষার্থীরা একেবারে উচ্চশিক্ষার জন্য বেরিয়ে যেতে পারবে।’

প্রধান শিক্ষক যখন কথা বলছিলেন তখন তাঁর কক্ষে আসেন রাজশাহী কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ঐশ্বরিয়া ফৌজদার। তিনি ২০২০ সালে এই স্কুল থেকেই এসএসসি পাস করেছেন। তিনি নাচে পারদর্শী। একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে অতীত অর্জন সম্পর্কে সনদ প্রয়োজন। সে জন্যই এসেছেন প্রধান শিক্ষকের কাছে। স্কুল সম্পর্কে জানতে চাইলে ঐশ্বরিয়া বললেন, ‘এই স্কুলের ভালো দিক বলে শেষ করা যাবে না।’

ঐশ্বরিয়া বের হতেই ঢুকলেন জাফরিন হাসান। প্রধান শিক্ষককে বললেন, ‘ম্যাম, আমি এবার বুয়েটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে চান্স পেয়েছি।’ চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে জাফরিনকে জড়িয়ে ধরলেন প্রধান শিক্ষক তৌহিদ আরা। দুজনেরই চোখ তখন ছলছল।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

ভারতের ভিসা নীতি দুই দেশের মানুষের মধ্যে সম্পর্কে প্রভাব ফেলছে: বলছেন কূটনীতিকেরা

বিকেলে সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে ছাত্রদল ও এনসিপি

ফাইনালে ভারতের ‘যম’কে খেলানো নিয়ে দোটানায় নিউজিল্যান্ড

ফেরত পাঠাতে ৫০০ বাংলাদেশিকে চিহ্নিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র

নিষিদ্ধ হিযবুত তাহ্‌রীরের মিছিল, পুলিশের টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেডে ছত্রভঙ্গ

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত