পাভেল পার্থ
আমাদের কি বরেন্দ্র অঞ্চলের অভিনাথ মার্ডী ও রবি মার্ডী নামে দুই গরিব সাঁওতাল কৃষকের কথা মনে আছে? সেচের পানি না পেয়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। মনে থাকার কোনো কারণ নেই। কারণ, গ্রামেগঞ্জে কৃষকের ঘরে বা হাটবাজারে বিষ থাকে। চাইলে কেউ বিষ খেয়ে মরতে পারে কিংবা বিষক্রিয়ায় গ্রামে, কৃষিজীবনে মানুষ বেশি আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু আমাদের কি ২০২৩ সালের জুন মাসে ঢাকা শহরের একটি ঘটনা মনে আছে? বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এক অভিজাত পরিবারের দুই শিশু বালাইনাশকের বিষক্রিয়ায় মারা গিয়েছিল? না, তারা আত্মহত্যা করেনি। না, তাদের হয়তো খুনও করা হয়নি। তারা কোনো কৃষক পরিবারের ছিল না, এমনকি তারা হয়তো তাদের ছাদবাগান থাকলে সেখানেও যায়নি সেদিন। তাদের বেঘোরে মৃত্যু ঘটেছিল বিষের কারণেই। কারণ তাদের বাসায় তেলাপোকা মারতে ভয়াবহ রাসায়নিক বিষ অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহৃত হয়েছিল। শায়ান মোবারত ও শাহির মোবারত নামে দুই উচ্ছল ভাইয়ের করুণ মৃত্যু ঘটে সেই ফসফাইডের বিষক্রিয়ায়। এ ঘটনার পর ‘ডিসিএস অর্গানাইজেশন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। হয়তো ঘটনাটি ঢাকার অভিজাত এলাকার ধনী পরিবারে ঘটেছে কিংবা কর্তৃপক্ষ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে চেয়েছে দ্রুত।
বালাইনাশকের বিষক্রিয়ায় দেশজুড়ে মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা, অণুজীব, পতঙ্গসহ বহু প্রাণের মৃত্যু ঘটছে প্রতিনিয়ত। এসব মৃত্যুর সব কিন্তু আত্মহত্যা নয়, রাসায়নিক কৃষিকাঠামোর ফলে হত্যাও আছে। তবে এই বালাইনাশকের কারণে খুন-জখমের বিচার, দণ্ড, শাস্তি হয়েছে এমন উদাহরণ বিরল। যা হোক, বসুন্ধরার দুই শিশুর মৃত্যু কেবল নয়, অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইডের বিষক্রিয়ায় মৃত্যু বিশ্বজুড়ে এক প্রশ্নহীন ‘সাধারণ’ ঘটনা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর রোমানিয়ার তিমিসোয়ারায়ও ঢাকার বসুন্ধরার মতোই ঘরের ভেতরে ফসফাইড ধোঁয়া ব্যবহারের ফলে দুই শিশুসহ তিনজনের মৃত্যু ঘটে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফ্রান্সের কাছাকাছি একটি কার্গো জাহাজে ফসফাইডের বিষক্রিয়ায় বহু মানুষ মারাত্মকভাবে আহত হয় এবং একজন মারা যায়। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ট্রেইলর পার্কে ইঁদুর মারার জন্য এই ট্যাবলেট ব্যবহৃত হলে পার্কে ঘুরতে আসা চারটি শিশুর নিদারুণ মৃত্যু ঘটে বিষক্রিয়ায়। থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক হোটেলে বিছানার ছারপোকা মারার জন্য এই ট্যাবলেট ব্যবহৃত হয় এবং অধিকাংশ সময় হোটেলের কক্ষ বন্ধ থাকে এবং এতে দেখা গেছে প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটে। উত্তর ভারতে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে এই বিষ ট্যাবলেট খুব বেশি ব্যবহৃত হয়। এমনকি ইরানে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে এই বিষ ব্যবহৃত হয়। ২০০৯ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ফসফাইড আছে এমন সব ধরনের বালাইনাশক নিষিদ্ধ করা হয়।
বাংলাদেশে এই ‘ইঁদুর মারার বিষ’, ‘গ্যাস ট্যাবলেট’, ‘তেলাপোকার যম’ নানা নামে শহরের অলিগলিতে এই বিষ বিক্রি হয়। ‘কুইকফস’, ‘সালফস’ কিংবা ‘সেলফস’ নামে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি হয় মুদিদোকান থেকে শুরু করে বালাইনাশক বিক্রয়কেন্দ্রে। এটি কতটা প্রাণসংহারী ও বিপজ্জনক এবং কীভাবে এর ব্যবহার করতে হয়, তা নিয়ে আমাদের জানা-বোঝা একেবারেই কম। তবে এই বিষ আমদানি, বিক্রি, মজুত বা ব্যবহারের অনুমোদন ও বৈধতা কিন্তু রাষ্ট্রই দিয়েছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, কৃষি বিভাগ, ভ্রাম্যমাণ আদালত, স্থানীয় সরকার, বাজার কমিটি যারা কোনো বাজারে দোকানে কী বিক্রি হয়, কেন হয় এসব দেখভাল করে, তারা দেশজুড়ে বালাইনাশক বিক্রি-ব্যবহারের ক্ষেত্রে চরম মাত্রায় উদাসীন। একই সঙ্গে দায়িত্বশীল নয় এবং এমনকি নিষিদ্ধ বালাইনাশক কেন বিক্রি ও ব্যবহৃত হচ্ছে, সে বিষয়েও কোনো দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অপারগ। আর কর্তৃপক্ষের এই রহস্যজনক নিশ্চুপতা, অবহেলা কিংবা নানামুখী বাণিজ্যস্বার্থের কারণে দেশজুড়ে মাটি, পানি, বাতাস থেকে শুরু করে মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে মারাত্মক প্রাণসংহারী বালাইনাশক বিষ। একই সঙ্গে শহর এলাকায় ‘পেস্ট কন্ট্রোলের’ নামে প্রাণঘাতী বালাইনাশকের ব্যবহার জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। তবে যে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড নিয়ে আমরা আলাপ শুরু করেছি, জানা যাচ্ছে, এই প্রাণঘাতী বিষ আমাদের খাবারে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে আমরা সবচেয়ে বেশি যে খাদ্য গ্রহণ করি ভাত, সেই চালে।
‘চালের পোকা মারার ট্যাবলেটে স্বাস্থ্যঝুঁকি’ শিরোনামে একটি সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দৈনিক আজকের পত্রিকা। প্রতিবেদনটি জানায়, চালের পোকা দমনে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইডের যথেচ্ছ ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে (সূত্র: ৩ /৪ / ২৪)। ডাল, সুজি, গম ও শাক-সবজিতেও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী গুদামে খাদ্যশস্য পোকামুক্ত রাখতে নিয়ম মেনে এটি ব্যবহৃত হলেও বাংলাদেশে গুদাম, পাইকারি ও খুচরা দোকান সর্বত্র এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি চালের বস্তায়ও ব্যবহৃত হচ্ছে এই বিষ। প্রতিবেদনমতে, গ্রামগঞ্জ থেকে শুরু করে শহরের মুদিদোকানেও বিক্রি হচ্ছে এই ভয়াবহ বিষ। ঢাকার মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, বাবুবাজার, বাদামতলী, কারওয়ান বাজারের চালের আড়তে এবং বনশ্রী, রামপুরাসহ বিভিন্ন এলাকার মুদিদোকানেও চালের বস্তার পোকা মারতে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহারের কথা গণমাধ্যমকে জানান ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা। কোনো চালের বস্তায় পোকা দেখা গেলে একটি ট্যাবলেট দিয়ে এক দিন ঢেকে রাখা হয়। এরপর পোকা মরে গেলে চাল বিক্রি করা হয়।
২০০০ সালের দিকে কুমিল্লার একটি খাদ্যগুদামে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করা হয়েছিল। বন্ধ গুদামঘরে কোনো ভেন্টিলেশন বা ফাঁকা জায়গা ছিল না। সারা দিনে ফসফাইড গ্যাস জমে গুদামঘর ভর্তি হয়েছিল। পরদিন সেই গুদামে যে শ্রমিকেরা কাজ করতে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছয়জন বিষক্রিয়ায় মারা যান এবং অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী গণমাধ্যমে জানান, চালের পোকা মারার জন্য ট্যাবলেট চালে লাগানো যাবে না, একটি শুকনো কাপড়ের ভেতরে রাখতে হবে এবং ২৪ ঘণ্টা পর চালের বস্তা থেকে বের করে সেই কাপড় কমপক্ষে এক ফুট মাটির তলায় পুঁতে ফেলতে হবে। গ্যাস ট্যাবলেট ব্যবহার করা হয়েছে এমন বস্তার চাল কমপক্ষে ১০ দিন পর খাওয়া দরকার। উচ্চ তাপেও ফসফাইড গ্যাস নিঃসরণ হয় না, কিন্তু পানি ও আর্দ্রতার স্পর্শে এলে এটি মানুষের ফুসফুসে ঢুকে যেতে পারে।
অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইডের বিষক্রিয়াজনিত মৃত্যুর ঘটনা খুব বেশি ঘটে। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইডের বিষক্রিয়ায় মুহূর্তেই রক্ত সঞ্চালনব্যবস্থা, হৃদ্যন্ত্র এবং পুরো শরীর বিকল হয়ে যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি এর সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে ক্যানসার, ফুসফুসের জটিল অসুখ এবং নানা প্রাণঘাতী শারীরিক অসুস্থতা তৈরি হতে পারে। মাত্র ০.১৫ গ্রাম থেকে ০.৫ গ্রাম ফসফাইড প্রায় ৮৫ ভাগ মৃত্যু ঘটাতে পারে। তাহলে এই বিপজ্জনক বিষ কেন এবং কীভাবে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের অগোচরে (কিংবা গোচরে) চালের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে? সরকারের খাদ্যমান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান, বাজার তদারককারী কর্তৃপক্ষ, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কিংবা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ তাহলে কী করছে? চালের বাজারে কেন এভাবে কোনো নিয়ন্ত্রণ ও পদ্ধতিগত ব্যবস্থাপনা ছাড়া এই বিষ ব্যবহৃত হচ্ছে? দ্রুত আমাদের এ ঘটনার তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা জরুরি।
চালসহ সব খাদ্যপণ্য গুদামজাতকরণ থেকে শুরু করে বালাই থেকে সুরক্ষায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইডের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা দরকার। কারণ প্রতিদিন আমাদের নগরে মানুষ বাড়ছে, ঘিঞ্জি এলাকা বাড়ছে, একই সঙ্গে জলবায়ুগত সংকটের কারণে আর্দ্রতা ও দাবদাহ সবই বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে চালসহ খাদ্যসামগ্রী আমরা কীভাবে নিরাপদে মজুত করতে পারি, সে বিষয়ে সামগ্রিকভাবে সবার মতামত ও প্রস্তাব নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। আমাদের বহু লোকায়ত পদ্ধতি আছে, বহু ভেষজ প্রাকৃতিক পন্থা আছে, পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর নানা শক্তিশালী অনুশীলনও এ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য সংবেদনশীল ও টেকসই হবে। এমনকি বাসাবাড়িতে তেলাপোকা, ছারপোকা, ইঁদুর মারার জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইডসহ সব প্রাণঘাতী রাসায়নিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে প্রাকৃতিক নিরাপদ পন্থাগুলো আমাদের অনুশীলন করা জরুরি।
এ ক্ষেত্রে গ্রামীণ কৃষক সমাজ থেকে শুরু করে অন্যান্য দেশের বহু প্রাকৃতিক চর্চার উদাহরণ, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নানা প্রাকৃতিক বালাইনাশক উদ্ভাবনসমূহ আমাদের একত্র করতে হবে। নিজেদের মধ্যে বিনিময় ও সহযোগিতা বাড়াতে হবে। আমাদের আশপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র ও প্রাণ-প্রকৃতির বিশৃঙ্খল দৈন্যদশাকে বুঝতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো আন্দাজ করতে হবে। কেন চালে বা বিছানায় পোকা হচ্ছে বা ইঁদুরের উপদ্রব কেন বাড়ে, এই বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের ফয়সালা প্রাকৃতিক পন্থার বিজ্ঞান অনুশীলনের মধ্য দিয়েই খুঁজতে হবে। সব কার্যকারণ চাপিয়ে, দাবিয়ে, লুকিয়ে রেখে কেবল কিছু বহুজাতিক কোম্পানির রাসায়নিক বিক্রির মুনাফাকে চাঙা রাখতে আমরা বারবার আত্মঘাতী হয়ে উঠব? ডিডিটি, ডাইক্লোফেনাক, কিটোপ্রোফেন কিংবা কার্বোফুরানের মতো রাসায়নিক বিষগুলোর বিশাল ব্যবসা ও বাজার ছিল বাংলাদেশে। এমনকি এসব বিষ ছাড়া আমাদের উৎপাদন ও জীবন থমকে যাবে এমন মিথ্যাচার করা হয়েছিল দীর্ঘ সময়। এসব প্রাণঘাতী বিষ বাংলাদেশ নিষিদ্ধ করতে পেরেছে। আমরা আশা করব, অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইডের মতো বিষ নিষিদ্ধ করে আমাদের খাদ্য, স্বাস্থ্য ও জীবনকে নিরাপদ করবে রাষ্ট্র।
লেখক: লেখক ও গবেষক
আমাদের কি বরেন্দ্র অঞ্চলের অভিনাথ মার্ডী ও রবি মার্ডী নামে দুই গরিব সাঁওতাল কৃষকের কথা মনে আছে? সেচের পানি না পেয়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। মনে থাকার কোনো কারণ নেই। কারণ, গ্রামেগঞ্জে কৃষকের ঘরে বা হাটবাজারে বিষ থাকে। চাইলে কেউ বিষ খেয়ে মরতে পারে কিংবা বিষক্রিয়ায় গ্রামে, কৃষিজীবনে মানুষ বেশি আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু আমাদের কি ২০২৩ সালের জুন মাসে ঢাকা শহরের একটি ঘটনা মনে আছে? বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এক অভিজাত পরিবারের দুই শিশু বালাইনাশকের বিষক্রিয়ায় মারা গিয়েছিল? না, তারা আত্মহত্যা করেনি। না, তাদের হয়তো খুনও করা হয়নি। তারা কোনো কৃষক পরিবারের ছিল না, এমনকি তারা হয়তো তাদের ছাদবাগান থাকলে সেখানেও যায়নি সেদিন। তাদের বেঘোরে মৃত্যু ঘটেছিল বিষের কারণেই। কারণ তাদের বাসায় তেলাপোকা মারতে ভয়াবহ রাসায়নিক বিষ অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহৃত হয়েছিল। শায়ান মোবারত ও শাহির মোবারত নামে দুই উচ্ছল ভাইয়ের করুণ মৃত্যু ঘটে সেই ফসফাইডের বিষক্রিয়ায়। এ ঘটনার পর ‘ডিসিএস অর্গানাইজেশন লিমিটেড’ নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস কোম্পানির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালককে (এমডি) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। হয়তো ঘটনাটি ঢাকার অভিজাত এলাকার ধনী পরিবারে ঘটেছে কিংবা কর্তৃপক্ষ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে চেয়েছে দ্রুত।
বালাইনাশকের বিষক্রিয়ায় দেশজুড়ে মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা, অণুজীব, পতঙ্গসহ বহু প্রাণের মৃত্যু ঘটছে প্রতিনিয়ত। এসব মৃত্যুর সব কিন্তু আত্মহত্যা নয়, রাসায়নিক কৃষিকাঠামোর ফলে হত্যাও আছে। তবে এই বালাইনাশকের কারণে খুন-জখমের বিচার, দণ্ড, শাস্তি হয়েছে এমন উদাহরণ বিরল। যা হোক, বসুন্ধরার দুই শিশুর মৃত্যু কেবল নয়, অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইডের বিষক্রিয়ায় মৃত্যু বিশ্বজুড়ে এক প্রশ্নহীন ‘সাধারণ’ ঘটনা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ২০১৯ সালের ১৬ নভেম্বর রোমানিয়ার তিমিসোয়ারায়ও ঢাকার বসুন্ধরার মতোই ঘরের ভেতরে ফসফাইড ধোঁয়া ব্যবহারের ফলে দুই শিশুসহ তিনজনের মৃত্যু ঘটে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফ্রান্সের কাছাকাছি একটি কার্গো জাহাজে ফসফাইডের বিষক্রিয়ায় বহু মানুষ মারাত্মকভাবে আহত হয় এবং একজন মারা যায়। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের ট্রেইলর পার্কে ইঁদুর মারার জন্য এই ট্যাবলেট ব্যবহৃত হলে পার্কে ঘুরতে আসা চারটি শিশুর নিদারুণ মৃত্যু ঘটে বিষক্রিয়ায়। থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক হোটেলে বিছানার ছারপোকা মারার জন্য এই ট্যাবলেট ব্যবহৃত হয় এবং অধিকাংশ সময় হোটেলের কক্ষ বন্ধ থাকে এবং এতে দেখা গেছে প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটে। উত্তর ভারতে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে এই বিষ ট্যাবলেট খুব বেশি ব্যবহৃত হয়। এমনকি ইরানে আত্মহত্যার ক্ষেত্রে এই বিষ ব্যবহৃত হয়। ২০০৯ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ফসফাইড আছে এমন সব ধরনের বালাইনাশক নিষিদ্ধ করা হয়।
বাংলাদেশে এই ‘ইঁদুর মারার বিষ’, ‘গ্যাস ট্যাবলেট’, ‘তেলাপোকার যম’ নানা নামে শহরের অলিগলিতে এই বিষ বিক্রি হয়। ‘কুইকফস’, ‘সালফস’ কিংবা ‘সেলফস’ নামে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি হয় মুদিদোকান থেকে শুরু করে বালাইনাশক বিক্রয়কেন্দ্রে। এটি কতটা প্রাণসংহারী ও বিপজ্জনক এবং কীভাবে এর ব্যবহার করতে হয়, তা নিয়ে আমাদের জানা-বোঝা একেবারেই কম। তবে এই বিষ আমদানি, বিক্রি, মজুত বা ব্যবহারের অনুমোদন ও বৈধতা কিন্তু রাষ্ট্রই দিয়েছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, কৃষি বিভাগ, ভ্রাম্যমাণ আদালত, স্থানীয় সরকার, বাজার কমিটি যারা কোনো বাজারে দোকানে কী বিক্রি হয়, কেন হয় এসব দেখভাল করে, তারা দেশজুড়ে বালাইনাশক বিক্রি-ব্যবহারের ক্ষেত্রে চরম মাত্রায় উদাসীন। একই সঙ্গে দায়িত্বশীল নয় এবং এমনকি নিষিদ্ধ বালাইনাশক কেন বিক্রি ও ব্যবহৃত হচ্ছে, সে বিষয়েও কোনো দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে অপারগ। আর কর্তৃপক্ষের এই রহস্যজনক নিশ্চুপতা, অবহেলা কিংবা নানামুখী বাণিজ্যস্বার্থের কারণে দেশজুড়ে মাটি, পানি, বাতাস থেকে শুরু করে মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে মারাত্মক প্রাণসংহারী বালাইনাশক বিষ। একই সঙ্গে শহর এলাকায় ‘পেস্ট কন্ট্রোলের’ নামে প্রাণঘাতী বালাইনাশকের ব্যবহার জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। তবে যে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড নিয়ে আমরা আলাপ শুরু করেছি, জানা যাচ্ছে, এই প্রাণঘাতী বিষ আমাদের খাবারে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে আমরা সবচেয়ে বেশি যে খাদ্য গ্রহণ করি ভাত, সেই চালে।
‘চালের পোকা মারার ট্যাবলেটে স্বাস্থ্যঝুঁকি’ শিরোনামে একটি সরেজমিন প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দৈনিক আজকের পত্রিকা। প্রতিবেদনটি জানায়, চালের পোকা দমনে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইডের যথেচ্ছ ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করছে (সূত্র: ৩ /৪ / ২৪)। ডাল, সুজি, গম ও শাক-সবজিতেও এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী গুদামে খাদ্যশস্য পোকামুক্ত রাখতে নিয়ম মেনে এটি ব্যবহৃত হলেও বাংলাদেশে গুদাম, পাইকারি ও খুচরা দোকান সর্বত্র এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি চালের বস্তায়ও ব্যবহৃত হচ্ছে এই বিষ। প্রতিবেদনমতে, গ্রামগঞ্জ থেকে শুরু করে শহরের মুদিদোকানেও বিক্রি হচ্ছে এই ভয়াবহ বিষ। ঢাকার মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, বাবুবাজার, বাদামতলী, কারওয়ান বাজারের চালের আড়তে এবং বনশ্রী, রামপুরাসহ বিভিন্ন এলাকার মুদিদোকানেও চালের বস্তার পোকা মারতে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহারের কথা গণমাধ্যমকে জানান ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা। কোনো চালের বস্তায় পোকা দেখা গেলে একটি ট্যাবলেট দিয়ে এক দিন ঢেকে রাখা হয়। এরপর পোকা মরে গেলে চাল বিক্রি করা হয়।
২০০০ সালের দিকে কুমিল্লার একটি খাদ্যগুদামে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ব্যবহার করা হয়েছিল। বন্ধ গুদামঘরে কোনো ভেন্টিলেশন বা ফাঁকা জায়গা ছিল না। সারা দিনে ফসফাইড গ্যাস জমে গুদামঘর ভর্তি হয়েছিল। পরদিন সেই গুদামে যে শ্রমিকেরা কাজ করতে গিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছয়জন বিষক্রিয়ায় মারা যান এবং অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী গণমাধ্যমে জানান, চালের পোকা মারার জন্য ট্যাবলেট চালে লাগানো যাবে না, একটি শুকনো কাপড়ের ভেতরে রাখতে হবে এবং ২৪ ঘণ্টা পর চালের বস্তা থেকে বের করে সেই কাপড় কমপক্ষে এক ফুট মাটির তলায় পুঁতে ফেলতে হবে। গ্যাস ট্যাবলেট ব্যবহার করা হয়েছে এমন বস্তার চাল কমপক্ষে ১০ দিন পর খাওয়া দরকার। উচ্চ তাপেও ফসফাইড গ্যাস নিঃসরণ হয় না, কিন্তু পানি ও আর্দ্রতার স্পর্শে এলে এটি মানুষের ফুসফুসে ঢুকে যেতে পারে।
অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইডের বিষক্রিয়াজনিত মৃত্যুর ঘটনা খুব বেশি ঘটে। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইডের বিষক্রিয়ায় মুহূর্তেই রক্ত সঞ্চালনব্যবস্থা, হৃদ্যন্ত্র এবং পুরো শরীর বিকল হয়ে যেতে পারে। দীর্ঘমেয়াদি এর সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে ক্যানসার, ফুসফুসের জটিল অসুখ এবং নানা প্রাণঘাতী শারীরিক অসুস্থতা তৈরি হতে পারে। মাত্র ০.১৫ গ্রাম থেকে ০.৫ গ্রাম ফসফাইড প্রায় ৮৫ ভাগ মৃত্যু ঘটাতে পারে। তাহলে এই বিপজ্জনক বিষ কেন এবং কীভাবে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের অগোচরে (কিংবা গোচরে) চালের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে? সরকারের খাদ্যমান নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান, বাজার তদারককারী কর্তৃপক্ষ, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কিংবা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ তাহলে কী করছে? চালের বাজারে কেন এভাবে কোনো নিয়ন্ত্রণ ও পদ্ধতিগত ব্যবস্থাপনা ছাড়া এই বিষ ব্যবহৃত হচ্ছে? দ্রুত আমাদের এ ঘটনার তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা জরুরি।
চালসহ সব খাদ্যপণ্য গুদামজাতকরণ থেকে শুরু করে বালাই থেকে সুরক্ষায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইডের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা দরকার। কারণ প্রতিদিন আমাদের নগরে মানুষ বাড়ছে, ঘিঞ্জি এলাকা বাড়ছে, একই সঙ্গে জলবায়ুগত সংকটের কারণে আর্দ্রতা ও দাবদাহ সবই বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে চালসহ খাদ্যসামগ্রী আমরা কীভাবে নিরাপদে মজুত করতে পারি, সে বিষয়ে সামগ্রিকভাবে সবার মতামত ও প্রস্তাব নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। আমাদের বহু লোকায়ত পদ্ধতি আছে, বহু ভেষজ প্রাকৃতিক পন্থা আছে, পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর নানা শক্তিশালী অনুশীলনও এ ক্ষেত্রে আমাদের জন্য সংবেদনশীল ও টেকসই হবে। এমনকি বাসাবাড়িতে তেলাপোকা, ছারপোকা, ইঁদুর মারার জন্য অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইডসহ সব প্রাণঘাতী রাসায়নিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে প্রাকৃতিক নিরাপদ পন্থাগুলো আমাদের অনুশীলন করা জরুরি।
এ ক্ষেত্রে গ্রামীণ কৃষক সমাজ থেকে শুরু করে অন্যান্য দেশের বহু প্রাকৃতিক চর্চার উদাহরণ, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নানা প্রাকৃতিক বালাইনাশক উদ্ভাবনসমূহ আমাদের একত্র করতে হবে। নিজেদের মধ্যে বিনিময় ও সহযোগিতা বাড়াতে হবে। আমাদের আশপাশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র ও প্রাণ-প্রকৃতির বিশৃঙ্খল দৈন্যদশাকে বুঝতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো আন্দাজ করতে হবে। কেন চালে বা বিছানায় পোকা হচ্ছে বা ইঁদুরের উপদ্রব কেন বাড়ে, এই বৈজ্ঞানিক প্রশ্নের ফয়সালা প্রাকৃতিক পন্থার বিজ্ঞান অনুশীলনের মধ্য দিয়েই খুঁজতে হবে। সব কার্যকারণ চাপিয়ে, দাবিয়ে, লুকিয়ে রেখে কেবল কিছু বহুজাতিক কোম্পানির রাসায়নিক বিক্রির মুনাফাকে চাঙা রাখতে আমরা বারবার আত্মঘাতী হয়ে উঠব? ডিডিটি, ডাইক্লোফেনাক, কিটোপ্রোফেন কিংবা কার্বোফুরানের মতো রাসায়নিক বিষগুলোর বিশাল ব্যবসা ও বাজার ছিল বাংলাদেশে। এমনকি এসব বিষ ছাড়া আমাদের উৎপাদন ও জীবন থমকে যাবে এমন মিথ্যাচার করা হয়েছিল দীর্ঘ সময়। এসব প্রাণঘাতী বিষ বাংলাদেশ নিষিদ্ধ করতে পেরেছে। আমরা আশা করব, অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইডের মতো বিষ নিষিদ্ধ করে আমাদের খাদ্য, স্বাস্থ্য ও জীবনকে নিরাপদ করবে রাষ্ট্র।
লেখক: লেখক ও গবেষক
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৪ দিন আগে