গয়নার গ্রাম ধরমপুর

গনেশ দাস, বগুড়া
প্রকাশ : ৩১ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮: ৩৫

বগুড়া শহরের ধরমপুরে ঢুকলেই টুংটাং শব্দ কানে বাজবে। দেখবেন, এখানে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই চলছে গয়না তৈরির কাজ। বাড়ির নারীরা কেউ ঘরের ভেতরে, আবার কেউ বারান্দা ও উঠোনে বসে তামা ও ব্রোঞ্জের গয়না গড়ছেন। কেউ লাগাচ্ছেন পুঁতি। গয়নাগুলো দেখতে ঠিক হাল ফ্যাশনের নয়, পুরোনো যুগের অলংকারের নকশায় গড়া। তাই এর নাম দেওয়া হয়েছে অ্যান্টিক গয়না। আর ধরমপুরকে বলা হয় অ্যান্টিক গয়নার গ্রাম।

ধরমপুর গয়নার গ্রাম হলো কীভাবে—সেই গল্প বেশি দিন আগের নয়। মাত্র ২৫ বছর আগে আবদুল হান্নান নামের এক স্বর্ণকার ধরমপুর গ্রামে গয়না তৈরির কাজ শুরু করেন। তাঁর হাতেই এই গ্রামের বাসিন্দাদের গয়নার কাজে হাতেখড়ি। পরে ধরমপুর তো বটেই, সেখান থেকে আশপাশের গ্রামগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে এই হস্তশিল্প। হান্নানের দেখানো পথে অ্যান্টিক গয়না তৈরির কারিগর বনে যান এই এলাকার কয়েক হাজার নারী-পুরুষ। এই কারিগরেরা জানান, এখন সেখানে গয়না তৈরির কাজের সঙ্গে জড়িত ৪০ হাজার নারী-পুরুষ।স্কুল-কলেজগামী ছাত্রছাত্রীরাও লেখা পড়ার ফাঁকে অ্যান্টিকের গয়না তৈরির কাজ করে নিজ বাড়িতে।

গয়নার গ্রাম ধরমপুর নিয়ে কথা হয় বগুড়া স্বর্ণশিল্পী শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি জাকির হোসেন মিঠুর সঙ্গে। তাঁর মুখে শোনা যায় পুরো ইতিহাস। মিঠুর ভাষ্য, বগুড়া শহরের আটাপাড়ায় স্বর্ণশ্রমিকের কাজ করতেন আবদুল হান্নান। একসময় তাঁর মাথায় ঢোকে স্বর্ণ নয়, বিকল্প কোনো ধাতু দিয়ে গয়না গড়বেন। যেই কথা সেই কাজ। ১৯৯৭ সালে প্রথমে শহরের গালাপট্টি মন্ডল মার্কেটে তামা ও ব্রোঞ্চ দিয়ে স্বর্ণের বিকল্প গয়না তৈরির কাজ শুরু করেন তিনি। অল্প দিনেই এই গয়নার চাহিদা বাড়লে ধরমপুর গ্রামে গড়ে তোলেন কারখানা। আর সেখান থেকেই ধরমপুর গ্রামের নাম হয়ে যায় গয়নার গ্রাম। একজনের দেখাদেখি আরেকজন কাজ শিখে গয়না তৈরি শুরু করেন এখানকার মানুষ। বর্তমানে ধরমপুর ছাড়াও বারপুর, আটপাড়া, বৃন্দাবনপাড়া, ঝোপগাড়ি, নিশিন্দারা, জয়পুরপাড়া, মগলিশপুর, মাটিডালি, ফুলবাড়ির পাড়া-মহল্লার প্রতিটি বাড়িই যেন এক একটা গয়না তৈরির কারখানা।

ডিজাইনের চুড়ি, মালা, আংটি, টিকলি, সীতাহার, মনিপুরি চেইন, গলার কণ্ঠী, বিছাসহ সব ধরনের গয়নাই তৈরি করছেন বগুড়ার কারিগরেরা। তবে স্বর্ণের বিকল্প ধাতু তামা, ব্রোঞ্জ ও পিতল দিয়ে তৈরি এসব অলংকারে সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য বসানো হয় বিভিন্ন ডিজাইনের পুঁতি-পাথর।

সোনার রং ও নিখুঁত কারুকার্যে তৈরি এসব গয়না এক থেকে দেড় বছর ব্যবহার করা যায়। রং নষ্ট হয়ে গেলে অর্ধেক দামে বিক্রি অথবা নতুন করে রং করে নেওয়া যায়। এক ভরি স্বর্ণের গয়না তৈরিতে যেখানে ৮০ হাজার টাকা খরচ হয়, সেখানে একই ডিজাইনের বগুড়ায় তৈরি অ্যান্টিকের গয়না পাওয়া যায় মাত্র ৮০০ টাকায়। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বগুড়ায় তৈরি এসব অ্যান্টিক গয়নার ব্যবহারও বাড়ছে।

শহরের ব্যবসায়ীরা এসব গয়না ঢাকা, সিলেট, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করে থাকেন। এভাবেই অ্যান্টিকের তৈরি গয়নার চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দিন দিন নতুন নতুন কারিগর যুক্ত হচ্ছেন এই পেশায়। যাঁদের অধিকাংশই নারী।

আজমল নামের এক ব্যবসায়ী জানান, প্রতি মাসে তিনি নিজেই ৫ লক্ষাধিক টাকার খুচরা গয়না বিক্রি করে থাকেন। আর সব মিলে বগুড়া থেকেই প্রতি মাসে ৫-৭ কোটি টাকার গয়না পাইকারি বিক্রি হয় দেশের বিভিন্ন জেলায়।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত