Ajker Patrika

ফার্মগেটের মাঠটিতে আর খেলা হবে না, থাকছে না সবুজ ঘাস

সাইফুল মাসুম, ঢাকা
আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২৪, ১২: ১৮
ফার্মগেটের মাঠটিতে আর খেলা হবে না, থাকছে না সবুজ ঘাস

ফার্মগেটের আনোয়ারা উদ্যান। কয়েক বছর আগেও এই মাঠে খেলাধুলায় মেতে থাকত শিশু-কিশোররা, বড়রা বসে দিত আড্ডা। অনেকেই আবার শরীরচর্চা করতে আসত সেখানে। সবুজ সেই মাঠটি এখন আর সবুজ নেই। নেই উন্মুক্ত। মেট্রোরেল প্রকল্পের প্রয়োজনে সাময়িক ব্যবহারের জন্য নেওয়া আনোয়ারা উদ্যানে এবার স্থায়ী স্টেশন প্লাজা স্থাপন করতে চায় ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। এটি করা হলে রাজধানীর বুক থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে আরেকটি উন্মুক্ত মাঠ।

ফার্মগেটের এই উদ্যানটি গণপূর্ত অধিদপ্তরের। ২০১৬ সালে সেটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনকে (ডিএনসিসি) হস্তান্তর করে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। শর্ত ছিল, সেখানে কোনো স্থায়ী স্থাপনা বা অবকাঠামো নির্মাণ করা যাবে না। রাখা যাবে না গাড়ি। আর হস্তান্তরের তারিখ থেকে তিন বছর পর চুক্তি নবায়ন করতে হবে। কিন্তু মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ শুরু হলে ডিএনসিসিকে দেওয়া সেই শর্ত ধরে রাখতে পারেনি গণপূর্ত।

গত সোমবার সরেজমিনে দেখা যায়, আনোয়ারা উদ্যান পার্কে মেট্রোরেল প্রকল্পের বিভিন্ন সরঞ্জাম ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ইটের তৈরি একটি তিনতলা ভবনসহ অন্তত পাঁচটি স্থাপনা রয়েছে সেখানে। একাধিক কনটেইনার, পিকআপ ভ্যান, মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কারও পার্ক করা আছে। পার্কের পশ্চিম পাশে আনোয়ারা উদ্যান মসজিদ ও তার সঙ্গে রয়েছে পাবলিক টয়লেট। এখন সেখানে স্থায়ী স্থাপনা স্টেশন প্লাজা করতে চায় ডিএমটিসিএল।

স্টেশন প্লাজার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমটিসিএলের পরিচালক মো. আব্দুল বাকী মিয়া বলেন, ‘বিষয়টি এখনো পরিকল্পনার পর্যায়ে আছে। ধাপে ধাপে করব। এখানে স্টেশন প্লাজা হবে। আর গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রাখা হবে।’

এদিকে আনোয়ারা উদ্যানে স্টেশন প্লাজা নির্মাণের ব্যাপারে জোর আপত্তি জানিয়েছে ডিএনসিসি। স্টেশন প্লাজা তৈরির উদ্যোগ খুবই দুঃখজনক মন্তব্য করে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘ফার্মগেটের মতো এ রকম বাণিজ্যিক এলাকায় একটা খোলা উদ্যান থাকবে না, এটা তো মেনে নেওয়া কষ্টকর।’

সম্প্রতি পার্কটির পূর্ব অংশে ও দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে ‘শহীদ আনোয়ারা উদ্যান পার্ক’ লেখা দুটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছে ডিএনসিসি। জানতে চাইলে ডিএনসিসির অঞ্চল-৫-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মোতাকাব্বীর আহমেদ আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আনোয়ারা উদ্যান মেট্রোরেলকে কিছু সময়ের জন্য ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। অস্থায়ী অফিস ও সরঞ্জাম রাখার জন্য এটা নিয়েছিল তারা। এটা আমরা করতে দেব না। এটাকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে এনে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।’

সিটি করপোরেশন পার্কটিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে চাইলেও আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, সম্প্রতি গণপূর্ত অধিদপ্তর মেট্রোরেলের স্টেশন প্লাজা তৈরির জন্য ডিএমটিসিএলকে অনুমতি দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ডিএনসিসি চুক্তি নবায়ন চেয়ে চিঠি দিলেও কোনো সাড়া দেয়নি গণপূর্ত।

এ বিষয়ে জানতে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতারকে একাধিকবার কল ও মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়ে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে শেরে বাংলা নগর গণপূর্ত বিভাগ-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য আলাদা করে আনোয়ারা উদ্যানের জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দুটো প্রতিষ্ঠানই স্থায়ী অবকাঠামো তৈরি করবে। রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এখনো গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনে আনোয়ারা উদ্যানের কিছু জায়গা অবশিষ্ট রয়েছে। 

বিশেষজ্ঞ ও স্থানীয়দের বিরক্তি-উদ্বেগ 

আনোয়ারা উদ্যানে সোনালি শৈশব-কৈশোর পার করেছেন ফার্মগেটসংলগ্ন পশ্চিম রাজাবাজার এলাকার বাসিন্দা ফরিদুর রহমান খান ইরান। যৌবনে তিনি এখন ডিএনসিসি ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। ইরান বলেন, ‘ছোটবেলায় এই উদ্যানে কত ক্রিকেট খেলেছি। সবুজ ঘাসে বসে বন্ধুদের সঙ্গে কত আড্ডা দিয়েছি। এখন সেই আনোয়ারা উদ্যান দেখে নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে।’

কোনো কারিগরি সমীক্ষা ছাড়াই ঢাকা শহরের একটি উদ্যানকে স্টেশন প্লাজার জন্য দিয়ে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, ‘ঢাকায় প্লাজার কোনো সংকট নেই, সংকট হচ্ছে পার্ক, উদ্যান আর উন্মুক্ত জায়গার। স্টেশন প্লাজা থেকে মেট্রোরেল যে আয় করবে, উন্মুক্ত জায়গা হিসেবে আনোয়ারা উদ্যান স্থানীয় মানুষের জন্য পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত ভ্যালু তার কয়েকগুণ বেশি।

আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘উন্মুক্ত জায়গা দখলের প্রক্রিয়া এভাবে চলতে থাকলে শহরে মেট্রো থাকবে, উন্নয়ন থাকবে, কিন্তু মানুষ থাকবে না। কংক্রিটের দূষণে বিকলাঙ্গ মানুষ তৈরি হবে।’

আনোয়ারা উদ্যানকে আগের রূপে ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ আনোয়ারা উদ্যানকে কমার্শিয়াল ব্যবহার করার জন্য এখন স্টেশন প্লাজা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। কোনো মাঠ বা পার্ক প্রকল্পের জন্য নেওয়া হলে তা আগের রূপে ফিরিয়ে আনা অনেক কঠিন। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে এটাকে কীভাবে গণপরিসর হিসেবে ফিরিয়ে আনা যায়, সেই পদক্ষেপ নিতে হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত