দুর্বিনীত শিক্ষার্থী, অসহায় শিক্ষক

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ৩০ জুন ২০২২, ০৬: ৩২
আপডেট : ৩০ জুন ২০২২, ১৯: ২৮

নীরবে বেশ বড়সড় বদল ঘটে চলেছে পরিবারে, সমাজে। কোমলমতি বলে সমাজে চিরকাল প্রশ্রয় পাওয়া শিক্ষার্থীদের একটি অংশ হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। শিক্ষকের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলাই যেখানে বেয়াদবি বলে বিবেচিত হতো এই সমাজে, সেখানে হরহামেশা অনেক শিক্ষক হচ্ছেন লাঞ্ছিত নিজেরই ছাত্রছাত্রীদের দ্বারা। ছাত্রের অসত্য অভিযোগে মুন্সিগঞ্জের স্কুলশিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করে জেলে নেওয়ার ঘটনা ঘটল এই সেদিন। এটাই প্রথম ঘটনা ছিল না শিক্ষক হেনস্তার। শেষ ঘটনাও নয়। ঘটনা ঘটেই চলেছে, বিদ্যালয় থেকে শুরু করে মহাবিদ্যালয়, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও।

ঘটনা আজকাল আর বেয়াদবি কিংবা হেনস্তায় সীমিত থাকছে না। এমনকি ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে নিজ ছাত্রের বেপরোয়া হামলায় গুরুতর আহত হন ঢাকার আশুলিয়ার শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার। হয়তো জেলে গিয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন হৃদয় মণ্ডল। ছাড়া পেয়ে ক্ষমা করে দিতে পেরেছেন নিজের ছাত্রদের। কিন্তু সে সুযোগ মেলেনি উৎপল সরকারের। চিকিৎসাধীন অবস্থায় হাসপাতালে মারা যান তিনি।

শিক্ষক উৎপলের হত্যাকারী গ্রেপ্তার
উৎপল সরকার হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতুকে গতকাল বুধবার গাজীপুরের শ্রীপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁর বাবা মোহাম্মদ উজ্জ্বলকেও গ্রেপ্তার করা হয় গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে, কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে। অভিযোগ উঠেছে, তিনি তাঁর ছেলেকে প্রশ্রয় দিয়েছেন, সহায়তা করেছেন পালাতে। মামলার বিবরণে জানা গেছে, গত শনিবার ছাত্রীদের ইভ টিজিংয়ের অভিযোগে জিতুকে সতর্ক করায় ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে শিক্ষক উৎপল সরকারকে গুরুতরভাবে আহত করেন জিতু। গত সোমবার ভোরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই শিক্ষক মারা যান।

নড়াইলের ঘটনায় দুঃখিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
এদিকে নড়াইলে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় শিউরে উঠেছে মানুষ। একটি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে পুলিশের উপস্থিতিতে জুতার মালা পরিয়ে দিয়েছে তাঁরই প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা। জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার এ সময় সামনে না থাকলেও ক্যাম্পাসেই উপস্থিত ছিলেন।

নড়াইলে শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানোর ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেন, ‘নড়াইলের ঘটনায় আমরা সত্যিই দুঃখিত। উত্তেজিত জনতা শিক্ষককে জুতার মালা পরিয়ে দিয়েছে। আমাদের ডিসি ও এসপি তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিয়েছিল।’

রাজশাহীতে প্রবীণ অধ্যাপক আক্রান্ত
এত আলোচনা-সমালোচনার পরেও শিক্ষক লাঞ্ছনা থেমে নেই। এবারের ঘটনা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। গতকাল শ্রেণিকক্ষের দরজায় আইন বিভাগের প্রবীণ অধ্যাপক বেগম আসমা সিদ্দীকার গতিরোধ করেন একই বিভাগের ছাত্র আশিক উল্লাহ। তিনি অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন এবং হত্যার হুমকি দেন বলেও অভিযোগ আছে। আশিক বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী। আশিককে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

গতকাল চতুর্থ বর্ষের ক্লাস চলাকালে ইমপ্রুভমেন্টের কথা বলে ক্লাসে ঢোকেন আশিক। তবে তাঁর কোনো ইমপ্রুভমেন্ট ছিল না। ক্লাসের শেষের দিকে তিনি ওই অধ্যাপককে বিব্রত করার জন্য অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন করতে থাকেন। একপর্যায়ে তিনি ক্লাস থেকে বের হতে গেলে আশিক উল্লাহ দরজা লাগিয়ে তাঁকে মারতে উদ্যত হন। অন্য শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে সরিয়ে নেন। তাঁরা অভিযুক্তকে আটক করে বিভাগের সভাপতির কক্ষে দুই ঘণ্টা আটকে রাখেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। তাঁকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

এ ঘটনায় ভুক্তভোগী অধ্যাপক বলেন, তিনি চতুর্থ বর্ষের ক্লাস শেষ করে বের হতে গেলে ওই ছাত্র পথরোধ করেন। বিভাগের অভ্যন্তরীণ একটি বিষয়ে সে সমাধান চাইলে তিনি তাঁকে চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। কিন্তু সে তা না শুনেই অসৌজন্যমূলক আচরণ করে। আশিকের বিরুদ্ধে নিয়মিত শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করা এবং শ্রেণিকক্ষে মেয়েদের উদ্দেশে অশালীন মন্তব্য করার অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ দেখায়।

এ বিষয়ে বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক হাসিবুল আলম প্রধান বলেন, অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে বিভাগের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অভিযোগের তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সমাধান প্রথমে আসতে হবে পরিবার থেকে
কেন ঘটে চলেছে এসব ঘটনা? কেন বেপরোয়া হয়ে উঠছে শিক্ষার্থীরা। এ বিষয়ে বিশিষ্ট মনোবিজ্ঞানী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মাহফুজা বেগমের পর্যবেক্ষণ হলো, ‘পরিবার আর সমাজে বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে। মূল্যবোধের মারাত্মক অবক্ষয়ে ছাত্ররা বেপরোয়া হয়ে উঠছে।’ এ ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকাই প্রধান উল্লেখ করে তিনি বলেন, পরিবারে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। বাচ্চারা সঠিক শিক্ষা পায় না। অনেক বাবা-মা বাচ্চাদের রোল মডেল হতে পারছেন না। এ ছাড়া যন্ত্রনির্ভরতায় মানুষের আবেগ-অনুভূতি কমে গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পাড়া-মহল্লায় আগে সবাই আত্মীয়ের মতো বড় হয়েছে মানুষ। সমাজে সবাই সবাইকে চিনত। এখন পাশের ফ্ল্যাটের মানুষকেই চেনে না।

এ পরিবর্তনের পেছনে শিক্ষকদেরও কিছু দায় আছে জানিয়ে এই অধ্যাপক বলেন, ঠিকমতো পাঠদান না করাসহ নানা কারণে অনেকে শিক্ষক হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি ধরে রাখতে পারেননি। এর ওপর আছে বাইরের সংস্কৃতির প্রভাব। কিন্তু এসব ঘটনা প্রায় সবাই উপেক্ষা করেই চলেছে। তাঁর মতে, গভীর এই সমস্যার সমাধান প্রথমে আসতে হবে পরিবার থেকে। শত ব্যস্ততায় বাচ্চাকে সময় দিতে হবে। ওদের আবেগ-অনুভূতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। অন্য মানুষকে সম্মান করার মূল্য ওদের বোঝাতে হবে। বাচ্চাদের মূল্যবোধের শিকড় নড়বড়ে রেখে সমাজ এগোবে না।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের বিবৃতি
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক গতকাল এক বিবৃতিতে সাভারে উৎপল সরকারের হত্যাকাণ্ডের বিচার দ্রুততম সময়ে করা এবং তাঁর পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। এ ছাড়া নড়াইলে অধ্যক্ষ স্বপন কুমারকে স্বপদে ফিরিয়ে আনাসহ তিন দফা দাবি জানিয়েছে এ সংগঠন। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮১ জন শিক্ষক তাঁদের বিবৃতিতে বলেছেন, সংখ্যাগুরুর দাপটে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে না। দেশের সংবিধান-আইনকানুনে যা-ই লেখা থাক, প্রশাসন ও রাজনীতিবিদেরা সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষেই কাজ করে চলেছেন।

উল্লেখ্য, শিক্ষকদের ওপর হামলার পরপর ঘটে যাওয়া ঘটনায় ভুক্তভোগীদের বড় একটি অংশ ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের। এ তালিকায় আরও আছেন ঢাকার তেজগাঁও কলেজশিক্ষক ড. লতা সমাদ্দার, বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের রুমা সরকার, নারায়ণগঞ্জ স্কুলশিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঞ্জয় সরকার ও উমেশ রায়, গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার স্কুলশিক্ষক মিলটন তালুকদার এবং নওগাঁ স্কুলশিক্ষক আমোদিনী পাল।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত