দুই মন্ত্রণালয়ের মতবিরোধে রুগ্‌ণ রেলওয়ে হাসপাতাল

আজাদুল আদনান, ঢাকা
প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮: ২৪

দেশের অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে যেখানে চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র রাজধানীর কমলাপুরে রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালে। রোগীদের আনাগোনা নেই। গল্প-আড্ডায় সময় পার করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। যে যন্ত্রপাতি আছে, সেগুলোও নষ্টের পথে। নেই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ও হাই ডিপেডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ)। এমনকি প্রসব করানোর ব্যবস্থাও নেই।

রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে উন্নত চিকিৎসা দেওয়ার লক্ষ্যে ২০১৫ সালে ‘রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতাল’ নামে রূপান্তর হয় বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল। ওই সময় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একটি সমঝোতা চুক্তি হয় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের। তবে দুই মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতায় গত সাত বছরেও সেই সমঝোতার সুফল মেলেনি। উল্টো দুই মন্ত্রণালয়ের বিরোধে হাসপাতালটিই এখন রুগ্‌ণ অবস্থায়। চুক্তির শুরু থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চিকিৎসাসেবাসহ সব ধরনের দায়িত্ব নিতে চাইলেও তাতে রাজি হয়নি রেল মন্ত্রণালয়।

এমতাবস্থায় বিকল্প উপায় হিসেবে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব (পিপিপি) প্রকল্পে চলে যাচ্ছে হাসপাতালটি। ইতিমধ্যে দরপত্রও আহ্বান করা হয়েছে। সম্প্রতি এমনটাই জানিয়েছে রেলওয়ে অধিদপ্তর।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ৮০ শয্যার হাসপাতালটিতে সপ্তাহে দু-একজন রোগী ভর্তি থাকলেও নেই কোনো সুযোগ-সুবিধা। শয্যাগুলো ধুলায় ভরা। জীর্ণ অবস্থা টেবিলসহ অন্যান্য আসবাবপত্রের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বছরখানেক আগেও হাসপাতালটিতে রক্ত, মূত্রসহ প্রাথমিক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলেও রিএজেন্টের (পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপকরণ) সংকটে এক বছরের বেশি সময় ধরে তা হচ্ছে না। ৯ জন চিকিৎসক থাকলেও নেই অ্যানেসথেটিস্ট, মেডিসিন, সার্জারি, নাক, কান, গলা ও নিউরোলজি চিকিৎসার ব্যবস্থা। 

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. জহিরুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, সংকট নিরসনে তেমন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। সমঝোতা চুক্তি হলেও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে একটা জটিলতা রয়েছে। দুই মন্ত্রণালয়ের মাঝে আটকে পড়েছে এখানকার স্বাস্থ্যসেবা।

হাসপাতালের বহির্বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, মাঝেমধ্যে দু-একজন রোগী আসছে। দিনে সর্বোচ্চ ৫০ রোগী চিকিৎসা নেয় বহির্বিভাগে। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ সাধারণ নাগরিক।

পঞ্চাশোর্ধ্ব রেলওয়ের কর্মী ইদ্রিস আলী দীর্ঘদিন ধরে চোখে অস্পষ্ট দেখছেন। গত মঙ্গলবার তিনি চিকিৎসা নিতে আসেন হাসপাতালটিতে। এসে দেখেন, নেই কোনো চক্ষুবিশেষজ্ঞ। ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্বে থাকা আশরাফুল ইসলাম মামুন গতকাল বুধবার আসেন হাসপাতালটিতে। চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘নামের হাসপাতাল, কামের না।’

প্যাথলজি বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, পরীক্ষা-নিরীক্ষার যন্ত্র সাদা কাপড়ে ঢাকা। জানা যায়, দুই বছর আগে যুক্তরাষ্ট্র সরকার উপহার হিসেবে বায়োকেমিস্ট্রির সিলেক্ট্রা, রক্তের প্লাটিলেটসহ বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য হেমাটোলজি অ্যানালাইজার দেয়। কিন্তু এক বছর না যেতেই রিএজেন্টের সংকটে নষ্টের পথে যন্ত্র দুটি। হাসপাতালের একমাত্র এক্স-রে মেশিনের বয়স ৪০ বছর, যা এখন অনেকটাই অচল। চালু রয়েছে কেবল আলট্রাসনোগ্রাম।

মিলছে না প্রয়োজনীয় ওষুধও। এমনিতেই রোগীর সংখ্যা কম, তারপরও যে কজন আসছে, তারাও প্রয়োজনীয় ওষুধ পাচ্ছে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. শেখ দাউদ আদনান বলেন, ‘চুক্তি হলেও সেটিতে স্থায়ী কোনো সমাধানের পথ ছিল না। স্বাস্থ্য বিভাগকে দিলে সে অনুযায়ী চলত। কিন্তু যেহেতু রেলপথ মন্ত্রণালয় দেয়নি, সে ক্ষেত্রে আমাদের কী করার আছে?’

বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার বলেন, সংকট নিরসনে পিপিপি প্রকল্পের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেখানে ৫০০ শয্যা থাকবে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যে সমঝোতা চুক্তি হয়েছিল, সেটি বাতিল হবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় সিদ্ধান্ত নেবে বলে জানান রেলওয়ের মহাপরিচালক।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত