ডেডলাইন ২৮ অক্টোবর: মুখোমুখি অবস্থানে এগোচ্ছে সব পক্ষ

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০২৩, ০৮: ৪৭
আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০২৩, ০৮: ৫৩

২৮ অক্টোবর রাজধানীর নয়াপল্টনে পূর্বঘোষিত মহাসমাবেশ সফল করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। ক্ষমতাসীনদের হুঁশিয়ারি, মামলা-হামলা-ধরপাকড়সহ সব ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে মহাসমাবেশ সফল করার কথা বলছেন দলটির নেতারা। একই দিনে জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে আওয়ামী লীগ জনসভা ও মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামীও। এ অবস্থায় ২৮ অক্টোবর ঘিরে সজাগ রয়েছে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে এদিন রাজধানীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেন স্বাভাবিক থাকে, জনজীবন যাতে ব্যাহত না হয়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বলেছি। জেলা প্রশাসকদেরও এ বিষয়ে বলা হয়েছে।’

১৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির জনসমাবেশ থেকে ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ওই সমাবেশ থেকে সরকার পতন আন্দোলনের ‘মহাযাত্রা’ শুরু হবে বলে জানান তিনি। 

বিএনপির প্রস্তুতি 
বিএনপির নেতারা জানান, ২৮ অক্টোবর ঢাকায় স্মরণকালের জনসমাগম ঘটিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে চান তাঁরা। এ জন্য মহানগরের সমন্বয় কমিটিগুলো জেলার সঙ্গে সমন্বয় করছে। প্রতিটি জেলা থেকে অধিকসংখ্যক নেতা-কর্মী ঢাকায় আনার কথা বলা হয়েছে দায়িত্বশীল নেতাদের। নেতা-কর্মীদের ঢাকায় আনা পর্যন্ত মামলা-হামলা ও ধরপাকড় এড়ানোর জন্য ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে নেতা-কর্মীদের আগেভাগে ঢাকায় আনার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে শেষ সময়ে অঘোষিত পরিবহন ধর্মঘট ঘোষণা হতে পারে, সে বিষয়টিও ভাবনায় রেখেছেন বিএনপির হাইকমান্ড। সে রকম হলে পরিবহন সেক্টরের সঙ্গে জড়িত আছেন, দলের এমন নেতাদের বিকল্প পরিবহনের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে।

জেলা পর্যায়ের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, ২৮ অক্টোবর নিয়ে প্রস্তুতিমূলক সভা করা হচ্ছে। নেতা-কর্মীদের ঢাকায় নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। পরিবহন বিড়ম্বনা এড়াতে যতটা সম্ভব আগেভাগেই নেতা-কর্মীদের নিজ উদ্যোগে ঢাকায় যেতে বলা হচ্ছে। এরই মধ্যে অনেকেই ঢাকা গেছেন। গ্রেপ্তার এড়াতে ব্যক্তিগত গাড়ি, ভাড়া করা পরিবহনে না গিয়ে গণপরিবহনে যেতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ঢাকায় গিয়ে আবাসিক হোটেলে না উঠে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে থাকতে বলা হয়েছে।

মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে বিএনপি আগ বাড়িয়ে কোনো সংঘাতে জড়াতে চায় না বলে জানিয়েছেন দলটির নেতারা। তাঁরা বলছেন, শান্তিপূর্ণভাবে মহাসমাবেশ করতে চান। এই বার্তা দলের সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তবে বাধা এলে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে।

মহাসমাবেশ-পরবর্তী কর্মসূচির বিষয়ে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি জানিয়ে বিএনপির নেতারা বলছেন, সচিবালয় ঘেরাও, অবস্থানসহ বেশ কিছু কর্মসূচির প্রস্তাব আছে। পরিস্থিতি বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ২৮ অক্টোবর রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে মহাসমাবেশ করতে চেয়ে এরই মধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছে অবহিতকরণের চিঠি দিয়েছে বিএনপি। নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে না দিয়ে বিকল্প স্থানের প্রস্তাব করা হলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলছেন দলটির নেতারা।

২৮ অক্টোবর বিএনপির পাশাপাশি রাজধানীতে সমাবেশ করবে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকেরাও। মহাসমাবেশ এবং চলমান এক দফা আন্দোলন সফল করতে গতকাল যুগপৎ আন্দোলনের অন্যতম শরিক গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপি। এদিন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জরুরি সভা করেছে ছাত্রদল কেন্দ্রীয় সংসদ। সভায় মহাসমাবেশ উপলক্ষে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতাদের যথাযথভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

এদিকে, মহাসমাবেশ সামনে রেখে নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় অব্যাহত রয়েছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। গতকাল নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এই অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, ১৮ অক্টোবর থেকে গতকাল (সোমবার) পর্যন্ত অন্তত ৬২০ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই সময়ে ৪৯টি মামলায় ১২ হাজার ৯৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে। 

আওয়ামী লীগের প্রস্তুতি
 ২৮ অক্টোবর নিয়ে প্রস্তুতির কথা জানিয়ে আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচন ঠেকাতে ২৮ অক্টোবরের কর্মসূচিতে সহিংস আচরণ শুরু করতে পারে বিএনপি। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার পাশাপাশি প্রশাসনের সহযোগিতায় দমনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ আজকের পত্রিকাকে বলেন, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সহযোগিতা করা হবে। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে অশান্তি করে জনজীবন বিপর্যস্ত করা, সহিংসতা ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড করলে কঠোরভাবে দমন করা হবে।

ওইদিন বায়তুল মোকাররম মসজিদের দক্ষিণ গেটে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের আয়োজনে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০ অক্টোবর সমাবেশের অনুমতি চেয়ে ডিএমপির কাছে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। সমাবেশে লোকসমাগম ঘটাতে দফায় দফায় বৈঠক করছে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ। এ উপলক্ষে বুধবার ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগসহ সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘নির্বাচনের আগপর্যন্ত আমরা মাঠে থাকব, এটা আমাদের পুরোনো ঘোষণায় আছে।’ বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে সহিংসতা হলে আওয়ামী লীগ কীভাবে মোকাবিলা করবে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সময়ই সবকিছু বলে দেবে। আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি আছে। সকাল থেকেই আওয়ামী লীগের নেতারা রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে সতর্ক অবস্থায় থাকবে।’ 

পুলিশের প্রস্তুতি
 ২৮ অক্টোবরকে কেন্দ্র করে আগামী চার-পাঁচ দিন বিএনপির মধ্যম সারির নেতাদের দিকে নজরদারি বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ। পাশাপাশি সমাবেশের দিন পুলিশ সদস্যদের মাথা ঠান্ডা রেখে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। গতকাল পুলিশ সদর দপ্তরে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের সঙ্গে ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি বৈঠক হয়।

বৈঠক সূত্র বলছে, বিএনপির মধ্যম সারির নেতাদের মধ্যে যাঁদের বিরুদ্ধে আদালতের পরোয়ানা আছে, থানায় মামলা রয়েছে, তাঁদের সমাবেশের আগে গ্রেপ্তারের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। আগামী আরও চার-পাঁচ দিন দেশব্যাপী পুলিশের অভিযান অব্যাহত থাকবে।

সমাবেশের অনুমতির বিষয় নিয়েও বৈঠকে আলোচনা হয়। বিএনপিকে ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশের জন্য কোন জায়গা দেওয়া হবে, তা নিয়ে পুলিশ আলোচনা করছে। তবে অনুমতি দেওয়ার আগে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ৫০টি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের (ওসি) কাছে তাঁদের নিজ নিজ এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি উল্লেখ করে প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। সম্ভাব্য যেসব এলাকায় সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হতে পারে সেসব এলাকায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের অবস্থান ও সক্ষমতা জানাতে বলা হয়েছে। ৫০ থানার ওসিদের প্রতিবেদন ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন মূল্যায়ন করার পর দলটিকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হবে বলেও বৈঠক সূত্র জানিয়েছে।

এ ছাড়া পুলিশ সদর দপ্তরের বৈঠকে বিএনপি শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের শিগগিরই বৈঠক করে সমাবেশ নিয়ে আলোচনা করতে নির্দেশনা দিয়েছেন আইজিপি। ওই বৈঠকে দলটির কর্মীরা সমাবেশের দিন যাতে দায়িত্বশীল রাজনৈতিক আচরণ করেন, পুলিশ তাদের সেই আকাঙ্ক্ষার কথা বিএনপির নেতাদের জানাবেন।

ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) বিপ্লব কুমার সরকার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিএনপির সমাবেশকে কেন্দ্র করে এখনো কোনো নাশকতার আশঙ্কা করছি না। কোনো ভীতির কিছুও দেখছি না। ডিএমপির কমিশনার নিরাপদ মনে করলে অনুমতি দেবেন, আর যদি ঝুঁকি থাকে তাহলে অনুমতি দেবেন না।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত