রেল শহরে রোমান স্থাপত্য

রেজা মাহমুদ, সৈয়দপুর (নীলফামারী)
প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮: ২৩

বাঙালি কাবাব খেতে অভ্যস্ত হলেও, তৈরিতে অভ্যস্ত নয়। শীতের বিবর্ণ বিকেলে সৈয়দপুর শহরে হাঁটলে আপনার নাকে কাবাবের গন্ধ ঝাপটা মারবে। বুঝবেন, শহরটিতে মানুষের বৈচিত্র্য আছে। এ শহরে হাঁটলে আসাম বেঙ্গল রেলের গল্প মনে পড়বে আপনার। সে সূত্রে মনে পড়বে, হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান, বাঙালি, বিহারি মিলিয়ে এক দারুণ গল্প রয়েছে এই রেল শহরের। কোম্পানি আমলে গড়ে ওঠা সৈয়দপুর ছিল আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের ছোট্ট একটি স্টেশন। সে সূত্রে এ শহরকে ঘিরে আছে অনেক ইতিহাস আর তার গল্প।

সৈয়দপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে পশ্চিম দিকে তাকালে গাছ-পালার ফাঁক দিয়ে আপনার দৃষ্টি আটকে যাবে দুটি ভবনের ওপর। স্টেশন থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ভবন দুটি আসলে গির্জা। তথ্য হলো, আঠারো শতকের শুরুর দিকে নির্মাণ করা এ ভবনগুলো বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রাচীনতম গির্জা। এগুলোর নির্মাণশৈলী মুগ্ধ করবে আপনাকে।

১৮৭০ সালে সৈয়দপুর রেলস্টেশনের উত্তর দিকে স্থাপন করা হয় ছোট একটি লোকোশেড। পরবর্তী সময়ে এ লোকোশেডটি ঘিরেই ১০৬ একর জমি নিয়ে গড়ে তোলা হয় বিশাল রেলওয়ে কারখানা। এ কারখানাটিতে বাঙালি ও বিহারিদের সঙ্গে কাজ করতেন বহু ব্রিটিশ নাগরিক এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান রোমান ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের খ্রিষ্টান। তাঁদের বসবাসের জন্য গড়ে তোলা হয় এ শহরে বেশ কটি আবাসিক এলাকা। এর মধ্যে সাব-অর্ডিনেট কলোনি, সাহেবপাড়া ও অফিসার্স কলোনি অন্যতম।

১৮৮৬ সালে খ্রিষ্টানদের উপাসনার জন্য ব্রিটিশ সরকার সাহেবপাড়ার দুই প্রান্তে দুটি গির্জা নির্মাণ করে। এর একটি ছিল রোমান ক্যাথলিক ও অপরটি প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায়ের ক্রাইস্টচার্চ গির্জা। রোমান-ইউরোপীয় স্থাপত্য রীতিতে এগুলো নির্মাণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে রেলওয়ে কারখানা গেটসংলগ্ন গির্জাটি মা মেরি বা কুমারী মরিয়মের নামে উৎসর্গ করা হয়। ব্রিটিশ সরকার ১৮৯২ সালে ওই গির্জার পাশেই রেলওয়ের তিন বিঘা জমির ওপর পুরোহিত ভবন বা ফাদার কুঠি নির্মাণ করে। তখন ফাদার ফ্রান্সিস বোক্কা লিমে প্রভু যিশুখ্রিষ্টের ভক্ত-অনুরক্তদের নিয়ে এখানে আধ্যাত্মিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন।

সৈয়দপুর শহরের নতুন বাবুপাড়ায়, যা ছিল আগের খ্রিষ্টানপাড়া, বসবাস করেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নন্দিনী মল্লিক। তিনি জানান, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর সৈয়দপুরে বসবাসকারী ইংরেজ ও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের বেশির ভাগ ব্রিটেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চলে গেলেও কিছুসংখ্যক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান এ শহরে থেকে যান। সেই দেশান্তরের কালে ঢাকা, মানিকগঞ্জ, বরিশাল, পাবনা, কুষ্টিয়াসহ বিভিন্ন জেলার বাঙালি ও অন্যান্য খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের মানুষ রেলওয়েতে চাকরি করতে এসে এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

সৈয়দপুর ক্রাইস্ট চার্চের সাধারণ সম্পাদক প্রদীপ বিশ্বাস জানান, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় ১৬ এপ্রিল সৈয়দপুরে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু হলে অবাঙালি ও পাকিস্তানি সেনাদের হাতে শহীদ হন বেশ কজন খ্রিষ্টান। সে সময় সৈয়দপুরের বাঙালি খ্রিষ্টানদের বিভিন্ন বিপদে যাঁরা এগিয়ে আসেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন ফাদার কালিন্তস কোডাইয়া, ফাদার পরিবলদি, ফাদার রায়ার বয়েন ও ফাদার প্যাট্রেক গোমেজ।

সৈয়দপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোখছেদুল মোমিন বলেছেন, ‘সৈয়দপুর শহরের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে গির্জা দুটি। এখানে আমরা হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সবাই মিলেমিশে থাকি এবং থাকতে চাই।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত