সৃষ্টি জাসওয়াল
ডানপন্থী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ফিরে আসার এক বছর আগে ২০১৮ সালে ভারতের তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি বিশ্বাস করেন যে ভারতীয় হিন্দুরা ‘ঋষিদের’ বংশধর, বানরের নয়।
তৎকালীন মানব সম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী সত্যপাল সিং বলেছিলেন, চার্লস ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব ‘বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল’। তিনি আরও বলেছিলেন ‘স্কুল ও কলেজের পাঠ্যক্রম পরিবর্তন করা দরকার। পৃথিবীতে সব সময় মানুষকেই দেখা গেছে। কেউ বানরকে মানুষে পরিণত হতে দেখেনি।’
সত্যপাল যা বলেছিলেন তার বাস্তবায়ন এখন ঘটছে। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে, ডারউইনের তত্ত্বটি নীরবে নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে বিবর্তনবাদ বিষয়টি স্কুলের পাঠ্যপুস্তক থেকে সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলা হয়।
ভারতের শিক্ষক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন লাখ লাখ স্কুল শিক্ষার্থী ডারউইন কে ছিলেন বা তাঁর তত্ত্ব কী বলে, তা জানতে পারবে না, যদি না তারা একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে জীববিদ্যা বিষয়টি বেছে নেয়।
ভারতের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংস্থা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের (এনসিইআরটি) পরামর্শে পাঠ্যপুস্তকে এসব পরিবর্তন আনা হয় ।
ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব সেকেন্ডারি এডুকেশনের (সিবিএসই) অধিভুক্ত ২৪ হাজারের বেশি স্কুলে এসব পাঠ্যপুস্তক এখন পড়ানো হচ্ছে। তা ছাড়া, ভারতের ১৪টি রাজ্যের অন্তত ১৯টি স্কুল বোর্ডের অধীন স্কুলগুলোতে এসব বই পড়ানো হচ্ছে।
নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক দল বিজেপি ও এর পরামর্শদাতা অতি-ডান রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে দীর্ঘদিন ধরে ভারতের পাঠ্যপুস্তকগুলোকে সংশোধনের জন্য ব্যাপক প্রচার চালিয়ে আসছে। সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ নয় বরং ভারত একটি জাতিগত হিন্দু রাষ্ট্র—এটা প্রতিষ্ঠা করাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।
বিজেপি এবং আরএসএস-সংশ্লিষ্ট হিন্দু গোষ্ঠীগুলো ভারতের ২০ কোটি মুসলমানকে কোণঠাসা করার জন্য এই প্রচার চালাচ্ছে, যারা কিনা দেশটির জনসংখ্যার মাত্র ১৪ শতাংশ। মুসলমানরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেছে, ঐতিহাসিক এ সত্যকে অস্বীকার করা এবং কথিত হিন্দু নিপীড়নের একটি বিকল্প ইতিহাস তৈরি করে সেই মুসলিম শাসকদের শয়তানরূপে হাজির করা—সেইসব প্রচারের প্রধান উপাদান।
এই প্রচারের অংশ হিসেবে ১৬ ও ১৯ শতকের মধ্যে এই উপমহাদেশ শাসনকারী মোগলদের কথাও ইতিহাসের বই থেকে মুছে ফেলা হয়েছে।
এনসিইআরটি সপ্তম শ্রেণির ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক থেকে বেশ কয়েকটি পৃষ্ঠা বাদ দিয়েছে, যাতে দিল্লি সালতানাতের শাসকদের কথা উল্লেখ ছিল। এটি মোগল সম্রাটদের মাইলফলক এবং সাফল্যের বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে—এমন দুটি পৃষ্ঠাও বাদ দিয়েছে।
দিল্লি সালতানাতের সম্প্রসারণ সম্পর্কে বলা তিনটি পৃষ্ঠা এবং একটি ‘মসজিদ’ তৈরির ইতিহাস বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে–এমন একটি অনুচ্ছেদও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক থেকে কিংস অ্যান্ড ক্রনিকলস নামে একটি অধ্যায়, যেখানে মোগল সম্রাটদের নানা গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস লেখা ছিল, তা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তবে এনসিইআরটি দাবি করেছে, করোনাকালে শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে পড়ালেখার বোঝা কমাতেই মোগল শাসকদের ইতিহাস বাদ দেওয়া হয়েছে।
এনসিইআরটি ১১ এবং ১২ গ্রেডের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নতুন বইতে হিন্দুত্ববাদীদের প্রতি স্বাধীনতাসংগ্রামী মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধীর নেতিবাচক মনোভাব এবং গান্ধীকে হত্যার পরে আরএসএসের ওপর নিষেধাজ্ঞার ঘটনাটি মুছে দিয়েছে। ১৯৪৮ সালে গান্ধীকে হত্যাকারী নাথুরাম গডসের সঙ্গে আরএসএসের যোগসূত্র ছিল—এই তথ্য এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
পাঠ্যপুস্তকের ২০২০-২১ সংস্করণের একটি বাক্য—গান্ধী ‘বিশ্বাস করতেন যে ভারতকে শুধু হিন্দুদের জন্য একটি দেশে পরিণত করার যেকোনো প্রচেষ্টা দেশটিকে ধ্বংস করবে’—এটিও মুছে ফেলা হয়েছে। অন্য একটি বাক্যও বাদ দেওয়া হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে, গান্ধীর ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অবিচল সাধনা হিন্দু চরমপন্থীদের এতটাই উত্তেজিত করেছিল যে তারা গান্ধীজিকে হত্যা করার জন্য বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছিল’।
এনসিইআরটি একাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বই থেকে ভারতের মুসলিম স্বাধীনতাসংগ্রামী মৌলানা আবুল কালাম আজাদের কথাও মুছে দিয়েছে। আজাদ ছিলেন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী এবং গণপরিষদের সদস্য, যিনি ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতার পর দেশের সংবিধানের খসড়া তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
পাঠ্যপুস্তকের আগের সংস্করণে একটি বাক্য ছিল: ‘গণপরিষদের বিভিন্ন বিষয়ে আটটি প্রধান কমিটি ছিল। সাধারণত, জওহরলাল নেহরু (ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী), রাজেন্দ্র প্রসাদ (প্রথম ভারতীয় রাষ্ট্রপতি), সর্দার প্যাটেল (বল্লভভাই প্যাটেল, প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী), মৌলানা আজাদ ও আম্বেদকর (ভীম রাও আম্বেদকর, খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান) এসব কমিটি সভাপতিত্ব করতেন।’
দ্য হিন্দু পত্রিকার মতে, সংশোধিত পাঠ্যপুস্তকে বলা হয়েছে: ‘সাধারণত, জওহরলাল নেহরু, রাজেন্দ্র প্রসাদ, সর্দার প্যাটেল এবং বি আর আম্বেদকর এই কমিটিগুলোর সভাপতিত্ব করতেন।’
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার তদন্তে পাওয়া গেছে, সামাজিক বিজ্ঞানের সব বই থেকে নরেন্দ্র মোদির নিজ রাজ্য গুজরাটে ২০০২ সালের দাঙ্গার ঘটনা মুছে ফেলা হয়েছে। সেই দাঙ্গায় প্রায় দুই হাজার লোক, যাদের বেশির ভাগই মুসলমান নিহত হয়েছিল। সম্প্রতি, ভারত সরকার বিবিসির একটি তথ্যচিত্র নিষিদ্ধ করেছে, যেখানে বলা হয়েছিল যে মোদি তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং হত্যাকাণ্ডের জন্য সরাসরি দায়ী ছিলেন।
ভারতের ইতিহাসবিদ এস ইরফান হাবিব বলেছেন, ইতিহাসের পুনর্লিখন বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রচারণার একটি প্রচেষ্টা। পাঠ্যবইয়ে কাটছাঁটকে একটি ‘বড় হামলা’ হিসেবে অভিহিত করে হাবিব বলেন, ‘এটি তরুণ প্রজন্মকে আমরা যা ভাবতে পারি তার চেয়ে বেশি প্রভাবিত করবে।’
হাবিব বলেন, ছোট বাচ্চাদের মগজ ধোলাই করে ভারতে ধর্মীয় বিভাজন আরও বাড়াতে অ্যাজেন্ডা অনুসরণ করা বর্তমান সরকারের একটি সচেতন কাজ। সরকার স্কুলের পাঠ্যক্রম বিষাক্ত করে ভারতের নৈতিকতাকে আঘাত করছে।
ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের কথা বলা হয়েছে—এমন একটি অধ্যায় ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক থেকে মুছে ফেলা হয়েছে।
সপ্তম শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞান বই থেকে দুটি অধ্যায় মুছে ফেলা হয়েছে। একটি আন্ডারস্ট্যান্ডিং অ্যাডভার্টাইজমেন্টস শিরোনামে, যেখানে মিডিয়াতে বড় ব্যবসার ভূমিকা সম্পর্কে বলা হয়েছে। অন্যটি, স্ট্রাগলস ফর ইকুয়ালিটি শিরোনামে, যেখানে ভারতে কেন মানুষের সঙ্গে অসম আচরণ করা হয়, তার বিভিন্ন কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছিল এবং নারীর ক্ষমতায়নের জন্য আন্দোলনের কথা লেখা ছিল।
ইতিহাসবিদ হাবিব বলেছেন, ‘স্কুলের বইকে রাজনৈতিকীকরণের প্রচেষ্টা নতুন কিছু নয় কিন্তু এটি আরএসএস এবং হিন্দুত্ববাদীদের বহুদিনের অ্যাজেন্ডা। এবং মাত্রাটি উদ্বেগজনক।’ তিনি বলেন, ‘ভারতের শতাব্দীপ্রাচীন ধর্মনিরপেক্ষতা এবং হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতিকে তুলে ধরে— এমন তথ্য বিজেপি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখছে একটি বিকৃত হিন্দু জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করতে যে ভারত শুধু হিন্দুদের জন্য।’
এক বিবৃতিতে এনসিইআরটির পরিচালক ডি পি সাকলানি বলেছেন, মুছে ফেলা অধ্যায়গুলো পুনরুদ্ধার করা হবে না, কারণ সেগুলো একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে করা হয়েছে।
বিশিষ্ট মুসলিম সংসদ সদস্য আসাদুদ্দিন ওয়াইসি শাসক বিজেপির বিরুদ্ধে স্কুলের পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পুনর্লিখনের মাধ্যমে ‘তার রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডাকে চাপিয়ে দেওয়ার’ অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি ভীত যে তারা শিগগিরই স্কুলে শেখাবে গডসের গান্ধীকে হত্যা করা ঠিক কাজ ছিল। বিজেপি যা করছে তা অন্যান্য ফ্যাসিবাদী শাসকদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। আমরা অন্যান্য দেশে দেখেছি কীভাবে ফ্যাসিস্টরা তাদের আদর্শের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ইতিহাস নিয়ে খেলা করেছে। একই ঘটনা এখন ভারতেও ঘটছে, তবে মাত্রাটি অনেক বেশি।
সৃষ্টি জাসওয়াল ভারতীয় সাংবাদিক
(আল জাজিরায় প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন সাংবাদিক ও কলাম লেখক রোকেয়া রহমান)
ডানপন্থী ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ফিরে আসার এক বছর আগে ২০১৮ সালে ভারতের তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, তিনি বিশ্বাস করেন যে ভারতীয় হিন্দুরা ‘ঋষিদের’ বংশধর, বানরের নয়।
তৎকালীন মানব সম্পদ উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী সত্যপাল সিং বলেছিলেন, চার্লস ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব ‘বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল’। তিনি আরও বলেছিলেন ‘স্কুল ও কলেজের পাঠ্যক্রম পরিবর্তন করা দরকার। পৃথিবীতে সব সময় মানুষকেই দেখা গেছে। কেউ বানরকে মানুষে পরিণত হতে দেখেনি।’
সত্যপাল যা বলেছিলেন তার বাস্তবায়ন এখন ঘটছে। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে, ডারউইনের তত্ত্বটি নীরবে নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে বিবর্তনবাদ বিষয়টি স্কুলের পাঠ্যপুস্তক থেকে সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলা হয়।
ভারতের শিক্ষক ও শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন লাখ লাখ স্কুল শিক্ষার্থী ডারউইন কে ছিলেন বা তাঁর তত্ত্ব কী বলে, তা জানতে পারবে না, যদি না তারা একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে জীববিদ্যা বিষয়টি বেছে নেয়।
ভারতের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সংস্থা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের (এনসিইআরটি) পরামর্শে পাঠ্যপুস্তকে এসব পরিবর্তন আনা হয় ।
ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব সেকেন্ডারি এডুকেশনের (সিবিএসই) অধিভুক্ত ২৪ হাজারের বেশি স্কুলে এসব পাঠ্যপুস্তক এখন পড়ানো হচ্ছে। তা ছাড়া, ভারতের ১৪টি রাজ্যের অন্তত ১৯টি স্কুল বোর্ডের অধীন স্কুলগুলোতে এসব বই পড়ানো হচ্ছে।
নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক দল বিজেপি ও এর পরামর্শদাতা অতি-ডান রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণে দীর্ঘদিন ধরে ভারতের পাঠ্যপুস্তকগুলোকে সংশোধনের জন্য ব্যাপক প্রচার চালিয়ে আসছে। সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ নয় বরং ভারত একটি জাতিগত হিন্দু রাষ্ট্র—এটা প্রতিষ্ঠা করাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।
বিজেপি এবং আরএসএস-সংশ্লিষ্ট হিন্দু গোষ্ঠীগুলো ভারতের ২০ কোটি মুসলমানকে কোণঠাসা করার জন্য এই প্রচার চালাচ্ছে, যারা কিনা দেশটির জনসংখ্যার মাত্র ১৪ শতাংশ। মুসলমানরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেছে, ঐতিহাসিক এ সত্যকে অস্বীকার করা এবং কথিত হিন্দু নিপীড়নের একটি বিকল্প ইতিহাস তৈরি করে সেই মুসলিম শাসকদের শয়তানরূপে হাজির করা—সেইসব প্রচারের প্রধান উপাদান।
এই প্রচারের অংশ হিসেবে ১৬ ও ১৯ শতকের মধ্যে এই উপমহাদেশ শাসনকারী মোগলদের কথাও ইতিহাসের বই থেকে মুছে ফেলা হয়েছে।
এনসিইআরটি সপ্তম শ্রেণির ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক থেকে বেশ কয়েকটি পৃষ্ঠা বাদ দিয়েছে, যাতে দিল্লি সালতানাতের শাসকদের কথা উল্লেখ ছিল। এটি মোগল সম্রাটদের মাইলফলক এবং সাফল্যের বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে—এমন দুটি পৃষ্ঠাও বাদ দিয়েছে।
দিল্লি সালতানাতের সম্প্রসারণ সম্পর্কে বলা তিনটি পৃষ্ঠা এবং একটি ‘মসজিদ’ তৈরির ইতিহাস বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে–এমন একটি অনুচ্ছেদও সরিয়ে ফেলা হয়েছে। দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক থেকে কিংস অ্যান্ড ক্রনিকলস নামে একটি অধ্যায়, যেখানে মোগল সম্রাটদের নানা গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস লেখা ছিল, তা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তবে এনসিইআরটি দাবি করেছে, করোনাকালে শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে পড়ালেখার বোঝা কমাতেই মোগল শাসকদের ইতিহাস বাদ দেওয়া হয়েছে।
এনসিইআরটি ১১ এবং ১২ গ্রেডের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নতুন বইতে হিন্দুত্ববাদীদের প্রতি স্বাধীনতাসংগ্রামী মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধীর নেতিবাচক মনোভাব এবং গান্ধীকে হত্যার পরে আরএসএসের ওপর নিষেধাজ্ঞার ঘটনাটি মুছে দিয়েছে। ১৯৪৮ সালে গান্ধীকে হত্যাকারী নাথুরাম গডসের সঙ্গে আরএসএসের যোগসূত্র ছিল—এই তথ্য এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
পাঠ্যপুস্তকের ২০২০-২১ সংস্করণের একটি বাক্য—গান্ধী ‘বিশ্বাস করতেন যে ভারতকে শুধু হিন্দুদের জন্য একটি দেশে পরিণত করার যেকোনো প্রচেষ্টা দেশটিকে ধ্বংস করবে’—এটিও মুছে ফেলা হয়েছে। অন্য একটি বাক্যও বাদ দেওয়া হয়েছে, যাতে বলা হয়েছে, গান্ধীর ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অবিচল সাধনা হিন্দু চরমপন্থীদের এতটাই উত্তেজিত করেছিল যে তারা গান্ধীজিকে হত্যা করার জন্য বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছিল’।
এনসিইআরটি একাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বই থেকে ভারতের মুসলিম স্বাধীনতাসংগ্রামী মৌলানা আবুল কালাম আজাদের কথাও মুছে দিয়েছে। আজাদ ছিলেন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী এবং গণপরিষদের সদস্য, যিনি ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতার পর দেশের সংবিধানের খসড়া তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
পাঠ্যপুস্তকের আগের সংস্করণে একটি বাক্য ছিল: ‘গণপরিষদের বিভিন্ন বিষয়ে আটটি প্রধান কমিটি ছিল। সাধারণত, জওহরলাল নেহরু (ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী), রাজেন্দ্র প্রসাদ (প্রথম ভারতীয় রাষ্ট্রপতি), সর্দার প্যাটেল (বল্লভভাই প্যাটেল, প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী), মৌলানা আজাদ ও আম্বেদকর (ভীম রাও আম্বেদকর, খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান) এসব কমিটি সভাপতিত্ব করতেন।’
দ্য হিন্দু পত্রিকার মতে, সংশোধিত পাঠ্যপুস্তকে বলা হয়েছে: ‘সাধারণত, জওহরলাল নেহরু, রাজেন্দ্র প্রসাদ, সর্দার প্যাটেল এবং বি আর আম্বেদকর এই কমিটিগুলোর সভাপতিত্ব করতেন।’
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার তদন্তে পাওয়া গেছে, সামাজিক বিজ্ঞানের সব বই থেকে নরেন্দ্র মোদির নিজ রাজ্য গুজরাটে ২০০২ সালের দাঙ্গার ঘটনা মুছে ফেলা হয়েছে। সেই দাঙ্গায় প্রায় দুই হাজার লোক, যাদের বেশির ভাগই মুসলমান নিহত হয়েছিল। সম্প্রতি, ভারত সরকার বিবিসির একটি তথ্যচিত্র নিষিদ্ধ করেছে, যেখানে বলা হয়েছিল যে মোদি তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং হত্যাকাণ্ডের জন্য সরাসরি দায়ী ছিলেন।
ভারতের ইতিহাসবিদ এস ইরফান হাবিব বলেছেন, ইতিহাসের পুনর্লিখন বিজেপির হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রচারণার একটি প্রচেষ্টা। পাঠ্যবইয়ে কাটছাঁটকে একটি ‘বড় হামলা’ হিসেবে অভিহিত করে হাবিব বলেন, ‘এটি তরুণ প্রজন্মকে আমরা যা ভাবতে পারি তার চেয়ে বেশি প্রভাবিত করবে।’
হাবিব বলেন, ছোট বাচ্চাদের মগজ ধোলাই করে ভারতে ধর্মীয় বিভাজন আরও বাড়াতে অ্যাজেন্ডা অনুসরণ করা বর্তমান সরকারের একটি সচেতন কাজ। সরকার স্কুলের পাঠ্যক্রম বিষাক্ত করে ভারতের নৈতিকতাকে আঘাত করছে।
ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের কথা বলা হয়েছে—এমন একটি অধ্যায় ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক থেকে মুছে ফেলা হয়েছে।
সপ্তম শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞান বই থেকে দুটি অধ্যায় মুছে ফেলা হয়েছে। একটি আন্ডারস্ট্যান্ডিং অ্যাডভার্টাইজমেন্টস শিরোনামে, যেখানে মিডিয়াতে বড় ব্যবসার ভূমিকা সম্পর্কে বলা হয়েছে। অন্যটি, স্ট্রাগলস ফর ইকুয়ালিটি শিরোনামে, যেখানে ভারতে কেন মানুষের সঙ্গে অসম আচরণ করা হয়, তার বিভিন্ন কারণ ব্যাখ্যা করা হয়েছিল এবং নারীর ক্ষমতায়নের জন্য আন্দোলনের কথা লেখা ছিল।
ইতিহাসবিদ হাবিব বলেছেন, ‘স্কুলের বইকে রাজনৈতিকীকরণের প্রচেষ্টা নতুন কিছু নয় কিন্তু এটি আরএসএস এবং হিন্দুত্ববাদীদের বহুদিনের অ্যাজেন্ডা। এবং মাত্রাটি উদ্বেগজনক।’ তিনি বলেন, ‘ভারতের শতাব্দীপ্রাচীন ধর্মনিরপেক্ষতা এবং হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতিকে তুলে ধরে— এমন তথ্য বিজেপি শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখছে একটি বিকৃত হিন্দু জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করতে যে ভারত শুধু হিন্দুদের জন্য।’
এক বিবৃতিতে এনসিইআরটির পরিচালক ডি পি সাকলানি বলেছেন, মুছে ফেলা অধ্যায়গুলো পুনরুদ্ধার করা হবে না, কারণ সেগুলো একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে করা হয়েছে।
বিশিষ্ট মুসলিম সংসদ সদস্য আসাদুদ্দিন ওয়াইসি শাসক বিজেপির বিরুদ্ধে স্কুলের পাঠ্যপুস্তক সংশোধন ও পুনর্লিখনের মাধ্যমে ‘তার রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডাকে চাপিয়ে দেওয়ার’ অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি ভীত যে তারা শিগগিরই স্কুলে শেখাবে গডসের গান্ধীকে হত্যা করা ঠিক কাজ ছিল। বিজেপি যা করছে তা অন্যান্য ফ্যাসিবাদী শাসকদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। আমরা অন্যান্য দেশে দেখেছি কীভাবে ফ্যাসিস্টরা তাদের আদর্শের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে ইতিহাস নিয়ে খেলা করেছে। একই ঘটনা এখন ভারতেও ঘটছে, তবে মাত্রাটি অনেক বেশি।
সৃষ্টি জাসওয়াল ভারতীয় সাংবাদিক
(আল জাজিরায় প্রকাশিত লেখাটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন সাংবাদিক ও কলাম লেখক রোকেয়া রহমান)
গাজীপুর মহানগরের বোর্ডবাজার এলাকার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা পিকনিকে যাচ্ছিলেন শ্রীপুরের মাটির মায়া ইকো রিসোর্টে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক থেকে বাসগুলো গ্রামের সরু সড়কে ঢোকার পর বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে যায় বিআরটিসির একটি দোতলা বাস...
২ দিন আগেঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৬ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৬ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৬ দিন আগে