ফারুক মেহেদী, ঢাকা
কঠিন টানে দেশের অর্থনীতি। এক সময়ের রেকর্ড রিজার্ভ এখন মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের চাপে স্থবির। ডলার বাজারের অস্থিতিশীলতায় রেমিট্যান্স প্রবাহ গতিহীন। রপ্তানি ইতিবাচক থাকলেও অর্ডার কমছে। সরকারের নগদ অর্থের কোষাগার হিসেবে পরিচিত রাজস্ব আয়ে মন্দা। মধ্যবিত্তের সহজ বিনিয়োগের ভরসাস্থল পুঁজিবাজার আস্থাহীনতায় এখন প্রায় খাদের কিনারে। সব মিলিয়ে সরকারের আয় কম, অথচ ব্যয় পাহাড়সম। খরচের খাত কমিয়েও সংকট সামলানো যাচ্ছে না।
সরকার একদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে মরিয়া। অন্যদিকে দেশ চালানোর টাকাকড়ি জোগাড়ে কঠিন শর্তের ঋণ পাওয়ার চেষ্টা। টেনেটুনে অর্থনীতির একদিকের হিসাব মেলাতে গেলে, গোল পাকছে অন্যদিকে। লোকসান, ঘাটতির মারপ্যাঁচে ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
আর এ সবকিছুর চাপ আর ভোগান্তি গিয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। আমদানিতে উচ্চ ব্যয়, ডলারের দাম বৃদ্ধি, জিনিসপত্রের অসহনীয় দামের উত্তাপ আর সবশেষ জ্বালানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির আগুনে এখন দরিদ্র শ্রেণি আর গোটা মধ্যবিত্ত সমাজ পুড়ছে। গত কিছুদিন ধরে চলা অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা, দেশি–বিদেশি পর্যবেক্ষণ আর বিশ্লেষকদের মতামত থেকে এমন চিত্রই উঠে আসছে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এখন একটি ক্রান্তিকাল পার করছে। এ সময়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার অঙ্কে সামান্য ভুল হলেই মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।
এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দেশের সার্বিক অর্থনীতির সূচকগুলো নিয়েই এখন ভাবার বিষয়। সবকিছুই চাপের মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্স, কর্মসংস্থান, মূল্যস্ফীতি। রপ্তানি যদি কমে আসে, আর বিশ্বের মূল্যস্ফীতি যদি না কমে তাহলে ডলার সহজলভ্য হবে না। এর রেশ তখন অর্থনীতির বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়বে।
গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় সরকার মোটাদাগে তিন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রথমত আমদানি নিয়ন্ত্রণ, টাকাকে অবমূল্যায়িত করা আর কৃচ্ছ্রসাধনসহ নানা কড়াকড়ি। তবে আমি মনে করি, আরও কিছু পদক্ষেপ দরকার। বিশেষ করে ব্যাংকের ঋণ–আমানতের সুদের হার ধরে না রেখে এর সীমা তুলে দিতে হবে। যদিও এসব পদক্ষেপের একটা নেতিবাচক দিকও আছে। এসবের ফলে সার্বিক প্রবৃদ্ধি কমে যাবে।
করোনা সহনীয় হয়ে আসার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ প্রায় সব পণ্যের অসহনীয় দামের ধাক্কা এসে লেগেছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। ফলে রেকর্ড ঘাটতিতে পড়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। পরিমাণে কম আমদানি করেও এর জন্য আগের চেয়ে অনেক বেশি বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি আয়ের ঘাটতি গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। অঙ্কের হিসাবে তা প্রায় ১ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। আমদানি বিল শোধের চাপে চাহিদা বাড়ে ডলারের। ফলে ডলারের দাম বেড়েছে। সরকারি হিসাবেই গত সাত মাসে ডলারপ্রতি টাকার দর কমেছে প্রায় ৯ টাকা। আর খোলাবাজারে সবশেষ গতকালও এক ডলার কিনতে ১১৫ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়েছে বলে জানা গেছে। গত বছরের আগস্টে যে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল, তা এখন ৩৯-৪০ বিলিয়ন ডলারের বৃত্ত ভেঙে উপড়ে উঠতে পারছে না।
গত মাসে ২০৯ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলেও এর ধারাবাহিকতা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ এর আগের বেশ কয়েক মাস ধরেই রেমিট্যান্স প্রবাহ নিয়মিত কমতির দিকে। একা রপ্তানি আয়ের রেকর্ড প্রবৃদ্ধি হলেও তা ডলারের বিপুল চাহিদাকে কোনোভাবেই বশে আনতে পারেনি।
এমন প্রেক্ষাপটে সরকার দফায় দফায় ডলার রক্ষায় কড়াকড়ি আরোপ করে। বিলাসী পণ্য আমদানি সীমিত করে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয়। যদিও অনেক মন্ত্রণালয় তা থোড়াই কেয়ার করছে। নিষেধাজ্ঞার ফাঁক গলে অনেকেই বিদেশ ঘুরে আসছেন। একইভাবে ডলারের সংশ্লেষ আছে এমন প্রকল্প কাটছাঁটের পাশাপাশি কৃচ্ছ্রসাধনের অংশ হিসেবে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প স্থগিত এবং বরাদ্দ কমানো হয়েছে। তবে কৃচ্ছ্রসাধনের পুরো সুফল দেখা যাচ্ছে না। বরং সরকারি গাড়িতে অপ্রয়োজনে জ্বালানি পোড়ানো হচ্ছে, অফিস কক্ষে কেউ না থাকলেও এসি চালানো হচ্ছে। ফলে সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বললেও, নজরদারির অভাবে এর সুফল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গত কয়েক মাসে জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক দাম সাধারণ মানুষকে চরম ভোগান্তির মধ্যে ফেলেছে। ভোজ্যতেলের দাম যখন রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে তখন থেকেই মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ শুরু হয়। বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম কমতে থাকলেও দেশের বাজারে এখনো এর রেশ কাটেনি। চাল, ডাল, চিনি, পেঁয়াজ, শাকসবজিসহ এমন কোনো পণ্য নেই যার দাম বাড়েনি। সীমিত আয়ের মানুষ যখন এর সঙ্গে টিকে থাকার লড়াই করছে, তখনই ঘাটতির কথা বলে আকস্মিক এক নোটিশে জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড বাড়ানো হয়েছে। যে বৃদ্ধি নিয়ে সর্বত্র এখনো আলোচনা হচ্ছে। প্রায় ৫১ শতাংশ বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। এতে অর্থনীতির প্রায় সব খাতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
বেড়েছে পরিবহন ভাড়া। আরেক দফা আগুন লাগতে শুরু করেছে সব ধরনের নিত্যপণ্যের বাজারে। সাধারণ মানুষ হতাশ। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, আয়ের চেয়ে ব্যয় অস্বাভাবিক বাড়লে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গিয়ে ক্রমেই তারা দরিদ্র হয়। দারিদ্র্য নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়লে দরিদ্র হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে প্রায় ৫৫ শতাংশ মানুষ। অর্থনীতিতে আকস্মিক চাপ বা নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম দারিদ্র্যসীমার একটু ওপরে থাকা পরিবারকে দরিদ্র করে ফেলতে পারে। বিবিএসের সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ৯ কোটির বেশি মানুষ এমন ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
মূল্যস্ফীতি এমনিতেই বাড়তির দিকে। তার সঙ্গে নতুন করে জ্বালানির দাম মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে প্রকাশিত বিবিএসের হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, জুলাই মাসে ‘পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে’ সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশে পৌঁছায়। অর্থাৎ গত বছরের জুলাই মাসে দেশের মানুষ যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পেয়েছিলেন, এ বছর জুলাই মাসে তা কিনতে ১০৭ টাকা ৪৮ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। সরকার যদিও বলছে, এ হার আগের মাসের চেয়ে কমেছে। জুনে তা ছিল ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। তবে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার পূর্বাভাস বলছে, সামনের দিনে মূল্যস্ফীতির পারদ আরও ওপরে উঠবে।
রপ্তানিকারকেরা জানান, বিদ্যুতের লোডশেডিং বাড়ায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অর্ডার ধরে রাখতে গিয়ে ডিজেলে বিকল্প উপায়ে কারখানা চালু রাখতে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংক রেটের চেয়ে অনেক বেশিতে ডলার কিনে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করতে গিয়েও তাঁরা হিমশিম খাচ্ছেন। তা ছাড়া বিশ্বমন্দার ঝুঁকির কারণে এরই মধ্যে ক্রেতারা পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যের অর্ডার কমিয়ে দিচ্ছে। নতুন করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় মারাত্মক উদ্বেগে আছেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা।
দেশের নিট পোশাক রপ্তানি খাতের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ডলারের কারণে আমদানি-রপ্তানির লেনদেনে একটা বড় পার্থক্য তৈরি হয়েছে। ব্যাংকগুলো সুযোগ নিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে, আমদানি ঠিকমতো না হলে, উৎপাদনে প্রভাব পড়বে। তখন এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাজারে। আর সবকিছুই মূল্যস্ফীতি উসকে দেবে।
করোনার কারণে এমনিতেই সার্বিক অর্থনীতির গতি মন্থর। গত দুই অর্থবছর ধরে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আয় হচ্ছে না। একদিন আগেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জানিয়েছে, গত অর্থবছরে তারা প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকার কম রাজস্ব আয় করতে পেরেছে। অর্থাৎ বাজেট বাস্তবায়নের জন্য যে রাজস্ব আয় করার কথা তা হচ্ছে না। চলতি বাজেটও আকারে বিশাল। রাজস্ব আয়ের ধারায় উন্নতির লক্ষণ নতুন অর্থবছরেও নেই।
ফলে ভবিষ্যতের জন্য আইএমএফসহ বিভিন্ন উৎস থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। এরই মধ্যে আইএমএফের কাছ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠানো হয়েছে। সাধারণত আইএমএফ ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে ভর্তুকি কমানো। ঋণ নিয়ে এখনো আলোচনা শুরু না হলেও সরকার জ্বালানি ও সারে ভর্তুকি কমানো শুরু করেছে। যদিও সরকার বলছে, এ ভর্তুকি কমানোর সঙ্গে আইএমএফের শর্তের কোনো সংশ্লেষ নেই। কিন্তু ভর্তুকি কমানোর অংশ হিসেবেই জ্বালানির দাম রেকর্ড পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এটিই এখন অর্থনীতির সর্বস্তরে নেতিবাচক প্রভাবের উপলক্ষ হয়ে উঠছে।
কঠিন টানে দেশের অর্থনীতি। এক সময়ের রেকর্ড রিজার্ভ এখন মাত্রাতিরিক্ত ব্যয়ের চাপে স্থবির। ডলার বাজারের অস্থিতিশীলতায় রেমিট্যান্স প্রবাহ গতিহীন। রপ্তানি ইতিবাচক থাকলেও অর্ডার কমছে। সরকারের নগদ অর্থের কোষাগার হিসেবে পরিচিত রাজস্ব আয়ে মন্দা। মধ্যবিত্তের সহজ বিনিয়োগের ভরসাস্থল পুঁজিবাজার আস্থাহীনতায় এখন প্রায় খাদের কিনারে। সব মিলিয়ে সরকারের আয় কম, অথচ ব্যয় পাহাড়সম। খরচের খাত কমিয়েও সংকট সামলানো যাচ্ছে না।
সরকার একদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখতে মরিয়া। অন্যদিকে দেশ চালানোর টাকাকড়ি জোগাড়ে কঠিন শর্তের ঋণ পাওয়ার চেষ্টা। টেনেটুনে অর্থনীতির একদিকের হিসাব মেলাতে গেলে, গোল পাকছে অন্যদিকে। লোকসান, ঘাটতির মারপ্যাঁচে ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ছে।
আর এ সবকিছুর চাপ আর ভোগান্তি গিয়ে পড়ছে সাধারণ মানুষের ঘাড়ে। আমদানিতে উচ্চ ব্যয়, ডলারের দাম বৃদ্ধি, জিনিসপত্রের অসহনীয় দামের উত্তাপ আর সবশেষ জ্বালানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির আগুনে এখন দরিদ্র শ্রেণি আর গোটা মধ্যবিত্ত সমাজ পুড়ছে। গত কিছুদিন ধরে চলা অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পর্যালোচনা, দেশি–বিদেশি পর্যবেক্ষণ আর বিশ্লেষকদের মতামত থেকে এমন চিত্রই উঠে আসছে। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এখন একটি ক্রান্তিকাল পার করছে। এ সময়ে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার অঙ্কে সামান্য ভুল হলেই মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।
এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দেশের সার্বিক অর্থনীতির সূচকগুলো নিয়েই এখন ভাবার বিষয়। সবকিছুই চাপের মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে আমদানি, রপ্তানি, রেমিট্যান্স, কর্মসংস্থান, মূল্যস্ফীতি। রপ্তানি যদি কমে আসে, আর বিশ্বের মূল্যস্ফীতি যদি না কমে তাহলে ডলার সহজলভ্য হবে না। এর রেশ তখন অর্থনীতির বিভিন্ন স্তরে ছড়িয়ে পড়বে।
গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় সরকার মোটাদাগে তিন ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রথমত আমদানি নিয়ন্ত্রণ, টাকাকে অবমূল্যায়িত করা আর কৃচ্ছ্রসাধনসহ নানা কড়াকড়ি। তবে আমি মনে করি, আরও কিছু পদক্ষেপ দরকার। বিশেষ করে ব্যাংকের ঋণ–আমানতের সুদের হার ধরে না রেখে এর সীমা তুলে দিতে হবে। যদিও এসব পদক্ষেপের একটা নেতিবাচক দিকও আছে। এসবের ফলে সার্বিক প্রবৃদ্ধি কমে যাবে।
করোনা সহনীয় হয়ে আসার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্যসহ প্রায় সব পণ্যের অসহনীয় দামের ধাক্কা এসে লেগেছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। ফলে রেকর্ড ঘাটতিতে পড়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। পরিমাণে কম আমদানি করেও এর জন্য আগের চেয়ে অনেক বেশি বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি আয়ের ঘাটতি গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। অঙ্কের হিসাবে তা প্রায় ১ হাজার ৯০০ কোটি ডলার। আমদানি বিল শোধের চাপে চাহিদা বাড়ে ডলারের। ফলে ডলারের দাম বেড়েছে। সরকারি হিসাবেই গত সাত মাসে ডলারপ্রতি টাকার দর কমেছে প্রায় ৯ টাকা। আর খোলাবাজারে সবশেষ গতকালও এক ডলার কিনতে ১১৫ টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়েছে বলে জানা গেছে। গত বছরের আগস্টে যে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল, তা এখন ৩৯-৪০ বিলিয়ন ডলারের বৃত্ত ভেঙে উপড়ে উঠতে পারছে না।
গত মাসে ২০৯ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলেও এর ধারাবাহিকতা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ এর আগের বেশ কয়েক মাস ধরেই রেমিট্যান্স প্রবাহ নিয়মিত কমতির দিকে। একা রপ্তানি আয়ের রেকর্ড প্রবৃদ্ধি হলেও তা ডলারের বিপুল চাহিদাকে কোনোভাবেই বশে আনতে পারেনি।
এমন প্রেক্ষাপটে সরকার দফায় দফায় ডলার রক্ষায় কড়াকড়ি আরোপ করে। বিলাসী পণ্য আমদানি সীমিত করে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয়। যদিও অনেক মন্ত্রণালয় তা থোড়াই কেয়ার করছে। নিষেধাজ্ঞার ফাঁক গলে অনেকেই বিদেশ ঘুরে আসছেন। একইভাবে ডলারের সংশ্লেষ আছে এমন প্রকল্প কাটছাঁটের পাশাপাশি কৃচ্ছ্রসাধনের অংশ হিসেবে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প স্থগিত এবং বরাদ্দ কমানো হয়েছে। তবে কৃচ্ছ্রসাধনের পুরো সুফল দেখা যাচ্ছে না। বরং সরকারি গাড়িতে অপ্রয়োজনে জ্বালানি পোড়ানো হচ্ছে, অফিস কক্ষে কেউ না থাকলেও এসি চালানো হচ্ছে। ফলে সরকার কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বললেও, নজরদারির অভাবে এর সুফল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গত কয়েক মাসে জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক দাম সাধারণ মানুষকে চরম ভোগান্তির মধ্যে ফেলেছে। ভোজ্যতেলের দাম যখন রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে তখন থেকেই মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ শুরু হয়। বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম কমতে থাকলেও দেশের বাজারে এখনো এর রেশ কাটেনি। চাল, ডাল, চিনি, পেঁয়াজ, শাকসবজিসহ এমন কোনো পণ্য নেই যার দাম বাড়েনি। সীমিত আয়ের মানুষ যখন এর সঙ্গে টিকে থাকার লড়াই করছে, তখনই ঘাটতির কথা বলে আকস্মিক এক নোটিশে জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড বাড়ানো হয়েছে। যে বৃদ্ধি নিয়ে সর্বত্র এখনো আলোচনা হচ্ছে। প্রায় ৫১ শতাংশ বেড়েছে জ্বালানি তেলের দাম। এতে অর্থনীতির প্রায় সব খাতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
বেড়েছে পরিবহন ভাড়া। আরেক দফা আগুন লাগতে শুরু করেছে সব ধরনের নিত্যপণ্যের বাজারে। সাধারণ মানুষ হতাশ। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, আয়ের চেয়ে ব্যয় অস্বাভাবিক বাড়লে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গিয়ে ক্রমেই তারা দরিদ্র হয়। দারিদ্র্য নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদন বলছে, জিনিসপত্রের দাম বাড়লে দরিদ্র হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে প্রায় ৫৫ শতাংশ মানুষ। অর্থনীতিতে আকস্মিক চাপ বা নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম দারিদ্র্যসীমার একটু ওপরে থাকা পরিবারকে দরিদ্র করে ফেলতে পারে। বিবিএসের সর্বশেষ জনশুমারি অনুযায়ী, বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ৯ কোটির বেশি মানুষ এমন ঝুঁকিতে পড়তে পারে।
মূল্যস্ফীতি এমনিতেই বাড়তির দিকে। তার সঙ্গে নতুন করে জ্বালানির দাম মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে প্রকাশিত বিবিএসের হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, জুলাই মাসে ‘পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে’ সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশে পৌঁছায়। অর্থাৎ গত বছরের জুলাই মাসে দেশের মানুষ যে পণ্য বা সেবা ১০০ টাকায় পেয়েছিলেন, এ বছর জুলাই মাসে তা কিনতে ১০৭ টাকা ৪৮ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। সরকার যদিও বলছে, এ হার আগের মাসের চেয়ে কমেছে। জুনে তা ছিল ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। তবে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার পূর্বাভাস বলছে, সামনের দিনে মূল্যস্ফীতির পারদ আরও ওপরে উঠবে।
রপ্তানিকারকেরা জানান, বিদ্যুতের লোডশেডিং বাড়ায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অর্ডার ধরে রাখতে গিয়ে ডিজেলে বিকল্প উপায়ে কারখানা চালু রাখতে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। ব্যাংক রেটের চেয়ে অনেক বেশিতে ডলার কিনে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করতে গিয়েও তাঁরা হিমশিম খাচ্ছেন। তা ছাড়া বিশ্বমন্দার ঝুঁকির কারণে এরই মধ্যে ক্রেতারা পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যের অর্ডার কমিয়ে দিচ্ছে। নতুন করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় মারাত্মক উদ্বেগে আছেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা।
দেশের নিট পোশাক রপ্তানি খাতের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ডলারের কারণে আমদানি-রপ্তানির লেনদেনে একটা বড় পার্থক্য তৈরি হয়েছে। ব্যাংকগুলো সুযোগ নিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে, আমদানি ঠিকমতো না হলে, উৎপাদনে প্রভাব পড়বে। তখন এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বাজারে। আর সবকিছুই মূল্যস্ফীতি উসকে দেবে।
করোনার কারণে এমনিতেই সার্বিক অর্থনীতির গতি মন্থর। গত দুই অর্থবছর ধরে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আয় হচ্ছে না। একদিন আগেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জানিয়েছে, গত অর্থবছরে তারা প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকার কম রাজস্ব আয় করতে পেরেছে। অর্থাৎ বাজেট বাস্তবায়নের জন্য যে রাজস্ব আয় করার কথা তা হচ্ছে না। চলতি বাজেটও আকারে বিশাল। রাজস্ব আয়ের ধারায় উন্নতির লক্ষণ নতুন অর্থবছরেও নেই।
ফলে ভবিষ্যতের জন্য আইএমএফসহ বিভিন্ন উৎস থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। এরই মধ্যে আইএমএফের কাছ থেকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাঠানো হয়েছে। সাধারণত আইএমএফ ঋণের অন্যতম শর্ত হচ্ছে ভর্তুকি কমানো। ঋণ নিয়ে এখনো আলোচনা শুরু না হলেও সরকার জ্বালানি ও সারে ভর্তুকি কমানো শুরু করেছে। যদিও সরকার বলছে, এ ভর্তুকি কমানোর সঙ্গে আইএমএফের শর্তের কোনো সংশ্লেষ নেই। কিন্তু ভর্তুকি কমানোর অংশ হিসেবেই জ্বালানির দাম রেকর্ড পরিমাণে বাড়ানো হয়েছে। বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এটিই এখন অর্থনীতির সর্বস্তরে নেতিবাচক প্রভাবের উপলক্ষ হয়ে উঠছে।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৪ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৪ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৪ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৪ দিন আগে