পাভেল পার্থ
প্রতি সেকেন্ডে দুনিয়ায় প্রায় ২৫ হাজার কাপ চা খায় মানুষ। কিন্তু চায়ের নিদারুণ রক্ত-আখ্যান জানা আছে কতজনের? দীর্ঘ ঔপনিবেশিকতা আর কাঠামোগত বৈষম্যের কারাগারে বন্দী চা-শ্রমিকের রক্ত-ঘামই কি আমাদের পেয়ালায় চা হিসেবে টগবগ করে ওঠে?
এই সাহস কি আছে তিনটি কুঁড়ি একটি পাতার? নাকি নয়া উদারবাদী ব্যবস্থায় এসব যন্ত্রণা আর প্রতিরোধী ক্ষরণ প্রশ্নহীনভাবে আড়াল করেই রাখা হয়? ২১ মে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় চা দিবস। ২০০৫ সালে চা-উৎপাদনকারী দেশগুলো এক হয়ে চা দিবস পালন করে। ২০১৯ সালের ২১ মে বিশ্ব চা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয় এবং ২০২০ সালে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে চা দিবস শুরু করে। আর আমাদের দেশে জাতীয় চা দিবস আজ, ৪ জুন। এ বছর তৃতীয়বারের মতো পালিত হচ্ছে দিবসটি।
অবশ্যই বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এই পানীয় নিয়ে একটি দিন থাকা জরুরি। পাশাপাশি এই চায়ের উৎপাদনে কী ধরনের ঔপনিবেশিকতা ও বৈষম্য এখনো জারি আছে, তা-ও আলাপচারিতায় আসা দরকার। জানেন, ১৯২১ সালের ২০ মে কী ঘটেছিল? বাংলাদেশের চা-শ্রমিকের রক্তে লাল হয়েছিল মেঘনা। কত জীবন গেছে—সেই খতিয়ান কারও কাছে নেই, কিন্তু তরতর করে দুনিয়ায় দীর্ঘ হয়েছে চা-বাণিজ্যের মুনাফা। কয়েক বছর ধরে মূলত বাংলাদেশের চা-বাগানে দিনটি স্মরণে ‘চা-শ্রমিক দিবস’ বা ‘চা-শ্রমিক হত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে।
ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনী বাহাদুরিগুলো প্রায় একই কায়দার রয়ে গেছে। যে পানীয় পানে ‘ক্লান্তি’ দূর হয়, সেই চা চাষে নিযুক্ত শ্রমিকের ক্লান্তি নিয়ে প্রশ্ন করার কায়দা এখনো তৈরি হয়নি। কারণ রাষ্ট্র বা এজেন্সি এ ধরনের প্রশ্ন সহ্য করে না।
বিশ্বব্যাপী যখন ২১ মে চা দিবস পালন করা হচ্ছে, একই সময়ে চলতি আলাপখানি অন্যায়ভাবে মুছে ফেলা চা-শ্রমিক গণহত্যার রক্ত-আখ্যানের খোঁজ করছে।
অরণ্য, পাহাড় থেকে নিম্নবর্গের মানুষ ধরে এনে চা-বাগানের বন্দী শ্রমিক বানানোর কাজটি মূলত সংঘটিত হয়েছে ‘আড়কাঠিদের’ দ্বারা।তারা ব্রিটিশ শাসকের দাস-দালাল হিসেবে কাজ করত। তারাই নানা গ্রামে গ্রামে যেত আর পরিশ্রমী নারী-পুরুষদের বাধ্য করত।
আড়কাঠিদের মাধ্যমেই ব্রিটিশ বণিকেরা চা-বাণিজ্যের ভেতর দিয়ে এক নির্মম ‘দাস-বাণিজ্য’কে বৈধ করে। কমরেড অচিন্ত্য ভট্টাচার্য (১৯৯৫) তাঁর লেখায় জানিয়েছেন, ১৮৬৩-১৮৬৬ সালের ভেতর ব্রিটিশ চা কোম্পানিগুলো জন্মমাটি থেকে জবরদস্তি করে ও মিথ্যা সবক ছড়িয়ে প্রায় ৮৪ হাজার ৯৯৫ জন নারী-পুরুষ সংগ্রহ করে এবং এই সময়কালে তাঁদের ভেতর থেকে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের করুণ মৃত্যু ঘটে। ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিক চা-বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। সাঁওতাল, মুন্ডা, কোল, ভীল, মাহালী, ওঁরাও, খাড়িয়া, কন্দ, মুসহর, রবিদাস, ভূমিজ, উড়িয়া, শীল, নায়েক, রাজপুত, অসমিয়া, ভর, লোহার, ডুকলা, পাইনকা, গঞ্জু, পাল, তাঁতি, বড়াইক, সিং, বাগদী, মাহাতো, তুরী, নিষাদ, দোসাদ, রাজোয়াড়, পাহাড়িয়া, সৌরা-ভিম, মালো, মালী—এ রকম জাতিগত পরিচয় হারিয়ে সবার নাম হয়ে যায় চা-বাগানের ‘কুলি’।
অন্যায়, জুলুম, মজুরিবৈষম্য আর অমানবিক জীবন চাপিয়ে দিয়ে চাঙা হতে থাকা চা-বাণিজ্যকে প্রশ্ন করে গড়ে ওঠে বাগানে বাগানে প্রতিরোধ। ১৯২০ সালে এই প্রতিরোধ বাগান থেকে বাগানে ছড়িয়ে পড়ে। হুল বা সাঁওতাল বিদ্রোহ, উলগুলান বা মুন্ডা বিদ্রোহের প্রতিরোধী চৈতন্য এ ক্ষেত্রে চা-শ্রমিকদের সংগঠিত হতে প্রেরণা জোগায়। চা-বাগানের ভেতর জমে থাকা ক্ষোভ ও দ্রোহ ক্রমে ক্রমে ব্রিটিশ উপনিবেশবিরোধী এক গণরাজনৈতিক আন্দোলন ধারার প্রবাহে মিশে যায়। চা-শ্রমিকেরা সংঘবদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ বেনিয়াদের জুলুমের ঘের ভেঙে নিজেদের জন্মমাটিতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আর চা-বাগানের ইতিহাসে চা-শ্রমিকদের এই অবিস্মরণীয় সংগ্রামী কর্মসূচিটিই ‘মুলুকযাত্রা’ বা ‘মুলুকে চলো’ হিসেবে এক রক্তাক্ত স্মৃতি-বিস্মৃতি হয়ে আছে।
কমরেড অজয় ভট্টাচার্যের ‘অর্ধশতাব্দী আগে গণ-আন্দোলন এ দেশে কেমন ছিল’ বই থেকে ঘটনার বিবরণ কিছুটা উল্লেখ করা যাক।
‘...১৯২১ সালে একটি বাগানের সমস্ত শ্রমিক মিলে মুলুরওনানা হওয়ার দিন-ক্ষণ ঠিক করে। নির্দিষ্ট তারিখে “গান্ধীজি কি জয়’’ বলে রাস্তায় নামে। বর্তমান ভারতের করিমগঞ্জ মহকুমার চরগোলা ভ্যালির এ বাগানটির সঙ্গে যোগ দিতে থাকে অন্যান্য বাগানের শ্রমিকেরা। ছড়িয়ে পড়ে খবর। উপত্যকার বাগানগুলো থেকে হাজার হাজার শ্রমিক বেরিয়ে পড়ে। বাগানের ব্যবস্থাপক ও কর্মচারীরা শ্রমিকদের ঠেকাবার চেষ্টা করে। কিন্তু সফল হয়নি। স্টেশনে পৌঁছালে ট্রেনে উঠতে দেওয়া হয়নি। তাতেও দমেনি শ্রমিকেরা। রেলপথ ধরে হাঁটতে শুরু করে।
পৌঁছে করিমগঞ্জ জংশনে। ইতিমধ্যে আরও অনেক বাগানের শ্রমিকেরা মিলিত হলো স্টেশনে, এখানেও ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।তবু সংকল্পে অটল এরা। নিজ মুলুকে যাবেই। আজীবন গিরমিট প্রথায় আবদ্ধ থাকতে চায় না আর। হাজার হাজার নর-নারী, শিশু-বৃদ্ধ মিলে হাঁটতে থাকে। রেলপথ ধরে হাঁটছেই হাঁটছে। দিন যায়, রাত হয়। আবার দিন। তারও অবসান হয়। কিন্তু আসাম প্রদেশের হাজার হাজার শ্রমিক হাঁটছেই। একদিন পৌঁছে গেল তারা নদীবন্দর চাঁদপুরে। আর যে এগোনো যায় না। সামনে বিশাল নদী পথ রোধ করে আছে।
আটকা পড়ে তারা। এদিকে সরকার শ্রমিকদের পথ রোধ করতে চাঁদপুরে মোতায়েন করেছে গুর্খা সৈন্য। আসাম রাইফেলসের গুর্খা দল ঘেরাও করে শ্রমিকদের। আটক শ্রমিকেরা গুর্খা সৈন্যদের ঘেরাওয়ের মধ্যে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে কালাতিপাত করতে থাকে। খাদ্য, ওষুধ, পানীয় প্রভৃতির অভাব। আশ্রয়ও নেই কারও। এ অবস্থায়ও অপেক্ষা করছে পদ্মা পারাপারের। কিন্তু তাদের পার করবে না কেউ। রয়েছে সরকারি নিষেধাজ্ঞা। এ ধরনের বীভৎস ঘটনা প্রত্যক্ষ করেনি কেউ কোনো দিন। শিউরে ওঠে চাঁদপুরবাসী। কিন্তু ঠেকাবার সাধ্য নেই কারও। এদিকে যে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে শ্রমিকদের বহন করতে অস্বীকৃত হয়েছিল, সেই রেলশ্রমিকদের হৃদয় এবার বিদীর্ণ। ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে তারা। প্রতিবাদে রেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ ঘটনায় কংগ্রেস ও খিলাফত প্রতিবাদের ডাক দেয়। বিশাল সমাবেশ ও মিছিল হয়।
এতে সরকার ও চা কোম্পানিগুলোর নিন্দা করে বক্তৃতা করেন মহাত্মা গান্ধী, মৌলানা মোহাম্মদ আলী, মৌলানা শওকত আলী।’ এ সময় বরাখাই, মনিমারখাল, বড়জালেঙ্গা, বাগবাহার, লোহারবন্দ, পালরবন্দ, লালা, লালামুখ চা-বাগানগুলো ধর্মঘটের ডাক দেয়। সিলেট-কাছাড় চা-বাগান মজদুর ইউনিয়ন এ ধর্মঘট পরিচালনা করে। শ্রমিকেরা হেঁটেই রওনা দেন। সাত হাজারেরও বেশি শ্রমিককে যাত্রাপথেই প্রাণ দিতে হয়। শ্রমিকেরা বর্তমান বাংলাদেশের চাঁদপুরে পৌঁছালে তিন হাজার শ্রমিককে চাঁদপুর রেলস্টেশনে আটক করা হয়। ব্রিটিশ সরকার গুর্খা সৈন্যদের নির্দেশ দেয়। নির্বিচার গুলিতে শহীদ হন হাজার হাজার শ্রমিক। নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে চাঁদপুরে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়।
ঝাড়ু দেওয়ার জন্য সরকারি অফিসে কোনো লোক পাওয়া যায়নি। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ ও নেত্রকোনার উকিলরা কাজ বন্ধ রেখে প্রতিবাদ জানান। বরিশাল, সিলেট ও ঢাকায় বিক্ষোভ প্রতিবাদ হয়। এক শ বছর ধরে চা-শ্রমিক গণহত্যার এই আখ্যান আমরা আড়াল করে রেখেছি। আজ চা দিবস নিয়ে আমাদের কত আয়োজন, কিন্তু আমরা বারবার ২০ মের সেই নিদারুণ ক্ষত বিস্মৃত হচ্ছি।
কেবল চা দিবস উদ্যাপন নয়, যাদের বঞ্চনার দামে আমাদের পেয়ালায় উপচে পড়ে গরম রক্ত, সেই চা-শ্রমিকদের ইতিহাস ও ভাষ্য অবশ্যই আমাদের চায়ের আলাপে যুক্ত হওয়া জরুরি। এখনো কয়েক টাকা মজুরি বাড়ানোর জন্য অনাহারী থেকে আন্দোলন করেন চা-শ্রমিকেরা। এখনো চা-বাগানে বাসস্থান, পানীয় জল কিংবা পয়োনিষ্কাশন নিশ্চিত হয়নি। এখনো দূষিত পানি পান করে ডায়রিয়া আক্রান্ত হন তাঁরা। দেশের সবচেয়ে বেশি কুষ্ঠ রোগী চা-বাগানে, কারণ এক বিঘত জায়গায় গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগির সঙ্গে পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকতে হয়। এখনো বাগানমালিক চাইলে যেকোনো সময় যেকোনো চা-বাগান বন্ধ করে দেন। এভাবে বারবার বন্ধের কারণে না খেয়ে মারা যান জুড়ির রতনা চা-বাগানের ৩০ জন শ্রমিক।
এখনো চা-বাগানগুলোতে মনস্যান্টোর রাউন্ড আপসহ নানা বিপজ্জনক রাসায়নিক বিষ ব্যবহার করা হয়, যার ধকল সারা জীবন সইতে হয় বহু মানুষকে। চাঁদপুর-বেগমখানের মতো চা-বাগানের শ্রমিকদের কৃষিজমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের প্রকল্প গৃহীত হয় এখনো।
কয়েক লাখ স্থায়ী চা-শ্রমিকসহ চা-বাগানিয়াদের সংখ্যা দশ লাখের বেশি। দেশের অর্থনীতি, খাদ্যব্যবস্থা কিংবা উন্নয়নের ভিত জাগিয়ে রাখা এই বঞ্চিত মানুষদের কথা রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। চলতি আলাপ ১৯২১ সালের চা-শ্রমিক গণহত্যাকে রাষ্ট্রীয় ইতিহাসে দলিলায়নের ভেতর দিয়ে স্বীকৃতির আহ্বান জানায় এবং চা-শ্রমিকদের ওপর ঐতিহাসিকভাবে চাপিয়ে রাখা সব বঞ্চনা ও নিপীড়নের অবসান চায়, ন্যায়বিচার দাবি করে।
প্রতি সেকেন্ডে দুনিয়ায় প্রায় ২৫ হাজার কাপ চা খায় মানুষ। কিন্তু চায়ের নিদারুণ রক্ত-আখ্যান জানা আছে কতজনের? দীর্ঘ ঔপনিবেশিকতা আর কাঠামোগত বৈষম্যের কারাগারে বন্দী চা-শ্রমিকের রক্ত-ঘামই কি আমাদের পেয়ালায় চা হিসেবে টগবগ করে ওঠে?
এই সাহস কি আছে তিনটি কুঁড়ি একটি পাতার? নাকি নয়া উদারবাদী ব্যবস্থায় এসব যন্ত্রণা আর প্রতিরোধী ক্ষরণ প্রশ্নহীনভাবে আড়াল করেই রাখা হয়? ২১ মে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় চা দিবস। ২০০৫ সালে চা-উৎপাদনকারী দেশগুলো এক হয়ে চা দিবস পালন করে। ২০১৯ সালের ২১ মে বিশ্ব চা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয় এবং ২০২০ সালে জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে চা দিবস শুরু করে। আর আমাদের দেশে জাতীয় চা দিবস আজ, ৪ জুন। এ বছর তৃতীয়বারের মতো পালিত হচ্ছে দিবসটি।
অবশ্যই বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় এই পানীয় নিয়ে একটি দিন থাকা জরুরি। পাশাপাশি এই চায়ের উৎপাদনে কী ধরনের ঔপনিবেশিকতা ও বৈষম্য এখনো জারি আছে, তা-ও আলাপচারিতায় আসা দরকার। জানেন, ১৯২১ সালের ২০ মে কী ঘটেছিল? বাংলাদেশের চা-শ্রমিকের রক্তে লাল হয়েছিল মেঘনা। কত জীবন গেছে—সেই খতিয়ান কারও কাছে নেই, কিন্তু তরতর করে দুনিয়ায় দীর্ঘ হয়েছে চা-বাণিজ্যের মুনাফা। কয়েক বছর ধরে মূলত বাংলাদেশের চা-বাগানে দিনটি স্মরণে ‘চা-শ্রমিক দিবস’ বা ‘চা-শ্রমিক হত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে।
ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশে বিজ্ঞাপনী বাহাদুরিগুলো প্রায় একই কায়দার রয়ে গেছে। যে পানীয় পানে ‘ক্লান্তি’ দূর হয়, সেই চা চাষে নিযুক্ত শ্রমিকের ক্লান্তি নিয়ে প্রশ্ন করার কায়দা এখনো তৈরি হয়নি। কারণ রাষ্ট্র বা এজেন্সি এ ধরনের প্রশ্ন সহ্য করে না।
বিশ্বব্যাপী যখন ২১ মে চা দিবস পালন করা হচ্ছে, একই সময়ে চলতি আলাপখানি অন্যায়ভাবে মুছে ফেলা চা-শ্রমিক গণহত্যার রক্ত-আখ্যানের খোঁজ করছে।
অরণ্য, পাহাড় থেকে নিম্নবর্গের মানুষ ধরে এনে চা-বাগানের বন্দী শ্রমিক বানানোর কাজটি মূলত সংঘটিত হয়েছে ‘আড়কাঠিদের’ দ্বারা।তারা ব্রিটিশ শাসকের দাস-দালাল হিসেবে কাজ করত। তারাই নানা গ্রামে গ্রামে যেত আর পরিশ্রমী নারী-পুরুষদের বাধ্য করত।
আড়কাঠিদের মাধ্যমেই ব্রিটিশ বণিকেরা চা-বাণিজ্যের ভেতর দিয়ে এক নির্মম ‘দাস-বাণিজ্য’কে বৈধ করে। কমরেড অচিন্ত্য ভট্টাচার্য (১৯৯৫) তাঁর লেখায় জানিয়েছেন, ১৮৬৩-১৮৬৬ সালের ভেতর ব্রিটিশ চা কোম্পানিগুলো জন্মমাটি থেকে জবরদস্তি করে ও মিথ্যা সবক ছড়িয়ে প্রায় ৮৪ হাজার ৯৯৫ জন নারী-পুরুষ সংগ্রহ করে এবং এই সময়কালে তাঁদের ভেতর থেকে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের করুণ মৃত্যু ঘটে। ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিক চা-বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। সাঁওতাল, মুন্ডা, কোল, ভীল, মাহালী, ওঁরাও, খাড়িয়া, কন্দ, মুসহর, রবিদাস, ভূমিজ, উড়িয়া, শীল, নায়েক, রাজপুত, অসমিয়া, ভর, লোহার, ডুকলা, পাইনকা, গঞ্জু, পাল, তাঁতি, বড়াইক, সিং, বাগদী, মাহাতো, তুরী, নিষাদ, দোসাদ, রাজোয়াড়, পাহাড়িয়া, সৌরা-ভিম, মালো, মালী—এ রকম জাতিগত পরিচয় হারিয়ে সবার নাম হয়ে যায় চা-বাগানের ‘কুলি’।
অন্যায়, জুলুম, মজুরিবৈষম্য আর অমানবিক জীবন চাপিয়ে দিয়ে চাঙা হতে থাকা চা-বাণিজ্যকে প্রশ্ন করে গড়ে ওঠে বাগানে বাগানে প্রতিরোধ। ১৯২০ সালে এই প্রতিরোধ বাগান থেকে বাগানে ছড়িয়ে পড়ে। হুল বা সাঁওতাল বিদ্রোহ, উলগুলান বা মুন্ডা বিদ্রোহের প্রতিরোধী চৈতন্য এ ক্ষেত্রে চা-শ্রমিকদের সংগঠিত হতে প্রেরণা জোগায়। চা-বাগানের ভেতর জমে থাকা ক্ষোভ ও দ্রোহ ক্রমে ক্রমে ব্রিটিশ উপনিবেশবিরোধী এক গণরাজনৈতিক আন্দোলন ধারার প্রবাহে মিশে যায়। চা-শ্রমিকেরা সংঘবদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ বেনিয়াদের জুলুমের ঘের ভেঙে নিজেদের জন্মমাটিতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আর চা-বাগানের ইতিহাসে চা-শ্রমিকদের এই অবিস্মরণীয় সংগ্রামী কর্মসূচিটিই ‘মুলুকযাত্রা’ বা ‘মুলুকে চলো’ হিসেবে এক রক্তাক্ত স্মৃতি-বিস্মৃতি হয়ে আছে।
কমরেড অজয় ভট্টাচার্যের ‘অর্ধশতাব্দী আগে গণ-আন্দোলন এ দেশে কেমন ছিল’ বই থেকে ঘটনার বিবরণ কিছুটা উল্লেখ করা যাক।
‘...১৯২১ সালে একটি বাগানের সমস্ত শ্রমিক মিলে মুলুরওনানা হওয়ার দিন-ক্ষণ ঠিক করে। নির্দিষ্ট তারিখে “গান্ধীজি কি জয়’’ বলে রাস্তায় নামে। বর্তমান ভারতের করিমগঞ্জ মহকুমার চরগোলা ভ্যালির এ বাগানটির সঙ্গে যোগ দিতে থাকে অন্যান্য বাগানের শ্রমিকেরা। ছড়িয়ে পড়ে খবর। উপত্যকার বাগানগুলো থেকে হাজার হাজার শ্রমিক বেরিয়ে পড়ে। বাগানের ব্যবস্থাপক ও কর্মচারীরা শ্রমিকদের ঠেকাবার চেষ্টা করে। কিন্তু সফল হয়নি। স্টেশনে পৌঁছালে ট্রেনে উঠতে দেওয়া হয়নি। তাতেও দমেনি শ্রমিকেরা। রেলপথ ধরে হাঁটতে শুরু করে।
পৌঁছে করিমগঞ্জ জংশনে। ইতিমধ্যে আরও অনেক বাগানের শ্রমিকেরা মিলিত হলো স্টেশনে, এখানেও ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।তবু সংকল্পে অটল এরা। নিজ মুলুকে যাবেই। আজীবন গিরমিট প্রথায় আবদ্ধ থাকতে চায় না আর। হাজার হাজার নর-নারী, শিশু-বৃদ্ধ মিলে হাঁটতে থাকে। রেলপথ ধরে হাঁটছেই হাঁটছে। দিন যায়, রাত হয়। আবার দিন। তারও অবসান হয়। কিন্তু আসাম প্রদেশের হাজার হাজার শ্রমিক হাঁটছেই। একদিন পৌঁছে গেল তারা নদীবন্দর চাঁদপুরে। আর যে এগোনো যায় না। সামনে বিশাল নদী পথ রোধ করে আছে।
আটকা পড়ে তারা। এদিকে সরকার শ্রমিকদের পথ রোধ করতে চাঁদপুরে মোতায়েন করেছে গুর্খা সৈন্য। আসাম রাইফেলসের গুর্খা দল ঘেরাও করে শ্রমিকদের। আটক শ্রমিকেরা গুর্খা সৈন্যদের ঘেরাওয়ের মধ্যে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে কালাতিপাত করতে থাকে। খাদ্য, ওষুধ, পানীয় প্রভৃতির অভাব। আশ্রয়ও নেই কারও। এ অবস্থায়ও অপেক্ষা করছে পদ্মা পারাপারের। কিন্তু তাদের পার করবে না কেউ। রয়েছে সরকারি নিষেধাজ্ঞা। এ ধরনের বীভৎস ঘটনা প্রত্যক্ষ করেনি কেউ কোনো দিন। শিউরে ওঠে চাঁদপুরবাসী। কিন্তু ঠেকাবার সাধ্য নেই কারও। এদিকে যে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে শ্রমিকদের বহন করতে অস্বীকৃত হয়েছিল, সেই রেলশ্রমিকদের হৃদয় এবার বিদীর্ণ। ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে তারা। প্রতিবাদে রেল চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ ঘটনায় কংগ্রেস ও খিলাফত প্রতিবাদের ডাক দেয়। বিশাল সমাবেশ ও মিছিল হয়।
এতে সরকার ও চা কোম্পানিগুলোর নিন্দা করে বক্তৃতা করেন মহাত্মা গান্ধী, মৌলানা মোহাম্মদ আলী, মৌলানা শওকত আলী।’ এ সময় বরাখাই, মনিমারখাল, বড়জালেঙ্গা, বাগবাহার, লোহারবন্দ, পালরবন্দ, লালা, লালামুখ চা-বাগানগুলো ধর্মঘটের ডাক দেয়। সিলেট-কাছাড় চা-বাগান মজদুর ইউনিয়ন এ ধর্মঘট পরিচালনা করে। শ্রমিকেরা হেঁটেই রওনা দেন। সাত হাজারেরও বেশি শ্রমিককে যাত্রাপথেই প্রাণ দিতে হয়। শ্রমিকেরা বর্তমান বাংলাদেশের চাঁদপুরে পৌঁছালে তিন হাজার শ্রমিককে চাঁদপুর রেলস্টেশনে আটক করা হয়। ব্রিটিশ সরকার গুর্খা সৈন্যদের নির্দেশ দেয়। নির্বিচার গুলিতে শহীদ হন হাজার হাজার শ্রমিক। নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে চাঁদপুরে সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়।
ঝাড়ু দেওয়ার জন্য সরকারি অফিসে কোনো লোক পাওয়া যায়নি। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ ও নেত্রকোনার উকিলরা কাজ বন্ধ রেখে প্রতিবাদ জানান। বরিশাল, সিলেট ও ঢাকায় বিক্ষোভ প্রতিবাদ হয়। এক শ বছর ধরে চা-শ্রমিক গণহত্যার এই আখ্যান আমরা আড়াল করে রেখেছি। আজ চা দিবস নিয়ে আমাদের কত আয়োজন, কিন্তু আমরা বারবার ২০ মের সেই নিদারুণ ক্ষত বিস্মৃত হচ্ছি।
কেবল চা দিবস উদ্যাপন নয়, যাদের বঞ্চনার দামে আমাদের পেয়ালায় উপচে পড়ে গরম রক্ত, সেই চা-শ্রমিকদের ইতিহাস ও ভাষ্য অবশ্যই আমাদের চায়ের আলাপে যুক্ত হওয়া জরুরি। এখনো কয়েক টাকা মজুরি বাড়ানোর জন্য অনাহারী থেকে আন্দোলন করেন চা-শ্রমিকেরা। এখনো চা-বাগানে বাসস্থান, পানীয় জল কিংবা পয়োনিষ্কাশন নিশ্চিত হয়নি। এখনো দূষিত পানি পান করে ডায়রিয়া আক্রান্ত হন তাঁরা। দেশের সবচেয়ে বেশি কুষ্ঠ রোগী চা-বাগানে, কারণ এক বিঘত জায়গায় গরু-ছাগল-হাঁস-মুরগির সঙ্গে পরিবার-পরিজন নিয়ে থাকতে হয়। এখনো বাগানমালিক চাইলে যেকোনো সময় যেকোনো চা-বাগান বন্ধ করে দেন। এভাবে বারবার বন্ধের কারণে না খেয়ে মারা যান জুড়ির রতনা চা-বাগানের ৩০ জন শ্রমিক।
এখনো চা-বাগানগুলোতে মনস্যান্টোর রাউন্ড আপসহ নানা বিপজ্জনক রাসায়নিক বিষ ব্যবহার করা হয়, যার ধকল সারা জীবন সইতে হয় বহু মানুষকে। চাঁদপুর-বেগমখানের মতো চা-বাগানের শ্রমিকদের কৃষিজমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের প্রকল্প গৃহীত হয় এখনো।
কয়েক লাখ স্থায়ী চা-শ্রমিকসহ চা-বাগানিয়াদের সংখ্যা দশ লাখের বেশি। দেশের অর্থনীতি, খাদ্যব্যবস্থা কিংবা উন্নয়নের ভিত জাগিয়ে রাখা এই বঞ্চিত মানুষদের কথা রাষ্ট্রকে ভাবতে হবে। চলতি আলাপ ১৯২১ সালের চা-শ্রমিক গণহত্যাকে রাষ্ট্রীয় ইতিহাসে দলিলায়নের ভেতর দিয়ে স্বীকৃতির আহ্বান জানায় এবং চা-শ্রমিকদের ওপর ঐতিহাসিকভাবে চাপিয়ে রাখা সব বঞ্চনা ও নিপীড়নের অবসান চায়, ন্যায়বিচার দাবি করে।
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
২ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
২ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে