১০ কোটি অগ্রিম বিল দিয়েও লঘু দণ্ডে পার

তোফাজ্জল হোসেন রুবেল, ঢাকা
প্রকাশ : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮: ৪৯
আপডেট : ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৯: ০৯

কাজের আগেই ঠিকাদারকে অগ্রিম প্রায় সাড়ে ১০ কোটি টাকা পরিশোধ করার আলোচিত ঘটনায় লঘু দণ্ড দিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীকে বিভাগীয় মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়েছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। রাজধানীতে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটাল সম্প্রসারণ প্রকল্পে বিতর্কিত ঠিকাদার এস এম গোলাম কিবরিয়া ওরফে জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠানকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ পরিশোধ করেছিলেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের শেরেবাংলা নগর ডিভিশনের তখনকার নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফজলুল হক। বর্তমানে তিনি রাজশাহী সার্কেলে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত। তাঁকে বর্তমান বেতন গ্রেডের প্রারম্ভিক ধাপে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে।

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন গত ২৫ জানুয়ারি প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফজলুল হকের বিষয়ে এক অফিস আদেশ জারি করেন। বিভাগীয় মামলাটি দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রেখে সচিব অভিযুক্ত প্রকৌশলীকে বেতন কমানোর মতো লঘু দণ্ড দিয়েছেন। অথচ কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ নির্মাণ প্রকল্পে দরপত্র আহ্বানসংক্রান্ত কাজে অনিয়মের অভিযোগে সংশ্লিষ্ট তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে পদাবনতি দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে পূর্তসচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিনকে পরপর দুই দিন দফায় দফায় ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। এরপর বার্তা পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।

গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, প্রকৌশলী ফজলুল হকের বিষয়ে সচিবের অফিস আদেশে বলা হয়েছে, অগ্রিম বিল পরিশোধের অভিযোগে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে চলমান বিভাগীয় মামলার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাকিলা জেরিন খানকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তা প্রতিবেদনে বলেন, নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতালে কাজের আগেই ১০ কোটি ৪৪ লাখ ৯০ হাজার টাকা ঠিকাদারকে পরিশোধের বিষয়ে প্রকৌশলী ফজলুল হকের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তিনি পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন, ২০০৬ এবং সরকারি ক্রয় বিধিমালা (পিপিআর), ২০০৮-এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে আর্থিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করেছেন। পরবর্তী সময়ে জামানতের টাকা থেকে তা সমন্বয় করে সরকারের বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা মিলেছে।

সচিবের অফিস আদেশে আরও বলা হয়, ফজলুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগটি আর্থিক শৃঙ্খলাজনিত হওয়ায় চাকরি বিধিমালার সংশ্লিষ্ট ধারায় ‘বেতন গ্রেডের নিম্নতর ধাপে অবনতিকরণ বা বর্তমান বেতন গ্রেডের প্রারম্ভিক ধাপে নামিয়ে দেওয়ার শাস্তি দেওয়া হলো।’

মন্ত্রণালয় ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, সংশ্লিষ্ট আইনে এটি মূলত লঘু দণ্ড হিসেবে বিবেচিত।

জানা যায়, জি কে শামীমের মালিকানাধীন জি কে বিল্ডার্স শেরেবাংলা নগরে নিউরোসায়েন্সেস হাসপাতাল সম্প্রসারণ প্রকল্পের কাজ শুরু করেছিল ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর। এ প্রকল্পে ১৬৭ কোটি ৭৩ লাখ ৬৯ হাজার ৬৩৩ টাকা ব্যয়ে ১৫ তলা ভবন নির্মাণের জন্য সময় নির্ধারিত ছিল দুই বছর। এর মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শোর পাইলিংয়ের কাজ শেষ করে মূল ভবনের মাটি কাটার কাজ আংশিক শেষ করেছিল। বেসমেন্টের ম্যাটের প্রায় ৩০ শতাংশ ঢালাই শেষ করে সেখানে ২ ও ৩ নম্বর বেসমেন্টের ছাদ ঢালাই শেষ করা হয়। কিন্তু জি কে শামীম গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁর প্রতিষ্ঠান নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেয়।

ফলে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা কাজটি বাতিল করে কর্তৃপক্ষ। ওই সময় প্রকল্পে ঠিক কতটুকু কাজ সম্পন্ন হয়েছে, তা নিশ্চিত হতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ দেখতে পায়, কাজের মূল্যের চেয়ে প্রায় সাড়ে ১০ কোটি টাকা বেশি পরিশোধ করা হয়েছে জি কে বিল্ডার্সকে।

গণপূর্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, অধিদপ্তরের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. রোকন উদ্দিনের এক চিঠিতে জি কে বিল্ডার্সকে অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করার বিষয়টি উঠে আসে। ঘটনা জানাজানি হলে প্রকৌশলী ফজলুল হককে তাৎক্ষণিকভাবে প্রত্যাহার করা হয়। পরে তিনি নিজ দপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের হাত করে রাজশাহী সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে যান। নতুন দায়িত্ব নিলেও বিভাগীয় মামলার কারণে বেশির ভাগ সময় তিনি ঢাকায় অবস্থান করেন। অবশেষে নামেমাত্র শাস্তি নিয়ে তিনি পার পেয়ে যাচ্ছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকৌশলী মোহাম্মদ ফজলুল হক বলেন, ‘আমার দায়িত্ব পালনকালে যে পরিমাণ টাকা অতিরিক্ত দেওয়া হয়েছিল, তা জামানতের অর্থ থেকে সমন্বয় করা হয়েছে। এরপর আমার আর কোনো দায় থাকার কথা নয়। কিন্তু আমাকে শাস্তি দেওয়া হলো। আমি এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করব।’ জামানতের টাকা এভাবে সমন্বয় করার আইনগত সুযোগ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যাঁরা করেছেন, সব বুঝেশুনে করেছেন।’

গণপূর্ত অধিদপ্তরের কয়েকজন প্রকৌশলী জানান, জামানতের অর্থ থেকে অতিরিক্ত টাকা সমন্বয়ের দাবি করা হলেও বাস্তবে তা করা হয়েছে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জি কে শামীমের ১২ কোটি টাকার কাজ বেশি করা ছিল দেখিয়ে। দুই প্রকল্পের কাজ দুটি ভিন্ন চুক্তিতে এবং ভিন্ন অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল। জি কে শামীমকে দুটি প্রকল্পেই ডিফল্ট দেখানো হয়েছে এবং চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করায় নিয়ম অনুযায়ী দুটি প্রকল্পেই তাঁর পারফরম্যান্স গ্যারান্টি বাতিল করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে টাকা জমা হওয়ার কথা। কিন্তু তা না করে উল্টো তাঁকে ১০ কোটি টাকার বিল পরিশোধ দেখিয়ে তা অন্য প্রকল্পে অতিরিক্ত পরিশোধ করা ১০ কোটি টাকা সমন্বয় করা হয়েছে। এই অনিয়মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী এবং জি কে শামীমের ঘনিষ্ঠ একটি চক্র জড়িত। কারণ, জরিমানা বা পারফরম্যান্স গ্যারান্টি বাতিল করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে টাকা জমা না করে বিল সমন্বয় করা বেআইনি।

ওই প্রকৌশলীরা আরও জানান, জি কে শামীমের একটি প্রকল্পের কাজে অতিরিক্ত পরিশোধ করা বিল যে প্রকল্পের বিল থেকে সমন্বয় করা হয়েছে, সেটি জি কে শামীমের প্রতিষ্ঠান অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে পেয়েছিল। তাই দুটি কাজের হিসাব আলাদা হওয়ায় বিল সমন্বয় করার কোনো সুযোগ নেই।

সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার বলেন, ‘ফজলুল হকের বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে বিভাগীয় মামলা তদন্ত করে করণীয় ঠিক করেছে। এখানে আমাদের কিছু বলার নেই।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

টাঙ্গাইলে দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার

পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে অফিস বানিয়েছেন সন্ত্রাসী নুরু

ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের বিক্ষোভ, জনদুর্ভোগ চরমে

শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ সুরক্ষায় নতুন উদ্যোগ

জাতিকে ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল নির্বাচন উপহার দিতে চাই: নতুন সিইসি

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত