ড. আর এম দেবনাথ
কোটা সংস্কার আন্দোলনের কি পরিসমাপ্তি হলো, নাকি এর জের চলতেই থাকবে? এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। সোমবার যখন এ লেখা লিখছি, তখনো কারফিউ চলছে। অফিস-আদালত, মিল-ফ্যাক্টরি বন্ধ। রেল চলাচল স্থগিত। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত। ইন্টারনেট যোগাযোগ বন্ধ থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি বিঘ্নিত। হোটেল, রেস্তোরাঁ, পর্যটন, পরিবহন ব্যবসা, তৈরি পোশাক কারখানা, অর্থনীতির অনানুষ্ঠানিক (ইনফরমাল) খাত অচল, বন্ধ। এককথায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে অন্য কোথায় কী হলো, তা যেমন একটি বিবেচ্য বিষয়, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে অর্থনীতি। অর্থনীতি বিধ্বস্ত। দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ শত শত নয়, হাজার হাজার কোটি টাকা।
এমনিতেই আমরা যাচ্ছি এক দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে। প্রথমেই চীনাগত করোনা মহামারি, এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের কাহিল করে ফেলেছে। সর্বত্র মন্দা, বিশ্বে মন্দা, আমাদেরও মন্দা। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হ্রাসমান। আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায় স্থবিরতা। রেমিট্যান্স আসছে কম। ডলারের উচ্চমূল্য। আমদানিনির্ভর অর্থনীতি। অতএব সব পণ্যের মূল্যই ঊর্ধ্বগতি। কোটা সংস্কার বা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, তারপর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, পুলিশের গুলি, পুলিশকে গুলি, মৃত্যু, জ্বালাও-পোড়াও, বিটিভিসহ অসংখ্য সরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ, কারফিউ—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি অস্বস্তির, অস্থির।
আমরা জানি না এর শেষ কোথায়? যদিও আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দাবির ভিত্তিতে সম্মানজনক একটি রায় দিয়েছেন। ৫৬ শতাংশ কোটার পরিবর্তে তা হবে এখন মাত্র ৭ শতাংশ। ৯৩ শতাংশ চাকরি হবে মেধার ভিত্তিতে। এই রায়ের পরও পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক না হলে তা হবে দুঃখজনক। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস চলছে; অর্থাৎ অর্থবছরের শুরুটাই হলো খারাপ, অস্বাভাবিক। গত অর্থবছরের ৫ দশমিক ৮২ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের তুলনায় এবারের জন্য তা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হার প্রাক্কলিত ৬ দশমিক ৫ শতাংশে। কিন্তু বাজার এখন দ্বিগুণ চড়া। এক অনিশ্চয়তার মধ্যেই শুরু ২০২৪-২৫ অর্থবছর।
অনিশ্চয়তার মূলে কী? আমি করোনা মহামারি বা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বলছি না। বলছি, এই মুহূর্তের অনিশ্চয়তার কারণ কী? দৃশ্যত কোটা সংস্কার আন্দোলন, যাকে শিক্ষার্থীরা মেধা বনাম কোটা আন্দোলন বলেও আখ্যায়িত করছেন। আবার দেখলাম কেউ কেউ একে বলছেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। কী সে বৈষম্য? কী সে কোটা? সরকারি চাকরিতে। তাহলে কী দাঁড়াল? মূল বিষয়টি তাহলে চাকরি নয় কি? অর্থাৎ কর্মসংস্থান। চাকরি চাই। বেকারত্ব চাই না। দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চাই। এই তো মূলকথা। এর চেয়ে ন্যায্য দাবি আর কী হতে পারে, যেখানে আমাদের সংবিধান অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের নিশ্চয়তা দিয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসব কখন সম্ভব? সম্ভব ক্রয়ক্ষমতা থাকলে। ক্রয়ক্ষমতা আসবে রোজগার থেকে। রোজগার হবে স্বকর্মসংস্থান থেকে, নয়তো সরকারি চাকরি থেকে, নয়তো বেসরকারি কর্মসংস্থান থেকে। এ কথা আমরা সবাই জানি, আমাদের কর্মসংস্থানের সিংহভাগ জোগান দেয় অনানুষ্ঠানিক খাত বা ইনফরমাল সেক্টর। এর অর্থ বেসরকারি উৎসেই আমাদের কর্মসংস্থান সবচেয়ে বেশি। কৃষি, কুটিরশিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সঙ্গে আছে স্বোপার্জিত খাত। সরকারি চাকরি সামান্য, তুলনামূলকভাবে কিছুই না। সব মিলিয়ে বড়জোর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হবে ১৫-১৮ লাখ। ১৭-১৮ কোটি লোকের দেশে এই সংখ্যা কিছুই না। কার্যত দুই-এক বছর পরপর কিছু চাকরির ব্যবস্থা হয়। তা–ও হাজারে হাজারে, লাখে লাখে নয়। সীমিতসংখ্যক পদে। দেখা যাচ্ছে এই সামান্য কয়টা চাকরির জন্য মেধার ভিত্তিতে ঢুকতে লাখ লাখ শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছে। এ বিষয়টিই আমি বুঝতে অক্ষম। তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটাই হয়ে পড়েছে চাকরিমুখী? অথচ তা কিন্তু এই বাজার অর্থনীতির যুগে হওয়ার কথা এন্টারপ্রাইজমুখী। নিজেরা করে খাবে। কারণ, বাজার অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতই এক নম্বর। মেধা, যোগ্যতা, পরিশ্রম, দক্ষতা, প্রতিযোগিতার মধ্যে যে কেউ তার রোজগারের পথ বেছে নেবে। হবে সেলফ এমপ্লয়েড। শুধু সেলফ এমপ্লয়েড নয়, তারা অন্যদেরও চাকরির সুযোগ করে দেবে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে। ধনীদের জন্য শ্রম না দিয়ে নিজেই শ্রম ও মেধা দ্বারা ধনী হবে এবং এটাই এখন ভীষণ দরকার।
একই সঙ্গে দরকার সাধারণ শিক্ষার বদলে কারিগরি শিক্ষার। দরকার কর্মমুখী শিক্ষার। তৈরি পোশাকশিল্পের বিভিন্ন প্রযুক্তিমূলক কাজ, মোবাইল মেরামত, মোটর মেকানিক, গাড়ি মেরামত, অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা, গ্রাফিকস, ফ্যাশনমূলক কাজ, সূচিকর্ম ইত্যাদি লোকের অভাব। গ্লাস ওয়ার্কার, দক্ষ কাঠমিস্ত্রি, ওয়েলডার, বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি, দক্ষ চালক ইত্যাদির অভাব বাজারে। বিপণনের লোক নেই, হিসাবরক্ষণের লোক নেই। ডায়িং, মার্চেন্ডাইজিংয়ের লোক নেই। ব্যবসায়ীরা, তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকেরা এসব কর্মী বিদেশ থেকে আনেন। ভীষণ অভাব এসবের। কাগজে দেখি, বিদেশে বেশির ভাগ লোক কারিগরি শিক্ষা নেন। জার্মানিতে ৭৩, জাপানে ৬৫, অস্ট্রেলিয়ায় ৬০, চীনে ৫৫ শতাংশ যুবক-যুবতী কারিগরি শিক্ষা পান।
আর আমাদের দেশে? আমাদের দেশে মাত্র ৪৫ শতাংশ। আমরা দেখছি, আমাদের দেশে শুধু সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হচ্ছে। হরেদরে বিবিএ, এমবিএ দেওয়া হচ্ছে। এমএ, এমকম, এমএসসিতে বাজার ভরপুর। তাঁরা চাকরি না পেয়ে ঘুরঘুর করছেন। তদবির করে বেড়াচ্ছেন। সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, সচিবদের পেছনে ঘুরছেন একটা চাকরির জন্য। যেকোনো মূল্যে। তাঁরা প্রশ্নপত্র ফাঁস করতে প্রস্তুত। বাজারে গুজব, সব চাকরিতে ঘুষ দিতে হয়। কোটার চাকরিতে নয় কি? অসম্ভব ব্যাপার। সবাই পাগল সরকারি চাকরির জন্য। যেসব গ্র্যাজুয়েট বেরোচ্ছেন, তার বিরাট অংশই না জানে বাংলা, না জানে অঙ্ক, না জানে ইংরেজি। এসব খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়। সবারই নজর সরকারি চাকরিতে। এর একটা কারণও আছে। সরকারি চাকরি এখন আগের চেয়ে অনেক লোভনীয়। আগে বেসরকারি খাতের চাকরি ছিল লোভনীয়। বেতন-ভাতার সুযোগ-সুবিধা সেখানে বেশি ছিল। সরকারি চাকরিতে ছিল কম। গত কয়েক বছরে সরকারি চাকরি হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজার চাকরি। বেতন-ভাতা অনেক, বোনাস অনেক, গাড়ির ভাতা অনেক। গৃহনির্মাণ ঋণের সুদ কম। আয়েশের চাকরি। এরপর পেনশন-আজীবন, তারপর ছেলেমেয়ে। দফায় দফায় পদোন্নতি, চাকরি যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। মফস্বলের চাকরিতে অফিসে না গেলেও চলে। বিপরীতে বেসরকারি চাকরিতে ঝুট-ঝামেলা অনেক বেশি। যখন-তখন চাকরি যায়, বেতন বাড়ে না, পদোন্নতি হয় না। টেনশনের পর টেনশন।
এ অবস্থায় যুবসমাজ, তরুণসমাজ, বিএ-এমএ-এমবিএ সমাজ এখন সরকারি চাকরিমুখী। অবস্থাটা এমন যে ডাক্তার, প্রকৌশলী পর্যন্ত এখন যার যার কর্মভূমি ছেড়ে বিসিএস সাধারণ ক্যাডারে যোগ দিচ্ছে। ৪০তম বিসিএস সাধারণ পরীক্ষায় নেওয়া হয় ৫৭৪ জন। তাঁদের মধ্যে ১৫৩ জন প্রকৌশলী, ডাক্তার ২৩ জন। ৪১তম বিসিএস সাধারণ ক্যাডারে নেওয়া হয় ৮১৬ জন। তাঁদের মধ্যে ১৯৫ জন প্রকৌশলী, ১৮ জন ডাক্তার। একই অবস্থা ৪৩তম বিসিএসের। এসব খবর জুন মাসের ২২ তারিখের একটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এসব খবরের অর্থ কী?
কী কারণে প্রকৌশলী, ডাক্তাররা নিজ নিজ পেশা ছেড়ে বিসিএস সাধারণ ক্যাডারে আসছেন? কী মধু এখানে? এসব খুঁজে বের করা দরকার। সরকারি যেনতেন চাকরিও কেন এত আকর্ষণীয় হয়ে উঠল? কেন লাখ লাখ ছেলেমেয়ে দিনের পর দিন রাস্তায় আন্দোলন করছেন সরকারি চাকরিতে ঢোকার জন্য? এখানে যে চাকরির সুযোগ কম, এটা জেনেও তাঁরা ওই চাকরির জন্য কেন জান দিচ্ছেন?
অথচ আমরা সরকারি চাকরিরতদের কাছ থেকে মুহূর্তে কী ধরনের সেবা পাচ্ছি, তা সবাই জানি। কোনো সরকারি কাজই বিনা মূল্যে পাওয়া যায় না। এসবের কোনো ব্যাখ্যাও পাই না। বর্তমানে যারা সরকারি কাজে নিয়োজিত, তাঁদের কয়জন মেধায় ঢুকেছেন, কয়জন কোটায় ঢুকেছে—তা কেউ জানি না। কিন্তু জানি, কোনো সেবা আমরা বিনা মূল্যে পাই না। কীভাবে বুঝব, কে কে বেআইনি কাজ করছে? এসবেরই প্রতিকার দরকার। মেধায়ই হোক আর কোটাতেই হোক, সরকারি চাকরিতে যেন আর বেনজীর আহমেদ আমরা না পাই। কে এই ভরসা দেবে?
লেখক: সাবেক শিক্ষক, ঢাবি; অর্থনীতি বিশ্লেষক
কোটা সংস্কার আন্দোলনের কি পরিসমাপ্তি হলো, নাকি এর জের চলতেই থাকবে? এই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই। সোমবার যখন এ লেখা লিখছি, তখনো কারফিউ চলছে। অফিস-আদালত, মিল-ফ্যাক্টরি বন্ধ। রেল চলাচল স্থগিত। সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সরবরাহ চেইন বিঘ্নিত। ইন্টারনেট যোগাযোগ বন্ধ থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি বিঘ্নিত। হোটেল, রেস্তোরাঁ, পর্যটন, পরিবহন ব্যবসা, তৈরি পোশাক কারখানা, অর্থনীতির অনানুষ্ঠানিক (ইনফরমাল) খাত অচল, বন্ধ। এককথায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে অন্য কোথায় কী হলো, তা যেমন একটি বিবেচ্য বিষয়, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে অর্থনীতি। অর্থনীতি বিধ্বস্ত। দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ শত শত নয়, হাজার হাজার কোটি টাকা।
এমনিতেই আমরা যাচ্ছি এক দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে। প্রথমেই চীনাগত করোনা মহামারি, এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের কাহিল করে ফেলেছে। সর্বত্র মন্দা, বিশ্বে মন্দা, আমাদেরও মন্দা। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হ্রাসমান। আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায় স্থবিরতা। রেমিট্যান্স আসছে কম। ডলারের উচ্চমূল্য। আমদানিনির্ভর অর্থনীতি। অতএব সব পণ্যের মূল্যই ঊর্ধ্বগতি। কোটা সংস্কার বা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, তারপর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, পুলিশের গুলি, পুলিশকে গুলি, মৃত্যু, জ্বালাও-পোড়াও, বিটিভিসহ অসংখ্য সরকারি স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ, কারফিউ—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি অস্বস্তির, অস্থির।
আমরা জানি না এর শেষ কোথায়? যদিও আমাদের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দাবির ভিত্তিতে সম্মানজনক একটি রায় দিয়েছেন। ৫৬ শতাংশ কোটার পরিবর্তে তা হবে এখন মাত্র ৭ শতাংশ। ৯৩ শতাংশ চাকরি হবে মেধার ভিত্তিতে। এই রায়ের পরও পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক না হলে তা হবে দুঃখজনক। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম মাস চলছে; অর্থাৎ অর্থবছরের শুরুটাই হলো খারাপ, অস্বাভাবিক। গত অর্থবছরের ৫ দশমিক ৮২ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের তুলনায় এবারের জন্য তা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হার প্রাক্কলিত ৬ দশমিক ৫ শতাংশে। কিন্তু বাজার এখন দ্বিগুণ চড়া। এক অনিশ্চয়তার মধ্যেই শুরু ২০২৪-২৫ অর্থবছর।
অনিশ্চয়তার মূলে কী? আমি করোনা মহামারি বা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বলছি না। বলছি, এই মুহূর্তের অনিশ্চয়তার কারণ কী? দৃশ্যত কোটা সংস্কার আন্দোলন, যাকে শিক্ষার্থীরা মেধা বনাম কোটা আন্দোলন বলেও আখ্যায়িত করছেন। আবার দেখলাম কেউ কেউ একে বলছেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। কী সে বৈষম্য? কী সে কোটা? সরকারি চাকরিতে। তাহলে কী দাঁড়াল? মূল বিষয়টি তাহলে চাকরি নয় কি? অর্থাৎ কর্মসংস্থান। চাকরি চাই। বেকারত্ব চাই না। দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চাই। এই তো মূলকথা। এর চেয়ে ন্যায্য দাবি আর কী হতে পারে, যেখানে আমাদের সংবিধান অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের নিশ্চয়তা দিয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এসব কখন সম্ভব? সম্ভব ক্রয়ক্ষমতা থাকলে। ক্রয়ক্ষমতা আসবে রোজগার থেকে। রোজগার হবে স্বকর্মসংস্থান থেকে, নয়তো সরকারি চাকরি থেকে, নয়তো বেসরকারি কর্মসংস্থান থেকে। এ কথা আমরা সবাই জানি, আমাদের কর্মসংস্থানের সিংহভাগ জোগান দেয় অনানুষ্ঠানিক খাত বা ইনফরমাল সেক্টর। এর অর্থ বেসরকারি উৎসেই আমাদের কর্মসংস্থান সবচেয়ে বেশি। কৃষি, কুটিরশিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সঙ্গে আছে স্বোপার্জিত খাত। সরকারি চাকরি সামান্য, তুলনামূলকভাবে কিছুই না। সব মিলিয়ে বড়জোর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী হবে ১৫-১৮ লাখ। ১৭-১৮ কোটি লোকের দেশে এই সংখ্যা কিছুই না। কার্যত দুই-এক বছর পরপর কিছু চাকরির ব্যবস্থা হয়। তা–ও হাজারে হাজারে, লাখে লাখে নয়। সীমিতসংখ্যক পদে। দেখা যাচ্ছে এই সামান্য কয়টা চাকরির জন্য মেধার ভিত্তিতে ঢুকতে লাখ লাখ শিক্ষার্থী রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছে। এ বিষয়টিই আমি বুঝতে অক্ষম। তাহলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটাই হয়ে পড়েছে চাকরিমুখী? অথচ তা কিন্তু এই বাজার অর্থনীতির যুগে হওয়ার কথা এন্টারপ্রাইজমুখী। নিজেরা করে খাবে। কারণ, বাজার অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতই এক নম্বর। মেধা, যোগ্যতা, পরিশ্রম, দক্ষতা, প্রতিযোগিতার মধ্যে যে কেউ তার রোজগারের পথ বেছে নেবে। হবে সেলফ এমপ্লয়েড। শুধু সেলফ এমপ্লয়েড নয়, তারা অন্যদেরও চাকরির সুযোগ করে দেবে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে। ধনীদের জন্য শ্রম না দিয়ে নিজেই শ্রম ও মেধা দ্বারা ধনী হবে এবং এটাই এখন ভীষণ দরকার।
একই সঙ্গে দরকার সাধারণ শিক্ষার বদলে কারিগরি শিক্ষার। দরকার কর্মমুখী শিক্ষার। তৈরি পোশাকশিল্পের বিভিন্ন প্রযুক্তিমূলক কাজ, মোবাইল মেরামত, মোটর মেকানিক, গাড়ি মেরামত, অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা, গ্রাফিকস, ফ্যাশনমূলক কাজ, সূচিকর্ম ইত্যাদি লোকের অভাব। গ্লাস ওয়ার্কার, দক্ষ কাঠমিস্ত্রি, ওয়েলডার, বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি, দক্ষ চালক ইত্যাদির অভাব বাজারে। বিপণনের লোক নেই, হিসাবরক্ষণের লোক নেই। ডায়িং, মার্চেন্ডাইজিংয়ের লোক নেই। ব্যবসায়ীরা, তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকেরা এসব কর্মী বিদেশ থেকে আনেন। ভীষণ অভাব এসবের। কাগজে দেখি, বিদেশে বেশির ভাগ লোক কারিগরি শিক্ষা নেন। জার্মানিতে ৭৩, জাপানে ৬৫, অস্ট্রেলিয়ায় ৬০, চীনে ৫৫ শতাংশ যুবক-যুবতী কারিগরি শিক্ষা পান।
আর আমাদের দেশে? আমাদের দেশে মাত্র ৪৫ শতাংশ। আমরা দেখছি, আমাদের দেশে শুধু সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হচ্ছে। হরেদরে বিবিএ, এমবিএ দেওয়া হচ্ছে। এমএ, এমকম, এমএসসিতে বাজার ভরপুর। তাঁরা চাকরি না পেয়ে ঘুরঘুর করছেন। তদবির করে বেড়াচ্ছেন। সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, সচিবদের পেছনে ঘুরছেন একটা চাকরির জন্য। যেকোনো মূল্যে। তাঁরা প্রশ্নপত্র ফাঁস করতে প্রস্তুত। বাজারে গুজব, সব চাকরিতে ঘুষ দিতে হয়। কোটার চাকরিতে নয় কি? অসম্ভব ব্যাপার। সবাই পাগল সরকারি চাকরির জন্য। যেসব গ্র্যাজুয়েট বেরোচ্ছেন, তার বিরাট অংশই না জানে বাংলা, না জানে অঙ্ক, না জানে ইংরেজি। এসব খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়। সবারই নজর সরকারি চাকরিতে। এর একটা কারণও আছে। সরকারি চাকরি এখন আগের চেয়ে অনেক লোভনীয়। আগে বেসরকারি খাতের চাকরি ছিল লোভনীয়। বেতন-ভাতার সুযোগ-সুবিধা সেখানে বেশি ছিল। সরকারি চাকরিতে ছিল কম। গত কয়েক বছরে সরকারি চাকরি হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজার চাকরি। বেতন-ভাতা অনেক, বোনাস অনেক, গাড়ির ভাতা অনেক। গৃহনির্মাণ ঋণের সুদ কম। আয়েশের চাকরি। এরপর পেনশন-আজীবন, তারপর ছেলেমেয়ে। দফায় দফায় পদোন্নতি, চাকরি যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। মফস্বলের চাকরিতে অফিসে না গেলেও চলে। বিপরীতে বেসরকারি চাকরিতে ঝুট-ঝামেলা অনেক বেশি। যখন-তখন চাকরি যায়, বেতন বাড়ে না, পদোন্নতি হয় না। টেনশনের পর টেনশন।
এ অবস্থায় যুবসমাজ, তরুণসমাজ, বিএ-এমএ-এমবিএ সমাজ এখন সরকারি চাকরিমুখী। অবস্থাটা এমন যে ডাক্তার, প্রকৌশলী পর্যন্ত এখন যার যার কর্মভূমি ছেড়ে বিসিএস সাধারণ ক্যাডারে যোগ দিচ্ছে। ৪০তম বিসিএস সাধারণ পরীক্ষায় নেওয়া হয় ৫৭৪ জন। তাঁদের মধ্যে ১৫৩ জন প্রকৌশলী, ডাক্তার ২৩ জন। ৪১তম বিসিএস সাধারণ ক্যাডারে নেওয়া হয় ৮১৬ জন। তাঁদের মধ্যে ১৯৫ জন প্রকৌশলী, ১৮ জন ডাক্তার। একই অবস্থা ৪৩তম বিসিএসের। এসব খবর জুন মাসের ২২ তারিখের একটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। এসব খবরের অর্থ কী?
কী কারণে প্রকৌশলী, ডাক্তাররা নিজ নিজ পেশা ছেড়ে বিসিএস সাধারণ ক্যাডারে আসছেন? কী মধু এখানে? এসব খুঁজে বের করা দরকার। সরকারি যেনতেন চাকরিও কেন এত আকর্ষণীয় হয়ে উঠল? কেন লাখ লাখ ছেলেমেয়ে দিনের পর দিন রাস্তায় আন্দোলন করছেন সরকারি চাকরিতে ঢোকার জন্য? এখানে যে চাকরির সুযোগ কম, এটা জেনেও তাঁরা ওই চাকরির জন্য কেন জান দিচ্ছেন?
অথচ আমরা সরকারি চাকরিরতদের কাছ থেকে মুহূর্তে কী ধরনের সেবা পাচ্ছি, তা সবাই জানি। কোনো সরকারি কাজই বিনা মূল্যে পাওয়া যায় না। এসবের কোনো ব্যাখ্যাও পাই না। বর্তমানে যারা সরকারি কাজে নিয়োজিত, তাঁদের কয়জন মেধায় ঢুকেছেন, কয়জন কোটায় ঢুকেছে—তা কেউ জানি না। কিন্তু জানি, কোনো সেবা আমরা বিনা মূল্যে পাই না। কীভাবে বুঝব, কে কে বেআইনি কাজ করছে? এসবেরই প্রতিকার দরকার। মেধায়ই হোক আর কোটাতেই হোক, সরকারি চাকরিতে যেন আর বেনজীর আহমেদ আমরা না পাই। কে এই ভরসা দেবে?
লেখক: সাবেক শিক্ষক, ঢাবি; অর্থনীতি বিশ্লেষক
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে