কাঠগড়ায় রাজউক-ফায়ার

শাহরিয়ার হাসান, ঢাকা
প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৪, ০৮: ০৫

রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল আবাসিক ভবন হিসেবে। কিন্তু সেটি বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমোদন দেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। কোনো ধরনের অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা ছাড়াই ভবনটির ফ্লোরে ফ্লোরে এত খাবারের দোকান ও রেস্তোরাঁয় গ্যাস সিলিন্ডার-চুলা ব্যবহৃত হলেও শুধু নোটিশ দিয়েই দায় সেরেছে ফায়ার সার্ভিস। এ কারণে সরকারি এই দুই সংস্থাও আগুনে এত মানুষের মৃত্যুর দায় এড়াতে পারে না বলে মনে করে বিশেষজ্ঞ, পুলিশ, ব্যবসায়ীসহ অনেকেই।

পুড়ে যাওয়া ভবনটির সামনে গতকাল শনিবারও ভিড় করেছে উৎসুক মানুষেরা। আগুন লাগার কারণ নিয়ে নানা কথা বলছিলেন তাঁরা। সবার কথার একই সুর। ঘটনাস্থল দেখতে আসা ব্যক্তিরা বলেন, ৪৬ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে ভবনমালিক ও সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর অবহেলাতেই। এ জন্য সুনির্দিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা উচিত।

গ্রিন কোজি কটেজে আগুনে পুড়ে মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল সকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা থানায় একটি মামলা হয়েছে। পুলিশ বাদী হয়ে করা সেই মামলার এজাহারেও বলা হয়, ভবনের মালিক, ম্যানেজার ও রেস্তোরাঁর মালিক—কেউই ভবন ব্যবহারের নিয়ম মানেননি। আবাসিক ভবনকে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য ভাড়া দেওয়া হয়েছে। রাজউকের দোকান পরিদর্শকদের ম্যানেজ করে অবৈধভাবে রেস্তোরাঁ স্থাপন, গ্যাসের চুলা ও সিলিন্ডার ব্যবহার করা হচ্ছিল সেখানে।

গতকাল পুলিশ, রাজউক, ফায়ার সার্ভিসের আলাদা আলাদা তদন্ত দল বেইলি রোডের ওই ভবনটি পরিদর্শন করেছে। তদন্ত দলের সদস্যরা ঘণ্টাখানেক সেখানে ঘোরাফেরা করেন। তবে কী দেখলেন তা গণমাধ্যমের সামনে বলতে রাজি হননি।

তবে ৪৬ জনের প্রাণহানির জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আমিন হেলালীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ওই ভবনটি পরিদর্শন করেছে। পরিদর্শন শেষে আমিন হেলালী বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের জন্য কেবল একতরফাভাবে ব্যবসায়ীদের দায়ী করলে হবে না। এ এলাকা দেখার জন্য রেগুলেটর প্রতিষ্ঠানের অনেক ইন্সপেক্টর (পরিদর্শক) আছে, তারা কী করেছে? আমি মনে করি, তাদের গাফিলতি আছে।’

এদিকে ফায়ার সার্ভিসের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)-এর সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান। গতকাল ‘বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ড এবং ভবনে জীবনের নিরাপত্তা: বিআইপির পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাবনা’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ভবনটিতে কার্যকর কোনো অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা এবং অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা ছিল না। এই দুর্ঘটনার আগে ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে ভবন কর্তৃপক্ষকে তিনবার নোটিশ দিয়েই দায় সারে ফায়ার সার্ভিস।

প্রায় একই অভিযোগ তুলেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেনও। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার মনে হয়, গণপূর্ত ও রাজউককে আরও সজাগ হওয়া উচিত। সাধারণ একটা ভুলের জন্য ৪৬টা প্রাণ চলে গেল।’

প্রিয় শিক্ষক প্রাণ হারিয়েছেন যেখানে, সেই ভবনটি দেখতে এসেছিলেন ভিকারুনিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী মাইশা আক্তার। আজকের পত্রিকাকে তিনি বলেন, এত এত পরিদর্শনকারী আছে, তারা এই ভবনটিতে কীভাবে ব্যবসা করার সুযোগ দিল? ওই ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনলে ধীরে ধীরে এসব ঘটনা কমে আসবে।

ভবনের ম্যানেজার গ্রেপ্তার
গত বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ নামের ভবনটিতে লাগা আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় আগুনের উৎপত্তিস্থল চুমুক ফাস্ট ফুডের মালিক আনোয়ারুল হক, ভবনটির স্বত্বাধিকারী আমিন মোহাম্মাদ গ্রুপ, ম্যানেজার মুন্সি হামিমুল আলম বিপুল, তৃতীয় তলায় থাকা কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টের মালিক সোহেল সিরাজকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অবহেলা, অসাবধানতা, বেপরোয়া ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ কাজের কারণে হত্যার অভিযোগ আনা হয়। মামলার পরপরই ভবনটির ম্যানেজার মুন্সি হামিমুল আলস বিপুলকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায় পুলিশ। আদালত তিনিসহ শুক্রবার গ্রেপ্তার করা চুমুক ও কাচ্চি ভাইয়ের তিন কর্মচারীর দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

আহত ৫ জন এখনো ‘শঙ্কামুক্ত নয়
ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে আহত ১১ জনের মধ্যে ৬ জনকে চিকিৎসা শেষে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁরা এখন সুস্থ রয়েছেন। তবে চিকিৎসাধীন ৫ জন এখনো শঙ্কামুক্ত নন। গতকাল সকালে আহত রোগীদের দেখার পর সাংবাদিকদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বার্ন ইনস্টিটিউটে বেলা পর্যন্ত ১১ জন আহত রোগী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ৫ জন হাসপাতালেই থাকবেন, কারণ তাঁরা এখনো কেউ শঙ্কামুক্ত নন। তাঁদের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে, একটু কমপ্লিকেশন আছে। যার জন্য আমরা তাদের রেখে দিয়েছি। তাদেরকে আরও কয়েক দিন পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব কী করা যায়।’ 

৪৪ লাশ বুঝে নিল পরিবার
বেইলি রোডের ভবনের অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৪৬ জনের মধ্যে পরিচয় নিশ্চিত হয়ে ৪৪ জনের মরদেহ বুঝে নিয়েছে তাঁদের পরিবার। সর্বশেষ গতকাল সন্ধ্যায় কে এম মিনহাজ উদ্দিনের (২৬) মরদেহ শনাক্ত করে তাঁর পরিবার। এ সময় মিনহাজের বড় ভাই আমিনুল ইসলাম খান মরদেহটি বুঝে নেন। রমনা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. হাবিবুর রহমান বলেন, মিনহাজের পরিবার ঘড়ি ও পেটের অপারেশনের দাগ দেখে মরদেহ শনাক্ত করেছিল। তবে ডিএনএর অপেক্ষায় অশনাক্ত অবস্থায় মর্গে এখনো দুটো মরদেহ পড়ে আছে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত