ড. মইনুল ইসলাম
৮ জানুয়ারি একটি ইংরেজি দৈনিকের বিজনেস শাখার প্রথম পৃষ্ঠার শিরোনাম: ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্টস্ আন্ডার স্ট্রেস’, মানে ‘দেশের লেনদেনের ভারসাম্য চাপের মুখে’। ২০২২ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর—এই পাঁচ মাসে ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের ‘ওভার-অল ঘাটতি’ এর আগের বছরের ওই পাঁচ মাসের ঘাটতি ২ দশমিক ০২৩ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৬ দশমিক ৩৮৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। আরও বিস্ময়কর হলো, ওই খবর অনুযায়ী ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট বহু বছর পর এই পাঁচ মাসে নেতিবাচক প্রবাহ দেখাচ্ছে। ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের এমন একটি কম্পোনেন্ট, যার মধ্যে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং পোর্টফোলিও বিনিয়োগ অন্তর্ভুক্ত হয়।
২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর পর্যায়ে ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ৪ দশমিক ৮৩৮ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত ছিল, কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ওখানেই ১৫৭ মিলিয়ন ডলার ঘাটতি সৃষ্টি হয়ে গেছে। দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর দাবি করেছেন, গত কুড়ি বছরে তিনি কখনোই ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতি হতে দেখেননি—এবারই প্রথম দেখলেন। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেনও তাঁর কথায় সায় দিয়েছেন। জাহিদ হোসেনের মতে, এই ঘাটতি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে আগামী মাসগুলোতেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ
সংকট অব্যাহত থাকবে।
২০২৩ সালের ৫ জানুয়ারি এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের পাওনা পরিশোধের পর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টের ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে সরকারের হিসাব মোতাবেক ৩২ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। আইএমএফের নির্দেশনা মানলে রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। যে হিসাবই ব্যবহার করা হোক, এক বছর চার মাসে রিজার্ভের এহেন পতনের ধারা অত্যন্ত বিপজ্জনক। তার মানে, বাংলাদেশের অর্থনীতি একটা বড় ধরনের রিজার্ভ-সংকটে পতিত হয়েছে, যেখান থেকে মুক্তি এখনো দৃশ্যমান নয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের চলতি হিসাব বা কারেন্ট অ্যাকাউন্টে অভূতপূর্ব ঘাটতির জন্য প্রধানত আমদানি ব্যয়ের উল্লম্ফনকে দায়ী করা হচ্ছিল। কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে বাংলাদেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টের ঘাটতি ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ কমে ৫ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যার প্রধান কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মোতাবেক ২০২২ সালের জুলাই-নভেম্বর পর্যায়ে দেশের আমদানি ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ বিলিয়ন ডলারে, রপ্তানি আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলারে, আর রেমিট্যান্স প্রবাহ দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু একেবারেই অন্য কারণে ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের ‘ওভার-অল ঘাটতি’ ওই পাঁচ মাসে তিন গুণ বেড়ে ৬ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে, যার জন্য প্রধানত দায়ী প্রাইভেট সেক্টরে বাণিজ্য-ঋণের (ট্রেড ক্রেডিট) উল্লম্ফন এবং বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ও পোর্টফোলিও বিনিয়োগের পতন। ট্রেড-ক্রেডিটের ঘাটতি এই পাঁচ মাসে চার গুণ বেড়ে ২ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে।
দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত প্রাইভেট সেক্টরের বৈদেশিক ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারে, যার মধ্যে ১১ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার হলো স্বল্পমেয়াদি ট্রেড-ক্রেডিট। জাহিদ হোসেনের মতে, দুটো বিষয় ট্রেড ক্রেডিটকে বাড়িয়ে দিচ্ছে: প্রথমত, রপ্তানির শিপমেন্ট হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও হয়তো রপ্তানি আয় এসে পৌঁছায়নি, আর দ্বিতীয়ত, হয়তো ‘স্বল্পমেয়াদি বায়ার্স ক্রেডিট’ পরিশোধ করা হয়েছে অথচ নতুন ঋণ না আসায় অর্থের বহির্গমন বেড়ে যাচ্ছে। আহসান মনসুর বলছেন, ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের ওপর চাপ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা হয়তো সন্ত্রস্ত হয়ে এ দেশ থেকে বিনিয়োগের অর্থ ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এটা নিশ্চিতভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। সরকারকে প্রদত্ত ঋণের অর্থছাড়ও ইদানীং কমে গেছে। সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ জানাচ্ছে, ২০২২ সালের নভেম্বর মাসের ঋণের অর্থছাড় ২০২১ সালের নভেম্বরের ৩ দশমিক শূন্য ১ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ২০ শতাংশ কমে ২ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে।
ওপরের অনুচ্ছেদে প্রাইভেট সেক্টরের বৈদেশিক ঋণের অভূতপূর্ব যে ২৫ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারের স্ফীতি উল্লেখ করা হলো তার দায় নিঃসন্দেহে বর্তমান অর্থমন্ত্রীর ওপরেই বর্তাবে। বিশেষত, ১১ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারের স্বল্পমেয়াদি ট্রেড-ক্রেডিট পুঞ্জীভূত হওয়ার যে কাহিনি উদ্ঘাটিত হলো, তার জন্য অর্থমন্ত্রীর অস্বাভাবিক রকমের ব্যবসায়ীপ্রীতিকেই দায়ী করতে হবে। এসব ঋণ আদায়ে তাঁর অদক্ষতা এবং অব্যবস্থাপনাকেও দোষারোপ করতে হবে। ব্যাংকিং সিস্টেমের খেলাপি ঋণের দ্রুত উল্লম্ফনের জন্যও অর্থমন্ত্রীর ভুল নীতিগুলোই দায়ী। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি, দেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ইতিমধ্যেই ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে; অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্লাসিফায়েড লোনের সর্বশেষ হিসাব বলছে, মাত্র ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা নাকি ক্লাসিফায়েড লোন। এই ভুয়া তথ্য দিয়ে অর্থমন্ত্রী খেলাপি ঋণ সমস্যাকে কার্পেটের তলায় লুকিয়ে ফেলার সুব্যবস্থা করলেও তাঁর মন্ত্রিত্বের চার বছর মেয়াদে তিনি কত কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায় করতে পেরেছেন, সে হিসাবটা প্রকাশ করার জন্য তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি। অর্থমন্ত্রীর প্রবর্তিত নিয়ম মোতাবেক মাত্র ২ শতাংশ খেলাপি ঋণ জমা দিয়ে ১০ বছরের জন্য যদি রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিরা খেলাপির তালিকা থেকে নিজেদের নাম উধাও করে দিতে পারেন, তাহলে কোন আহাম্মক খেলাপি ঋণ ফেরত দিতে যাবে?
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে, তার জন্য প্রধানত অর্থমন্ত্রীর অদক্ষতা ও গাফিলতিই দায়ী। দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচার এখন অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সংকট। ২০২২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সরকারের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) বরাত দিয়ে পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে যে শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বর্তমানে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে আমদানির ওভার ইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনার মতো মূল সমস্যাগুলো যোগ করলে দেখা যাবে, প্রতিবছর এখন কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। এর মানে বাংলাদেশ থেকে বছরে কমপক্ষে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি এখন বিদেশে পাচার হয়ে চলেছে, যার অর্ধেকের মতো পাচার হচ্ছে হুন্ডি প্রক্রিয়ার বেলাগাম বিস্তারের মাধ্যমে।
আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যে টালমাটাল অবস্থার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, এর জন্য প্রধানত দায়ী পুঁজি পাচার-প্রক্রিয়া। তাই পুঁজি পাচারকে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের প্রধান অগ্রাধিকারে নিয়ে আসতেই হবে। সরকারকে মেনে নিতেই হবে যে পুঁজি পাচার বর্তমান পর্যায়ে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। অর্থমন্ত্রী কি আদৌ তা করছেন? এবারের বাজেটে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনতে চাইলে মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে তা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্তু খবর নিয়ে জানা যাচ্ছে, গত ছয় মাসে কেউ এই সুবিধা নেয়নি। (বর্তমান বাজেটে অর্থমন্ত্রী মহোদয় পাচার করা অর্থ ফেরত আনার জন্য যে ‘টোটকা দাওয়াই’-এর প্রস্তাব করেছেন, সেগুলোকে আমি দেশের জনগণের সঙ্গে ‘মশকরা’ আখ্যায়িত করেছি। আমি বলেছি, তিনি পুরো ব্যাপারটাকে লঘু করার জন্য এই প্রহসনমূলক পদক্ষেপ নিয়েছেন। বছর শেষে দেখা যাবে ফলাফল শূন্য)।
২০২৩ সালের ৭ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কেউ এই সুবিধা না নিলে সরকারের কিছুই করার নেই, বাজেট বানানোর সময় তিনি নাকি এই খাত থেকে কোনো অর্থ আসবে বলে হিসাবে ধরেননি। দায় অস্বীকার করার কী অভিনব প্রয়াস! গত এক বছরে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার বৈদেশিক মান প্রায় ২৪ শতাংশ অবচয়নের শিকার হয়েছে। এশিয়ার বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর তুলনায় এই অবচয়ন সর্বোচ্চ।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারাকে থামাতে না পারলে ডলারের কার্ব মার্কেটের দামের উল্লম্ফন এবং টাকার বৈদেশিক মানের দ্রুত অবচয়নকে থামানো যাবে না। আর এ জন্য প্রয়োজন পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে সরকারের বিশ্বাসযোগ্য, কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা। সময় থাকতে কঠোরভাবে পুঁজি পাচার দমন করুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। অর্থনীতির বর্তমান সংকট সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিচ্ছেন না, কোনো কার্যকর পদক্ষেপও নিচ্ছেন না। আহসান মনসুর বর্তমান অর্থমন্ত্রীকে ‘এবসেন্ট ফিন্যান্স মিনিস্টার’ আখ্যায়িত করেছেন। দেশের জনগণের মধ্যে একটা সাধারণ ধারণা গড়ে উঠেছে যে বর্তমান অর্থমন্ত্রী চলমান অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট দক্ষ নন। অতএব অবিলম্বে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনুন, কালক্ষেপণ সংকটকে শুধুই দীর্ঘস্থায়ী করবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
৮ জানুয়ারি একটি ইংরেজি দৈনিকের বিজনেস শাখার প্রথম পৃষ্ঠার শিরোনাম: ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্টস্ আন্ডার স্ট্রেস’, মানে ‘দেশের লেনদেনের ভারসাম্য চাপের মুখে’। ২০২২ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর—এই পাঁচ মাসে ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের ‘ওভার-অল ঘাটতি’ এর আগের বছরের ওই পাঁচ মাসের ঘাটতি ২ দশমিক ০২৩ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৬ দশমিক ৩৮৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে, যা খুবই উদ্বেগজনক। আরও বিস্ময়কর হলো, ওই খবর অনুযায়ী ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট বহু বছর পর এই পাঁচ মাসে নেতিবাচক প্রবাহ দেখাচ্ছে। ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের এমন একটি কম্পোনেন্ট, যার মধ্যে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং পোর্টফোলিও বিনিয়োগ অন্তর্ভুক্ত হয়।
২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর পর্যায়ে ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ৪ দশমিক ৮৩৮ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত ছিল, কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে ওখানেই ১৫৭ মিলিয়ন ডলার ঘাটতি সৃষ্টি হয়ে গেছে। দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর দাবি করেছেন, গত কুড়ি বছরে তিনি কখনোই ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে ঘাটতি হতে দেখেননি—এবারই প্রথম দেখলেন। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট জাহিদ হোসেনও তাঁর কথায় সায় দিয়েছেন। জাহিদ হোসেনের মতে, এই ঘাটতি সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে যে আগামী মাসগুলোতেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ
সংকট অব্যাহত থাকবে।
২০২৩ সালের ৫ জানুয়ারি এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের পাওনা পরিশোধের পর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টের ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে সরকারের হিসাব মোতাবেক ৩২ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। আইএমএফের নির্দেশনা মানলে রিজার্ভ ২৪ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার। যে হিসাবই ব্যবহার করা হোক, এক বছর চার মাসে রিজার্ভের এহেন পতনের ধারা অত্যন্ত বিপজ্জনক। তার মানে, বাংলাদেশের অর্থনীতি একটা বড় ধরনের রিজার্ভ-সংকটে পতিত হয়েছে, যেখান থেকে মুক্তি এখনো দৃশ্যমান নয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের চলতি হিসাব বা কারেন্ট অ্যাকাউন্টে অভূতপূর্ব ঘাটতির জন্য প্রধানত আমদানি ব্যয়ের উল্লম্ফনকে দায়ী করা হচ্ছিল। কিন্তু ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে বাংলাদেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টের ঘাটতি ৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ কমে ৫ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যার প্রধান কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের আমদানি নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মোতাবেক ২০২২ সালের জুলাই-নভেম্বর পর্যায়ে দেশের আমদানি ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ বিলিয়ন ডলারে, রপ্তানি আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলারে, আর রেমিট্যান্স প্রবাহ দাঁড়িয়েছে ৮ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু একেবারেই অন্য কারণে ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের ‘ওভার-অল ঘাটতি’ ওই পাঁচ মাসে তিন গুণ বেড়ে ৬ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে, যার জন্য প্রধানত দায়ী প্রাইভেট সেক্টরে বাণিজ্য-ঋণের (ট্রেড ক্রেডিট) উল্লম্ফন এবং বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ও পোর্টফোলিও বিনিয়োগের পতন। ট্রেড-ক্রেডিটের ঘাটতি এই পাঁচ মাসে চার গুণ বেড়ে ২ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে।
দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত প্রাইভেট সেক্টরের বৈদেশিক ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারে, যার মধ্যে ১১ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলার হলো স্বল্পমেয়াদি ট্রেড-ক্রেডিট। জাহিদ হোসেনের মতে, দুটো বিষয় ট্রেড ক্রেডিটকে বাড়িয়ে দিচ্ছে: প্রথমত, রপ্তানির শিপমেন্ট হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও হয়তো রপ্তানি আয় এসে পৌঁছায়নি, আর দ্বিতীয়ত, হয়তো ‘স্বল্পমেয়াদি বায়ার্স ক্রেডিট’ পরিশোধ করা হয়েছে অথচ নতুন ঋণ না আসায় অর্থের বহির্গমন বেড়ে যাচ্ছে। আহসান মনসুর বলছেন, ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের ওপর চাপ বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীরা হয়তো সন্ত্রস্ত হয়ে এ দেশ থেকে বিনিয়োগের অর্থ ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এটা নিশ্চিতভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না। সরকারকে প্রদত্ত ঋণের অর্থছাড়ও ইদানীং কমে গেছে। সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ জানাচ্ছে, ২০২২ সালের নভেম্বর মাসের ঋণের অর্থছাড় ২০২১ সালের নভেম্বরের ৩ দশমিক শূন্য ১ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় ২০ শতাংশ কমে ২ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে।
ওপরের অনুচ্ছেদে প্রাইভেট সেক্টরের বৈদেশিক ঋণের অভূতপূর্ব যে ২৫ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারের স্ফীতি উল্লেখ করা হলো তার দায় নিঃসন্দেহে বর্তমান অর্থমন্ত্রীর ওপরেই বর্তাবে। বিশেষত, ১১ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারের স্বল্পমেয়াদি ট্রেড-ক্রেডিট পুঞ্জীভূত হওয়ার যে কাহিনি উদ্ঘাটিত হলো, তার জন্য অর্থমন্ত্রীর অস্বাভাবিক রকমের ব্যবসায়ীপ্রীতিকেই দায়ী করতে হবে। এসব ঋণ আদায়ে তাঁর অদক্ষতা এবং অব্যবস্থাপনাকেও দোষারোপ করতে হবে। ব্যাংকিং সিস্টেমের খেলাপি ঋণের দ্রুত উল্লম্ফনের জন্যও অর্থমন্ত্রীর ভুল নীতিগুলোই দায়ী। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি, দেশের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ইতিমধ্যেই ৪ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে; অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্লাসিফায়েড লোনের সর্বশেষ হিসাব বলছে, মাত্র ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা নাকি ক্লাসিফায়েড লোন। এই ভুয়া তথ্য দিয়ে অর্থমন্ত্রী খেলাপি ঋণ সমস্যাকে কার্পেটের তলায় লুকিয়ে ফেলার সুব্যবস্থা করলেও তাঁর মন্ত্রিত্বের চার বছর মেয়াদে তিনি কত কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায় করতে পেরেছেন, সে হিসাবটা প্রকাশ করার জন্য তাঁকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি। অর্থমন্ত্রীর প্রবর্তিত নিয়ম মোতাবেক মাত্র ২ শতাংশ খেলাপি ঋণ জমা দিয়ে ১০ বছরের জন্য যদি রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিরা খেলাপির তালিকা থেকে নিজেদের নাম উধাও করে দিতে পারেন, তাহলে কোন আহাম্মক খেলাপি ঋণ ফেরত দিতে যাবে?
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে, তার জন্য প্রধানত অর্থমন্ত্রীর অদক্ষতা ও গাফিলতিই দায়ী। দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচার এখন অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সংকট। ২০২২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সরকারের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) বরাত দিয়ে পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে যে শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বর্তমানে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে আমদানির ওভার ইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনার মতো মূল সমস্যাগুলো যোগ করলে দেখা যাবে, প্রতিবছর এখন কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। এর মানে বাংলাদেশ থেকে বছরে কমপক্ষে ১৫-১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি এখন বিদেশে পাচার হয়ে চলেছে, যার অর্ধেকের মতো পাচার হচ্ছে হুন্ডি প্রক্রিয়ার বেলাগাম বিস্তারের মাধ্যমে।
আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলছি, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যে টালমাটাল অবস্থার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, এর জন্য প্রধানত দায়ী পুঁজি পাচার-প্রক্রিয়া। তাই পুঁজি পাচারকে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের প্রধান অগ্রাধিকারে নিয়ে আসতেই হবে। সরকারকে মেনে নিতেই হবে যে পুঁজি পাচার বর্তমান পর্যায়ে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। অর্থমন্ত্রী কি আদৌ তা করছেন? এবারের বাজেটে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনতে চাইলে মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে তা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কিন্তু খবর নিয়ে জানা যাচ্ছে, গত ছয় মাসে কেউ এই সুবিধা নেয়নি। (বর্তমান বাজেটে অর্থমন্ত্রী মহোদয় পাচার করা অর্থ ফেরত আনার জন্য যে ‘টোটকা দাওয়াই’-এর প্রস্তাব করেছেন, সেগুলোকে আমি দেশের জনগণের সঙ্গে ‘মশকরা’ আখ্যায়িত করেছি। আমি বলেছি, তিনি পুরো ব্যাপারটাকে লঘু করার জন্য এই প্রহসনমূলক পদক্ষেপ নিয়েছেন। বছর শেষে দেখা যাবে ফলাফল শূন্য)।
২০২৩ সালের ৭ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী বলেছেন, কেউ এই সুবিধা না নিলে সরকারের কিছুই করার নেই, বাজেট বানানোর সময় তিনি নাকি এই খাত থেকে কোনো অর্থ আসবে বলে হিসাবে ধরেননি। দায় অস্বীকার করার কী অভিনব প্রয়াস! গত এক বছরে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার বৈদেশিক মান প্রায় ২৪ শতাংশ অবচয়নের শিকার হয়েছে। এশিয়ার বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর তুলনায় এই অবচয়ন সর্বোচ্চ।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারাকে থামাতে না পারলে ডলারের কার্ব মার্কেটের দামের উল্লম্ফন এবং টাকার বৈদেশিক মানের দ্রুত অবচয়নকে থামানো যাবে না। আর এ জন্য প্রয়োজন পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে সরকারের বিশ্বাসযোগ্য, কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা। সময় থাকতে কঠোরভাবে পুঁজি পাচার দমন করুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। অর্থনীতির বর্তমান সংকট সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিচ্ছেন না, কোনো কার্যকর পদক্ষেপও নিচ্ছেন না। আহসান মনসুর বর্তমান অর্থমন্ত্রীকে ‘এবসেন্ট ফিন্যান্স মিনিস্টার’ আখ্যায়িত করেছেন। দেশের জনগণের মধ্যে একটা সাধারণ ধারণা গড়ে উঠেছে যে বর্তমান অর্থমন্ত্রী চলমান অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট দক্ষ নন। অতএব অবিলম্বে অর্থ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনুন, কালক্ষেপণ সংকটকে শুধুই দীর্ঘস্থায়ী করবে।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে