স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন: পাস হওয়ার আগেই বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা

রাশেদ রাব্বি, ঢাকা
প্রকাশ : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০: ৩৫

সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত কোনো স্বাস্থ্যকর্মী নির্ধারিত অফিস সময়ে অন্য কোথাও সেবা দিলে এক লাখ টাকা জরিমানা। কোনো স্বাস্থ্যকর্মীকে হুমকি দিলে বা আঘাত করলে অথবা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করলে তিন লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি দুই বছরের দণ্ডও হতে পারে। বেসরকারি হাসপাতালের নিবন্ধন পেতে প্রত্যেক রোগীর জন্য রাখতে হবে কমপক্ষে ৮০ বর্গফুট জায়গা। আইন অমান্য করলে প্রয়োজনে তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করা যাবে বেসরকারি হাসপাতাল। এমন সব বিধান রেখে প্রণয়ন করা হয়েছে ‘স্বাস্থ্য সেবা ও সুরক্ষা আইন, ২০২২’-এর খসড়া। এরই মধ্যে খসড়াটি চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার-কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সচিব আমার কাছে ফাইল পাঠিয়েছেন। আমি সেটি দেখেছি। এখন এটি আইন মন্ত্রণালয়ে যাবে ভেটিংয়ে। সেখান থেকে আবার আমার কাছে আসবে। কোনো পরিবর্তন না থাকলে আমরা ক্যাবিনেটে পাঠাব। ক্যাবিনেটে অনুমোদনের পরে যাবে সংসদে।’ তিনি বলেন, ‘আশা করছি, আগামী সংসদে (অধিবেশনে) এই আইন পাস হবে।’

খসড়ায় রোগীর স্বার্থ সংরক্ষিত হচ্ছে বলে মনে হলেও তা কতটুকু কার্যকর হবে, তা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, শুধু কঠোর আইন হলেই হয় না, দরকার সঠিক বাস্তবায়ন। কেউ কেউ আবার এ বিষয়ে নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তাই দেখছেন না।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল হাসান খান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেক আইন বাস্তবায়িত হয় না প্রয়োগকারী সংস্থার কারণে।’

জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডা. ফয়জুল হাকিম বলেন, ‘আপাতত মনে হচ্ছে, রোগীর স্বার্থেই খসড়া হয়েছে। তবে বেসরকারি হাসপাতাল নিবন্ধনের যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, সেগুলো আদৌ প্রতিপালন হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। কারণ, আগেও এ ধরনের শর্ত ছিল। কিন্তু খোদ রাজধানীতেই সরকারের নাকের ডগায় বেসরকারি হাসপাতালগুলো সেবার নামে যা ইচ্ছে তাই করছে। অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নীরব।’

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, ‘নতুন আইনের উপযোগিতা দেখছি না। কোনো রোগী হয়রানির শিকার বা সঠিক সেবা থেকে বঞ্চিত হলে সিভিল কোর্টে আবেদনের মাধ্যমে প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ আছে। কোনো চিকিৎসক হুমকি বা নির্যাতনের শিকার হলে সেটি ফৌজদারি অপরাধ। সে ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনে যথাযথ প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ আছে।’

যে কারণে নতুন আইন
দেশের সব বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিচালিত হচ্ছিল ১৯৮২ সালের ‘দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স’-এর মাধ্যমে। সামরিক ফরমানবলে জারি করা অধ্যাদেশগুলো অনুমোদন ও সমর্থন-সংক্রান্ত চতুর্থ তফসিলের ১৯ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করা হয়। ফলে অধ্যাদেশগুলোর কার্যকারিতা লোপ পায় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে। তাই স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সেবা-গ্রহীতার সুরক্ষা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে যুগোপযোগী আইনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। গত বছর এই আইন প্রণয়নের কাজ শুরু করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. শামিউল ইসলাম বলেন, এই আইন পাস হলে রোগী ও চিকিৎসকের নিরাপত্তা ও স্বার্থ সংরক্ষিত হবে।

খসড়ায় যা আছে
খসড়া আইনের ৫ নম্বর ধারায় বেসরকারি হাসপাতালের লাইসেন্স পাওয়ার বিভিন্ন শর্ত রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আবেদনকারী প্রতিটি হাসপাতালে অবস্থান উপযোগী রোগীর স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, রোগীপ্রতি ন্যূনতম ৮০ বর্গফুট জায়গা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অস্ত্রোপচার কক্ষ, অত্যাবশ্যকীয় মেডিকেল যন্ত্রপাতি, পর্যাপ্ত জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী নির্দিষ্টসংখ্যক ব্যক্তি এবং রোগীর চিকিৎসা তদারকি ও শল্যচিকিৎসার জন্য পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকতে হবে। থাকতে হবে স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থা।

৬ ধারার ২(ক) উপধারায় বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট বেসরকারি হাসপাতাল প্রদত্ত সেবা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বা মানসম্মত না হলে এবং এই আইন, বিধি বা নির্দেশ বা লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গের প্রকৃতি যদি এমন হয় যে, ওই হাসপাতালকে কারণ দর্শানোর সুযোগ দেওয়া সমীচীন নয়, সে ক্ষেত্রে জনস্বার্থে প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স স্থগিত করে তাৎক্ষণিকভাবে সেটি বন্ধ করা যাবে।

১০ ধারার (১) উপধারায় বলা হয়েছে, সরকারি বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় কর্মরত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তি নির্ধারিত অফিস সময়ে বা দাপ্তরিক দায়িত্ব পালনকালে বেসরকারি হাসপাতাল বা ব্যক্তিগত চেম্বারে সেবা দিতে পারবেন না। একই ধারার (২) উপধারায় বলা হয়েছে, ছুটির দিনে নিজ কর্মস্থলের বা জেলার বাইরে বেসরকারি হাসপাতালে বা ব্যক্তিগত চেম্বারে ফি নিয়ে সেবা দিলে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার অনুমতি নিতে হবে। তবে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা যেকোনো সময়ে অনুমতি স্থগিত বা বাতিল করতে পারবে।

আইনের ২৫ ধারায় (অপরাধ ও দণ্ড) বলা হয়েছে, বেসরকারি হাসপাতাল স্থাপনে কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ন্যূনতম তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা দুই বছরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে; স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ব্যক্তিকে হুমকি, ভীতি প্রদর্শন, দায়িত্ব পালনে বাধা, আঘাত কিংবা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তির ক্ষতিসাধন বা দখল করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির অনধিক তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা দুই বছরের কারাদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে; সরকার নিযুক্ত কোনো কর্মকর্তা বা কমিটিকে হাসপাতাল পরিদর্শন, তল্লাশি ও জব্দ করার কাজে বাধা দিলে ওই প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে তিন লাখ টাকা জরিমানা বা এক বছরের কারাদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ড দেওয়া যাবে।

ওই ধারায় আরও বলা হয়েছে, সরকারি বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থায় নিয়োজিত ব্যক্তি নির্ধারিত সময়ে বা পালাক্রমিক দায়িত্ব পালনকালে কোনো বেসরকারি হাসপাতালে বা ব্যক্তিগত চেম্বারে সেবা দিলে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড হবে; সরকারি স্বাস্থ্যসবায় নিয়োজিত ব্যক্তিকে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অফিস সময়ে বেসরকারি হাসপাতালে সেবাদানে নিয়োজিত করলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনধিক পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড হবে; ব্যক্তির ক্ষেত্রে তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড হবে। এতে আরও আছে, লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রত্যেক হাসপাতালে ন্যূনতম জরুরি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের প্রয়োজনীয় সুবিধাসংবলিত জরুরি বিভাগ না থাকলে ওই হাসপাতালকে পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে কর্তৃপক্ষের তিন মাসের কারাদণ্ড হবে; বেসরকারি চিকিৎসা অনুশীলনের ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতাদের জন্য ন্যূনতম বসার স্থান না রাখলে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড হবে।

প্রয়োগে আন্তরিকতায় জোর
দেশের স্বাস্থ্য খাত সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সময়োপযোগী আইনের প্রয়োজন থাকলেও তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োগকারী সংস্থার আন্তরিকতাই আসল বলে মনে করেন অধ্যাপক কামরুল হাসান খান। তিনি বলেন, ‘দেশে অনেক আইন বাস্তবায়িত হয় না প্রয়োগকারী সংস্থার অনীহা, গাফিলতি ও ভীতির কারণে। প্রয়োগকারী সংস্থা আন্তরিক হলে যেকোনো আইন বাস্তবায়ন সম্ভব।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত