চিররঞ্জন সরকার
বর্তমান যুগে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বেড়েছে। তাই বলে ধর্মও কিন্তু রাজনীতির বাইরে নয়। এক একটা ধর্মে, এক একটা ধর্মীয় আখ্যান তৈরি হয় রাজনৈতিক চিন্তা থেকেই। এমনকি দেবী দুর্গার আখ্যানও রাজনীতিমুক্ত নয়। এই রাজনীতি পুরুষের বা পুরুষতন্ত্রের রাজনীতি। একই সঙ্গে কৌশলে সামাজিক সাম্য বিনষ্ট করে উচ্চশ্রেণির আধিপত্য প্রতিষ্ঠারও রাজনীতি।
দুর্গাপূজাকে বলা হয় অকালবোধন। ঘুমন্ত দেবীকে অকালবোধন ঘটিয়ে জাগাতে হবে, এটা একেবারেই বাঙালি রীতি। বাল্মীকি বা তুলসীদাসে অকালবোধন পাওয়া যায় না। এটি কৃত্তিবাসী রামায়ণের নিজস্ব সংযোজন। গবেষকদের মতে, এর মধ্যেও সূক্ষ্ম রাজনৈতিক হিসাব ও মতলব আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্বের অধ্যাপক র্যালফ নিকোলাস অনেক গবেষণা করে দুর্গা, লক্ষ্মী, কালী, জগদ্ধাত্রীপূজা এবং শারদীয় উৎসব নিয়ে ‘নাইট অব দ্য গড্স’ নামে একটি বই লিখেছেন। এই বইয়ে তিনি অভিনব সব বিশ্লেষণী মতামত তুলে ধরেছেন।
অধ্যাপক র্যালফ নিকোলাসের গবেষণামতে, দুর্গাপূজা ছিল প্রধানত জমিদারদের পূজা। তাতে সামাজিক স্তরবিভাজন পরিষ্কার ছিল। কাছারির সামনে দুর্গাদালানে পূজা হতো। কাছারিতেই জমিদার খাজনা নেবেন, প্রজাদের শাস্তিবিধান করবেন। ফলে সেখানেই হবে পূজা।
তিন দিন ধরে দুর্গার চোখে ধরা দেবে গ্রামসমাজের বিভিন্ন স্তরবিন্যাস। পুরোহিত পূজা করবেন, কর্মকার বলি দেবেন, মালাকার মালা গাঁথবেন। শেষে সবাই প্রসাদ পাবেন—এক সুতোয় বাঁধা থাকবে থাকবন্দি সমাজ। এই ধারা অনেক দিন বহাল ছিল।
কোম্পানির আমলে এই ধারার পরিবর্তন হয়। শহরেও শুরু হয় পূজা। কিন্তু নব্যবাবুদের খাজনা আদায়, শাস্তিবিধানের অধিকার নেই। ফলে আলাদাভাবে থাকা কাছারিবাড়ির দুর্গাদালান বিদায় নিতে শুরু করে। বদলে যায় দুর্গাপূজার পরিসর। দুর্গামন্দির স্থাপন করা হয় বাড়ির অন্দরমহলে। নতুন এই বাবুদের পূজা শুধুই বিত্ত প্রদর্শনের ব্যাপার ছিল। সবার প্রবেশাধিকার নেই, সাহেবসুবো ও বড় মানুষেরাই আমন্ত্রিত হতেন। বাইনাচ হতো, মদের ফোয়ারা ছুটত। শাস্ত্রীয় রিচুয়াল নয়, আমোদ-আহ্লাদই সেখানে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।
একটু একটু করে সমাজে নতুন এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। বড়লোকদের বিত্তবৈভব প্রদর্শনের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ মধ্যবিত্তরা একত্র হয়ে নিজেরাই পূজার আয়োজনের দিকে ঝোঁকে। বঞ্চিত শ্রমজীবীদেরও তারা কাছে টানে। এই সময়েই বারোয়ারি পূজার উদ্ভব। সেখানে সবার সমান অধিকার। উনিশ শতকে বাংলার জনপরিসরে সমান অধিকারের ধারণার সূত্রপাত হয় ওই সব পূজাতেই।
র্যালফ নিকোলাসের মতে, শারদীয় দুর্গাপূজা আবহমানকাল ধরে চলছে না। ক্ষমতাবান ব্রাহ্মণ ও কায়স্থরা সাধারণ মানুষের জনপ্রিয় উৎসব গাজনকে আত্মসাৎ করার জন্য অকালবোধন চালু করেন। গুপ্তযুগেও বাংলায় কোনো ব্রাহ্মণ ছিলেন না। এ ব্যাপারে সংস্কৃত ধর্মসূত্রের মন্তব্য স্মরণীয়: গৌড়ের লোকেরা দস্যু, সেখানে দিন কাটালে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। এবার সেই কিংবদন্তি: রাজা আদি শূর কনৌজ থেকে ব্রাহ্মণদের এই অজায়গায় নিয়ে এসে জমি দিয়ে বসত করান।
ব্রাহ্মণেরা এসে দেখলেন, এ দেশে জনজীবনের মূল উৎসব চৈত্র মাসের গাজন। জাতিভেদ নেই, সারা গ্রাম একসঙ্গে ধর্মঠাকুরের পূজায় মেতে ওঠে। এই ধর্ম নিতান্ত লৌকিক দেবতা, যুধিষ্ঠিরের বাবার সঙ্গে সম্পর্ক নেই। কিন্তু এই সর্বজনীন সামাজিক উৎসব বহাল থাকলে শ্রেণিবিভক্ত ‘থাকবন্দি’ শাসনকাঠামো ধরে রাখা যাবে না। অতএব শুরু হলো উচ্চবর্গের বিচিত্র অন্তর্ঘাত। প্রথমেই এল দুর্গাপূজা। কিন্তু সেই বাসন্তীপূজা গাজনের জনপ্রিয়তা কমাতে পারল না। ক্ষমতা গাজনকে বরাবর সন্দেহ করেছে।
চৈত্র হলো বছরের দ্বাদশ মাস। তার উল্টো দিকেই ষষ্ঠ মাস—আশ্বিন। উত্তরাপথে নবরাত্রি সেই সময়। রাজা সুরথ রাজ্য হারিয়ে বনে ঘুরছিলেন, মেধস মুনি সেই সময় তাঁকে শ্রী শ্রীচণ্ডীর কাহিনি শোনান। রাজা দেবীর পূজা করে রাজ্য ফিরে পান। এ যে রাজধর্মের পূজা! সেই সংস্কৃত মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর মুখ্যত তিন অংশ। প্রথম অংশে ৩২টি শ্লোক, দেবী মধু ও কৈটভ দানবকে বধ করেন। দ্বিতীয় অংশে ১০৯টি শ্লোক, দেবী মহিষাসুরকে বধ করেন। তৃতীয় অংশ আরও বড়, ১৯৩টি শ্লোক। বাঙালির দুর্গাপূজার শাস্ত্রীয় আচার এই ন্যারেটিভ কাঠামো মেনে তৈরি করা হয়। সপ্তমীর থেকে অষ্টমী পূজা আরও দীর্ঘ, নবমী পূজা আরও বেশি সময়ের।
এই সংস্কৃত চণ্ডীর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হলো বাংলার চণ্ডীকে। মর্ত্যে পূজা পাওয়ার জন্য কালকেতুকে রাজা করে দেন চণ্ডী। সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলা মঙ্গলচণ্ডী কীভাবে মিশে গেল, দুর্গাপ্রতিমাই তার প্রমাণ। বাঙালির কাছে দুর্গা একই সঙ্গে অসুরনাশিনী, শিবের ঘরনি, কৈলাস ছেড়ে পিতৃগৃহে আসা কন্যা, কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী ও সরস্বতীর মা। নেশাগ্রস্ত স্বামীর ঘর করা সংস্কৃতে নেই। অসুরনাশিনী সেখানে লক্ষ্মীর মা এবং নারায়ণের শাশুড়িও নন। গাজনের জন-উৎসবকে উৎখাত করতেই ‘ক্ষমতা’ সংস্কৃত পুরাণ এবং বাংলা লোককাহিনি মিলিয়ে শারদীয় পূজার আখ্যান তৈরি করা হয়েছে।
কিন্তু শরৎকালে পূজা হবে কীভাবে? আষাঢ় মাসের শুক্লা একাদশীতে দেবতাদের রাত শুরু। ঘুম ভাঙে কার্তিক মাসের একাদশীতে।ব্রাহ্মণ্যবাদ তখন অকালবোধন শুরু করে। পণ্ডিত রঘুনন্দন ভট্টাচার্যের আগে অকালবোধনের কথা জানা যায় না। লক্ষ্মী, কালী বা জগদ্ধাত্রী পূজায় কিন্তু দেবীর ঘুম ভাঙানো হয় না।
দুর্গা ক্ষমতার পূজা, জগদ্ধাত্রীও তাই। বস্তুত দুর্গার তন্ত্র-মন্ত্রে চার হাতের দেবীর যে বর্ণনা, তা জগদ্ধাত্রী রূপ। দশ হাতের দুর্গা মহিষাসুরনাশিনী, চার হাতের জগদ্ধাত্রী বধ করেন করিণ্ডাসুরকে। কালী বা চামুণ্ডাও অসুরকে ধ্বংস করেন। অসুরনাশই ক্ষমতার কাম্য।কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা, যেখানে নারীরা লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়েন, সেটাও কিন্তু মেয়েলি ব্রতকথা নয়। লক্ষ্মীর পাঁচালি রাজধর্মের কথাই বলে।
রাজা ঠিক করেছেন, বাজারে কিছু বিক্রি না হলে তিনি নিজে সেটি কিনে নেবেন। এভাবেই এক বিক্রেতার থেকে অলক্ষ্মীর মূর্তি কেনেন তিনি। ফলে ভাগ্যলক্ষ্মী, যশোলক্ষ্মী, ধনলক্ষ্মী সবাই রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে যান। বিরক্ত রাজা রানিকে জঙ্গলে রেখে আসেন। অসহায় রানি সেখানে ঘুরতে ঘুরতে কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে গ্রামের নারীদের দেখে লক্ষ্মীপূজায় বসেন। সেই পূজার ফলে অলক্ষ্মী বিদায় নেয়।
যশোলক্ষ্মী, ভাগ্যলক্ষ্মী সবাই প্রাসাদে ফেরেন। রাজাও রানিকে ফিরিয়ে আনেন। অতঃপর সুখে রাজ্যশাসন। আসলে দুর্গা, কালী বা জগদ্ধাত্রীর থেকে ছোট আকারে হলেও লক্ষ্মী রাজধর্মেরই পূজা। গাজনকে উৎখাত করতে চারটি উৎসবই ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যবাদের অবদান।
আসলে জনগণের উৎসবে অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে ক্ষমতা এভাবেই নিজস্ব উৎসব তৈরি করে! এবং বোঝা যায়, বাঙালির উৎসব কোনো দিনই রাজনীতিবর্জিত ছিল না।
হ্যাঁ, ধর্ম কিংবা উৎসবের সঙ্গে রাজনীতির যোগ আছে। বর্তমানের রাজনীতি যেমন ধর্মমুক্ত নয়, আবার ধর্মেও রাজনীতির মিশেল আছে। পুরুষতন্ত্র বা ক্ষমতাকাঠামো টিকিয়ে রাখার রাজনীতিকে স্বীকার করে নিয়েও বলতে হয়, দেবী দুর্গা বাঙালির এক অনন্য সৃষ্টি।
পরাক্রমশালী মহিষাসুরের অত্যাচারে যখন ত্রিভুবন থরহরি কম্পমান, তখন কীভাবে দেবতারা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে প্রজাপতি ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর দেবাদিদেব মহাদেবের শরণাপন্ন হলেন, কীভাবে সবার তেজ এক জোট করে সৃষ্টি হলেন আদি পরাশক্তি দেবী দুর্গা, কীভাবে ভয়ংকর যুদ্ধের পর শূলবিদ্ধ হলেন মহিষাসুর? আর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল স্বর্গ মর্ত্য পাতাল–মার্কণ্ডেয় পুরাণে বর্ণিত এই পুরো গল্পটা সব বাঙালির কমবেশি জানা।
পরম পরাক্রমশালী দেবী দুর্গা, যিনি সবার মিলিত শক্তির আধার, যিনি স্বয়ং শিবেরও অগম্য, তাঁকে বাঙালিরা একেবারে ‘ঘরের মেয়ে’ বানিয়ে ফেলেছে। যিনি প্রতি আশ্বিনে বাপের বাড়ি আসেন চার সন্তান নিয়ে। বাঙালি হিন্দুর দুর্গাপূজা এখানেই অনন্য, এখানেই মূলগতভাবে এক হয়েও অন্য হিন্দুদের থেকে ভাবে ও প্রকাশে আলাদা। বাকিদের কাছে দেবী দুর্গা শুধুই এক সর্বশক্তিময়ী আদিসত্তা, বাঙালির মতো ‘বাড়ির মেয়ে’ নন।
বাঙালি সবকিছু নিজের মতো করে গড়ে নেয়, গড়ে নিতে চায়। দুর্গাকেও বাঙালি নিজের আবেগ ও মমতা দিয়ে গড়েছেন। বাঙালির মনে ধর্মের মৌলিক চরিত্র কঠোর জবরদস্তি নয়; বরং মানবিক, অন্তরঙ্গ এবং কিছুটা নারীত্বের প্রসাদপ্রাপ্ত। তাতে সব অর্থেই ‘মমত্ববোধ’ আছে। বাঙালির দুর্গা তাই ছেলেপুলে নিয়ে বিবাহিতা মেয়ের বাপের বাড়ি যাওয়ার গল্প। তার প্রকাশ গ্রাম্য ছড়ায়: ‘শয়নকালে দুর্গা বলে আজ্ঞা দেহ স্বামী,/ ইচ্ছা হয় যে বাপের বাড়ি কাল যাইব আমি।’
এদিকে বাংলার যত স্বপ্ন-দেখা সংগ্রামী নারী দুর্গার প্রতিরূপের সাধনা করেন। ঘরে-বাইরের বিমলা বলে: ‘আমি দেশের এমন একটি প্রত্যক্ষ রূপ চাই যাকে আমি মা বলব, দেবী বলব, দুর্গা বলব।’ সেই দেবীর নানা অভিব্যক্তি বাঙালি হিন্দু আপন করে নিয়েছেন।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
বর্তমান যুগে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার বেড়েছে। তাই বলে ধর্মও কিন্তু রাজনীতির বাইরে নয়। এক একটা ধর্মে, এক একটা ধর্মীয় আখ্যান তৈরি হয় রাজনৈতিক চিন্তা থেকেই। এমনকি দেবী দুর্গার আখ্যানও রাজনীতিমুক্ত নয়। এই রাজনীতি পুরুষের বা পুরুষতন্ত্রের রাজনীতি। একই সঙ্গে কৌশলে সামাজিক সাম্য বিনষ্ট করে উচ্চশ্রেণির আধিপত্য প্রতিষ্ঠারও রাজনীতি।
দুর্গাপূজাকে বলা হয় অকালবোধন। ঘুমন্ত দেবীকে অকালবোধন ঘটিয়ে জাগাতে হবে, এটা একেবারেই বাঙালি রীতি। বাল্মীকি বা তুলসীদাসে অকালবোধন পাওয়া যায় না। এটি কৃত্তিবাসী রামায়ণের নিজস্ব সংযোজন। গবেষকদের মতে, এর মধ্যেও সূক্ষ্ম রাজনৈতিক হিসাব ও মতলব আছে।
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্বের অধ্যাপক র্যালফ নিকোলাস অনেক গবেষণা করে দুর্গা, লক্ষ্মী, কালী, জগদ্ধাত্রীপূজা এবং শারদীয় উৎসব নিয়ে ‘নাইট অব দ্য গড্স’ নামে একটি বই লিখেছেন। এই বইয়ে তিনি অভিনব সব বিশ্লেষণী মতামত তুলে ধরেছেন।
অধ্যাপক র্যালফ নিকোলাসের গবেষণামতে, দুর্গাপূজা ছিল প্রধানত জমিদারদের পূজা। তাতে সামাজিক স্তরবিভাজন পরিষ্কার ছিল। কাছারির সামনে দুর্গাদালানে পূজা হতো। কাছারিতেই জমিদার খাজনা নেবেন, প্রজাদের শাস্তিবিধান করবেন। ফলে সেখানেই হবে পূজা।
তিন দিন ধরে দুর্গার চোখে ধরা দেবে গ্রামসমাজের বিভিন্ন স্তরবিন্যাস। পুরোহিত পূজা করবেন, কর্মকার বলি দেবেন, মালাকার মালা গাঁথবেন। শেষে সবাই প্রসাদ পাবেন—এক সুতোয় বাঁধা থাকবে থাকবন্দি সমাজ। এই ধারা অনেক দিন বহাল ছিল।
কোম্পানির আমলে এই ধারার পরিবর্তন হয়। শহরেও শুরু হয় পূজা। কিন্তু নব্যবাবুদের খাজনা আদায়, শাস্তিবিধানের অধিকার নেই। ফলে আলাদাভাবে থাকা কাছারিবাড়ির দুর্গাদালান বিদায় নিতে শুরু করে। বদলে যায় দুর্গাপূজার পরিসর। দুর্গামন্দির স্থাপন করা হয় বাড়ির অন্দরমহলে। নতুন এই বাবুদের পূজা শুধুই বিত্ত প্রদর্শনের ব্যাপার ছিল। সবার প্রবেশাধিকার নেই, সাহেবসুবো ও বড় মানুষেরাই আমন্ত্রিত হতেন। বাইনাচ হতো, মদের ফোয়ারা ছুটত। শাস্ত্রীয় রিচুয়াল নয়, আমোদ-আহ্লাদই সেখানে মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়।
একটু একটু করে সমাজে নতুন এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব ঘটে। বড়লোকদের বিত্তবৈভব প্রদর্শনের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ মধ্যবিত্তরা একত্র হয়ে নিজেরাই পূজার আয়োজনের দিকে ঝোঁকে। বঞ্চিত শ্রমজীবীদেরও তারা কাছে টানে। এই সময়েই বারোয়ারি পূজার উদ্ভব। সেখানে সবার সমান অধিকার। উনিশ শতকে বাংলার জনপরিসরে সমান অধিকারের ধারণার সূত্রপাত হয় ওই সব পূজাতেই।
র্যালফ নিকোলাসের মতে, শারদীয় দুর্গাপূজা আবহমানকাল ধরে চলছে না। ক্ষমতাবান ব্রাহ্মণ ও কায়স্থরা সাধারণ মানুষের জনপ্রিয় উৎসব গাজনকে আত্মসাৎ করার জন্য অকালবোধন চালু করেন। গুপ্তযুগেও বাংলায় কোনো ব্রাহ্মণ ছিলেন না। এ ব্যাপারে সংস্কৃত ধর্মসূত্রের মন্তব্য স্মরণীয়: গৌড়ের লোকেরা দস্যু, সেখানে দিন কাটালে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। এবার সেই কিংবদন্তি: রাজা আদি শূর কনৌজ থেকে ব্রাহ্মণদের এই অজায়গায় নিয়ে এসে জমি দিয়ে বসত করান।
ব্রাহ্মণেরা এসে দেখলেন, এ দেশে জনজীবনের মূল উৎসব চৈত্র মাসের গাজন। জাতিভেদ নেই, সারা গ্রাম একসঙ্গে ধর্মঠাকুরের পূজায় মেতে ওঠে। এই ধর্ম নিতান্ত লৌকিক দেবতা, যুধিষ্ঠিরের বাবার সঙ্গে সম্পর্ক নেই। কিন্তু এই সর্বজনীন সামাজিক উৎসব বহাল থাকলে শ্রেণিবিভক্ত ‘থাকবন্দি’ শাসনকাঠামো ধরে রাখা যাবে না। অতএব শুরু হলো উচ্চবর্গের বিচিত্র অন্তর্ঘাত। প্রথমেই এল দুর্গাপূজা। কিন্তু সেই বাসন্তীপূজা গাজনের জনপ্রিয়তা কমাতে পারল না। ক্ষমতা গাজনকে বরাবর সন্দেহ করেছে।
চৈত্র হলো বছরের দ্বাদশ মাস। তার উল্টো দিকেই ষষ্ঠ মাস—আশ্বিন। উত্তরাপথে নবরাত্রি সেই সময়। রাজা সুরথ রাজ্য হারিয়ে বনে ঘুরছিলেন, মেধস মুনি সেই সময় তাঁকে শ্রী শ্রীচণ্ডীর কাহিনি শোনান। রাজা দেবীর পূজা করে রাজ্য ফিরে পান। এ যে রাজধর্মের পূজা! সেই সংস্কৃত মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর মুখ্যত তিন অংশ। প্রথম অংশে ৩২টি শ্লোক, দেবী মধু ও কৈটভ দানবকে বধ করেন। দ্বিতীয় অংশে ১০৯টি শ্লোক, দেবী মহিষাসুরকে বধ করেন। তৃতীয় অংশ আরও বড়, ১৯৩টি শ্লোক। বাঙালির দুর্গাপূজার শাস্ত্রীয় আচার এই ন্যারেটিভ কাঠামো মেনে তৈরি করা হয়। সপ্তমীর থেকে অষ্টমী পূজা আরও দীর্ঘ, নবমী পূজা আরও বেশি সময়ের।
এই সংস্কৃত চণ্ডীর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হলো বাংলার চণ্ডীকে। মর্ত্যে পূজা পাওয়ার জন্য কালকেতুকে রাজা করে দেন চণ্ডী। সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলা মঙ্গলচণ্ডী কীভাবে মিশে গেল, দুর্গাপ্রতিমাই তার প্রমাণ। বাঙালির কাছে দুর্গা একই সঙ্গে অসুরনাশিনী, শিবের ঘরনি, কৈলাস ছেড়ে পিতৃগৃহে আসা কন্যা, কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী ও সরস্বতীর মা। নেশাগ্রস্ত স্বামীর ঘর করা সংস্কৃতে নেই। অসুরনাশিনী সেখানে লক্ষ্মীর মা এবং নারায়ণের শাশুড়িও নন। গাজনের জন-উৎসবকে উৎখাত করতেই ‘ক্ষমতা’ সংস্কৃত পুরাণ এবং বাংলা লোককাহিনি মিলিয়ে শারদীয় পূজার আখ্যান তৈরি করা হয়েছে।
কিন্তু শরৎকালে পূজা হবে কীভাবে? আষাঢ় মাসের শুক্লা একাদশীতে দেবতাদের রাত শুরু। ঘুম ভাঙে কার্তিক মাসের একাদশীতে।ব্রাহ্মণ্যবাদ তখন অকালবোধন শুরু করে। পণ্ডিত রঘুনন্দন ভট্টাচার্যের আগে অকালবোধনের কথা জানা যায় না। লক্ষ্মী, কালী বা জগদ্ধাত্রী পূজায় কিন্তু দেবীর ঘুম ভাঙানো হয় না।
দুর্গা ক্ষমতার পূজা, জগদ্ধাত্রীও তাই। বস্তুত দুর্গার তন্ত্র-মন্ত্রে চার হাতের দেবীর যে বর্ণনা, তা জগদ্ধাত্রী রূপ। দশ হাতের দুর্গা মহিষাসুরনাশিনী, চার হাতের জগদ্ধাত্রী বধ করেন করিণ্ডাসুরকে। কালী বা চামুণ্ডাও অসুরকে ধ্বংস করেন। অসুরনাশই ক্ষমতার কাম্য।কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা, যেখানে নারীরা লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়েন, সেটাও কিন্তু মেয়েলি ব্রতকথা নয়। লক্ষ্মীর পাঁচালি রাজধর্মের কথাই বলে।
রাজা ঠিক করেছেন, বাজারে কিছু বিক্রি না হলে তিনি নিজে সেটি কিনে নেবেন। এভাবেই এক বিক্রেতার থেকে অলক্ষ্মীর মূর্তি কেনেন তিনি। ফলে ভাগ্যলক্ষ্মী, যশোলক্ষ্মী, ধনলক্ষ্মী সবাই রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে যান। বিরক্ত রাজা রানিকে জঙ্গলে রেখে আসেন। অসহায় রানি সেখানে ঘুরতে ঘুরতে কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে গ্রামের নারীদের দেখে লক্ষ্মীপূজায় বসেন। সেই পূজার ফলে অলক্ষ্মী বিদায় নেয়।
যশোলক্ষ্মী, ভাগ্যলক্ষ্মী সবাই প্রাসাদে ফেরেন। রাজাও রানিকে ফিরিয়ে আনেন। অতঃপর সুখে রাজ্যশাসন। আসলে দুর্গা, কালী বা জগদ্ধাত্রীর থেকে ছোট আকারে হলেও লক্ষ্মী রাজধর্মেরই পূজা। গাজনকে উৎখাত করতে চারটি উৎসবই ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যবাদের অবদান।
আসলে জনগণের উৎসবে অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে ক্ষমতা এভাবেই নিজস্ব উৎসব তৈরি করে! এবং বোঝা যায়, বাঙালির উৎসব কোনো দিনই রাজনীতিবর্জিত ছিল না।
হ্যাঁ, ধর্ম কিংবা উৎসবের সঙ্গে রাজনীতির যোগ আছে। বর্তমানের রাজনীতি যেমন ধর্মমুক্ত নয়, আবার ধর্মেও রাজনীতির মিশেল আছে। পুরুষতন্ত্র বা ক্ষমতাকাঠামো টিকিয়ে রাখার রাজনীতিকে স্বীকার করে নিয়েও বলতে হয়, দেবী দুর্গা বাঙালির এক অনন্য সৃষ্টি।
পরাক্রমশালী মহিষাসুরের অত্যাচারে যখন ত্রিভুবন থরহরি কম্পমান, তখন কীভাবে দেবতারা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে প্রজাপতি ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর দেবাদিদেব মহাদেবের শরণাপন্ন হলেন, কীভাবে সবার তেজ এক জোট করে সৃষ্টি হলেন আদি পরাশক্তি দেবী দুর্গা, কীভাবে ভয়ংকর যুদ্ধের পর শূলবিদ্ধ হলেন মহিষাসুর? আর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল স্বর্গ মর্ত্য পাতাল–মার্কণ্ডেয় পুরাণে বর্ণিত এই পুরো গল্পটা সব বাঙালির কমবেশি জানা।
পরম পরাক্রমশালী দেবী দুর্গা, যিনি সবার মিলিত শক্তির আধার, যিনি স্বয়ং শিবেরও অগম্য, তাঁকে বাঙালিরা একেবারে ‘ঘরের মেয়ে’ বানিয়ে ফেলেছে। যিনি প্রতি আশ্বিনে বাপের বাড়ি আসেন চার সন্তান নিয়ে। বাঙালি হিন্দুর দুর্গাপূজা এখানেই অনন্য, এখানেই মূলগতভাবে এক হয়েও অন্য হিন্দুদের থেকে ভাবে ও প্রকাশে আলাদা। বাকিদের কাছে দেবী দুর্গা শুধুই এক সর্বশক্তিময়ী আদিসত্তা, বাঙালির মতো ‘বাড়ির মেয়ে’ নন।
বাঙালি সবকিছু নিজের মতো করে গড়ে নেয়, গড়ে নিতে চায়। দুর্গাকেও বাঙালি নিজের আবেগ ও মমতা দিয়ে গড়েছেন। বাঙালির মনে ধর্মের মৌলিক চরিত্র কঠোর জবরদস্তি নয়; বরং মানবিক, অন্তরঙ্গ এবং কিছুটা নারীত্বের প্রসাদপ্রাপ্ত। তাতে সব অর্থেই ‘মমত্ববোধ’ আছে। বাঙালির দুর্গা তাই ছেলেপুলে নিয়ে বিবাহিতা মেয়ের বাপের বাড়ি যাওয়ার গল্প। তার প্রকাশ গ্রাম্য ছড়ায়: ‘শয়নকালে দুর্গা বলে আজ্ঞা দেহ স্বামী,/ ইচ্ছা হয় যে বাপের বাড়ি কাল যাইব আমি।’
এদিকে বাংলার যত স্বপ্ন-দেখা সংগ্রামী নারী দুর্গার প্রতিরূপের সাধনা করেন। ঘরে-বাইরের বিমলা বলে: ‘আমি দেশের এমন একটি প্রত্যক্ষ রূপ চাই যাকে আমি মা বলব, দেবী বলব, দুর্গা বলব।’ সেই দেবীর নানা অভিব্যক্তি বাঙালি হিন্দু আপন করে নিয়েছেন।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষায় সন্দ্বীপের ব্লক বেড়িবাঁধসহ একাধিক প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৫৬২ কোটি টাকা। এ জন্য টেন্ডারও হয়েছে। প্রায় এক বছর পেরিয়ে গেলেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ শুরু করছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তাগাদায়ও কোনো কাজ হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন...
৩ দিন আগেদেশের পরিবহন খাতের অন্যতম নিয়ন্ত্রণকারী ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির কমিটির বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাইফুল আলমের নেতৃত্বাধীন এ কমিটিকে নিবন্ধন দেয়নি শ্রম অধিদপ্তর। তবে এটি কার্যক্রম চালাচ্ছে। কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের...
৩ দিন আগেআলুর দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে এবার নিজেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বাজার স্থিতিশীল রাখতে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে রাজধানীতে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি মূল্যে আলু বিক্রি করা হবে। একজন গ্রাহক ৪০ টাকা দরে সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন...
৩ দিন আগেসপ্তাহখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকের ওয়াল বিষাদময় হয়ে উঠেছিল ফুলের মতো ছোট্ট শিশু মুনতাহাকে হত্যার ঘটনায়। ৫ বছর বয়সী সিলেটের এই শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করে লাশ গুম করতে ডোবায় ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেশী গৃহশিক্ষকের পরিকল্পনায় অপহরণের পর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়...
৩ দিন আগে