২০০ বিঘা জমির মাটি ইটভাটা গিলছে

আরিফুর রহমান মিঠু, শাজাহানপুর (বগুড়া)
প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২৪, ১০: ৪০

বগুড়ার শাজাহানপুরে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়ে চলছে পাঁচটি ইটভাটা। তবে বাস্তবে ইটভাটা আছে ২৯টি। অনুমোদিত প্রতিটি ভাটায় ১০ লাখ ইট পোড়ানোর অনুমোদন থাকলেও পোড়ানো হচ্ছে ৫০ থেকে ৮০ লাখ। ইট তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে আবাদি জমির মাটি। ইট পোড়ানোয় ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের। মালিকপক্ষ বলছে, সরকারি বিভিন্ন দপ্তরকে ম্যানেজ করে চালানো হয় এসব ভাটা। এসব ভাটায় প্রতিবছর ২০০ বিঘা জমির মাটি যাচ্ছে।

উপজেলার খোট্রাপাড়া ইউনিয়নের দুরুলিয়া, খলিশাকান্দি, খোট্রাপাড়া, জালশুকা গ্রাম; মাদলা ইউনিয়নের মাদলা চাচাইতারা, কাজিপাড়া, বলদিবলান গ্রাম; মাঝিড়া ইউনিয়নের সুজাবাদ গ্রাম এবং আড়িয়া ইউনিয়নের জামালপুর গ্রামে ইটভাটাগুলো রয়েছে।

সম্প্রতি এসব এলাকা ঘুরে দেখা যায়, প্রতিটি ভাটার আশপাশে মানুষের বসতি। আধা কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে সরকারি-বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উচ্চবিদ্যালয়, কমিউনিটি ক্লিনিক, মাদ্রাসা, মসজিদ, হাটবাজার। ইটভাটাগুলোর তিন কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে সেনানিবাস, উপজেলা পরিষদ ভবন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ ছোট-বড় অসংখ্য মুরগির খামার। রয়েছে ফসলের খেত।

শাজাহানপুর উপজেলা উপসহকারী প্রকৌশলী (এলজিইডি) আবু তালিম হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ইটভাটাগুলোর কারণে সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইট, মাটি, বালুবোঝাই ট্রাকের ওজন হয় ৩০ টনের বেশি। সড়ক নির্মাণের কিছুদিনের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বছরে ২০ কিলোমিটারের মতো সড়ক নষ্ট হচ্ছে। 

অভিযানে কাজ হয় না
উপজেলার সুজাবাদ এলাকায় ২০২২ সালের ১৭ নভেম্বর বদর ইটভাটা, বগুড়া ইটভাটা এবং মীর ইটভাটা ভেঙে দেন বগুড়া জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত। পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ২০২৩ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি অভিযান চালান উপজেলার দুরুলিয়া এলাকার এনএমবি ব্রিকস, খলিশাকান্দি এলাকার এলজিবি-১, এলজিবি-২, এলজিপি, এসবিএফ, জিবিএফ, এমবিএফ, এসএসবি এবং টপ ব্রিকসে।

এ সময় প্রতিটি ইটভাটাকে ৫ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। ভাটাগুলোয় নতুন করে ইট না পোড়ানোর নির্দেশও দেওয়া হয়। সে সময় জানানো হয়েছিল, ভাটাগুলোর পরিবেশ ছাড়পত্র ও নিবন্ধন নেই। কিন্তু ভাটাগুলো এখন পুরোদমে চলছে। 

এ বিষয়ে কথা বলতে শাজাহানপুর উপজেলা ইট প্রস্তুত মালিক সমিতির সভাপতি আলহাজ রফিকুল ইসলাম এবং সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান নাহিদের কার্যালয়ে যান এই প্রতিবেদক। কার্যালয়ে তাঁদের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা আজকের পত্রিকাকে বলেন, নাশকতার মামলায় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আত্মগোপনে আছেন।

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মোহাম্মদ মিকাইল হোসাইন আজকের পত্রিকাকে বলেন, চলতি বছর শাজাহানপুরে পাঁচটি ইটভাটা পরিবেশের ছাড়পত্র পেয়েছে। এর আগে অভিযানে বন্ধ করা ভাটাগুলোয় নতুন করে ইট পোড়ানোর সুযোগ নেই। জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে শাজাহানপুরেও অভিযান চালানো হবে।

মাটি খাচ্ছে ভাটা
একাধিক ভাটার মালিক বলেছেন, প্রতিটা ইটভাটায় ৫০ হাজার ইটের জন্য বছরে ৮ ফুট গভীর করে কমপক্ষে ৫ বিঘা জমির মাটি লাগে। কোনো কোনো ভাটায় ৮ বিঘা পর্যন্ত মাটি লাগে। সেই হিসাবে উপজেলার ২৯টি ভাটায় বছরে গড়ে ২০০ বিঘা জমির মাটি প্রয়োজন হয়। সূত্র বলছে, এর একটি বড় অংশ আসে আবাদি জমি থেকে। 

পরিচয় গোপন রাখার শর্তে মাদলা ইউনিয়নের একজন মাটি ব্যবসায়ী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ইট প্রস্তুত মালিক সমিতি এবং প্রশাসনের বিশ্বস্ত লোকের মাধ্যমে লেনেদেন করে থাকি। তারপরেও জরিমানা হয়। বর্তমানে প্রতি ট্রাক মাটি ইটভাটার মালিকেরা নিচ্ছেন প্রায় ১ হাজার ৭ টাকায়। ভাটা অনেক বেশি, ইটও পোড়ানো হয় অনেক। তাই মাটি লাগে অনেক।’

জানতে চাইলে শাজাহানপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কাজী মোহাম্মদ অনিক ইসলাম বলেন, ‘২০২৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর থেকে শুরু করে চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত ২৫ দিনে পৃথক ১৪টি ভ্রাম্যমাণ আদালতে মোট ১৩ লাখ ৬৮ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে, একটি মামলা করেছি। অবৈধভাবে মাটি-বালু উত্তোলন বন্ধে উপজেলা প্রশাসন তৎপর রয়েছে।’ 

‘ম্যানেজ’ করে চলে ভাটা
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে খলিশাকান্দি এবং সুজাবাদ এলাকার একাধিক ইটভাটার মালিক আজকের পত্রিকাকে বলেন, ইট প্রস্তুত মালিক সমিতির মাধ্যমে প্রতিটি ভাটা থেকে টাকা ওঠানো হয়। এই টাকা বিভিন্ন দপ্তর ম্যানেজ করতে দেওয়া হয়। ম্যানেজ না করে ইটভাটায় আগুন দেওয়ার উপায় নাই। প্রতিটা ভাটায় কমপক্ষে ৫০ লাখ এবং সর্বোচ্চ ৮০ লাখ ইট পোড়ানো হয়। 

জানতে চাইলে বগুড়া কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট অফিস সার্কেল-২-এর রাজস্ব কর্মকর্তা শ্যামল কুমার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘শাজাহানপুরে ইটভাটার মোট সংখ্যা ২৯টি। ১ লাখ ৮ হাজার ঘনফুট আয়তনের ইটভাটার প্রতিটা চিমনিতে ইট পোড়ানো যাবে ১০ লাখ। সে অনুযায়ী ভাটাগুলো থেকে বছরে রাজস্ব আসে ১৩ কোটি ৫০ হাজার টাকা। বেশি ইট পোড়ানোর বিষয়ে আমার জানা নেই।’

তিনি বলেন, ‘ইটভাটায় বসে থেকে ইট পোড়ানো গুনে দেখা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। বেশি ইট পোড়ানোর বিষয়ে কেউ প্রমাণ জোগাড় করে দিলে জেলা প্রশাসকের অনুমতি নিয়ে আমরা মামলা করতে পারব।’

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত