ইরানে বিরল ‘মাছ বৃষ্টি’! সংবাদমাধ্যমেও ভুয়া ভিডিও  

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক
প্রকাশ : ১০ মে ২০২৪, ১৭: ৪৫

ইরানে নাকি বিরল মাছ বৃষ্টির ঘটনা ঘটেছে! এই নিয়ে এক ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে এক্সে (সাবেক টুইটার) ও ইনস্টাগ্রামে। সোশ্যাল মিডিয়া সূত্রে এই খবর উঠে এসেছে দেশ-বিদেশের সংবাদমাধ্যমেও। এসব সংবাদমাধ্যমের কোনো কোনোটি আবার ঘটনার সত্যতা যাচাই করা যায়নি বলে ‘ডিসক্লেইমার’ও দিয়েছে। 

এই ঘটনা ঘিরে কোনো ‘ডিসক্লেইমার’ ছাড়া দেশীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর মধ্যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে একাত্তর টিভি, ঢাকা পোস্ট, কালবেলা, ঢাকা টাইমস ২৪, মানবকণ্ঠ, অর্থসূচক, বায়ান্ন টিভি, এক টাকার খবর। এসব সংবাদমাধ্যম সূত্রে ঘটনাটি উঠে এসেছে দেশের সোশ্যাল মিডিয়াতেও। বিদেশি সংবাদমাধ্যমের মধ্যে আছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম লাইভ মিন্ট, জি নিউজ, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, নিউজ ১৮, হিন্দুস্থান টাইমস। পাকিস্তানের এআরওয়াই নিউজ এবং যুক্তরাজ্যের ডেইলি স্টার। যদিও হিন্দুস্থান টাইমস ও ডেইলি স্টারে ঘটনাটির সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। 

ইরানে কী আসলেই ‘মাছ বৃষ্টি’র ঘটনা ঘটেছে? সত্যতা যাচাই করে দেখেছে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ। 

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইরানে ‘মাছ বৃষ্টি’র কথিত ঘটনাটি ঘটেছে ইরানের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ কোগিলওয়ে–বোয়ের আহমাদ প্রদেশের ইয়াসুজ শহরে। গত সোমবার (৬ মে) ঘটনাটির ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। সংবাদমাধ্যমগুলোতে ‘Mahi_Kadeh’ নামে ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা একটি ভিডিওকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। 

ঘটনাটির সত্যতা যাচাইয়ে ইরানের সংবাদমাধ্যমগুলোতে ঘটনাটির সত্যতা সম্পর্কে খোঁজ নেওয়া হয়। প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানে দেশটির একাধিক সংবাদমাধ্যমে ‘ইয়াসুজ শহরে’ মাছ বৃষ্টির ঘটনাটিকে ভুয়া হিসেবে উল্লেখ করেছে। দেশটির সংবাদমাধ্যম দ্য ফারারু ভিডিওটি সম্পর্কে এক প্রতিবেদনে জানায়, ইয়াজুস শহরে ‘মাছ বৃষ্টি’র একটি অস্বাভাবিক ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে।

সংবাদমাধ্যমটির অনুসন্ধান অনুযায়ী, ভিডিওটি সঠিক নয়। এটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং গ্রাফিকসের সহায়তায় তৈরি করা হয়েছে। একই তথ্য দিয়েছে দেশটির সংবাদমাধ্যম কেবনা নিউজ, খবর ফারসি। 

পরে রিভার্স ইমেজ অনুসন্ধানে ‘factnameh’ নামের ইরান ভিত্তিক তথ্য যাচাইকারী একটি ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে ভিডিওটি নিয়ে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ পাওয়া যায়। অ্যাকাউন্টটির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ইরানের ইয়াজুস শহরে কথিত ‘মাছ বৃষ্টি’র ভিডিওটি সঠিক নয়। এটি বিশেষ ইফেক্ট ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ভিডিওটির শুরুতে সড়কে অনেক মাছ পড়ে থাকতে দেখা গেলেও কয়েক সেকেন্ড পরেই কিছু মাছ অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগের পর্যবেক্ষণেও ‘factnameh’ এর পর্যবেক্ষণের সত্যতা পাওয়া যায়। 

ইরানের ‘মাছ বৃষ্টি’র ভিডিওটি নিয়ে ইরানি সংবাদমাধ্যমের সংবাদভিডিওটিতে দেখা যায়, রাস্তায় অনেক গাড়ি থাকলেও মাছগুলো কেবল সড়কের ওপরই পড়ছিল এবং মাছ নিয়ে ভিডিও ধারণকারী ব্যক্তি ব্যতীত আর কাউকে আগ্রহ প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে না। বরং সড়কের গাড়িগুলো আপন গতিতে চলাচল করছিল। স্বভাবতই, ‘মাছ বৃষ্টি’ বা বৃষ্টির সঙ্গে মাছ পড়া অস্বাভাবিক ঘটনা! তাই এমন ঘটনায় ভিডিও ধারণকারী ছাড়াও অন্যান্যদের আগ্রহ বা কৌতূহল প্রকাশ করাটা স্বাভাবিক। 

পরে ঘটনাটির অধিকতর সত্যতা যাচাইয়ে ভিডিওটি ধারণকারীর ‘Mahi_Kadeh’ নামে একটি ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা হয়। অ্যাকাউন্টটির বর্ণনা অনুযায়ী, এটি ইরানের চিংড়ি মাছ বিক্রয় সংক্রান্ত অনলাইন স্টোর, ফলোয়ার সংখ্যা ৭৫ হাজারের বেশি। অ্যাকাউন্টটিতে ‘মাছ বৃষ্টি’র কথিত ভিডিওটি ছাড়াও মাছ বিক্রি, মাছ ধরা ও প্রক্রিয়াজাতকরণের অনেক ভিডিও রয়েছে। 

‘মাছ বৃষ্টি’র কথিত ভিডিওটি অ্যাকাউন্টটিতে গত শুক্রবার (৩ মে) পোস্ট করা হয়। পোস্টের ক্যাপশনে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে লেখা হয়, ইয়াজুসে এখন ‘মাছ বৃষ্টি’ হচ্ছে? ক্যাপশনে মাছ কেনার জন্য অর্ডার দিতে হোয়াটস অ্যাপে যোগাযোগের পরামর্শ দেওয়া হয়। পোস্টটির কমেন্টবক্সে ‘goli_nab’ নামে ইনস্টাগ্রাম থেকে কমেন্ট করে দাবি করা হয়, তিনি ওই দিন বিকেলে ইয়াজুসে ছিলেন। কিন্তু সেখানে কোনো ‘মাছ বৃষ্টি’ হয়নি। অ্যাকাউন্টটি ইরান থেকে পরিচালিত। 

‘mehraban_mardom’ নামের আরেকটি অ্যাকাউন্ট থেকে কমেন্ট করে বলা হয়, ইয়াজুসে ‘মাছ বৃষ্টি’ কখন হলো? মাছগুলো কোনো ফিশ ফার্ম থেকে আনা হয়েছে। এই কমেন্টের উত্তরে ভিডিওটি ধারণকারী ‘Mahi_Kadeh’ অ্যাকাউন্টটি থেকে লাইক রিয়েকশন দেওয়া হয়। 

ইরানের রাজধানী তেহরানে ২০২০ সালের মার্চে ‘বেগুন বৃষ্টি’ হয়েছে এমন দাবিতে ইন্টারনেটে কিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল। দেশটির ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড পাবলিক সিকিউরিটি পুলিশ এই ঘটনায় পাঁচজনকে আটক করে। পরে আমির তাগিপুর নামে এক ব্যক্তি সোশ্যাল মিডিয়ায় স্বীকার করেন যে, তিনি তেহরানের একটি স্কুলে ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট শেখানোর অংশ হিসেবে ‘বেগুন বৃষ্টি’র ভিডিওটি তৈরি করেন। এই ঘটনাকে স্মরণ করে ‘Mahi_Kadeh’ এর পোস্টে ‘maryam. ansariiii’ নামের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে কমেন্ট করা হয়। ‘Mahi_Kadeh’ তাতে ‘হা হা’ প্রতিক্রিয়া দেয়। 

‘Mahi_Kadeh’ এর এসব প্রতিক্রিয়া ভিডিওটির সত্যতাকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করে। অনুসন্ধানের এ পর্যায়ে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ ‘Mahi_Kadeh’ অ্যাকাউন্টটিতে যোগাযোগের জন্য থাকা হোয়াটঅ্যাপ নম্বরে ভিডিওটি সম্পর্কে জানতে চেয়ে বার্তা পাঠায়। 

অ্যাকাউন্টটি থেকে উত্তরে জানানো হয়, ইরানের ইয়াজুস শহরের ‘মাছ বৃষ্টি’র ভিডিওটি বানানো। 

অর্থাৎ ইরানের ‘মাছ বৃষ্টি’র কথিত ভিডিওটি বানোয়াট। 

তবে এটা একেবারে অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়! এমনকি এর পেছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আছে। বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটে। টর্নেডোর মতো একধরনের ঝড় সাগর, হ্রদের মতো জায়গা থেকে মাছসহ জলজ প্রাণী উঠিয়ে নেয়। তারপর ঝোড়ো বাতাসে ভাসিয়ে বেশ কিছুটা দূরে মাটিতে নিয়ে ফেলে। দৃশ্যটা দেখলে যে কারও মনে হবে আকাশ থেকে মাছ বৃষ্টি হচ্ছে! 

শ্রীলঙ্কা, অস্ট্রেলিয়া, মেক্সিকোসহ বিভিন্ন দেশেই এভাবে আকাশ থেকে মাছ পড়ার রেকর্ড আছে। কখনো কখনো এভাবে পড়া মাছ খাওয়ার উপযোগী হলে যে এলাকায় ঘটনা ঘটে, সেখানকার মানুষ রীতিমতো ডাঙায় মাছ ধরার উৎসবে মেতে ওঠে। হন্ডুরাসের ছোট্ট গ্রাম ইয়রোতে এ ধরনের মাছ বৃষ্টির ঘটনা এত বেশি যে, প্রতি বছর একবার ‘লুভিয়া দ্য পেসেস’ বা মৎস্য বৃষ্টি উৎসব পালন করতে পারেন এখানকার বাসিন্দারা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত