শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী পরিচয়ে ফেসবুকে প্রশ্ন ফাঁসের জালিয়াতি

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক
প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২৪, ২১: ৫৩
আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৬: ১০

দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষা। এসব পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে ফেসবুকের বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে প্রশ্নপত্র পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখানো হচ্ছে।

পোস্টগুলোতে দাবি করা হচ্ছে, তাদের কাছে পরীক্ষা শুরুর আগেই ওই ইউনিটের প্রশ্ন এসে গেছে। ওইসব পোস্টের সঙ্গে প্রশ্নপত্রের আংশিক ছবিও যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বলা হয়েছে, যারা টাকার বিনিময়ে পুরো প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করতে চান, তাঁরা যেন দ্রুত ইনবক্সে যোগাযোগ করেন। প্রশ্নের জন্য টাকার পরিমাণ নির্দিষ্ট এবং টাকা অগ্রিম দিতে হবে।

আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগের অনুসন্ধানে ফেসবুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পাইয়ে দেওয়ার দাবি করছে এমন বেশ কয়েকটি অ্যাকাউন্ট খুঁজে পাওয়া গেছে। গত ২ মার্চ (শনিবার) দিবাগত রাত ১টা ৩৩ মিনিটে জাহিদ আফ্রিদী (Jahid Afridi) নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার বি১ উপ–ইউনিটের প্রশ্ন নিয়ে এমন একটি পোস্ট করা হয়। এতে দাবি করা হয়, ‘ভর্তি পরীক্ষা ২০২৩–২০২৪ এর বি১ উপ–ইউনিটের প্রশ্ন আমাদের হাতে চলে আসছে। নিচে প্রশ্নের কিছু অংশ ফ্রিতে দেওয়া হলো। সময় ০৩/০৩ /২০২৪ তারিখ, রাত ১টা ৩০মিনিট, এইটুকুই প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। যারা টাকার বিনিময়ে সম্পূর্ণ প্রশ্ন সংগ্রহ করতে চাও, তারা দ্রুত ইনবক্সে যোগাযোগ করো। টাকা ফিক্সড এবং অ্যাডভান্সড। ডেন্টাল, রাবি ও গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা ২০২৪ এর ১০০% অরজিনাল প্রশ্ন নিতে চাইলে ইনবক্সে যোগাযোগ করো।’

একই অ্যাকাউন্ট থেকে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা নিয়েও গত ৮ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ১টা ৮ মিনিটে একই ধরনের পোস্ট পাওয়া যায়। ওই পোস্টে দাবি করা হয়, ‘মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা ২০২৩–২০২৪ এর প্রশ্ন আমাদের হাতে চলে আসছে। নিচে প্রশ্নের কিছু অংশ দেওয়া হল। রাত ১টা এইটুকুই প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। যারা টাকার বিনিময়ে সম্পূর্ণ প্রশ্ন সংগ্রহ করতে চাও, তারা দ্রুত ইনবক্সে যোগাযোগ করো। টাকা ফিক্সড এবং অ্যাডভান্সড। ঢাবি, রাবি ও গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা ২০২৪ এর ১০০% অরিজিনাল প্রশ্ন নিতে চাইলে ইনবক্সে যোগাযোগ করো।’ 

একই ধরনের আরেকটি দাবি পাওয়া যায় গত ২২ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ২টা ৫ মিনিটে পোস্ট করা নাজমুস সাকিব (Nazmus Shakib) নামের একটি অ্যাকাউন্টে। ওই পোস্টে দাবি করা হয়, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার B ইউনিটের প্রশ্ন। রাত ২টা ৩ মিনিট, প্রশ্নের কিছু অংশ ফ্রিতে দিলাম। পরীক্ষার পর এসে মিলিয়ে নিয়ো। আমি অ্যাডভান্স টাকা ছাড়া কাউকে কোন প্রশ্ন দেইনি আর কোনদিন দিবও না। বলছিলাম, পরীক্ষার কিছুক্ষণ আগে ফ্রি দিব। কিছু দিলাম এইটুকুই প্রমাণের জন্য যথেষ্ট। যাদের রাবি, জাবি, চবি ও গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার ১০০% কমন প্রশ্ন লাগবে তারা দ্রুত যোগাযোগ করো। টাকা ফিক্সড এবং অ্যাডভান্স।’

প্রতিটি পোস্টের সঙ্গেই প্রশ্নপত্র দাবিতে ছবি যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে।

দাবির নেপথ্যে
দাবিগুলো যাচাই করতে গত ২ মার্চ (শনিবার) দিবাগত রাত ১টা ৩৩ মিনিটে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার বি১ উপ–ইউনিটের প্রশ্ন নিয়ে দেওয়া জাহিদ আফ্রিদীর ফেসবুক পোস্টটির এডিট হিস্ট্রি দেখা হয়। এতে দেখা যায়, ওই সময় পোস্টটিতে কোনো প্রশ্নেরপত্রের ছবি ছিল না এবং রিয়েকশনও ছিল না। পরে ৩ মার্চ (রোববার) দুপুর ১২টা ৩২ মিনিটে পোস্টটি এডিট করে প্রশ্নপত্রের ছবি যুক্ত করা হয় এবং তখন পোস্টে রিয়েকশন দেখায় ১৯৫টি।

যেখানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বি১ উপ–ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা গত ৩ মার্চ (রোববার) সকাল সোয়া ১০টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে।

একইভাবে গত ৮ ফেব্রুয়ারি (বৃহস্পতিবার) দিবাগত রাত ১টা ৮ মিনিটে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে জাহিদ আফ্রিদীর অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া পোস্টটির এডিট হিস্ট্রিতে গিয়ে দেখা যায়, শুরুতে এটিতেও কোনো প্রশ্নপত্রের ছবি ছিল না এবং পোস্টে কোনো রিয়েকশনও ছিল না। পরে ১০ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১টা ৪৩ মিনিটে পোস্টটিতে একটি প্রশ্নপত্রের ছবি যোগ করা হয় এবং রিয়েকশন পড়ে ৬৭টি। 

যেখানে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে শুক্রবার (৯ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত।

প্রশ্নফাঁস দাবিতে প্রচারিত পোস্টগুলোর এডিট হিস্ট্রি।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার বি ইউনিটের প্রশ্ন নিয়ে নাজমুস সাকিব নামের অ্যাকাউন্ট থেকে দেওয়া পোস্টের এডিট হিস্ট্রিতে গিয়ে একই চিত্র পাওয়া যায়। পোস্টটি প্রথম দেওয়া হয় ২২ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ২টা ৫ মিনিটে। তখন পোস্টটিতে কোনো ছবি যুক্ত ছিল না। এরপর পোস্টটি ২৩ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১টা ৫৯ মিনিটে এডিট করা হয়। তখনও পোস্টে কোনো ছবি ছিল না এবং রিয়েকশনও ছিল না। পোস্টটি সবশেষ এডিট করা হয় ওইদিন দুপুর ২টা ১১ মিনিটে এবং এতে প্রশ্নপত্রের ছবি যুক্ত করা হয়। ছবিটিতে রিয়েকশন দেখায় ৩৭৬টি। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে ২৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত। 

প্রশ্ন ফাঁসের দাবিতে করা এই পোস্টগুলোর এডিট হিস্ট্রি থেকেই বোঝা যায়, ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন বিক্রি করা হবে দাবিতে করা পোস্টগুলোতে মূলত ডিজিটাল জালিয়াতি করা হয়েছে। পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগের দিন রাতে তারা প্রশ্ন ফাঁস করার সামর্থ্য রাখে—এমন দাবিতে পোস্ট করে রাখা হয়েছে। পরে সংশিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর একটি প্রশ্নপত্রের ছবি যুক্ত করেছে। এডিট পোস্টটিকে তাদের সক্ষমতার প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করে প্রশ্নপত্র পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দিচ্ছে। কেউ প্রশ্নপত্র চাইলে ইনবক্সে যোগাযোগ করতে বলা হচ্ছে। অগ্রীম টাকার কথাও স্পষ্ট করে বলছে তারা।

অ্যাকাউন্টগুলোর পরিচয়
প্রশ্ন ফাঁস ও টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র দেওয়ার প্রলোভন দেখানো অন্তত তিনটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুঁজে পেয়েছে আজকের পত্রিকার ফ্যাক্টচেক বিভাগ। অ্যাকাউন্টগুলোর পরিচয় যাচাই করে দেখা যায়, প্রতিটি অ্যাকাউন্টধারীই নিজেদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করেছে। যেমন, হাবিবুর রহমান সোহেল (Habibur Rahaman Shohel) নামের একটি অ্যাকাউন্ট নিজেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কম্পিউটার টেকনিশিয়ান হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অ্যাকাউন্টের পরিচয়ে লেখা, ‘SSC-HSC-মেডিকেল-ডেন্টাঃ সহ যে কোনো পাবলিক ভর্তি পরীক্ষা ১০০% কমন প্রশ্ন লাগলে ইনবক্সে এ যোগাযোগ করুন।’

অ্যাকাউন্টটিতে একটি মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়েছে। নম্বরটিতে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।

প্রশ্নফাঁস দাবিতে ডিজিটাল জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ফেসবুক অ্যাকাউন্টগুলো নিজেদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বলে দাবি করেছে।পরে তাঁর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল খায়েরের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হয়। হাবিবুর রহমান সোহেল নামে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কোনো কম্পিউটার টেকনিশিয়ান আছে কি না তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়। প্রশ্নটি করার পরই অপর পাশ থেকে বলা হয়, তিনি কথা বুঝতে পারছেন না। তখন সংযোগটি কেটে দিয়ে আবার কল দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি। পরে একাধিক নম্বর থেকে কল দিয়েও তাঁর সাড়া পাওয়া যায়নি।

নাজমুস সাকিব (Nazmus Shakib) নামের অ্যাকাউন্টটিতেও একই পরিচয় উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তিনি কোনো পদের নাম উল্লেখ করেননি। তিনিও নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী বলে দাবি করেছেন। তাঁর প্রোফাইলের পরিচয়ে লেখা, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার ১০০% রিয়েল প্রশ্ন লাগলে ইনবক্সে যোগাযোগ করো।’ 

জাহিদ আফ্রিদী (Jahid Afridi) নামের অ্যাকাউন্টধারীও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজ করেন বলে দাবি করেছেন। তবে তিনিও কোনো পদের নাম উল্লেখ করেননি। এই অ্যাকাউন্টের পরিচয়ে লেখা, ‘SSC HSC Degree Honour’s এডমিশন যেকোনো ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট চেঞ্জ করা হয়। প্রয়োজন হলে যোগাযোগ করুন।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত