প্রশ্ন ফাঁসে বাতিল হয় ২৪ তম বিসিএস, তবে তাহসানের পররাষ্ট্রে প্রথম হওয়ার খবরটি গুজব

ফ্যাক্টচেক ডেস্ক
প্রকাশ : ১০ জুলাই ২০২৪, ১৮: ৪৪
আপডেট : ১১ জুলাই ২০২৪, ১১: ২৫

বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান হিসেবে ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন ড. জিনাতুন নেসা তাহমিদা বেগম। তিনি জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও অভিনেতা তাহসান খানের মা। সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (বিপিএসসি) অধীন বিসিএসের ক্যাডার এবং নন–ক্যাডার নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ও সাবেক যে ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, তাঁদের একজন পিএসসির চেয়ারম্যানের গাড়িচালক আবেদ আলী।

এই আবেদ আলীর সূত্রেই সামনে আসে ড. জিনাতুন নেসা তাহমিদা বেগমের নাম। পিএসসির আরেক সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক গতকাল মঙ্গলবার সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ড. জিনাতুন নেসা তাহমিদা বেগম ও এটিএম আহমেদুল হক চৌধুরী যখন পিএসসির চেয়ারম্যান ছিলেন, তখন আবেদ পিএসসির চেয়ারম্যানের গাড়িচালক ছিলেন। ইকরাম আহমদ যখন চেয়ারম্যান ছিলেন, তখন তিনি বরখাস্ত হন। পরে তাঁকে চাকরিচ্যুতও করা হয়।’

ড. মোহাম্মদ সাদিকের এই সাক্ষাৎকারের পরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হতে থাকে যে, ড. জিনাতুন নেসা তাহমিদা বেগমের চেয়ারম্যান থাকাকালে অনুষ্ঠিত ২৪ তম বিসিএসে পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম হয়েছিলেন তাঁর ছেলে সংগীতশিল্পী তাহসান খান। পরে অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় আবারও বিসিএসের ভাইভা অনুষ্ঠিত হয়। ভাইভায় বাদ পড়ে যান তাহসান।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল এ তথ্য উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যমেও। এসব সংবাদমাধ্যমের মধ্যে আছে—জাতীয় দৈনিক যুগান্তর, ডেইলি বাংলাদেশসহ বেশ কিছু অনলাইন নিউজ পোর্টাল।

ফেসবুকে ভাইরাল কিছু পোস্টে জাতীয় দৈনিক সমকাল ও বেসরকারি সম্প্রচার মাধ্যম আরটিভিকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে সমকাল, আরটিভিতে তাহসান খানের ২৪ তম বিসিএসে অংশগ্রহণ ও পররাষ্ট্র ক্যাডারে প্রথম হওয়া নিয়ে কোনো প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। 

পরে দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ওয়েবসাইটে ২৪ তম বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে তথ্য পাওয়া যায়। ওয়েবসাইটটিতে জাতীয় দৈনিক ইনকিলাবে ২০০৩ সালের ৪ মার্চ ‘২৪ তম বিসিএস পরীক্ষা বাতিল’ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের কপি পাওয়া যায়।

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, ওই বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি ২৪ তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার অনুষ্ঠিত হওয়ার দুই ঘণ্টা আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র হাতে লেখা প্রশ্নপত্র ও উত্তর নিয়ে রমনা থানায় জিডি করতে গিয়েছিলেন। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পরও তৎকালীন পিএসসি চেয়ারম্যান ড. জিনাতুন নেসা তাহমিদা বেগম কোনো পদক্ষেপ নেননি। প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত হওয়ার পরও পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় তপিএসসি চেয়ারম্যান কোনো তদন্ত কমিটি গঠন করা থেকে বিরত থাকেন।

পরে সারা দেশে বিক্ষোভ শুরু হলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গোয়েন্দা সংস্থা অনুসন্ধানে নেমে প্রাথমিক প্রমাণ পায়। গণমাধ্যমেও এ নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর আকস্মিকভাবেই ৩ মার্চ বিকেলে পিএসসির জরুরি বৈঠকে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

বিষয়টি সম্পর্কে আরও জানতে পুরোনো পত্রিকার অনলাইন সংরক্ষণাগার ‘সংগ্রামের নোটবুক’ এর ওয়েবসাইটের সহায়তা নেওয়া হয়। ওয়েবসাইটটি থেকে পাওয়া ২০০৩ সালের ৪ মার্চে প্রকাশিত জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো, ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের প্রধান সংবাদ সূত্রেও জানা যায়, ওই সময় ২৪ তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছিল। পরে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় একই বছরের ৮ আগস্ট এবং এই পরীক্ষার ভিত্তিতেই পরে লিখিত ও ভাইভা বা মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্ত নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়।

সংগ্রামের নোটবুক থেকে আরও জানা যায়, বাতিল হওয়ার পর ৮ আগস্ট ফের অনুষ্ঠিত ২৪তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষাতেও প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠেছিল। চারজনকে আটকও করা হয়।

প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বাতিল হয় ২৪ তম বিসিএস। ছবি: ব্যানবেইসপিএসসির ওয়েবসাইট সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে উপযুক্ত প্রার্থী মনোনয়নের উদ্দেশ্যে সরকারি কর্ম কমিশন তিন স্তর বিশিষ্ট নিয়োগ পরীক্ষা গ্রহণ করে থাকে। স্তর তিনটি হলো–২০০ নম্বরের ২ ঘণ্টা সময়ে ১০টি বিষয়ের ওপর বহুনির্বাচনী প্রিলিমিনারি টেস্ট, এতে কৃতকার্য প্রার্থীদের জন্য থাকে ৯০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা। তৃতীয় স্তর বা সর্বশেষ স্তরটি হলো, লিখিত পরীক্ষায় কৃতকার্য প্রার্থীদের জন্য ২০০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা। তবে ৩৪ তম বিসিএস পরীক্ষা পর্যন্ত ১০০ নম্বরে প্রিলিমিনারি টেস্ট নেওয়া হতো।

বিসিএস পরীক্ষা বিধিমালা–২০১৪–এর বিধানমতে, ৩৫ তম বিসিএস পরীক্ষা থেকে ২০০ নম্বরের ২ ঘণ্টা সময়ে ১০টি বিষয়ের ওপর বহুনির্বাচনী প্রিলিমিনারি টেস্ট নেওয়ার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। একজন বিসিএস পরীক্ষার্থী সবকটি ধাপ পেরিয়েই চূড়ান্ত নিয়োগ পান।

বিসিএসে নিয়োগ প্রক্রিয়ার এসব ধাপ থেকে নিশ্চিত যে, ২৪ তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা প্রথমবার অনুষ্ঠিত হওয়ার তিন দিনের মাথায় বাতিল হয়ে যায়। এই বিসিএসে ভাইভা বা মৌখিক পরীক্ষা বাতিল হওয়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। সুতরাং তাহসান খান ভাইভা থেকে বাদ পড়ার তথ্য সঠিক নয়।

২৪ তম বিসিএসে পররাষ্ট্র ক্যাডারে এককভাবে প্রথম হয়েছিলেন কাজী এহসানুল হক। ছবি: জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটপ্রসঙ্গত, সংগীতশিল্পী ও অভিনেতা তাহসান ২৪ তম বিসিএসের প্রিলিমিনারিতে অংশ নিয়েছিলেন কিনা এবং নিয়ে থাকলে পাস করেছিলেন কিনা সে সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

পরে আরও খুঁজে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের প্রজ্ঞাপনগুলো পাওয়া যায়। ওয়েবসাইটে পাওয়া ২৪ তম বিসিএসের প্রজ্ঞাপন থেকে জানা যায়, ওই বিসিএসে পররাষ্ট্র ক্যাডারে ১৫ জন নিয়োগ পান। এই ১৫ জনের মধ্যে এককভাবে প্রথম হয়েছিলেন কাজী এহসানুল হক। তাঁর রেজিস্ট্রেশন নম্বর ২৬৬৩৩। এই ১৫ জনের মধ্যে তাহসান রহমান খান নামে কেউ নেই।

ফ্যাক্টচেক সম্পর্কিত আরও খবর পড়ুন-

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সংবাদমাধ্যম বা যেকোনো মাধ্যমে প্রচারিত কোনো ছবি, ভিডিও বা তথ্য বিভ্রান্তিকর মনে হলে তার স্ক্রিনশট বা লিংক কিংবা সে সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য আমাদের ই-মেইল করুন। আমাদের ই-মেইল ঠিকানা [email protected]

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত