ডেঙ্গুতে টিকায় ভরসা বিশেষজ্ঞদের

রাশেদ রাব্বি, বিশেষ প্রতিনিধি 
প্রকাশ : ২৯ জুলাই ২০২৩, ০৮: ২৯

দেশে বিগত ২৩ বছর এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরের সংক্রমণ লক্ষণীয়। তবে এটি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর উদ্যোগ নেই কোনো কর্তৃপক্ষের। ফলে প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে বাড়ে দেশের মানুষের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা, হাসপাতালে বাড়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। ডেঙ্গু পরিস্থিতির এ অবস্থায় আশা জাগিয়েছে নতুন টিকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাপানের টাবেতা ফার্মাসিউটিক্যালস নতুন প্রজন্মের কিউডেঙ্গা টিকা তৈরি করেছে। দুই ডোজের কিউডেঙ্গা টিকা ডেঙ্গু জ্বর থেকে সুরক্ষা দেয় ৮০ দশমিক ২ শতাংশ এবং ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোধ করে ৯০ দশমিক ৪ শতাংশ। টিকার এই কার্যকারিতা বজায় থাকে ১৮ মাস পর্যন্ত। টিকার সুরক্ষা নির্ভর করে কোন সেরোটাইপের ডেঙ্গু ভাইরাস দিয়ে ডেঙ্গু জ্বর হয়েছে তার ওপর। যেমন ডেঙ্গু সেরোটাইপ-১ ও ২-এর সংক্রমণ প্রতিরোধে এই টিকার কার্যকারিতা যথাক্রমে ৭০ ও ৯৫ শতাংশ। তবে ডেঙ্গু সেরোটাইপ-৩ সংক্রমণ প্রতিরোধে এর কার্যকারিতা মাত্র ৪৯ শতাংশ। তবে যারা আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু সেরোটাইপ-৩-এর বিরুদ্ধে এই টিকার কার্যকারিতা ৭৪ শতাংশ, যা বজায় থাকে প্রায় ৫৪ মাস। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই টিকা সিভিয়ার ডেঙ্গু ও হেমোরেজিক ডেঙ্গু থেকে সাড়ে ৪ বছরের জন্য সুরক্ষা দেয় ৭০ শতাংশ, তা যে সেরোটাইপ দিয়েই সংক্রমণ হোক না কেন।

এর আগে সানোফির ডেঙ্গু টিকা তৈরি করেছিল। ইয়েলো ফিভার ভাইরাসের ভেতরে ডেঙ্গু ভাইরাসের এনভেলপ ও মেমব্রেন প্রোটিনের জিন প্রবেশ করিয়ে তৈরি ওই টিকা প্রয়োগে শরীরে হিউমোরাল বা অ্যান্টিবডিসমৃদ্ধ ইমিউনিটি তৈরি হয়। কিন্তু সেল-মেডিয়েটেড ইমিউনিটি তৈরি হয় না। ফলে এই টিকা দিলে শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাসের বিরুদ্ধে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তা সংক্রমণের পরে ভাইরাসের বংশবৃদ্ধি বহু গুণে বেড়ে যায়। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে তা নিয়ে জনমনে শঙ্কা দেখা দেয়। এমনকি ৯ বছরের নিচের শিশুদের এটি 
প্রয়োগ করা যায় না।

এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে টাকেডার নতুন কিউডেঙ্গা টিকার ১৯টি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করা হয়েছে সাড়ে ৪ বছর ধরে ২৮ হাজার শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক স্বেচ্ছাসেবকের ওপর। কোনো ট্রায়ালেই সানোফির মতো অ্যান্টিবডিনির্ভর মারাত্মক কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি। এর মূল কারণ, কিউডেঙ্গা টিকা তৈরি করা হয়েছে ডেঙ্গু ভাইরাসের সেরোটাইপ-২ স্ট্রেইন ব্যবহার করে। এটি একটি লাইভ অ্যাটিনিউয়েটেড টিকা, যার ভেতরে ডেঙ্গু ভাইরাসের ৪টি সেরোটাইপ বা স্ট্রেইনের জিন প্রবেশ করানো হয়েছে, যেখানে স্ট্রাকচারাল প্রোটিন ছাড়াও রয়েছে ভাইরাসের নন-স্ট্রাকচারাল প্রোটিন। আর এর ফলেই এই টেট্রাভ্যালেন্ট ভ্যাকসিন প্রয়োগে শরীরে তৈরি হয় অ্যান্টিবডি এবং সেল-মেডিয়েটেড ইমিউনিটি। এর ফলেই সম্ভবত এই টিকায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় না। আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত অথবা অনাক্রান্ত ৪ বছরের শিশু থেকে শুরু করে যেকোনো বয়সের মানুষ কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন নিতে পারবে।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী জানিয়েছেন, বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি কর্তৃক প্রস্তাবিত দুটি ডেঙ্গু টিকা আছে। যেগুলো ইতিমধ্যে বিশ্বের প্রায় ২০টি দেশে অনুমোদন পেয়েছে। টিকাগুলোর ডেঙ্গু প্রতিরোধ সক্ষমতা ৮০ শতাংশের ওপরে। এর প্রয়োগে প্রায় ৯০ শতাংশ ভ্যাকসিনপ্রাপ্ত ব্যক্তি ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেও হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হয় না। অতীতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এমন কোনো শিশুকে কিউডেঙ্গা টিকা দিলে শিশুটি দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে পারবে। তারপরও আক্রান্ত হলে শিশুটির জন্য সেই রোগ কম ঝুঁকিপূর্ণ হবে। তবে এই টিকা শুধু যারা আগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে, তাদেরই দিতে হবে। বর্তমানে বিশ্বের ২০টি দেশে এই ভ্যাকসিনের অনুমোদন রয়েছে। লাতিন আমেরিকা এবং এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৪টি দেশে একটি গবেষণায় ৪ থেকে ১৬ বছর বয়সী প্রায় ২০ হাজার শিশুকে কিউডেঙ্গা ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছিল। ভ্যাকসিন নেওয়ার পর ৮০ শতাংশ ডেঙ্গু জ্বর কমেছে এবং ৯০ শতাংশ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কমেছে।

বাংলাদেশে এই টিকা প্রয়োগের পরামর্শ দেন অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুন্সী। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম ‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শেষে’ দেশে এ টিকা অনুমোদন দেওয়া যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত