মানসিক চাপ ডিম্বাণুর প্রস্ফুটন দাবিয়ে রাখে

অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
প্রকাশ : ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ১২: ২৩
আপডেট : ২৮ জানুয়ারি ২০২৩, ১৫: ০৪

প্রশ্ন: যখন ডিপ্রেশনে থাকি, তখন আমার মিষ্টিজাতীয় খাবার খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। মিষ্টিসহ সব ধরনের মিষ্টি খাবার খেতে থাকি। একটা লম্বা সময় ধরে মানসিক চাপে আছি, কিন্তু রাতে বেঘোরে ঘুমাই। অনেক আগে ঘুমের সমস্যাও ছিল, এখন নেই। খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে, ফলে মেদও হচ্ছে, ওজন বাড়ছে। আমি আর স্বামী ছাড়া বাসায় কেউ নেই। দুজনেই চাকরিজীবী। 
দিনা আফরোজ, চট্টগ্রাম

আমরা যখন মানসিক চাপের মধ্যে থাকি, তখন মস্তিষ্কের ১২ শতাংশ বেশি এনার্জি দরকার হয়। এর জন্য শর্করাজাতীয় খাবার খাওয়ার প্রবণতা কারও কারও ক্ষেত্রে বেড়ে যায়। এতে কিছুটা ভালো লাগে। কিছুটা হলেও কাজের গতি বাড়ে।

গবেষণা বলছে, মিষ্টিজাতীয় খাবার বেশি খাওয়ার সঙ্গে মুড ভালো হওয়ার সম্পর্ক নেই। বরং খাবারে অতিরিক্ত চিনি থাকলে সেটা মুড ডিজঅর্ডার তৈরি করতে পারে। বিশেষ করে বয়স যদি ষাটের ওপরে হয়, তাহলে এটা দুশ্চিন্তা আরও বাড়ায়। যদিও চিনি মস্তিষ্কের হরমোন তৈরির ওপর কাজ করে কিছুটা অবসাদ কমায়। সেই সঙ্গে স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল তৈরিতে কিছুটা বাধা দেয়, যেটি আপনার ক্ষেত্রে হচ্ছে। কিন্তু এটা সাময়িক মুক্তি। এর পরিণতি স্থূলতা।

বেশি মাত্রায় চিনি সেরোটোনিন নামের একটি কেমিক্যাল তৈরি বাড়িয়ে দেয়, যেটা মানুষের ক্ষুধা, স্মৃতি ও সামাজিক আচরণ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করে। কাজেই বেশি চিনি মানে বেশি সেরোটোনিন, মানে সাময়িক আনন্দ। গবেষণায় দেখা গেছে, এটা একটা দূষিত চক্র। এই উচ্চমাত্রার চিনি মস্তিষ্কের কিছু কেমিক্যালকে ভারসাম্যহীন করে বিষণ্নতা তৈরি করছে এবং দীর্ঘ মেয়াদে মেন্টাল হেলথ ডিজঅর্ডারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

দেখা গেছে, একজন মানুষ, যিনি দৈনিক ৬৭ গ্রাম বা তার বেশি চিনি ব্যবহার করেন, তাঁর ২৩ শতাংশ বেশি ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনে ভোগার আশঙ্কা আছে পরবর্তী পাঁচ বছরে। হঠাৎ করে বেশি চিনি খাওয়ার অভ্যাস থেকে চিনি খাওয়া ছেড়ে দিলে দুশ্চিন্তা, খিটখিটে মেজাজ, কনফিউশন ও ক্লান্তি তৈরি হতে পারে। খেয়াল করে দেখুন, এই উইথড্রয়ালের লক্ষণগুলো অন্যান্য নেশাজাতীয় দ্রব্য ছেড়ে দেওয়ার সময় যে লক্ষণ দেখা যায়, তার সঙ্গে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ। ভয়ংকর কথা হলো, উচ্চমাত্রার চিনিযুক্ত পানীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তি কমিয়ে দেয়। তাই ধীরে ধীরে চিনি খাওয়া কমাতে হবে, যাতে মস্তিষ্ক টের না পায়।

বিষণ্ন থাকলে প্রক্রিয়াজাত মাংস, ভাজাপোড়া, সিরিয়াল, চকোলেট, পেস্ট্রি, উচ্চ ননিযুক্ত দুগ্ধজাত খাবার, মদ, জাংক খাবার ইত্যাদি খাওয়া থেকেও দূরে থাকতে হবে। খেতে হবে গাজর, লেটুস, কলা, আনারস, বাতাবিলেবু, শসা, বাদাম, দুধ, পনির, মুরগি, টার্কির মাংস, ডিম, গাঢ় সবুজ শাক আর স্বল্পমাত্রায় কফি।

প্রশ্ন: আমি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর ফাইনাল ইয়ারে পড়ছি। আমার বন্ধুর সংখ্যা দু-তিনজন। আমার বাবা সব সময় আমার বন্ধুদের কাছ থেকে আমার খোঁজখবর নেন। তাদের জিজ্ঞেস করেন, আমি ক্লাসে কী করি, প্রেম করি কি না ইত্যাদি। যারা বাবাকে এসব খোঁজখবর দেয়, তারা বাবার খুব প্রিয়। কিন্তু আমার যে বন্ধুরা আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে এসব খোঁজখবর বাবাকে জানায় না, তাদের বাবা একেবারেই সহ্য় করতে পারেন না। এক বছর আগে আমার এক ছেলেবন্ধুকে আমার খোঁজখবর জানানোর দায়িত্ব দিয়েছিলেন বাবা। কিন্তু বাবা জানতেনই না যে সেই ছেলেবন্ধু আমাকে প্রপোজ করেছে। সেই বন্ধু বাবার আহ্লাদে আমার প্রতি পজিটিভ হয়ে ওঠে। আমার গতিবিধি সবকিছু তাৎক্ষণিক বাবাকে জানাতে শুরু করে। এটা আমি টের পেয়েছি বহু পরে। বাবাও সেই বন্ধুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। একপর্যায়ে সেই বন্ধুর সঙ্গে আমি যোগাযোগ বন্ধ করে দিই। এটা অনেক কঠিন ছিল। কারণ, আমরা একই ক্লাসে পড়ি। এই স্পাইয়িং প্রক্রিয়াটা গ্রহণ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। আমি তো কারও ক্ষতি করি না, অপরাধ করি না। তবু ভয়ে থাকতে হয়। আমি ভয় পাই বাবার সন্দেহকে। এখন আর কোনো বন্ধুকেই বিশ্বাস করতে পারি না! আমি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে চাই। কী করণীয়?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ঢাকা

আপনার বাবা আপনাকে নিয়ে ইনসিকিউরিটিতে ভোগেন। এর কারণ হয়তো তাঁর অতীত অভিজ্ঞতা অথবা আপনার নির্দিষ্ট কোনো আচরণ। তিনি মনে করছেন, এভাবে আপনার খোঁজখবর রেখে আসলে আপনারই ভালো করছেন। খোলামেলা স্বচ্ছ আলোচনায় বাবাকে জানান যে আপনি কেমন বোধ করছেন তাঁর এই আচরণে। সঙ্গে এটাও বলবেন, বাবা যে দুশ্চিন্তা থেকে এটা করছেন, সেটা আপনি বুঝতে পারছেন। তার পরে আপনি জানতে চান যে বাবার এই ভয়ের জায়গাটা কমাতে আপনার কাছ থেকে কেমন আচরণ তিনি প্রত্যাশা করেন। আপনি কোন ধরনের আচরণ তাঁর কাছ থেকে আশা করেন, সেটাও জানান। কথা লম্বা সময় টেনে নেওয়ার দরকার নেই। প্রথম দিন অল্প কিছুক্ষণ। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার আগেই কথা বন্ধ করবেন। তারপর আবার কিছুদিন পরে অনুকূল পরিস্থিতিতে এই আলাপ চালিয়ে যাবেন। বাবা আপনার কাছ থেকে কীভাবে তথ্যগুলো জানতে চান এবং সেভাবে দেওয়াটা আপনার জন্য কতটুকু সুবিধাযুক্ত, সেটা খোলামেলা আলাপ করে নিন নিজেদের মধ্যে।

প্রশ্ন: আমার বিয়ে হয়েছে চার বছর। শুরু থেকেই চেয়েছিলাম, সন্তান একটু দেরিতে নেব। সিদ্ধান্ত দুজনেরই ছিল। কিন্তু এক বছর ধরে সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করেও সফল হচ্ছি না। এটা মানসিক পীড়া দিচ্ছে। অন্যদিকে আমার শাশুড়ির ধারণা, আমার সমস্যা। তাই সন্তান নিতে পারছি না। প্রচণ্ড মানসিক চাপে আছি। আসলে আমার নানামুখী মানসিক চাপও আছে। এ কারণেও কি কনসিভ করায় সমস্যা হচ্ছে?
তুষি পাল চৌধুরী, ঢাকা

সন্তান ধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর এক থেকে দুই বছর নিজেরা চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে চিকিৎসকের সহায়তা নেওয়া প্রয়োজন। জন্মবিরতিকরণ পদ্ধতি ছাড়া এক বছরের প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সন্তান ধারণের ব্যর্থতাকে বন্ধ্যত্ব বলা হয়। বন্ধ্যত্ব দুই ধরনের। প্রাইমারি, কখনোই সন্তান হয়নি। আর সেকেন্ডারি, আগে গর্ভধারণ হয়েছে, কিন্তু পরে আর হচ্ছে না। সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৮০ শতাংশ দম্পতি প্রথম বছরেই গর্ভধারণে সমর্থ হন। ১০ শতাংশ দ্বিতীয় বছরে। বাকি ১০ শতাংশের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

বন্ধ্যত্ব ৪০ শতাংশ নারী, ৪০ শতাংশ পুরুষ, বাকি ২০ শতাংশ উভয়ের সমস্যার জন্য হয়। কাজেই একজন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যেতে পারে। আপনি বলেছেন, আপনার মানসিক চাপ আছে। মানসিক চাপ কিন্তু ডিম্বাণুর প্রস্ফুটন দাবিয়ে রাখে। অস্থির হওয়ার কিছু নেই। বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি আছে। শুধু অন্যের কথায় কান দিয়ে নিজেকে অস্থির করা থেকে বিরত থাকুন।

পরামর্শ দিয়েছেন, অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া, চিকিৎসক ও কাউন্সেলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার, ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার, ঢাকা

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত