তাবৎ অনুমান বদলে দিয়েছে ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ : ২৬ জুলাই ২০২১, ২২: ২৩

করোনাভাইরাস মহামারি এমনিতেই গোটা বিশ্বকে এক অভাবনীয় বাস্তবতার মধ্যে এনে ফেলেছে। তারপরও দেড় বছরের বেশি সময় ধরে এর সঙ্গে চলতে চলতে মানুষ এর ধারা কিছুটা বুঝতে পেরেছিল বলে মনে করেছে। এই বোঝাপড়ার ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দেশ স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চেষ্টা করছিল, নতুন করে সচল করছিল অর্থনীতি। কিন্তু ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট এসে বুঝিয়ে দিল করোনা নিয়ে এত সব পূর্বানুমানের কোনো মানে হয় না।

ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ও মহামারি বিশারদেরা বলছেন, কোভিড–১৯ রোগ সৃষ্টিতে সক্ষম করোনার ডেলটা ধরন এর আগের যেকোনো ধরনের চেয়ে বেশি ভয়ংকর। এটি দ্রুত সংক্রমিত হয়, প্রতিকূল অবস্থায় টিকে থাকার ক্ষমতাও এর বেশি।

না, এমন নয় যে, এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আবিষ্কৃত টিকাগুলো কাজ করছে না। করছে। তবে এটাও মাথায় রাখতে হবে, বিশ্বের খুব অল্প মানুষই এই টিকা পেয়েছেন। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা মানুষেরাই বরং এখনো টিকা পাননি।

বিশ্বের সেরা ১০ জন ভাইরাস বিশেষজ্ঞের সঙ্গে করোনার এই ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে কথা বলেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। তাঁদের সবাই একটি বিষয়ে একমত যে, ভারতে প্রথম ধরা পড়া ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট মানুষকে ভীষণভাবে অসুস্থ করে ফেলে। একই সঙ্গে এটি খুব দ্রুত ও সহজে সংক্রমিত হয়। এই ডেলটা ধরনে আক্রান্ত রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির হার অনেক বেশি। এমনকি টিকা গ্রহণ করেচেন এমন ব্যক্তিদের মধ্যেও এটি সংক্রমিত হতে পারে। করোনার আগের ধরনগুলোরও এমন ক্ষমতা ছিল। কিন্তু টিকা গ্রহণকারী ব্যক্তিদের আক্রান্ত করার ক্ষেত্রে ডেলটা ধরন অনেক বেশি সক্রীয় বলে এরই মধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় শঙ্কার বিষয় হলো—ডেলটা ধরনে আক্রান্ত টিকা গ্রহণকারী ব্যক্তির কাছ থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়তেও পারে।

করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ধরনের জিনোম সিকোয়েন্স তৈরির জন্য ব্রিটেন যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার পরিচালক হিসেবে রয়েছে অণুজীব বিজ্ঞানী শ্যারন পিকক। রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে ডেলটা ধরনই বিশ্বের সামনে সবচেয়ে বড় হুমকি। এখন পর্যন্ত আসা সবচেয়ে দ্রুত সংক্রমণশীল ও শক্তিশালী ভ্যারিয়েন্ট এটি।’

যেকোনো ভাইরাসই প্রতিনিয়ত নিজের জিন কাঠামো পরিবর্তন করে টিকে থাকে। আর এই বদলের মধ্য দিয়েই হাজির হয় একেকটি ভাইরাসের নতুন নতুন ধরন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মূল ভাইরাসটির চেয়ে এর পরিবর্তিত ধরটিই হয়ে ওঠে বেশি ভয়ংকর। করোনার ডেলটা ধরনের ক্ষেত্রেও এমনটিই হয়েছে।

এখন পর্যন্ত ডেলটা ধরন সম্পর্কে যেথষ্ট তথ্য ভাইরাস বিশেষজ্ঞদের হাতে আসেনি। তাই তাঁরা করোনা মোকাবিলার অংশ হিসেবে মাস্ক পরাসহ বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শই দিচ্ছেন। একই সঙ্গে সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছেন, সুযোগ পাওয়ামাত্রই টিকা গ্রহণের জন্য।

ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট এখন বিশ্বের বহু দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ভারতে প্রথম এই ধরনটি শনাক্ত হলেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এটি চড়িয়ে যেতে সময় লাগেনি। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকাতেও ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে।

গত শুক্রবার পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের দেওয়া বিবৃতিতে জানানো হয়, ওই দিন ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়ে দেশটির বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয় ৩ হাজার ৬৯২ জন রোগী। এর মধ্যে ৫৮ দশমিক ৩ শতাংশ টিকা নেননি। আর পূর্ণাঙ্গ ডোজ টিকা গ্রহণের পরও করোনার এই ধরনটিতে আক্রান্ত হয়েছে মোট রোগীর ২২ দশমিক ৮ শতাংশ।

সিঙ্গাপুরে করোনা আক্রান্তদের মধ্যে ডেলটা ভ্যারিয়েন্টই মুখ্য হয়ে উঠেছে। দেশটির সরকার জানায়, দেশটিতে টিকা নেওয়ার পরও যারা করোনা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের তিন–চতুর্থাংশই এই ধরনে আক্রান্ত। যদিও তাঁদের কেউই গুরুতর অসুস্থ হননি।

ইসরায়েলেও টিকা নেওয়ার পর করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। দেশটিতে হাসপাতালে ভর্তি মোট করোনা রোগীর ৬০ শতাংশই টিকা নেওয়ার পর আক্রান্ত হয়েছে। করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে চিত্রটি আরও ভয়াবহ। নতুন আক্রান্তদের ৮৩ শতাংশই ডেলটা ধরনে আক্রান্ত। তবে যারা গুরুতর অসুস্থ হচ্ছেন, তাঁদের ৯৭ শতাংশই টিকা গ্রহণ না করার দলে।

ইসরায়েলের বেন গুরিয়ন ইউনিভার্সিটির জনস্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক নাদাভ দাভিদোভিচ বলেন, ‘সব সময়ই এমন একটা ধারণা আছে যে, কোথাও না কোথাও একটা জাদুকরী কিছু আছে, যা আমাদের সব সমস্যার সমাধান করবে। করোনাভাইরাস আমাদের এখন শিক্ষা দিয়ে ছাড়ছে।’

নাদাভ দাভিদোভিচের কথাটি বুঝতে হলে ইসরায়েলের সংক্রমণ পরিস্থিতির দিকে তাকাতে হবে। রয়টার্স জানাচ্ছে, ফাইজার–বায়োএনটেকের টিকা এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত টিকাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু ইসরায়েলে ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট ছড়ানোর পর এটি করোনা উপসর্গ ছড়ানো রোধে মাত্র ৪১ শতাংশ কার্যকর হতে পেরেছে। ইসরায়েল সরকারের দেওয়া এ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এখনই অবশ্য কোনো উসংহারে পৌঁছাতে চাইছেন না স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

কেন এমনটি হচ্ছে। নাদাভ দাভিদোভিচ বলেন, ‘করোনা থেকে কোনো ব্যক্তিকে সুরক্ষা দিতে এই টিকা বেশ কার্যকর হলেও ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে এটি বেশ দুর্বল।’

আর ডেলটা ভ্রারিয়েন্ট যেহেতু খুব দুত ও সহজে ছড়াতে পারে, সেহেতু এটি রোধ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এই একই তথ্য জানাচ্ছে চীন। তারা বলছে, উহান স্ট্রেইনের ক্ষেত্রে একজন ব্যক্তির নাকে যে পরিমাণ ভাইরাস থাকত, ডেলটা আক্রান্ত ব্যক্তির নাকে তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি ভাইরাস থাকে। আর বেশি ভাইরাস বহনের কারণে অন্যের মধ্যে এটি সংক্রমিত করার হারও বেশি।

এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার লা জোলার স্ক্রিপস রিসার্চ ট্রান্সলেশনাল ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও জিন বিশেষজ্ঞ এরিক টোপল রয়টার্সকে বলেন, ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের ইনকিউবেশন কাল অনেক কম। অর্থাৎ এটি সক্রিয় হতে কম সময় নেয়। একই সঙ্গে বিপলসংখ্যক ভাইরাস একসঙ্গে বাসা বাঁধে। এ কারণে টিকাগুলো একে সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। তাই টিকা যারা নিয়েছেন, তাঁদেরও আলাদাভাবে সতর্ক হওয়া জরুরি।

যুক্তরাষ্ট্রেই যেমন ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ার মূল কারণ মানুষের মাস্ক পরা কমিয়ে দেওয়া। বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন, ডেলটা ধরন হোক আর যা–ই হোক করোনা থেকে বাঁচতে এখন পর্যন্ত পরীক্ষিত ব্যবস্থা হিসেবে মাস্ক পরা ও পরিচ্ছন্নতার নিয়মগুলো মেনে চলা জরুরি। এর সঙ্গে যাবতীয় স্বাস্থ্য সতর্কতা মেনে চলার জন্য তাঁরা সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত