সৌদিতে বাংলাদেশি শ্রমিক: প্রতারিত, নির্যাতিত হয়ে খালি হাতে দেশে ফেরার গল্প

অনলাইন ডেস্ক
Thumbnail image

ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের অ্যারাইভাল গেটে পরিবারের সদস্যদের পুনর্মিলনের দৃশ্য অনেকটাই পরিচিত। তবে আরও একটি দৃশ্যও দেখা যায় সেখানে—দাঁড়িয়ে আছেন একদল যাত্রী। অনেকটাই হতভম্ব! এই মানুষদের বেশির ভাগের কাছেই একটি পাতলা কম্বল ছাড়া আর কিছুই নেই। কম্বলটিও তাঁরা উড়োজাহাজেই পেয়েছিলেন। তাঁদের পরনে সাধারণত থাকে ট্রাউজার, পায়ে রাবারের স্যান্ডেল। কেউ কেউ হাঁটেন খালি পায়ে। 

তাঁদের বেশির ভাগই সৌদি আরব বিতাড়িত শ্রমিক। প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের মানুষ ফিরছে বাংলাদেশে। ২০২২ সালে প্রায় ৭০ হাজার বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিককে বিতাড়িত করা হয়েছে সৌদি আরব থেকে। বেশির ভাগেরই ছিল না সেখানে বসবাসের এবং কাজ করার অনুমতি, যা ইকামা নামে পরিচিত। 

বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ থেকে তাঁরা ফিরে আসেন ক্ষুধার্ত, শরীরে জখম নিয়ে ও নিঃস্ব অবস্থায়। দেশে ফেরার পর তাঁদের হাতে বাসের টিকিট কেনার টাকাও থাকে না। তাঁরা কেবল সঙ্গে করে নিয়ে আসেন প্রতারিত, নিপীড়িত, ভুয়া চুক্তি ও মজুরি না পাওয়ার হৃদয়বিদারক সব গল্প। 

এমন একজন আমির হোসেন। সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য রিক্রুটিং এজেন্টদের ৪ লাখ টাকা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মাত্র এক বছর পরই তাঁকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। এই এক বছরের মধ্যে নয় মাস বিনা বেতনে কাজ করেছেন তিনি। 

আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘আমাকে বলা হয়েছিল, আমি একটি পাঁচতারকা হোটেলে কাজ করব। কিন্তু শেষে কাজ করতে হয়েছে একটি চায়ের স্টলে!’ 

তৃতীয় ব্যক্তি বলেন, তিনি তিন মাস কাজ করেছেন। কিন্তু মাত্র এক মাসের বেতন পেয়েছেন। 

২০৩৪ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজন করতে যাচ্ছে সৌদি আরব। এই স্বপ্ন পূরণে যে বিপুল অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে, সেটি নির্ভর করছে এই মানুষগুলোর মতো কয়েক লাখ সস্তা শ্রমিকের ওপর। 

চলতি বছরই ২০৩৪ সালের বিশ্বকাপের আয়োজক দেশের নাম ঘোষণা করবে ফিফা। আয়োজক হিসেবে দ্বিতীয় কোনো দেশের নাম আসেনি। ফলে সৌদি আরবের স্বাগতিক হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আর এটি হলে নাটকীয়ভাবে দেশটিতে বাংলাদেশি কর্মীর চাহিদা বেড়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

তবে সৌদি নিয়োগকর্তাদের হাতে শ্রমিকদের নিপীড়িত হওয়ার অভিযোগ ফিফার কাছে গেলে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। ২০২২ সালে কাতার বিশ্বকাপের সময়ও অনেক অভিবাসী শ্রমিকের নির্যাতিত হওয়ার খবর বের হয়েছিল। তখন ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিল আয়োজক দেশটি।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে সতর্ক করছে যে, সৌদি আরব অভিবাসী কর্মীদের নির্যাতন বন্ধ করার ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ না নিলে আরেকটি বিশ্বকাপের গায়ে লাগতে পারে শ্রমিকের ওপর শোষণ ও নির্যাতনের কলঙ্ক। 

বসবাসের বৈধ কাগজপত্র না থাকার জন্য বাংলাদেশি শ্রমিকদের সাধারণত দায়ী করা যায় না। বাংলাদেশে ফিরে আসা অনেকেই দাবি করেন, সৌদি আরবে তাঁদের নিয়োগকর্তা বা পৃষ্ঠপোষক তাঁদের ইকামা নথি সংগৃহ করতে বা নবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

সৌদি আরবে সাড়ে তিন বছর কাজ করা মোহাম্মদ রহমতউল্লাহ বলেন, ‘আমার বস আমাকে না জানিয়েই আমার ইকামা বাতিল করে দিয়েছেন। পুলিশ আমাকে ধরে আমার বসকে ডেকেছিল। বস এসে পুলিশকে বললেন, আমাকে দেশে ফেরত পাঠাতে। তাঁর কাছে আমার ছয় মাসের মজুরি পাওনা।’ 

আবার অনেক বাংলাদেশি শ্রমিকের অভিযোগ, তাঁদের ইকামার বৈধতা থাকলেও সৌদি আরব থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। শাহাবুদ্দিন নামের এমন এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমি পুলিশকে বলেছিলাম, আমাকে গ্রেপ্তার করছেন কেন? তারা আমাকে চুপ করতে বলেছিল।’ 

মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, সৌদি আরবে অভিবাসী শ্রমিকদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ এবং শ্রমিকেরা সেখানে স্পনসরশিপ ব্যবস্থার অধীনে নির্যাতিত এবং শোষিত হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষকে নির্বিচারে অমানবিক পরিস্থিতিতে আটকে রাখা হয়েছে, নির্যাতন করা হয়েছে। শেষে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে নিজ দেশে। 

সৌদি আরবে কাফালা সিস্টেম বাতিল করা হয়েছে। এই ব্যবস্থার অধীনেই নিয়োগকর্তার সঙ্গে আবদ্ধ থাকতেন শ্রমিকেরা। তবে অভিবাসীদের অধিকার বিষয়ক সংগঠন মাইগ্র্যান্ট–রাইটস অর্গানাইজেশনের সম্পাদক আলী মোহাম্মদ বলেন, নিয়োগকর্তারা ওয়ার্ক পারমিট প্রত্যাহার বা নবায়ন না করার ক্ষমতা রাখেন। শ্রমিক পালিয়ে গেলে মামলাও করতে পারেন। শ্রমিকের বিরুদ্ধে কাজে অনিয়মিত থাকার অভিযোগ তুলে দেশ থেকে বিতাড়িতও করতে পারেন। 

তিনি আরও বলেন, অভিবাসীদের গ্রেপ্তার এবং নির্বাসনকে নিয়োগকর্তাদের এখতিয়ারে রাখা এই ধারণাকেই শক্তিশালী করে যে, সৌদি কর্তৃপক্ষ অভিবাসীদের কেবল শোষণযোগ্য শ্রমিক হিসেবেই বিবেচনা করে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে শ্রমিকেরা বলেছেন, তাঁদের রাস্তায় আটক করা হয়েছিল বা সকালের নাশতা খাওয়ার সময় তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এরপর তাঁদের সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আটক কেন্দ্রে। সেখান থেকে তাঁদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল দেশে। এর আগে আটক কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল এক থেকে দুই সপ্তাহ। 

এই আটক কেন্দ্রের অবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই ভিন্ন হয়। অনেকে বলেন, তাঁদের রাখা হয়েছিল বিশাল এক ঘরে। সেখানে একসঙ্গে থাকে ২৫০ থেকে ৩০০ মানুষ। গোসলের কোনো সুযোগ ছিল না। খাবার ছিল সামান্য। ১৬ দিন আটক থেকে দেশে ফেরা রহমতউল্লাহ বলেন, ‘পরিস্থিতি শোচনীয় ছিল। আমি আমার জীবনে এমন জায়গা দেখিনি।’ 

সৌদি আরব থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশ ফেরত শ্রমিকদের অবস্থা সাধারণত নাজুক থাকে। প্রায় সব অভিবাসী শ্রমিককেই উপসাগরীয় দেশটিতে কাজের জন্য রিক্রুটিং এজেন্টকে টাকা দিতে হয়। বাংলাদেশিদের কাছ থেকে এই ফি সর্বোচ্চ। অনেককে তাঁদের নিয়োগের খরচ মেটাতে পারার আগেই বাড়ি ফিরতে বাধ্য করা হয়। 

সৌদি আরবে ২৬ বছর কাটিয়ে আসা ৬৫ বছর বয়সী সাবির আহমেদ ঢাকা বিমানবন্দরে এসেছেন ছোট একটি ব্যাগ নিয়ে। তাতে প্রায় কিছুই নেই। বাসে বাড়ি যাওয়ার টাকাও তার কাছে নেই। সাবির আহমেদ বলেন, ‘আমি বাড়ি পৌঁছালে আমার পরিবারকে বাস ভাড়া দিতে হবে।’ এ কথা বলে তিনি চলে গেলেন খালি ব্যাগটি নিয়ে। তিন দশক কাজ করার পর খালি ব্যাগটি ছাড়া তাঁর কাছে আর কিছুই নেই। 

সৌদি আরবের মানবসম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, কাজ এবং আবাসিক বিধিলঙ্ঘন করেছে বলে প্রমাণিত ব্যক্তিদেরই প্রত্যাবাসন করেন তাঁরা। সমস্ত আইনি প্রক্রিয়া মেনে এবং নিজ নিজ দেশের দূতাবাসের মধ্যে সমন্বয় করেই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, আটক কেন্দ্রগুলো সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করা হয়। শ্রমিকদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টি এবং পরিষ্কার ও নিরাপদ পরিবেশের অধিকার নিশ্চিত করা হয়। 

দ্য গার্ডিয়ানের নিবন্ধ থেকে অনূদিত

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত