অনলাইন ডেস্ক
আউটলুক ইন্ডিয়া: ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের পতনের পর পেরিয়ে গেছে ৩ সপ্তাহ। দেশ এখন একটি উত্তরণের সন্ধিক্ষণে। একজন কর্মী ও সমন্বয়ক হিসেবে বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
তাপসী দে প্রাপ্তি: শেখ হাসিনার একনায়কতান্ত্রিক শাসনামলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো ব্যাপকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিল। দেশে একটি এক দলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল যেখানে আওয়ামী লীগ এবং এর সঙ্গে জড়িতদেরই সুবিধা দিত। সব প্রতিকূলতার পরও আমরা এখন বিগত সরকারের দুর্নীতি ও নিপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে জাতিকে পুনর্গঠনের দিকে মনোনিবেশ করেছি।
যদিও প্রতিটি স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশি নাগরিকের প্রধান অগ্রাধিকার ছিল পূর্ববর্তী সরকারের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটানো, তবে এটা মনে রাখা জরুরি যে—আমাদের বিপ্লব কেবল হাসিনার সরকারকে উৎখাত করা ছিল না। এমন অনেক পরিবর্তন রয়েছে, যার জন্য আমাদের এখনো লড়াই করতে হবে। দায়মুক্তির সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে হবে, যে কোনো মূল্যে নারীর প্রতি যৌন নিপীড়ন ও বৈষম্য বন্ধ করতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক শাসন দূর করতে হবে এবং সরকারকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যান্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক সংস্কারও নিশ্চিত করতে হবে। এসব পরিবর্তন ছাড়া বিপ্লবকে কখনোই সফল বলে গণ্য করা যায় না। আজকের বাংলাদেশ আমাদের শহীদ ভাইদের আত্মত্যাগের ওপর দাঁড়িয়ে আছে যাদের জুলাই-আগস্টের বিক্ষোভ-আন্দোলনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। আমরা তাদের আত্মত্যাগ বৃথা যেতে দেব না।
আউটলুক ইন্ডিয়া: শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ক্রমবর্ধমান ঘটনা দেশের অভ্যন্তরে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করবেন কি?
তাপসী দে প্রাপ্তি: গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আইনশৃঙ্খলার অনুপস্থিতির কারণে ভাঙচুর ও লুটপাটের মর্মান্তিক ঘটনার সম্মুখীন হয়। তবে এরপর থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনিক ব্যবস্থা জোরদার করায় সাম্প্রদায়িক হামলা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। পুলিশ এখন সারা দেশে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে এবং প্রধানত হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকায় সামরিক উপস্থিতি মোতায়েন করা হয়েছে।
আউটলুক ইন্ডিয়া: এসব সাম্প্রদায়িক হামলার কতগুলো আসলে সত্য?
তাপসী দে প্রাপ্তি: বিবিসি সম্প্রতি একটি ফ্যাক্ট-চেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়ে ব্যাপকভাবে প্রচারিত সোশ্যাল মিডিয়া ফুটেজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই মিথ্যা এবং বানোয়াট। এই মিথ্যা দাবিগুলোর বেশির ভাগই ভারতীয় গোদি মিডিয়ার সৃষ্টি এবং তারাই এগুলো প্রচার করেছে। তারাই বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ড হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে—যা হিন্দুদের দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিকে ঠেলে দেয়।
যাই হোক, তারা (গোদি মিডিয়া) ইচ্ছাকৃতভাবে সেইসব অসংখ্য দৃষ্টান্ত উপেক্ষা করেছে যেখানে আমাদের মুসলিম ভাই ও বোনেরা সারা রাত হিন্দু মন্দির এবং অন্যান্য উপাসনালয়গুলোকে সচেতনভাবে রক্ষা করেছে। আমি নিজে একজন বাংলাদেশি হিন্দু হওয়ায় আমি আপনাকে বলতে পারি, আমরা বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে ঐক্যের এমন হৃদয়গ্রাহী প্রদর্শন আর দেখিনি।
আউটলুক ইন্ডিয়া: বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো কি দেশের ভেতরে ও বাইরে প্রচারিত এ ধরনের সাম্প্রদায়িক প্রোপাগান্ডা সম্পর্কে খুব বেশি সচেতন?
তাপসী দে প্রাপ্তি: হ্যাঁ! বাংলাদেশের অধিকাংশ সংখ্যালঘুরা ভালো করেই জানে যে, এই হামলাগুলো সাম্প্রদায়িক না হয়ে রাজনৈতিক কারণেই বেশি হয়। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশি হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুরা সর্বদা ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের রাজনৈতিক লাভের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছর ধরে আমাদের শোষণ করেছে, আগের খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জামায়াত-বিএনপি সরকারও একই কাজ করেছে।
হাসিনার প্রস্থানের পর আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী দলগুলো জনগণের বিদ্রোহকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করে। আবার বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো অন্যান্য মৌলবাদী দলগুলো তাদের সুবিধার জন্য পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত অশান্তি অব্যাহত ছিল। এবার, বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, সুফি এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কোনো বিভাজনমূলক এজেন্ডায় রাজনীতির দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত না হওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা দৃঢ়ভাবে কোনো সাম্প্রদায়িক ফাঁদে আটকা পড়তে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করি। কোনোভাবেই তা হতে দেওয়া যাবে না।
আউটলুক ইন্ডিয়া: নবগঠিত অন্তর্বর্তী সরকারে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা সামরিক সম্পৃক্ততার সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। আপনি কি মনে করেন যে, একটি সামরিক অভ্যুত্থানের কোনো সম্ভাবনা আছে?
তাপসী দে প্রাপ্তি: বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কেরা ধারাবাহিকভাবে জোর দিয়ে বলে আসছেন যে, সেনাবাহিনীর প্রতি ছাত্রদের মধ্যে আস্থার ব্যাপক অভাব আছে। কারণ সামরিক শাসিত রাষ্ট্র কখনোই বেসামরিক নাগরিকদের জন্য কোনো ভালো ফল বয়ে আনেনি। আগে অন্তর্বর্তী সরকারে সামরিক বাহিনী অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও—যেমনটা হয়েছে ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়—এবারে বর্তমান পরিস্থিতি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, বাংলাদেশ আর্মি একটি ‘হ্যান্ডস অফ’ পদ্ধতি—যেখানে তারা নাক না গলিয়ে সরকারকে আরও স্বায়ত্তশাসিত হিসেবে কাজ করা সুযোগ দিয়েছে।
এখন পর্যন্ত, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রশাসনিক দায়িত্ব অন্তর্বর্তী কর্তৃপক্ষের হাতে ছেড়ে দিয়েছে, তারা শাসনভার গ্রহণের কোনো প্রবণতা দেখায়নি। অপ্রত্যাশিত ঘটনা না ঘটলে বা অন্তর্বর্তী সরকারের পদ্ধতিতে উল্লেখযোগ্য ত্রুটি দেখা না দিলে, সেনাবাহিনী সম্ভবত ব্যারাকেই অবস্থান করবে।
আউটলুক ইন্ডিয়া: একটু পেছন ফিরে দেখলে, ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের সময় ইরানেও বাংলাদেশের মতো একটি পরিস্থিতি হয়েছিল। অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের একটি ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন?
তাপসী দে প্রাপ্তি: সত্যি কথা বলতে, আপাতত নয়। যদিও এটা অনস্বীকার্য যে, ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে যারা আমাদের সঙ্গে লড়াই করেছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলাদেশকে একটি ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়। আশা করা যায়, অধিকাংশ ছাত্র-নাগরিক বিক্ষোভকারীরা এখন একটি গণতান্ত্রিক, উদারনৈতিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ চায় কারণ এরশাদ, খালেদা এবং হাসিনার মতো স্বৈরাচারী ব্যক্তিত্বদের ক্ষমতা দেওয়ার পরিণতি আমরা এরই মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি। কেউই অতীতের পুনরাবৃত্তি চায় না।
আউটলুক ইন্ডিয়া: আরজি কর—এর বর্বরোচিত ঘটনার পর বাংলাদেশের নারীরা কলকাতায় নারীদের ‘রাত দখল করো’—মার্চের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বিক্ষোভ করেছে। একইভাবে, কলকাতার বিক্ষোভকারীরাও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিপ্লব থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছে। ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে যাওয়া এই বিদ্রোহী ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কে আপনার চিন্তা কি?
তাপসী দে প্রাপ্তি: তিলোত্তমার নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণ আমাদের একেবারে ভেঙে দিয়েছে। কলকাতায় মহিলাদের ‘রাত দখল করো’—পদযাত্রা দেখার পর, আমরা কুমিল্লার সোহাগী জাহান তনু এবং ঢাকার মোসাররাত জাহান মুনিয়াসহ সব ধর্ষণের মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবিতে কলকাতার বিক্ষোভের সঙ্গে একাত্মতা জানাতে বাংলাদেশেও একই ধরনের আন্দোলন সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আরজি করের ঘটনা আবারও সীমান্তের ওপারে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি তুলে ধরেছে এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে। তাই আমাদের বিক্ষোভে আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম, “আমরা সবাই তিলোত্তমা, আমরা সবাই তনু, সোহাগী জাহান, মোসাররাত জাহান মুনিয়া, আমরা সবাই কল্পনা চাকমা, আমরা সবাই ফিলিস্তিন!”
পুরো দক্ষিণ এশিয়া বর্তমানে নিপীড়ন, পিতৃতন্ত্র এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধের সাক্ষী। শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালের আরাগালায় বিপ্লব আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার প্রধান উৎস এবং কলকাতা ও বেলুচিস্তানে সাম্প্রতিক বিক্ষোভ আমাদের বিদ্রোহের অটল চেতনাকে প্রতিফলিত করেছে। তদুপরি, ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি নারীদের চলমান সংগ্রামও আমাদের অধিকারের লড়াইয়ের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই আন্তসীমান্ত ভাব আদান-প্রদান বিশ্বব্যাপী পিতৃতন্ত্র ও অবিচারের বিরুদ্ধে নারীদের প্রতিরোধের সর্বজনীন চেতনাকে প্রতিফলিত করে। ঢাকা থেকে বেলুচিস্তান হয়ে কলকাতা, সর্বত্রই বইছে পরিবর্তনের হাওয়া। বিপ্লব আসলেই সংক্রামক!
আরও খবর পড়ুন:
আউটলুক ইন্ডিয়া: ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনের পতনের পর পেরিয়ে গেছে ৩ সপ্তাহ। দেশ এখন একটি উত্তরণের সন্ধিক্ষণে। একজন কর্মী ও সমন্বয়ক হিসেবে বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
তাপসী দে প্রাপ্তি: শেখ হাসিনার একনায়কতান্ত্রিক শাসনামলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো ব্যাপকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিল। দেশে একটি এক দলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল যেখানে আওয়ামী লীগ এবং এর সঙ্গে জড়িতদেরই সুবিধা দিত। সব প্রতিকূলতার পরও আমরা এখন বিগত সরকারের দুর্নীতি ও নিপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে জাতিকে পুনর্গঠনের দিকে মনোনিবেশ করেছি।
যদিও প্রতিটি স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশি নাগরিকের প্রধান অগ্রাধিকার ছিল পূর্ববর্তী সরকারের ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান ঘটানো, তবে এটা মনে রাখা জরুরি যে—আমাদের বিপ্লব কেবল হাসিনার সরকারকে উৎখাত করা ছিল না। এমন অনেক পরিবর্তন রয়েছে, যার জন্য আমাদের এখনো লড়াই করতে হবে। দায়মুক্তির সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে হবে, যে কোনো মূল্যে নারীর প্রতি যৌন নিপীড়ন ও বৈষম্য বন্ধ করতে হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক শাসন দূর করতে হবে এবং সরকারকে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যান্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক সংস্কারও নিশ্চিত করতে হবে। এসব পরিবর্তন ছাড়া বিপ্লবকে কখনোই সফল বলে গণ্য করা যায় না। আজকের বাংলাদেশ আমাদের শহীদ ভাইদের আত্মত্যাগের ওপর দাঁড়িয়ে আছে যাদের জুলাই-আগস্টের বিক্ষোভ-আন্দোলনে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। আমরা তাদের আত্মত্যাগ বৃথা যেতে দেব না।
আউটলুক ইন্ডিয়া: শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ক্রমবর্ধমান ঘটনা দেশের অভ্যন্তরে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করবেন কি?
তাপসী দে প্রাপ্তি: গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আইনশৃঙ্খলার অনুপস্থিতির কারণে ভাঙচুর ও লুটপাটের মর্মান্তিক ঘটনার সম্মুখীন হয়। তবে এরপর থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনিক ব্যবস্থা জোরদার করায় সাম্প্রদায়িক হামলা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। পুলিশ এখন সারা দেশে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে এবং প্রধানত হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকায় সামরিক উপস্থিতি মোতায়েন করা হয়েছে।
আউটলুক ইন্ডিয়া: এসব সাম্প্রদায়িক হামলার কতগুলো আসলে সত্য?
তাপসী দে প্রাপ্তি: বিবিসি সম্প্রতি একটি ফ্যাক্ট-চেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়ে ব্যাপকভাবে প্রচারিত সোশ্যাল মিডিয়া ফুটেজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই মিথ্যা এবং বানোয়াট। এই মিথ্যা দাবিগুলোর বেশির ভাগই ভারতীয় গোদি মিডিয়ার সৃষ্টি এবং তারাই এগুলো প্রচার করেছে। তারাই বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ড হয়েছে বলে অভিযোগ করেছে—যা হিন্দুদের দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিকে ঠেলে দেয়।
যাই হোক, তারা (গোদি মিডিয়া) ইচ্ছাকৃতভাবে সেইসব অসংখ্য দৃষ্টান্ত উপেক্ষা করেছে যেখানে আমাদের মুসলিম ভাই ও বোনেরা সারা রাত হিন্দু মন্দির এবং অন্যান্য উপাসনালয়গুলোকে সচেতনভাবে রক্ষা করেছে। আমি নিজে একজন বাংলাদেশি হিন্দু হওয়ায় আমি আপনাকে বলতে পারি, আমরা বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে ঐক্যের এমন হৃদয়গ্রাহী প্রদর্শন আর দেখিনি।
আউটলুক ইন্ডিয়া: বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলো কি দেশের ভেতরে ও বাইরে প্রচারিত এ ধরনের সাম্প্রদায়িক প্রোপাগান্ডা সম্পর্কে খুব বেশি সচেতন?
তাপসী দে প্রাপ্তি: হ্যাঁ! বাংলাদেশের অধিকাংশ সংখ্যালঘুরা ভালো করেই জানে যে, এই হামলাগুলো সাম্প্রদায়িক না হয়ে রাজনৈতিক কারণেই বেশি হয়। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশি হিন্দু ও অন্যান্য সংখ্যালঘুরা সর্বদা ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিদের রাজনৈতিক লাভের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। আওয়ামী লীগ গত ১৫ বছর ধরে আমাদের শোষণ করেছে, আগের খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জামায়াত-বিএনপি সরকারও একই কাজ করেছে।
হাসিনার প্রস্থানের পর আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী দলগুলো জনগণের বিদ্রোহকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা করে। আবার বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো অন্যান্য মৌলবাদী দলগুলো তাদের সুবিধার জন্য পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত অশান্তি অব্যাহত ছিল। এবার, বাংলাদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, সুফি এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কোনো বিভাজনমূলক এজেন্ডায় রাজনীতির দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহৃত না হওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা দৃঢ়ভাবে কোনো সাম্প্রদায়িক ফাঁদে আটকা পড়তে দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করি। কোনোভাবেই তা হতে দেওয়া যাবে না।
আউটলুক ইন্ডিয়া: নবগঠিত অন্তর্বর্তী সরকারে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা সামরিক সম্পৃক্ততার সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। আপনি কি মনে করেন যে, একটি সামরিক অভ্যুত্থানের কোনো সম্ভাবনা আছে?
তাপসী দে প্রাপ্তি: বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কেরা ধারাবাহিকভাবে জোর দিয়ে বলে আসছেন যে, সেনাবাহিনীর প্রতি ছাত্রদের মধ্যে আস্থার ব্যাপক অভাব আছে। কারণ সামরিক শাসিত রাষ্ট্র কখনোই বেসামরিক নাগরিকদের জন্য কোনো ভালো ফল বয়ে আনেনি। আগে অন্তর্বর্তী সরকারে সামরিক বাহিনী অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও—যেমনটা হয়েছে ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়—এবারে বর্তমান পরিস্থিতি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, বাংলাদেশ আর্মি একটি ‘হ্যান্ডস অফ’ পদ্ধতি—যেখানে তারা নাক না গলিয়ে সরকারকে আরও স্বায়ত্তশাসিত হিসেবে কাজ করা সুযোগ দিয়েছে।
এখন পর্যন্ত, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রশাসনিক দায়িত্ব অন্তর্বর্তী কর্তৃপক্ষের হাতে ছেড়ে দিয়েছে, তারা শাসনভার গ্রহণের কোনো প্রবণতা দেখায়নি। অপ্রত্যাশিত ঘটনা না ঘটলে বা অন্তর্বর্তী সরকারের পদ্ধতিতে উল্লেখযোগ্য ত্রুটি দেখা না দিলে, সেনাবাহিনী সম্ভবত ব্যারাকেই অবস্থান করবে।
আউটলুক ইন্ডিয়া: একটু পেছন ফিরে দেখলে, ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের সময় ইরানেও বাংলাদেশের মতো একটি পরিস্থিতি হয়েছিল। অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের একটি ইসলামি রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন?
তাপসী দে প্রাপ্তি: সত্যি কথা বলতে, আপাতত নয়। যদিও এটা অনস্বীকার্য যে, ফ্যাসিবাদী হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে যারা আমাদের সঙ্গে লড়াই করেছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলাদেশকে একটি ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়। আশা করা যায়, অধিকাংশ ছাত্র-নাগরিক বিক্ষোভকারীরা এখন একটি গণতান্ত্রিক, উদারনৈতিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ চায় কারণ এরশাদ, খালেদা এবং হাসিনার মতো স্বৈরাচারী ব্যক্তিত্বদের ক্ষমতা দেওয়ার পরিণতি আমরা এরই মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি। কেউই অতীতের পুনরাবৃত্তি চায় না।
আউটলুক ইন্ডিয়া: আরজি কর—এর বর্বরোচিত ঘটনার পর বাংলাদেশের নারীরা কলকাতায় নারীদের ‘রাত দখল করো’—মার্চের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে বিক্ষোভ করেছে। একইভাবে, কলকাতার বিক্ষোভকারীরাও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বিপ্লব থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছে। ভৌগোলিক সীমানা পেরিয়ে যাওয়া এই বিদ্রোহী ভ্রাতৃত্ব সম্পর্কে আপনার চিন্তা কি?
তাপসী দে প্রাপ্তি: তিলোত্তমার নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণ আমাদের একেবারে ভেঙে দিয়েছে। কলকাতায় মহিলাদের ‘রাত দখল করো’—পদযাত্রা দেখার পর, আমরা কুমিল্লার সোহাগী জাহান তনু এবং ঢাকার মোসাররাত জাহান মুনিয়াসহ সব ধর্ষণের মামলার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবিতে কলকাতার বিক্ষোভের সঙ্গে একাত্মতা জানাতে বাংলাদেশেও একই ধরনের আন্দোলন সংগঠিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আরজি করের ঘটনা আবারও সীমান্তের ওপারে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি তুলে ধরেছে এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে। তাই আমাদের বিক্ষোভে আমরা ঘোষণা দিয়েছিলাম, “আমরা সবাই তিলোত্তমা, আমরা সবাই তনু, সোহাগী জাহান, মোসাররাত জাহান মুনিয়া, আমরা সবাই কল্পনা চাকমা, আমরা সবাই ফিলিস্তিন!”
পুরো দক্ষিণ এশিয়া বর্তমানে নিপীড়ন, পিতৃতন্ত্র এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধের সাক্ষী। শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালের আরাগালায় বিপ্লব আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার প্রধান উৎস এবং কলকাতা ও বেলুচিস্তানে সাম্প্রতিক বিক্ষোভ আমাদের বিদ্রোহের অটল চেতনাকে প্রতিফলিত করেছে। তদুপরি, ইসরায়েলি দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি নারীদের চলমান সংগ্রামও আমাদের অধিকারের লড়াইয়ের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই আন্তসীমান্ত ভাব আদান-প্রদান বিশ্বব্যাপী পিতৃতন্ত্র ও অবিচারের বিরুদ্ধে নারীদের প্রতিরোধের সর্বজনীন চেতনাকে প্রতিফলিত করে। ঢাকা থেকে বেলুচিস্তান হয়ে কলকাতা, সর্বত্রই বইছে পরিবর্তনের হাওয়া। বিপ্লব আসলেই সংক্রামক!
আরও খবর পড়ুন:
ইউনিক গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শাখাওয়াত হোসেন। পর্যটনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন আজকের পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি মনজুরুল ইসলাম।
০৩ অক্টোবর ২০২৪‘আমি এটাকে ঠিক রাজনৈতিক ভাবাদর্শ বলব না। আমি এটাকে বলব, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া, সেটা আমার পারিবারিক শিক্ষা। আমাদের ঘরের ডাইনিং টেবিল থেকে শুরু করে যেকোনো ক্ষেত্রে প্রয়োজনে পরিবারের বড়দের সাথে আমরা দ্বিমত পোষণ করতে পেরেছি। ছোট থেকে বড়, কারো কোনো কথা বা কাজ ভুল মনে হলে সেটাকে আমরা তার প্রতি স
৩১ আগস্ট ২০২৪নতুন ইতিহাস গড়েছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। মাত্র ২৬ বছর বয়সে তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টার দায়িত্ব পেয়েছেন। দীর্ঘদিনে ক্রীড়াঙ্গনে জেঁকে বসা অনিয়ম, সমস্যা, সংকট দূর করতে সংস্কারের অঙ্গীকার আসিফের।
১০ আগস্ট ২০২৪একেক মানুষ বেছে নেন একেক পেশা। তাঁদের মধ্যে কারও কারও পেশা একটু ভিন্ন ধরনের। যেমন—মো. মুনসুর আলী ওরফে মন্টু খলিফা। বাপ-দাদার পেশাকে ভালোবেসে শিশুদের খতনা করানো বা হাজামের কাজ বেছে নিয়েছেন পেশা হিসেবে। জীবনে পার করেছেন প্রায় ৮৫ বছর। জানিয়েছেন গত ৬০ বছরে ২ লাখের বেশি শিশুর মুসলমানি বা সুন্নতে খতনা দিয়
৩০ মার্চ ২০২৪