খলিফা ওমরের মানবিকতা ও সহাবস্থান নীতি

মুফতি আবু আবদুল্লাহ আহমদ
Thumbnail image

পৃথিবীবাসীকে দীর্ঘদিন ধরে শাসন করে যাওয়া শোষণমূলক সমাজব্যবস্থাকে পরাজিত করে আল্লাহ প্রদত্ত ইনসাফপূর্ণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার যে মিশন মহানবী (সা.) শুরু করেছিলেন, তাঁর পরবর্তী খলিফাগণ তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশ্বব্যাপী সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। সেই ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় খলিফা ওমর (রা.) রোমানদের শাসনাধীন থাকা নবী-রাসুলদের স্মৃতিবিজড়িত পবিত্র ভূমি জেরুজালেম ইসলামি সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়ে আসেন। 
 
যেভাবে এল বিজয়
ঐতিহাসিকদের বর্ণনা অনুসারে, খলিফা ওমর (রা.) জর্ডান ও ফিলিস্তিন অঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বিশিষ্ট সাহাবি আমর ইবনুল আস (রা.)কে সেনাপতি নিযুক্ত করেন। তাঁর নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী জর্ডান জয় করে ফিলিস্তিনের দিকে রওনা হয়। আমর দেখলেন, রোমান সেনারা গাজা থেকে কায়সারিয়া, আজনাদাইন থেকে জেরুজালেম—সবখানে ছড়িয়ে আছে। তাই পরামর্শ চেয়ে খলিফাকে চিঠি লেখেন। চিঠি পেয়ে ওমর (রা.) মুআবিয়া (রা.)কে কায়সারিয়া অবরোধের নির্দেশ দেন এবং আলকামা ইবনে মাজ্জারকে গাজা ঘেরাও করে রাখতে বলেন। এই সুযোগে আমর আজনাদাইন জয় করে নেন। রোমান সেনাপতি আরতাবুন আজনাদাইন জেরুজালেমে প্রতিরোধ গড়ে তুললে আমর (রা.) একে একে লড, নাবলুস, জাফা, আমওয়াস, বায়তজিবরিন, গাজা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল নিয়ন্ত্রণে নেন। তবু জেরুজালেম বিজয় করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই সহযোগিতা চেয়ে খলিফার কাছে আবার চিঠি লেখেন। চিঠি পেয়ে খলিফা ওমর (রা.) মদিনার শীর্ষ সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করে জেরুজালেম বিজয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। খলিফার আগমনের খবর পেয়ে জেরুজালেমবাসী যুদ্ধের চিন্তা বাদ দিয়ে সন্ধির জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আরতাবুন জেরুজালেমবাসীর মনোভাব বুঝতে পেরে সেখান থেকে পালিয়ে গেলেন। ওমর (রা.) জেরুজালেম পৌঁছানোর আগেই সেখানকার প্রতিনিধিদল সন্ধির আবেদন নিয়ে চলে আসে। ওমর প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং একটি ঐতিহাসিক চুক্তিনামা লিপিবদ্ধ করেন। 
 
চুক্তিনামায় যা লেখা ছিল
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। এই মর্মে ঘোষণা করা হচ্ছে যে, আল্লাহর বান্দা, ইমানদারদের সেনাপতি ওমর ইবনুল খাত্তাব জেরুজালেমের জনগণের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদান করছেন। নিরাপত্তা দিচ্ছেন তাদের জান, মাল, গির্জা ও আচার-অনুষ্ঠানাদির। মুসলিমরা তাদের গির্জা দখল বা ধ্বংস করবে না। তাদের জীবন, সম্পদ, আবাসভূমি, ক্রুশ—সবকিছুই নিরাপদ থাকবে। জোর করে কাউকে ধর্মান্তর করা হবে না। জেরুজালেমের অধিবাসীদের অন্যান্য শহরের লোকজনের মতো কর প্রদান করতে হবে এবং অবশ্যই রোমান ও লুটেরাদের বিতাড়িত করতে হবে। জেরুজালেমের যেসব অধিবাসী গির্জা ও ক্রুশ ছেড়ে রোমানদের সঙ্গে নিজেদের সম্পদ নিয়ে চলে যেতে ইচ্ছুক, আশ্রয়স্থলে পৌঁছানো পর্যন্ত তারা নিরাপদ থাকবে। গ্রামের লোকজন চাইলে শহরে বসবাস করতে পারে, তবে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই শহরের বাকি নাগরিকদের মতো তাদেরও কর প্রদান করতে হবে। সুতরাং কেউ চাইলে রোমানদের কাছে যেতে পারে, চাইলে পরিবার-পরিজনের কাছে থাকতে পারে। ফসল কাটার সময় না আসা পর্যন্ত কারও থেকে কিছুই নেওয়া হবে না। যদি তারা চুক্তি অনুযায়ী কর প্রদান করে, তাহলে এই চুক্তির অধীন শর্তাবলি আল্লাহর কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ। এই চুক্তিনামার পক্ষে সাক্ষী হিসেবে আছেন খালিদ ইবনুল ওয়ালিদ, আমর ইবনুল আস, আবদুর রাহমান ইবনে আওফ ও মুআবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রা.)।
 
যদিও তাবারির বর্ণনামতে, ওমর (রা.) ইহুদিদের জেরুজালেমে থাকতে নিষেধ করেছিলেন, তবে সেই বর্ণনার কোনো সূত্র উল্লেখ না করায় ইতিহাস গবেষকেরা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তদুপরি মুসলিম শাসনাধীন জেরুজালেমে ইহুদিদের স্বাধীন জীবনযাপনও সেই বর্ণনাকে ভুল হিসেবে চিহ্নিত করে। 
 
সহাবস্থান ও মানবিকতার নীতি
জেরুজালেমের ইহুদি-খ্রিষ্টানদের প্রতি বিজয়ী মুসলিম বাহিনী যে মানবিক আচরণ করেছিল, ইতিহাসে তার উদাহরণ বিরল। এর আগে যারাই কুদস বিজয় করেছিল, সবাই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের গণহারে হত্যা করেছিল অথবা জোরপূর্বক তাদের ধর্ম মেনে নিতে বাধ্য করেছিল। ইহুদিদের কর্তৃত্বে যখন ছিল, তখন তারা খ্রিষ্টানদের পবিত্র স্থাপনাসমূহের প্রতি চরম অসম্মান প্রদর্শন করেছিল। ইসা (আ.)-এর সমাধির পাশে নির্মিত গির্জাটি আবর্জনার স্তূপে পরিণত করে তার নাম দিয়েছিল কুমামা বা আবর্জনার গির্জা। পরে খ্রিষ্টানরা যখন তার দখল পায়, তখন ইহুদিদের কেবলা সাখরার এমন নিকৃষ্ট পরিণতি করে যে দূর-দূরান্ত থেকে নারীরা তাদের ঋতুস্রাবের ন্যাকড়া এখানে ফেলতে পাঠিয়ে দিত। 
 
ওমর (রা.) বায়তুল মাকদিসে যখন প্রবেশ করেন, তখন ময়লার স্তূপ মিহরাবে দাউদ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। তিনি নিজ হাতে তা পরিষ্কার করতে শুরু করেন। তাঁর দেখাদেখি উপস্থিত মুসলমানরা সেই কাজে অংশ নেন। ওমর (রা.)-এর এই কাজ গভীরভাবে প্রমাণ করে যে, ইসলাম অন্য সব ধর্মের প্রতি সতত শ্রদ্ধাশীল। 
 
খ্রিষ্টানদের সঙ্গে আরও বিস্ময় ও বিমুগ্ধ আচরণ করেন তিনি। তাদের বিশ্বাসের স্বাধীনতা দিয়েছেন। ক্রুশ ও গির্জায় তাদের বাধাহীন করেছেন। এরপর তিনি কিয়ামা গির্জায় যান। নামাজের সময় হলে যাজক গির্জার ভেতরে তাঁকে নামাজ আদায় করতে বলেন। কিন্তু তিনি এই বলে সেখানে নামাজ আদায় থেকে বিরত থাকলেন যে, পরবর্তী সময়ে মুসলমানরা একে দলিল হিসেবে নিয়ে তা মসজিদে রূপান্তর করতে চাইবে। অবশ্য বেথেলহামের একটি গির্জার ভেতরে তিনি নামাজ আদায় করেছিলেন। তখন ওই শঙ্কার কারণে তিনি সেই গির্জার জন্য আলাদা অঙ্গীকারপত্র লেখান এবং দল বেঁধে মুসলিমদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেন। 
 
পরবর্তী সময়ে যত দিন জেরুজালেম মুসলমানদের অধিকারে ছিল, তত দিন খলিফা ওমরের চুক্তিনামা অনুসারে মুসলিম, ইহুদি, খ্রিষ্টান—সবার স্বাধীনভাবে বসবাস এবং নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। 
 
সূত্র: ১. তারিখুত তাবারি। 
২. ফুতুহুল বুলদান। 
৩. চার খলিফা: জীবন, শাসন, যুদ্ধ।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত