রজত কান্তি রায়, ঢাকা
মরিচ নিয়ে শুধু বাজারেই নয়, ইতিহাসেও লঙ্কাকাণ্ড ঘটেছে এবং সেটা চলমান। বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, হার্মাদ পর্তুগিজদের হাত ধরে ভারত উপমহাদেশে মরিচের আগমন। তথ্যটি অসত্য নয়। জানা যায় যে মরিচের আদি নিবাস মেক্সিকো বা ইকুয়েডর। সেখান থেকে পর্তুগিজদের মাধ্যমে এটি তাদের কলোনিগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। যেভাবে ইংরেজদের হাত ধরে ক্রিকেটসহ বিভিন্ন জিনিস ছড়িয়ে পড়ে তাদের কলোনিগুলোতে।
জানিয়ে রাখা ভালো, ভারত উপমহাদেশে পর্তুগিজদের আগমন ১৪৯৮ সালে। তার মাত্র সাত বছরের মাথায় সম্ভবত ১৫০৫ সাল থেকে তারা এ অঞ্চলে উপনিবেশ তৈরি শুরু করে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তাদের সঙ্গে সঙ্গে বাগানের শোভাবর্ধক উদ্ভিদ হিসেবে মরিচ ছড়িয়ে পড়তে থাকে ভারতের বিভিন্ন জায়গায়। ঠিকই পড়েছেন, প্রথমে মরিচ খাওয়া হতো না। সেটি বাগানের শোভাই বর্ধন করত। ঘটনাচক্রে এটি রান্না ঘরের অপরিহার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়। আর এখন যে এটি অর্থনীতি ও রাজনীতির এক দারুণ ঘুঁটি হয়ে উঠেছে, সেটা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। যা হোক, আমরা বলছিলাম, এই দামি জিনিসটি কি আসলেই বিদেশি?
নামের ফেরে
খেয়াল করলে দেখবেন আমাদের দেশে মরিচের অনেকগুলো স্থানীয় নাম ও জাত আছে। যেমন, ধানি মরিচ, নাগা বা বোম্বাই মরিচ, জিয়া মরিচ নামে স্থানীয় জাতের মরিচ এবং অগ্নি, সূর্যমুখী, মনসা গর্জন, পিনিক ইত্যাদির মতো হাইব্রিড জাতের মরিচ। উত্তরবঙ্গে মরিচের স্থানীয় নাম আকালি, বগুড়ার কিছু অংশে এর নাম পইত্যা, কুমিল্লায় নাম মৈস। আসামে জলকিয়া নাম এটির। দার্জিলিং, সিকিম এবং হিমালয় অঞ্চলে এর নাম খুর্সানি। এর একটি বিখ্যাত প্রজাতি আছে ডল্লে খুর্সানি নামে। এ ছাড়া মরিচের আর এক নাম উভ্রা—এটি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান এলাকার আদিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত নাম।
এ ছাড়া বাংলাভাষী অঞ্চলগুলোতে একে ঝাল, লঙ্কা বা শব্দ বিপর্যয়ে নঙ্কা, মইচ ইত্যাদি নামে ডাকা হয়ে থাকে। কিশোরগঞ্জ জেলায় ছোট্ট আকারের ধানি মরিচের স্থানীয় নাম উবদা মরিচ। মানে উল্টো দিকে থাকা মরিচ। সাধারণত মরিচ গাছে ঝুলে থাকে। কিন্তু ধানি মরিচ বোঁটার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, মানে খাড়া হয়ে থাকে বলে এর বোঁটার দিক নিচে আর চিকন দিক ওপরে থাকে।
এর মানে কি প্রজাতি ভেদে এর আরও আলাদা নাম ছিল বা আছে?
বিভিন্ন অঞ্চলে খুঁজলে এ রকম আরও নাম পাওয়া যেতে পারে। তার মানে, মরিচের কোনো একটি জাত নয়, অনেকগুলো জাত বা প্রজাতি এবং নাম আছে আমাদের দেশে। সেই সূত্রে এটা অনুমান করা অসংগত নয়, পর্তুগিজরা ভারত উপমহাদেশে আসার আগেও এ অঞ্চলে মরিচ ছিল। কিন্তু সেগুলো কোন প্রজাতির? আর কোন প্রজাতির মরিচ পর্তুগিজরা নিয়ে এসেছিল মেক্সিকো থেকে? এসবের কোনো উত্তর নেই। কারণ এসব নিয়ে ব্যাপক মাত্রার কোনো গবেষণা হয়নি আমাদের এখানে। আমরা গড়ে ওঠা তথ্যকেই আওড়ে গেছি শত শত বছর।
মধ্যযুগের মঙ্গল কাব্যে
মরিচ যে আমাদের দেশের নয় অর্থাৎ এটি ভারতবর্ষীয় উদ্ভিদ নয়, এ তথ্যটি প্রমাণ করার জন্য অনেকেই বলে থাকেন, মধ্যযুগের কাব্যে মরিচের উল্লেখ নেই। ঝাল উপাদান হিসেবে খাবারে আদা, চুই বা চই, গোলমরিচ আর পিপুলের ব্যবহারের কথা বলা আছে। অসত্য নয়। কিন্তু তথ্য বলছে, মনসামঙ্গল কাব্যে ‘মরিচ’ শব্দটির ব্যবহার আছে স্পষ্টতই।
‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের অনেকগুলো পুঁথি পাওয়া যায়। বেহুলার বিয়ের ভোজে কোন কোন খাবার ছিল সে বিষয়টি নিয়ে লিখতে গিয়ে একসময় আমাকে চারখানা ‘মনসামঙ্গল’ পুঁথি ঘাঁটতে হয়েছিল। সেগুলো ছিল তমোনাশ চন্দ্র দাশগুপ্ত সম্পাদিত কবি নারায়ণ দেবের ‘পদ্মাপুরাণ’, বসন্ত কুমার ভট্টাচার্য সংকলিত কবি বিজয় গুপ্তের ‘পদ্মপুরাণ’, অচিন্ত্য বিশ্বাস সম্পাদিত বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের ‘মনসামঙ্গল’ এবং বসন্ত রঞ্জন রায় সম্পাদিত কবি ক্ষেমানন্দ দাসের ‘মনসামঙ্গল’। এ ছাড়া কবি জগজ্জীবন ঘোষালসহ আরও কয়েকজন কবি রচিত মনসামঙ্গল পাওয়া যায়। এগুলো সব একই কাহিনির বিভিন্ন পাঠ।
দীনেশ চন্দ্র সেনের মতো পণ্ডিত বলেছেন, নারায়ণদেব তাঁর মনসামঙ্গল লেখা শুরু করেছিলেন ১২৪৬ সালে। সেটা পর্তুগিজরা ভারতে আসার প্রায় আড়াই শ বছর আগের কথা। জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত না হলে কোনো কিছুই সাহিত্যে জায়গা পায় না। এ অঞ্চলে আগে থেকে যদি মরিচ নামের উদ্ভিদটি না থাকত এবং খাবারে তার প্রচলন না থাকত, তাহলে নারায়ণ দেব ‘মউয়া আলু কথ কাচা কাচা কাটী।/মরিচ রান্ধিল চৈ দিয়া বাটী।।’ এই লাইন লিখলেন কীভাবে? তাও পর্তুগিজদের ভারতে আসার প্রায় আড়াই শ বছর আগে? নারায়ণ দেব আরও লিখছেন, ‘ভাজিয়া তুলিল কথ চিতলের কোল।/মাগুর মৎস দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল।। …/রূহিতের মুণ্ডা দিয়া মাস দাইল করি।/রান্ধিল মরিচ তবে তারকা সুন্দরী।।’
পর্তুগিজদের ভারতে আসার আগে লেখা ‘পদ্মাপুরাণে’ মরিচের কথা বলা হচ্ছে রান্নার উপকরণ হিসেবে। খেয়াল করুন, ‘মরিচ রান্ধিল চৈ দিয়া বাটী’। চই বা চৈ ছিল প্রাচীন বাংলার খাবারে ব্যবহার করা ঝাল উপকরণ। তাহলে সেই ঝালকে আবার মরিচের ঝাল দিয়ে রান্না করা হচ্ছে কেন? আবার বলা হচ্ছে, ‘রান্ধিল মরিচ তবে তারকা সুন্দরী।।’ এখানেও বলা হচ্ছে, মরিচ রান্না করেছে তারকা নামের সুন্দরী।
বলে রাখা ভালো, চই বা চুই শুধু যশোর–খুলনা অঞ্চলেই পাওয়া যায় না। এটি উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন জায়গাতেও পাওয়া যায়। যশোর–খুলনায় যেভাবে চই দিয়ে মাংস বা অন্যান্য তরকারি রান্না করা হয়, অন্তত উত্তরবঙ্গে সেটা হয় না। সে অঞ্চলে চই খাওয়া হয় একটি সবজি হিসেবে অন্যান্য সবজির সঙ্গে রান্না করে এবং তা শুধু চৈত্র–বৈশাখ মাসে খাওয়া হয়। আর সন্তান প্রসবের পর চইয়ের ঝোল খাওয়ানো হয় নতুন মাকে, শরীরের ব্যথা দূর করার জন্য।
বলা হয়ে থাকে, নারায়ণদেব ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষ। নির্দিষ্ট করে বললে, কিশোরগঞ্জের বোরগ্রামের মানুষ। সে অঞ্চলে চইকে অন্যান্য সবজির সঙ্গে আরও ঝাল করে মরিচ দিয়ে রান্নার প্রণালি থাকা অস্বাভাবিক নয়। আবার এটাও হতে পারে যে, কম ঝালের মরিচকে বিশেষ ভাবে চই বাটা দিয়ে রান্না করা হয়েছে। যেভাবে আমরা তরকারিতে মরিচ ব্যবহারের পরেও মরিচের চাটনি খাই।
ভেবে দেখুন যে আজ থেকে প্রায় পৌনে আট শ বছর আগে বাংলা ভাষায় লেখা মঙ্গলকাব্যে ‘মরিচ’ শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে, যাকে আমরা এখনো ঝালের সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করি।
ভাওয়াইয়া গানে আছে ‘কানিছাত গাড়িনু আকাশি আকালি/আকালি ঝুম ঝুম করে…’। রংপুর অঞ্চলে মরিচকে বলা হয় ‘আকালি’। উত্তরবঙ্গে ‘ভদ্র মানুষ’রা মরিচ শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। তা ছাড়া আকালি শব্দটি সবাই ব্যবহার করে মরিচের প্রতিশব্দ হিসেবে। মনে রাখতে হবে, মরিচের প্রতিশব্দ হিসেবে আকালি শব্দটি ব্যবহৃত হয়। তার মানে কি উত্তরবঙ্গের প্রাচীন কোচ সমাজে মরিচের কোনো প্রজাতি ছিল? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না।
অনুমান করা হয়, ধানি মরিচ মানে আক্ষরিক অর্থে ধানের চেয়ে খানিক বড় আকারের মরিচটি এই অঞ্চলের আদি জাতের মরিচ। নাগা মরিচ আমাদের সিলেট, ভারতের আসাম, নাগাল্যান্ড ও মণিপুর অঞ্চলের স্থানীয় জাতের মরিচ, যেটিকে সাহেবরা চেনে ভূত জলোকিয়া নামে। এটি শ্রীলঙ্কাতেও আছে, যার নাম ‘নাই মিরিচ’। আবার চট্টগ্রামে প্রচলিত একটি শব্দ আছে, মরিচ হুয়োৎ। এর অর্থ, মরিচের স্বাদ। তাহলে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এই যে মরিচ শব্দটির উপস্থিতি এটি কি পর্তুগিজদের এ অঞ্চলে আসার পরের ঘটনা?
এসব তথ্যের কারণে আমরা বলতে পারছি না, ‘মরিচ’ নামের এই খাদ্য উপকরণটি বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশে পর্তুগিজদের অবদান। অবশ্যই মরিচের একটি প্রজাতি এসেছে তাদের হাত ধরে, মেক্সিকো বা ওই অঞ্চল থেকে। কিন্তু এ অঞ্চলের ‘মরিচ’ বহু আগে থেকেই রান্নাঘরে রাজত্ব করে চলেছে আদা, চৈ, পিপুলের সঙ্গে।
মরিচ নিয়ে শুধু বাজারেই নয়, ইতিহাসেও লঙ্কাকাণ্ড ঘটেছে এবং সেটা চলমান। বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, হার্মাদ পর্তুগিজদের হাত ধরে ভারত উপমহাদেশে মরিচের আগমন। তথ্যটি অসত্য নয়। জানা যায় যে মরিচের আদি নিবাস মেক্সিকো বা ইকুয়েডর। সেখান থেকে পর্তুগিজদের মাধ্যমে এটি তাদের কলোনিগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। যেভাবে ইংরেজদের হাত ধরে ক্রিকেটসহ বিভিন্ন জিনিস ছড়িয়ে পড়ে তাদের কলোনিগুলোতে।
জানিয়ে রাখা ভালো, ভারত উপমহাদেশে পর্তুগিজদের আগমন ১৪৯৮ সালে। তার মাত্র সাত বছরের মাথায় সম্ভবত ১৫০৫ সাল থেকে তারা এ অঞ্চলে উপনিবেশ তৈরি শুরু করে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। তাদের সঙ্গে সঙ্গে বাগানের শোভাবর্ধক উদ্ভিদ হিসেবে মরিচ ছড়িয়ে পড়তে থাকে ভারতের বিভিন্ন জায়গায়। ঠিকই পড়েছেন, প্রথমে মরিচ খাওয়া হতো না। সেটি বাগানের শোভাই বর্ধন করত। ঘটনাচক্রে এটি রান্না ঘরের অপরিহার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়। আর এখন যে এটি অর্থনীতি ও রাজনীতির এক দারুণ ঘুঁটি হয়ে উঠেছে, সেটা তো আমরা দেখতেই পাচ্ছি। যা হোক, আমরা বলছিলাম, এই দামি জিনিসটি কি আসলেই বিদেশি?
নামের ফেরে
খেয়াল করলে দেখবেন আমাদের দেশে মরিচের অনেকগুলো স্থানীয় নাম ও জাত আছে। যেমন, ধানি মরিচ, নাগা বা বোম্বাই মরিচ, জিয়া মরিচ নামে স্থানীয় জাতের মরিচ এবং অগ্নি, সূর্যমুখী, মনসা গর্জন, পিনিক ইত্যাদির মতো হাইব্রিড জাতের মরিচ। উত্তরবঙ্গে মরিচের স্থানীয় নাম আকালি, বগুড়ার কিছু অংশে এর নাম পইত্যা, কুমিল্লায় নাম মৈস। আসামে জলকিয়া নাম এটির। দার্জিলিং, সিকিম এবং হিমালয় অঞ্চলে এর নাম খুর্সানি। এর একটি বিখ্যাত প্রজাতি আছে ডল্লে খুর্সানি নামে। এ ছাড়া মরিচের আর এক নাম উভ্রা—এটি পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান এলাকার আদিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত নাম।
এ ছাড়া বাংলাভাষী অঞ্চলগুলোতে একে ঝাল, লঙ্কা বা শব্দ বিপর্যয়ে নঙ্কা, মইচ ইত্যাদি নামে ডাকা হয়ে থাকে। কিশোরগঞ্জ জেলায় ছোট্ট আকারের ধানি মরিচের স্থানীয় নাম উবদা মরিচ। মানে উল্টো দিকে থাকা মরিচ। সাধারণত মরিচ গাছে ঝুলে থাকে। কিন্তু ধানি মরিচ বোঁটার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, মানে খাড়া হয়ে থাকে বলে এর বোঁটার দিক নিচে আর চিকন দিক ওপরে থাকে।
এর মানে কি প্রজাতি ভেদে এর আরও আলাদা নাম ছিল বা আছে?
বিভিন্ন অঞ্চলে খুঁজলে এ রকম আরও নাম পাওয়া যেতে পারে। তার মানে, মরিচের কোনো একটি জাত নয়, অনেকগুলো জাত বা প্রজাতি এবং নাম আছে আমাদের দেশে। সেই সূত্রে এটা অনুমান করা অসংগত নয়, পর্তুগিজরা ভারত উপমহাদেশে আসার আগেও এ অঞ্চলে মরিচ ছিল। কিন্তু সেগুলো কোন প্রজাতির? আর কোন প্রজাতির মরিচ পর্তুগিজরা নিয়ে এসেছিল মেক্সিকো থেকে? এসবের কোনো উত্তর নেই। কারণ এসব নিয়ে ব্যাপক মাত্রার কোনো গবেষণা হয়নি আমাদের এখানে। আমরা গড়ে ওঠা তথ্যকেই আওড়ে গেছি শত শত বছর।
মধ্যযুগের মঙ্গল কাব্যে
মরিচ যে আমাদের দেশের নয় অর্থাৎ এটি ভারতবর্ষীয় উদ্ভিদ নয়, এ তথ্যটি প্রমাণ করার জন্য অনেকেই বলে থাকেন, মধ্যযুগের কাব্যে মরিচের উল্লেখ নেই। ঝাল উপাদান হিসেবে খাবারে আদা, চুই বা চই, গোলমরিচ আর পিপুলের ব্যবহারের কথা বলা আছে। অসত্য নয়। কিন্তু তথ্য বলছে, মনসামঙ্গল কাব্যে ‘মরিচ’ শব্দটির ব্যবহার আছে স্পষ্টতই।
‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের অনেকগুলো পুঁথি পাওয়া যায়। বেহুলার বিয়ের ভোজে কোন কোন খাবার ছিল সে বিষয়টি নিয়ে লিখতে গিয়ে একসময় আমাকে চারখানা ‘মনসামঙ্গল’ পুঁথি ঘাঁটতে হয়েছিল। সেগুলো ছিল তমোনাশ চন্দ্র দাশগুপ্ত সম্পাদিত কবি নারায়ণ দেবের ‘পদ্মাপুরাণ’, বসন্ত কুমার ভট্টাচার্য সংকলিত কবি বিজয় গুপ্তের ‘পদ্মপুরাণ’, অচিন্ত্য বিশ্বাস সম্পাদিত বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের ‘মনসামঙ্গল’ এবং বসন্ত রঞ্জন রায় সম্পাদিত কবি ক্ষেমানন্দ দাসের ‘মনসামঙ্গল’। এ ছাড়া কবি জগজ্জীবন ঘোষালসহ আরও কয়েকজন কবি রচিত মনসামঙ্গল পাওয়া যায়। এগুলো সব একই কাহিনির বিভিন্ন পাঠ।
দীনেশ চন্দ্র সেনের মতো পণ্ডিত বলেছেন, নারায়ণদেব তাঁর মনসামঙ্গল লেখা শুরু করেছিলেন ১২৪৬ সালে। সেটা পর্তুগিজরা ভারতে আসার প্রায় আড়াই শ বছর আগের কথা। জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত না হলে কোনো কিছুই সাহিত্যে জায়গা পায় না। এ অঞ্চলে আগে থেকে যদি মরিচ নামের উদ্ভিদটি না থাকত এবং খাবারে তার প্রচলন না থাকত, তাহলে নারায়ণ দেব ‘মউয়া আলু কথ কাচা কাচা কাটী।/মরিচ রান্ধিল চৈ দিয়া বাটী।।’ এই লাইন লিখলেন কীভাবে? তাও পর্তুগিজদের ভারতে আসার প্রায় আড়াই শ বছর আগে? নারায়ণ দেব আরও লিখছেন, ‘ভাজিয়া তুলিল কথ চিতলের কোল।/মাগুর মৎস দিয়া রান্ধে মরিচের ঝোল।। …/রূহিতের মুণ্ডা দিয়া মাস দাইল করি।/রান্ধিল মরিচ তবে তারকা সুন্দরী।।’
পর্তুগিজদের ভারতে আসার আগে লেখা ‘পদ্মাপুরাণে’ মরিচের কথা বলা হচ্ছে রান্নার উপকরণ হিসেবে। খেয়াল করুন, ‘মরিচ রান্ধিল চৈ দিয়া বাটী’। চই বা চৈ ছিল প্রাচীন বাংলার খাবারে ব্যবহার করা ঝাল উপকরণ। তাহলে সেই ঝালকে আবার মরিচের ঝাল দিয়ে রান্না করা হচ্ছে কেন? আবার বলা হচ্ছে, ‘রান্ধিল মরিচ তবে তারকা সুন্দরী।।’ এখানেও বলা হচ্ছে, মরিচ রান্না করেছে তারকা নামের সুন্দরী।
বলে রাখা ভালো, চই বা চুই শুধু যশোর–খুলনা অঞ্চলেই পাওয়া যায় না। এটি উত্তরবঙ্গসহ দেশের বিভিন্ন জায়গাতেও পাওয়া যায়। যশোর–খুলনায় যেভাবে চই দিয়ে মাংস বা অন্যান্য তরকারি রান্না করা হয়, অন্তত উত্তরবঙ্গে সেটা হয় না। সে অঞ্চলে চই খাওয়া হয় একটি সবজি হিসেবে অন্যান্য সবজির সঙ্গে রান্না করে এবং তা শুধু চৈত্র–বৈশাখ মাসে খাওয়া হয়। আর সন্তান প্রসবের পর চইয়ের ঝোল খাওয়ানো হয় নতুন মাকে, শরীরের ব্যথা দূর করার জন্য।
বলা হয়ে থাকে, নারায়ণদেব ময়মনসিংহ অঞ্চলের মানুষ। নির্দিষ্ট করে বললে, কিশোরগঞ্জের বোরগ্রামের মানুষ। সে অঞ্চলে চইকে অন্যান্য সবজির সঙ্গে আরও ঝাল করে মরিচ দিয়ে রান্নার প্রণালি থাকা অস্বাভাবিক নয়। আবার এটাও হতে পারে যে, কম ঝালের মরিচকে বিশেষ ভাবে চই বাটা দিয়ে রান্না করা হয়েছে। যেভাবে আমরা তরকারিতে মরিচ ব্যবহারের পরেও মরিচের চাটনি খাই।
ভেবে দেখুন যে আজ থেকে প্রায় পৌনে আট শ বছর আগে বাংলা ভাষায় লেখা মঙ্গলকাব্যে ‘মরিচ’ শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে, যাকে আমরা এখনো ঝালের সমার্থক হিসেবে ব্যবহার করি।
ভাওয়াইয়া গানে আছে ‘কানিছাত গাড়িনু আকাশি আকালি/আকালি ঝুম ঝুম করে…’। রংপুর অঞ্চলে মরিচকে বলা হয় ‘আকালি’। উত্তরবঙ্গে ‘ভদ্র মানুষ’রা মরিচ শব্দটি ব্যবহার করে থাকে। তা ছাড়া আকালি শব্দটি সবাই ব্যবহার করে মরিচের প্রতিশব্দ হিসেবে। মনে রাখতে হবে, মরিচের প্রতিশব্দ হিসেবে আকালি শব্দটি ব্যবহৃত হয়। তার মানে কি উত্তরবঙ্গের প্রাচীন কোচ সমাজে মরিচের কোনো প্রজাতি ছিল? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না।
অনুমান করা হয়, ধানি মরিচ মানে আক্ষরিক অর্থে ধানের চেয়ে খানিক বড় আকারের মরিচটি এই অঞ্চলের আদি জাতের মরিচ। নাগা মরিচ আমাদের সিলেট, ভারতের আসাম, নাগাল্যান্ড ও মণিপুর অঞ্চলের স্থানীয় জাতের মরিচ, যেটিকে সাহেবরা চেনে ভূত জলোকিয়া নামে। এটি শ্রীলঙ্কাতেও আছে, যার নাম ‘নাই মিরিচ’। আবার চট্টগ্রামে প্রচলিত একটি শব্দ আছে, মরিচ হুয়োৎ। এর অর্থ, মরিচের স্বাদ। তাহলে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় এই যে মরিচ শব্দটির উপস্থিতি এটি কি পর্তুগিজদের এ অঞ্চলে আসার পরের ঘটনা?
এসব তথ্যের কারণে আমরা বলতে পারছি না, ‘মরিচ’ নামের এই খাদ্য উপকরণটি বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশে পর্তুগিজদের অবদান। অবশ্যই মরিচের একটি প্রজাতি এসেছে তাদের হাত ধরে, মেক্সিকো বা ওই অঞ্চল থেকে। কিন্তু এ অঞ্চলের ‘মরিচ’ বহু আগে থেকেই রান্নাঘরে রাজত্ব করে চলেছে আদা, চৈ, পিপুলের সঙ্গে।
১৯৫১ সাল। ইরানের রাজা রেজা শাহ পাহলভি এলেন পৃথিমপাশা জমিদারবাড়িতে। সে এক হুলুস্থুল ব্যাপার! এ বাড়ির পূর্বপুরুষেরা ইরান থেকে এসেছিলেন বলে জানা যায়।
১ দিন আগেশীতে কাপড় ভালো রাখতে সেগুলোকে যেমন রোদে মেলে দিতে হয়, সম্পর্ক উন্নয়নে মাঝেমধ্যে তেমনি ভ্রমণেও যেতে হয়। শীত চলে এসেছে। ভ্রমণপ্রেমীরা হয়ে উঠেছেন সরব।
১ দিন আগেপর্যটন বন্ধে কারফিউ! হ্যাঁ, তেমনটিই ঘটেছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। গ্রামের নাম বুকচন হ্যানোক। দক্ষিণ কোরিয়ার জংনো জেলায় এর অবস্থান। বুকচন হ্যানোক দেশটির ‘মাস্ট ভিজিট’ পর্যটন গন্তব্য।
১ দিন আগেভ্রমণের স্বাদ একবার রক্তে ঢুকলে, তা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। এক অদৃশ্য তাড়না কাজ করতে থাকে ভেতরে-ভেতরে।
১ দিন আগে