রজত কান্তি রায়, সহকারী সম্পাদক ও গনেশ দাস, বগুড়া প্রতিনিধি
শহীদ খোকন পার্ক থেকে গালাপট্টির মোড় পর্যন্ত যে রাস্তা, বগুড়া শহরে সেটি খাতা-কলম ও সাইনবোর্ডে পরিচিত নবাব বাজার রোড হিসেবে। মূলত এই রাস্তার ব্যাপক পরিচিতি হোটেলপট্টি নামে। এই হোটেলপট্টির একটি হোটেলের নাম কাফেলা। হোটেলটির মালিক মো. রাজু মিয়া জানালেন, এর আগের নাম ছিল জশমতিয়া হোটেল।
হোটেল কাফেলায় সবাই যে খেতে আসছেন, তেমন নয়। গ্রীষ্মের দাবদাহে ভরদুপুরে হাতমুখে পানি দিয়ে ফ্যানের তলায় বসে খানিক বিশ্রাম নিতেও আসছেন কেউ কেউ। তাঁদেরই দু-একজন আমাদের আলাপ শুনতে উৎকর্ণ হলেন।
১৮৭০ সাল। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট এলাকার জমিদারের অত্যাচারে ৫০ থেকে ৬০টি পরিবার এলাকাছাড়া হয়। তারা সেখান থেকে এসে বসবাস শুরু করে বাঙ্গালী নদীর তীরের রাণীপাড়া গ্রামে। সেটি এখন প্রশাসনিকভাবে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নে পড়েছে। সেই গ্রামের দুটি পাড়ার একটির নাম প্রামাণিকপাড়া, অন্যটি মণ্ডলপাড়া। এই প্রামাণিকপাড়ার অধিবাসী ছিলেন জশমত উল্লা প্রামাণিক। আর মণ্ডলপাড়ায় বাড়ি ছিল ছহির উদ্দিন মণ্ডলের।
জশমত উল্লা প্রামাণিক ছিলেন ঠান্ডা মেজাজ ও উর্বর মস্তিষ্কের ব্যবসায়ী মানুষ। ব্যবসায়ী পরিবার হিসেবে খ্যাতি ছিল তাঁদের। আর মণ্ডল পরিবারের পরিচিতি গড়ে ওঠে রাজনীতির কারণে। জশমত উল্লা প্রামাণিক হজ করার পর জশমত হাজি নামে বিখ্যাত হন এলাকায় এবং তাঁর পাড়াটি হাজিপাড়া নামে পরিচিতি পায়। তিনি বগুড়া শহরের নবাব বাজার রোডে জশমতিয়া হোটেল প্রতিষ্ঠা করে ব্যবসা শুরু করেন। সময়টা স্পষ্ট করে আমাদের গল্পকথকদের কেউ বলতে পারলেন না বটে। তবে একাধিক সূত্র জানাল, সে ঘটনা ব্রিটিশ আমলেরই কোনো এক সময়। কারণ, জশমত উল্লা হাজি মারা গেছেন পাকিস্তান আমলে। তাঁর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয় ছহির উদ্দিন মণ্ডলের বড় ছেলে মরহুম আমির হোসেন মণ্ডলের। বগুড়া এলাকায় তো বটেই, আমাদের দেশের রাজনীতির ইতিহাসে আমির হোসেন মণ্ডলের যথেষ্ট পরিচিতি আছে। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
জশমতিয়া হোটেলের ঠিক পাশেই ১৩৬২ বাংলা সাল মোতাবেক ১৯৫৫ সালে মোস্তাফিয়া নামে একটি হোটেল খোলেন ছহির উদ্দিন মণ্ডল। এরপর ধীরে ধীরে আরও কিছু হোটেল গড়ে ওঠে এই রোডে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গুলিস্তান, আলো, সফুরা, মোহাম্মদিয়া। নবাব বাজার রোডে হোটেলের এই আধিক্যের কারণে ধীরে ধীরে এর নাম হয়ে যায় হোটেলপট্টি। এই হোটেলগুলো ছিল মূলত জশমতিয়া প্রামাণিক ও ছহির উদ্দিন মণ্ডলের আত্মীয়স্বজনের। এগুলোর কোনো কোনোটি এখন হাতবদল হয়েছে। কোনো কোনোটি আদি মালিকদের বর্তমান প্রজন্মের হাতেই আছে।
দেশের অন্যতম প্রাচীন জেলা বগুড়া। গাবতলী, ধুনটসহ বগুড়ার সব উপজেলা ছাড়াও জয়পুরহাট ও সিরাজগঞ্জ জেলার কিছু অংশের গ্রামগঞ্জ থেকে লোকজন বিভিন্ন কাজকর্মে আসত বগুড়া শহরে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য এবং মামলা-মোকদ্দমার কাজ। দূর-দূরান্ত থেকে নৌকা, গরুর গাড়ি কিংবা হেঁটে আসা মানুষের জন্য খুব অল্প টাকায় হোটেলপট্টির এসব হোটেলে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। রাজু মিয়াসহ অনেকেই জানালেন, এসব হোটেলের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল, খাওয়াদাওয়া করলে থাকা ফ্রি।
১৯৮০-র দশকেও হোটেলপট্টির হোটেলগুলোতে এক প্লেট গরুর মাংস ও ভরপেট ভাত খাওয়া যেত সোয়া দুই টাকায়, অর্থাৎ দুই টাকা পঁচিশ পয়সায়! এর মধ্যে ডাল থাকত ফ্রি। এই সোয়া দুই টাকা ব্যয় করলে রাতের বেলা হোটেলগুলোতে ঘুমানো যেত একেবারে মুফতে। তবে শুধু রাতযাপনই করা যেত। সে ক্ষেত্রে বিছানাপ্রতি নেওয়া হতো ৩ থেকে ৪ পয়সা করে।
এখানে খাওয়ার আরেকটি নিয়ম ছিল। চাল, মাছ, সবজি কিনে দিলে মাথাপিছু তিন টাকায় খাওয়া যেত এসব হোটেলে, সেটা ১৯৭৬-৭৭ সালের দিকে। কাফেলা হোটেলের বর্তমান মালিক রাজু মিয়া সে সময়কার একটি ঘটনা জানালেন। একবার ২০ থেকে ২৫ জনের একটি দল তাঁদের হোটেলে মাছ, চাল ও সবজি কিনে দিয়ে চলে যায় কোর্টে হাজিরা দিতে। আশা ছিল, কোর্ট থেকে জামিন পেয়ে তাঁরা এসে দুপুরের খাবার খাবেন। সেই অনুসারে রান্নাবান্না করে রাখা হয়। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামে। কারও দেখা নেই। শেষে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুরো দলটিকে পাঠানো হয়েছে জেলে! পরে সেই খাবার বিক্রি করা হয়।
এই হোটেলগুলোতে থাকার জন্য ছিল দুই ধরনের ব্যবস্থা—ভিআইপি সিঙ্গেল কেবিন এবং গণবিছানা। সিঙ্গেল কেবিনগুলোতে একজন মানুষ একটি চৌকির ওপর ভালোভাবে থাকতে পারতেন। হোটেল মোস্তাফিয়ায় এখনো গণবিছানার ব্যবস্থা আছে। তবে সেগুলোতে এখন আর রাজনৈতিক কর্মী নয়, নিম্ন আয়ের বিভিন্ন পেশার মানুষ ঘুমান অল্প টাকায়। হোটেলটিতে ম্যানেজারের টেবিলের পাশ দিয়ে একটি সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে। সেই সিঁড়ি ধরে উঠে গেলে দেড়তলা মতো একটি জায়গায় দেখা গেল এখনো গণবিছানা পাতা আছে। পাশেই পড়ে আছে দা-বঁটি-ছুরি ধার দেওয়ার মেশিন।
এই কাঠফাটা রোদে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন ছহির উদ্দিন মণ্ডলের ছোট ছেলে মো. দৌলত জামান মণ্ডল ওরফে মানিক। ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট জন্ম নেওয়া এই লোকটিকে এই এলাকার এনসাইক্লোপিডিয়া বলা চলে। তাঁর কাছে অনেক গল্প শোনা গেল। হোটেলপট্টির হোটেলগুলোর একেকটিতে ছিল একেক চরিত্রের মানুষের আনাগোনা। এর মধ্যে মণ্ডল পরিবারের মালিকানাধীন হোটেল মোস্তাফিয়ায় ছিল রাজনৈতিক নেতাদের ওঠাবসা। আর জশমতিয়া ছিল গ্রামীণ বড়লোক ও ব্যবসায়ীদের আড্ডাস্থল। হোটেল সফুরা ছিল সাংবাদিক, চাকরিজীবী আর সাংস্কৃতিক কর্মীদের পদচারণে মুখর, সেটা এখনো কিছু মাত্রায় বহাল আছে।
পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকের গোপন ও প্রকাশ্যে বগুড়া এলাকার প্রায় সব ধরনের রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক কর্মীদের আড্ডাস্থল ছিল হোটেল মোস্তাফিয়া। ছহির উদ্দিন মণ্ডলের একটি প্রভাব তো ছিলই। সঙ্গে ছিল ছেলে পাকিস্তান আমলের ডাকসাইটে ছাত্রনেতা আমির হোসেন মণ্ডলের পরিচিতিও। জীবনের শেষে বহু রাজনৈতিক দল ঘুরে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহসভাপতি ও বগুড়া জেলা কমিটির সভাপতি হয়েছিলেন তিনি। ফলে একটি রাজনৈতিক পরিবার পরিচালিত এ হোটেল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ভরসার জায়গা ছিল। নিরাপত্তার কারণে রাজনৈতিক মানুষেরা এ হোটেল পছন্দ করতেন।
কিন্তু জশমত উল্লা প্রামাণিক জাত ব্যবসায়ী ছিলেন বলে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়াননি নিজেকে। তাঁর ছেলেকেও তাতে জড়াতে দেননি। শুধু ব্যবসাটা করেছেন। সে জন্য জশমতিয়া হোটেলে দূর-দূরান্ত থেকে আসা সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের জমজমাট ভিড় ছিল। হোটেলগুলো ছিল নিরাপদ। লোকজন বিশ্বাস করে দোকানের ম্যানেজারের কাছে নিজেদের টাকাপয়সা জমা রাখত। কোনো হোটেলে রাখা টাকা খোয়া যাওয়ার ঘটনা শোনা যায় না। এই হোটেলগুলোতে থাকত শক্তপোক্ত সিন্দুক। সেই সব সিন্দুকে খদ্দরদের টাকা-পয়সা কিংবা কাগজপত্র জমা রাখা হতো। জশমতিয়া ও মোস্তাফিয়া দুই হোটেলেই আমাদের জং ধরা এবং অব্যবহৃত লোহার সিন্দুক দেখানো হয়েছে।
সময় বয়ে গেছে অনেকখানি। ব্রিটিশ আমল গেছে। পাকিস্তান আমলও চলে গেছে অর্ধশতকের বেশি সময় হয়ে গেল। ষাট, সত্তর কিংবা আশির দশকের রাজনীতি ও ব্যবসার ধরনও গেছে বদলে। বগুড়া শহর যে অর্থনীতির ওপর গড়ে উঠেছিল তার বদল হয়েছে। কিন্তু নবাব বাজার রোড ওরফে হোটেলপট্টির তেমন কোনো বদল হয়নি। সেই পুরোনো আমলের দালানের কাঠামো ও নকশা, সেই পুরোনো ধাঁচের চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চ। সেই কম দামের খাওয়া। আবার বদল হয়নি যে সেটাই-বা বলি কীভাবে! সেই সস্তার হোটেলগুলোর দু-একটা এখন বহুতল ভবন হয়ে ভোল পাল্টেছে। ঘুমানোর জায়গার বদল হয়েছে এখানে। পুরো বগুড়ায় এখন অনেক ঝাঁ-চকচকে হোটেল-মোটেল কিংবা রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্যও এই হোটেলপট্টিতেই গড়ে উঠেছে অনেক থাকার জায়গা। তার পরেও হোটেলপট্টি সচল আছে এখনো। জৌলুশ হারিয়ে বিবর্ণ এই জায়গায় এখনো স্মৃতি হাতড়ে ফেরেন মো. দৌলত জামান মণ্ডল কিংবা রাজু মিয়ার মতো হোটেলপট্টিতে জীবন প্রায় কাটিয়ে দেওয়া মানুষগুলো।
ছবি: রজত কান্তি রায়
শহীদ খোকন পার্ক থেকে গালাপট্টির মোড় পর্যন্ত যে রাস্তা, বগুড়া শহরে সেটি খাতা-কলম ও সাইনবোর্ডে পরিচিত নবাব বাজার রোড হিসেবে। মূলত এই রাস্তার ব্যাপক পরিচিতি হোটেলপট্টি নামে। এই হোটেলপট্টির একটি হোটেলের নাম কাফেলা। হোটেলটির মালিক মো. রাজু মিয়া জানালেন, এর আগের নাম ছিল জশমতিয়া হোটেল।
হোটেল কাফেলায় সবাই যে খেতে আসছেন, তেমন নয়। গ্রীষ্মের দাবদাহে ভরদুপুরে হাতমুখে পানি দিয়ে ফ্যানের তলায় বসে খানিক বিশ্রাম নিতেও আসছেন কেউ কেউ। তাঁদেরই দু-একজন আমাদের আলাপ শুনতে উৎকর্ণ হলেন।
১৮৭০ সাল। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট এলাকার জমিদারের অত্যাচারে ৫০ থেকে ৬০টি পরিবার এলাকাছাড়া হয়। তারা সেখান থেকে এসে বসবাস শুরু করে বাঙ্গালী নদীর তীরের রাণীপাড়া গ্রামে। সেটি এখন প্রশাসনিকভাবে বগুড়ার গাবতলী উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নে পড়েছে। সেই গ্রামের দুটি পাড়ার একটির নাম প্রামাণিকপাড়া, অন্যটি মণ্ডলপাড়া। এই প্রামাণিকপাড়ার অধিবাসী ছিলেন জশমত উল্লা প্রামাণিক। আর মণ্ডলপাড়ায় বাড়ি ছিল ছহির উদ্দিন মণ্ডলের।
জশমত উল্লা প্রামাণিক ছিলেন ঠান্ডা মেজাজ ও উর্বর মস্তিষ্কের ব্যবসায়ী মানুষ। ব্যবসায়ী পরিবার হিসেবে খ্যাতি ছিল তাঁদের। আর মণ্ডল পরিবারের পরিচিতি গড়ে ওঠে রাজনীতির কারণে। জশমত উল্লা প্রামাণিক হজ করার পর জশমত হাজি নামে বিখ্যাত হন এলাকায় এবং তাঁর পাড়াটি হাজিপাড়া নামে পরিচিতি পায়। তিনি বগুড়া শহরের নবাব বাজার রোডে জশমতিয়া হোটেল প্রতিষ্ঠা করে ব্যবসা শুরু করেন। সময়টা স্পষ্ট করে আমাদের গল্পকথকদের কেউ বলতে পারলেন না বটে। তবে একাধিক সূত্র জানাল, সে ঘটনা ব্রিটিশ আমলেরই কোনো এক সময়। কারণ, জশমত উল্লা হাজি মারা গেছেন পাকিস্তান আমলে। তাঁর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয় ছহির উদ্দিন মণ্ডলের বড় ছেলে মরহুম আমির হোসেন মণ্ডলের। বগুড়া এলাকায় তো বটেই, আমাদের দেশের রাজনীতির ইতিহাসে আমির হোসেন মণ্ডলের যথেষ্ট পরিচিতি আছে। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।
জশমতিয়া হোটেলের ঠিক পাশেই ১৩৬২ বাংলা সাল মোতাবেক ১৯৫৫ সালে মোস্তাফিয়া নামে একটি হোটেল খোলেন ছহির উদ্দিন মণ্ডল। এরপর ধীরে ধীরে আরও কিছু হোটেল গড়ে ওঠে এই রোডে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য গুলিস্তান, আলো, সফুরা, মোহাম্মদিয়া। নবাব বাজার রোডে হোটেলের এই আধিক্যের কারণে ধীরে ধীরে এর নাম হয়ে যায় হোটেলপট্টি। এই হোটেলগুলো ছিল মূলত জশমতিয়া প্রামাণিক ও ছহির উদ্দিন মণ্ডলের আত্মীয়স্বজনের। এগুলোর কোনো কোনোটি এখন হাতবদল হয়েছে। কোনো কোনোটি আদি মালিকদের বর্তমান প্রজন্মের হাতেই আছে।
দেশের অন্যতম প্রাচীন জেলা বগুড়া। গাবতলী, ধুনটসহ বগুড়ার সব উপজেলা ছাড়াও জয়পুরহাট ও সিরাজগঞ্জ জেলার কিছু অংশের গ্রামগঞ্জ থেকে লোকজন বিভিন্ন কাজকর্মে আসত বগুড়া শহরে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য এবং মামলা-মোকদ্দমার কাজ। দূর-দূরান্ত থেকে নৌকা, গরুর গাড়ি কিংবা হেঁটে আসা মানুষের জন্য খুব অল্প টাকায় হোটেলপট্টির এসব হোটেলে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। রাজু মিয়াসহ অনেকেই জানালেন, এসব হোটেলের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল, খাওয়াদাওয়া করলে থাকা ফ্রি।
১৯৮০-র দশকেও হোটেলপট্টির হোটেলগুলোতে এক প্লেট গরুর মাংস ও ভরপেট ভাত খাওয়া যেত সোয়া দুই টাকায়, অর্থাৎ দুই টাকা পঁচিশ পয়সায়! এর মধ্যে ডাল থাকত ফ্রি। এই সোয়া দুই টাকা ব্যয় করলে রাতের বেলা হোটেলগুলোতে ঘুমানো যেত একেবারে মুফতে। তবে শুধু রাতযাপনই করা যেত। সে ক্ষেত্রে বিছানাপ্রতি নেওয়া হতো ৩ থেকে ৪ পয়সা করে।
এখানে খাওয়ার আরেকটি নিয়ম ছিল। চাল, মাছ, সবজি কিনে দিলে মাথাপিছু তিন টাকায় খাওয়া যেত এসব হোটেলে, সেটা ১৯৭৬-৭৭ সালের দিকে। কাফেলা হোটেলের বর্তমান মালিক রাজু মিয়া সে সময়কার একটি ঘটনা জানালেন। একবার ২০ থেকে ২৫ জনের একটি দল তাঁদের হোটেলে মাছ, চাল ও সবজি কিনে দিয়ে চলে যায় কোর্টে হাজিরা দিতে। আশা ছিল, কোর্ট থেকে জামিন পেয়ে তাঁরা এসে দুপুরের খাবার খাবেন। সেই অনুসারে রান্নাবান্না করে রাখা হয়। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামে। কারও দেখা নেই। শেষে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুরো দলটিকে পাঠানো হয়েছে জেলে! পরে সেই খাবার বিক্রি করা হয়।
এই হোটেলগুলোতে থাকার জন্য ছিল দুই ধরনের ব্যবস্থা—ভিআইপি সিঙ্গেল কেবিন এবং গণবিছানা। সিঙ্গেল কেবিনগুলোতে একজন মানুষ একটি চৌকির ওপর ভালোভাবে থাকতে পারতেন। হোটেল মোস্তাফিয়ায় এখনো গণবিছানার ব্যবস্থা আছে। তবে সেগুলোতে এখন আর রাজনৈতিক কর্মী নয়, নিম্ন আয়ের বিভিন্ন পেশার মানুষ ঘুমান অল্প টাকায়। হোটেলটিতে ম্যানেজারের টেবিলের পাশ দিয়ে একটি সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরে। সেই সিঁড়ি ধরে উঠে গেলে দেড়তলা মতো একটি জায়গায় দেখা গেল এখনো গণবিছানা পাতা আছে। পাশেই পড়ে আছে দা-বঁটি-ছুরি ধার দেওয়ার মেশিন।
এই কাঠফাটা রোদে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন ছহির উদ্দিন মণ্ডলের ছোট ছেলে মো. দৌলত জামান মণ্ডল ওরফে মানিক। ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট জন্ম নেওয়া এই লোকটিকে এই এলাকার এনসাইক্লোপিডিয়া বলা চলে। তাঁর কাছে অনেক গল্প শোনা গেল। হোটেলপট্টির হোটেলগুলোর একেকটিতে ছিল একেক চরিত্রের মানুষের আনাগোনা। এর মধ্যে মণ্ডল পরিবারের মালিকানাধীন হোটেল মোস্তাফিয়ায় ছিল রাজনৈতিক নেতাদের ওঠাবসা। আর জশমতিয়া ছিল গ্রামীণ বড়লোক ও ব্যবসায়ীদের আড্ডাস্থল। হোটেল সফুরা ছিল সাংবাদিক, চাকরিজীবী আর সাংস্কৃতিক কর্মীদের পদচারণে মুখর, সেটা এখনো কিছু মাত্রায় বহাল আছে।
পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে আশি কিংবা নব্বইয়ের দশকের গোপন ও প্রকাশ্যে বগুড়া এলাকার প্রায় সব ধরনের রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক কর্মীদের আড্ডাস্থল ছিল হোটেল মোস্তাফিয়া। ছহির উদ্দিন মণ্ডলের একটি প্রভাব তো ছিলই। সঙ্গে ছিল ছেলে পাকিস্তান আমলের ডাকসাইটে ছাত্রনেতা আমির হোসেন মণ্ডলের পরিচিতিও। জীবনের শেষে বহু রাজনৈতিক দল ঘুরে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সহসভাপতি ও বগুড়া জেলা কমিটির সভাপতি হয়েছিলেন তিনি। ফলে একটি রাজনৈতিক পরিবার পরিচালিত এ হোটেল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ভরসার জায়গা ছিল। নিরাপত্তার কারণে রাজনৈতিক মানুষেরা এ হোটেল পছন্দ করতেন।
কিন্তু জশমত উল্লা প্রামাণিক জাত ব্যবসায়ী ছিলেন বলে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়াননি নিজেকে। তাঁর ছেলেকেও তাতে জড়াতে দেননি। শুধু ব্যবসাটা করেছেন। সে জন্য জশমতিয়া হোটেলে দূর-দূরান্ত থেকে আসা সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের জমজমাট ভিড় ছিল। হোটেলগুলো ছিল নিরাপদ। লোকজন বিশ্বাস করে দোকানের ম্যানেজারের কাছে নিজেদের টাকাপয়সা জমা রাখত। কোনো হোটেলে রাখা টাকা খোয়া যাওয়ার ঘটনা শোনা যায় না। এই হোটেলগুলোতে থাকত শক্তপোক্ত সিন্দুক। সেই সব সিন্দুকে খদ্দরদের টাকা-পয়সা কিংবা কাগজপত্র জমা রাখা হতো। জশমতিয়া ও মোস্তাফিয়া দুই হোটেলেই আমাদের জং ধরা এবং অব্যবহৃত লোহার সিন্দুক দেখানো হয়েছে।
সময় বয়ে গেছে অনেকখানি। ব্রিটিশ আমল গেছে। পাকিস্তান আমলও চলে গেছে অর্ধশতকের বেশি সময় হয়ে গেল। ষাট, সত্তর কিংবা আশির দশকের রাজনীতি ও ব্যবসার ধরনও গেছে বদলে। বগুড়া শহর যে অর্থনীতির ওপর গড়ে উঠেছিল তার বদল হয়েছে। কিন্তু নবাব বাজার রোড ওরফে হোটেলপট্টির তেমন কোনো বদল হয়নি। সেই পুরোনো আমলের দালানের কাঠামো ও নকশা, সেই পুরোনো ধাঁচের চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চ। সেই কম দামের খাওয়া। আবার বদল হয়নি যে সেটাই-বা বলি কীভাবে! সেই সস্তার হোটেলগুলোর দু-একটা এখন বহুতল ভবন হয়ে ভোল পাল্টেছে। ঘুমানোর জায়গার বদল হয়েছে এখানে। পুরো বগুড়ায় এখন অনেক ঝাঁ-চকচকে হোটেল-মোটেল কিংবা রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্যও এই হোটেলপট্টিতেই গড়ে উঠেছে অনেক থাকার জায়গা। তার পরেও হোটেলপট্টি সচল আছে এখনো। জৌলুশ হারিয়ে বিবর্ণ এই জায়গায় এখনো স্মৃতি হাতড়ে ফেরেন মো. দৌলত জামান মণ্ডল কিংবা রাজু মিয়ার মতো হোটেলপট্টিতে জীবন প্রায় কাটিয়ে দেওয়া মানুষগুলো।
ছবি: রজত কান্তি রায়
১৯৫১ সাল। ইরানের রাজা রেজা শাহ পাহলভি এলেন পৃথিমপাশা জমিদারবাড়িতে। সে এক হুলুস্থুল ব্যাপার! এ বাড়ির পূর্বপুরুষেরা ইরান থেকে এসেছিলেন বলে জানা যায়।
১ দিন আগেশীতে কাপড় ভালো রাখতে সেগুলোকে যেমন রোদে মেলে দিতে হয়, সম্পর্ক উন্নয়নে মাঝেমধ্যে তেমনি ভ্রমণেও যেতে হয়। শীত চলে এসেছে। ভ্রমণপ্রেমীরা হয়ে উঠেছেন সরব।
১ দিন আগেপর্যটন বন্ধে কারফিউ! হ্যাঁ, তেমনটিই ঘটেছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। গ্রামের নাম বুকচন হ্যানোক। দক্ষিণ কোরিয়ার জংনো জেলায় এর অবস্থান। বুকচন হ্যানোক দেশটির ‘মাস্ট ভিজিট’ পর্যটন গন্তব্য।
১ দিন আগেভ্রমণের স্বাদ একবার রক্তে ঢুকলে, তা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। এক অদৃশ্য তাড়না কাজ করতে থাকে ভেতরে-ভেতরে।
১ দিন আগে