মুনতাসির মইন
সাবমেরিনের পেটে বসে নীল সাগরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সাবমেরিনটা হেলেদুলে ঠিক যেন পালকির মতো চলছিল। আমি ছোটবেলায় চলে গেলাম। একসময় পড়ার বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে খুব জুলভার্ন পড়তাম। তখনকার পড়া ‘টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগ আন্ডার দ্য সি’ যেন চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। মনে হচ্ছিল, আমি নোটিলাসে বসে আছি, ক্যাপ্টেন নিমোর পাশে। হালকা থেকে গাঢ় হতে থাকল নীল। অদ্ভুত রং-বেরঙের নাম না জানা মাছ ছুটে বেড়াচ্ছে কোরাল বাগানে। চোখধাঁধানো রঙের সেই বাগান। কী সুন্দর, কী রহস্যময়! একসময় সাবমেরিন কোরাল রিফের শেষ প্রান্তে এসে পড়ল, তার নিচে গভীর খাদ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমাদের হলুদ সাবমেরিন কচুরিপানার মতো বিশাল সমুদ্রে ভাসতে লাগল। এভারেস্টের নিচে দাঁড়িয়ে যেমন গভীর শূন্যতা অনুভব করেছিলাম, এখানেও তা-ই হলো। গভীর ঘোর লেগে গেল। ছেলে ধাক্কা দিয়ে ঘোর ভাঙাল। ‘বাবা, এই মাছের নাম কী?’ আমি ফ্যালফ্যাল করে বললাম, ‘সি ফিশ!’ আজ আমাদের মালদ্বীপের দ্বিতীয় দিন।
প্লেনের ককপিটে যখন ক্যাপ্টেন বললেন, ‘আমরা আর কিছুক্ষণের মধ্যে মালদ্বীপে ল্যান্ড করব’, তখন জানালা দিয়ে তাকিয়ে এক অপার্থিব সৌন্দর্য দেখলাম। গাঢ় নীল একটি আর্টিস্ট প্লেটের মধ্যে যেন আকাশি, ফিরোজা, সাদা আর সবুজের রঙের প্রলেপ। এ রকম ছোট-বড় হাজার হাজার রঙের প্রলেপ প্লেটজুড়ে। এগুলো একেকটা দ্বীপ। ঠিক যেন রঙের মালা। কিছু কিছু পণ্ডিত মনে করেন, মালদ্বীপ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘মালা দ্বীপ’ থেকে, যার অর্থ ফুলের মালার দ্বীপ। তবে প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে এই দ্বীপকে বলা হয়েছে ‘লাক্ষাদ্বীপ’ বা শত হাজার দ্বীপ। তবে মালদ্বীপে হাজারের বেশি দ্বীপ থাকলেও ১ লাখ দ্বীপ নেই। বর্তমান মালদ্বীপে ১ হাজার ১৮৪টি দ্বীপ ও ২৮টি প্রাকৃতিক অ্যাটল আছে। এর মধ্যে মাত্র ১৮৭টি দ্বীপ বসবাসের উপযোগী।
আমাদের রিসোর্টটি ছিল এমনই এক দ্বীপে। রিসোর্টের নাম হার্ড রক হোটেল মালদ্বীপ। সাউথ মালে এটলে এটি অবস্থিত। এটল হচ্ছে দীর্ঘ বৃত্তাকার প্রবালপ্রাচীর। প্রবালপ্রাচীরের পার ঘেঁষে রিসোর্টগুলো গড়ে উঠেছে। মালে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে ২০ মিনিটে স্পিডবোটে করে রিসোর্টে পৌঁছানো যায়।
মালদ্বীপের ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টটা বেশ মজার। অন্য দেশের মতো নয়। অন্য যেকোনো দেশে আমরা এয়ারপোর্টে নেমে রাস্তা মাপি আর মালদ্বীপে মাপতে হয় সমুদ্র। এয়ারপোর্টে নেমেই বিশাল সমুদ্র। রিসোর্টে যেতে চাইলে উঠে পড়তে হয় স্পিডবোটে অথবা সি প্লেনে। আমাদের রিসোর্টের সদা হাস্যোজ্জ্বল ভুবন আমাদের রিসিভ করার জন্য এসেছিল। চমৎকার ইংরেজিতে বলল, ‘ওয়েলকাম টু দ্য হ্যাভেন।’ ছোট্ট এই লাইন জীবনতৃষ্ণা আরও বাড়িয়ে তুলল। কী চমৎকার মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি! প্লেনের চার ঘণ্টার বিরক্তিকর ভ্রমণ শেষে গাঢ় নীল সমুদ্র যেন ইফতারের শরবতের গ্লাস। নোনা বাতাসে ঝরঝরে লাগল শরীর, নোনা স্বাদও যেন পেল জিহ্বা। স্পিডবোট চলতে শুরু করল।
ছেলের চোখে আনন্দ আর মেয়ের চোখে উৎকণ্ঠা। কারণ, ততক্ষণে বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল আমাদের স্পিডবোটে। সেটি বাম্প করতে লাগল রোলার কোস্টারের মতো। ২০ মিনিট পর শান্ত হলো স্পিডবোট। আমরা ততক্ষণে গভীর সমুদ্র থেকে রিফে পৌঁছে গেছি। ধীরে ধীরে ল্যান্ডিং জেটি চোখে পড়ল। গাঢ় নীলের পর পান্না সবুজ পানি, তার ওপর সাদা দ্বীপ। জেটি সামনে আসতেই চোখে পড়ল, রিসোর্টের সাতজন স্টাফ হাত নেড়ে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। তাদের দলপতি স্বর্ণকেশী রাশিয়ান আলিশা। চমৎকার হেসে সম্ভাষণ জানাল আর বলল, ‘মইন ফ্যামিলিকে পেয়ে আমরা আনন্দিত।’ মনে হচ্ছিল কত দিনের চেনা।
রিসেপশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো কাঙ্ক্ষিত ওয়াটার বাংলোতে। আমাদের বাংলোটি স্বচ্ছ নীল পানির ওপর দুই রুমের কুঁড়েঘর। একটি মাস্টার বেডরুম আর একটি ড্রেসিং রুম। মাস্টার বেডরুমের সঙ্গে লাগোয়া একটি টেরেস। টেরেসের এক পাশে আছে সিঁড়ি, যা দিয়ে সরাসরি রিফে নেমে পড়া যায়। আর টেরেসের আরেক পাশে মোটা সাদা দড়ি দিয়ে বানানো হয়েছে বিশাল ট্রাম্পোলিন এবং তার ঠিক নিচে সমুদ্র। বাচ্চারা লাফালাফি শুরু করল ট্রাম্পোলিনে। আমরাও যোগ দিলাম তাদের সঙ্গে। আহা সে কী আনন্দ!
আসলে নামে কুঁড়েঘর হলেও আধুনিক বসবাসের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা মেলে এই বাংলোগুলোতে। স্টার রেটিং ভেদে বাড়তে থাকে সুযোগ-সুবিধার পরিধি। কিন্তু কিছু ম্যাজিক স্টার রেটিং মানে না। এই ম্যাজিকের ম্যাজিশিয়ান হলো রিফের বাসিন্দা বেবি সার্ক, স্টিং রে, সি টার্টল আর অসংখ্য নাম না জানা রংবেরঙের মাছ। তারা ম্যাজিক দেখাতে হঠাৎ হঠাৎ চলে আসে বাংলোগুলোর ঠিক নিচে। ওপর থেকে বসে তাদের খেলাধুলা দেখতে বেশ লাগে। সহজ-স্বাভাবিকভাবে তারা ঘুরে বেড়ায় বাংলোর আশপাশে। যেন আমাদের মতো তারাও ঘুরতে এসেছে মালদ্বীপে। এ রকম মানুষের সঙ্গে প্রাণীদের সহাবস্থান দেখতে আমার বেশ লাগে। নিজেদের সর্বশ্রেষ্ঠ তকমা লাগিয়ে অহংকার করা আমার মোটেও ভালো লাগে না। পুরো ইকোসিস্টেমে সবাই সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতি থেকে ক্ষুদ্র মৌমাছিকে বাদ দিলে কয়েক বছরের মধ্যে বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়বে সবুজ পৃথিবী। তখন কী হবে চিন্তা করা যায়?
আমরা মালদ্বীপে গিয়েছিলাম ৭ জানুয়ারি। তখন মাত্র ক্রিসমাস শেষ হয়েছে। কিন্তু রিসোর্টজুড়ে ছিল ক্রিসমাসের সাজসজ্জা আর আমেজ। গোলাপি আলোয় আলোকিত পুরো রিসোর্ট। সেদিনই ছিল তাদের ক্রিসমাস ডিনারের শেষ আয়োজন। সমুদ্রতটের সাদা বালুর ওপর বিছানো হয়েছে টেবিল। তার ওপর মোমবাতি। সাগরের মৃদুমন্দ হাওয়া তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্রাজিলিয়ান এক ব্যান্ড দল বাজিয়ে চলেছে ‘আভা মারিয়া’। করুণ আভা মারিয়া কেন যেন যিশুর লাস্ট সাপারের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। জীবনের শেষ নৈশভোজে বসেছেন যিশু তাঁর বারোজন শিষ্য নিয়ে। ভীষণ শান্ত স্বরে যিশু বললেন, ‘কাল তোমাদের মধ্যেই একজন আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে, ধরিয়ে দেবে আমাকে।’ যিশুর মুখে এই কথা শুনে বারোজনের কারও মুখে ভয়, কারও আগ্রহ, কারও সন্দেহ, কারও মুখে কৌতূহল, করো মুখে ঘৃণা, কারও মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠেছিল। কী অদ্ভুত!
এ নিয়ে একটি বিখ্যাত চিত্র আছে লেওনার্দ দ্য ভিঞ্চির, নাম ‘দ্য লাস্ট সাপার’। আঁকা হয়েছিল মিলানের সান্তা মারিয়া দেল্লে গ্র্যাছে। একবার এই ছবি দেখতে গিয়েছিলাম; কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি পনেরো মিনিটের জন্য। গির্জায় ঢোকার শেষ সময় ছয়টা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। আমাদের পৌঁছাতে পৌঁছাতে সাতটা বেজে গিয়েছিল। সেই আফসোস আমার আজও গেল না!
ক্রিসমাসের শেষ ডিনারের আয়োজনটা ছিল হুলুস্থুল রকমের। শুরুতেই এক গ্লাস শ্যাম্পেইন হাতে ধরিয়ে দিয়ে রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার অনিত বলল, ‘আজ ডায়েটের কথা ভুলে যাও। যা মন চায়, খাও।’ নাম না জানা অসংখ্য খাবারে পরিপূর্ণ ব্যুফে, কমলা আলাস্কান ক্র্যাব লেগ, খরগোশের নরম মাংসের ফ্রেঞ্চ টেরিন, সদ্য তোলা নীল রিফের ওয়েস্টার, চিজ হুইলে মাখানো গরম-গরম পাস্তা—আরও কত কী! অনিতের সঙ্গে খেতে খেতে গল্প হচ্ছিল, মালদ্বীপের প্রথম দিকের জনবসতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল তামিলরা, যারা প্রাচীন তামিলকাম থেকে এসেছিল। এই তামিলকামই বর্তমানে ভারতের তামিলনাড়ু। সেই সময় যেসব পর্যটক মালদ্বীপ ভ্রমণ করেছিল, তারা সবাই রানিশাসিত এই রাজ্যের কথা উল্লেখ করেছে। শ্রীলঙ্কার প্রাচীন সাহিত্য ‘মহাবংশ’-এ মালদ্বীপকে বলা হয়েছে ‘মহিলাদ্বীপ’ বা নারীদের দ্বীপ। তার মানে বোঝা যায়, মাতৃতান্ত্রিক এক সমাজব্যবস্থা ছিল এই মালদ্বীপে। লুইস মরগানের একটি চমৎকার বই আছে, নাম ‘অ্যানশায়েন্ট সোসাইটি’। সেখানে লেখকের দাবি, আদিমকালে সব গোষ্ঠী নাকি ছিল মাতৃতান্ত্রিক। কী মজার একটা ব্যাপার, মায়েদের চোখরাঙানি খেয়ে বাবারা চুপ করে বসে থাকত! এরপর সম্রাট অশোকের সময় বুদ্ধ ভিক্ষুরা গিয়ে মালদ্বীপে বসবাস শুরু করেন। তখনই বৌদ্ধধর্ম প্রসার পায়। এখনো তার প্রচুর নিদর্শন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অনেক দ্বীপে। বারো শতকের দিকে মুসলিম বণিকেরা ব্যবসা করতে ভারত সাগরে এসে ঘাঁটি গাড়ে মালদ্বীপে। শুরু হয় দীর্ঘ ইসলামি যুগের।
গল্প শেষে বিদায় নিয়ে চলে এলাম স্বপ্নের সেই কুটিরে। বাচ্চারা কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাদের বিছানায় রেখে আমরা শুয়ে রইলাম নেটের তৈরি টেরেসের সেই ট্রাম্পোলিনে। আকাশে তখন অনন্ত নক্ষত্রবীথি। তারায় পরিপূর্ণ আকাশ। এমন আকাশের দিকে তাকিয়ে অনন্ত জীবন বেঁচে থাকার লোভ জাগে। তখন ঠিক বারোটা। ঠিক সেই মুহূর্তেই আমাদের বিয়ের বারো বছর পূর্ণ হলো।
সকালে ঘুম ভাঙল মৃদু ঠকঠক শব্দে। উঠে দেখি ঘরে বেড়াতে এসেছে দুটো সাদা ড্রিল। ড্রিল হচ্ছে ছোট সাদা শামুক। হাঁটার সময় টালির সঙ্গে শক্ত খোলসের ঠক্করে শব্দ হচ্ছিল ঠকঠক। কিছুক্ষণ বাচ্চাদের নিয়ে শামুকদের সঙ্গে খেলে বললাম তাদের রিফে ফিরিয়ে দিতে। মালদ্বীপসহ প্রাচীন পৃথিবীর বেশ কিছু অঞ্চলের মুদ্রা ছিল একধরনের শামুক, যা আমরা কড়ি নামে চিনি। ১৩৪৪ সালে ইবনে বতুতা মালদ্বীপে এসে দেখেছিলেন, প্রতিবছর মালদ্বীপ ৪০ জাহাজ কড়ি রপ্তানি করত। প্রশ্ন জাগে, কেমন ছিল সেই কড়ির আর্থিক মান? তখন ৪ লাখ কড়ি দিয়ে একটি সোনার দিনার পাওয়া যেত।
এবার রিফে নামার পালা। রুমের সামনে টেরেসের সিঁড়ি দিয়ে নেমে পড়লাম স্বচ্ছ পানিতে। পানির তাপমাত্রা চমৎকার আরামদায়ক। কোমর পর্যন্ত পানিতে অনায়াসে হাঁটা যায় অনেক দূর পর্যন্ত। লাইফ জ্যাকেট পরে নিলাম। নরম বালিতে কিছুক্ষণ হাঁটার পর শরীর ভাসিয়ে দিলাম পানিতে। সাদা বালির ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য কোরাল। তার মাঝে মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট রংবেরঙের মাছ। হাত দিয়ে ধরতে গেলে তারা দৌড়ে পালায়। ততক্ষণে ছেলে কোরাল সংগ্রহে নেমে পড়েছে। রংবেরঙের কোরাল সংগ্রহ করে পকেটে পুরে রাখছে। ছেলে শুনে অবাক হলো, এই কোরলগুলোরও একসময় প্রাণ ছিল। পরে বুড়ো হয়ে মরে গিয়ে তারা জমতে শুরু করে সাগরের তলদেশে। মরে যাওয়ার পর তাদের দেহের চারপাশে ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের একটি পাথুরে স্তর তৈরি হয়। সেটাকেই আমরা প্রবাল বলি। এই প্রবালগুলো এভাবে লাখ লাখ বছর জমে একেকটি পাথরের আকৃতি নেয়। আর কোটি কোটি বছর জমে একটি দ্বীপ সৃষ্টি করে। কী অদ্ভুত প্রকৃতির খেয়াল!
ছেলেকে বললাম, ‘কোটি কোটি বছর পুরোনো এই পাথরবাগান কোনোভাবেই নষ্ট করা উচিত নয়। এরা খুবই দুর্লভ। পৃথিবীতে অল্প কিছু আছে, যার মধ্যে একটি আছে আমাদের দেশে। যাকে আমরা সেন্ট মার্টিন বলে জানি।’ সেন্ট মার্টিনের কথা বলতে বলতে মন খারাপ হয়ে গেল। দেশে এত সুন্দর একটা দ্বীপ আছে, যাকে ইচ্ছে করলেই এমন মালদ্বীপের মতো করা যেত। কিন্তু আমরা চরম অবহেলায় ফেলে রেখেছি। গুনগুন করে গাইতে লাগলাম—
জনম গেল বৃথা কাজে
আমি কাটানু দিন ঘরের মাঝে
তুমি বৃথা আমায় শক্তি দিলে, শক্তিদাতা
ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা।
রিফে সাঁতার কাটতে কাটতে আমরা সাবমেরিনের প্রোগ্রাম করলাম। রিসোর্টে একটি ছোট সাবমেরিন আছে। সেটা ঠিক সাবমেরিন নয়। সাবমেরিন আকৃতির নৌকা বলা যায়। নিচের দিকে ফাঁকা একটি জায়গায় ছয়-সাতজন বসতে পারে, চারদিক স্বচ্ছ জানালা দিয়ে ঘেরা। রিফের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে এই সাবমেরিনের জুড়ি নেই। স্নোরকেলিং করে অল্প একটু জায়গা ঘুরে দেখা যেতে পারে। ভালো ডাইভিংয়ের জন্য দরকার ট্রেনিং। এই দুটোর মাঝে সাবমেরিনে ভ্রমণ ভালো সুযোগ হতে পারে। সাবমেরিনের বর্ণনা প্রথমেই একটু বলেছিলাম। কিন্তু তার সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশের শব্দ আমার অভিধানে নেই।
আমাদের রিসোর্টে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট পনেরোটি রেস্টুরেন্ট ছিল। তার মধ্যে কিছু ইন্টারন্যাশনাল চেইন রেস্টুরেন্ট। মিনিস্ট্রি অব ক্র্যাব তেমনি এক রেস্টুরেন্ট। আজ ডিনারের জন্য আমরা সেই রেস্টুরেন্টে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। এই মিনিস্ট্রি অব ক্র্যাব এশিয়ার ছয়টি দেশে তাদের রেস্টুরেন্ট খুলে বসেছে। ওয়ার্ল্ডস ফিফটি বেস্ট রেস্টুরেন্টের তালিকায় তাদের অবস্থান পঁচিশ। বড় বড় কাঁকড়াই তাদের প্রধান আকর্ষণ। তাদের প্রধান নীতি হলো, তারা হিমায়িত খাবার পরিবেশন করে না। এ জন্য তাদের বিশাল ঝামেলা পোহাতে হয়। মালদ্বীপের এই রেস্টুরেন্টে তাদের কাঁকড়াগুলো আসে প্রাইভেট প্লেনে করে, শ্রীলঙ্কা থেকে। তারপর তাদের বসবাস উপযোগী একটি চৌবাচ্চায় জ্যান্ত সংরক্ষণ করা হয় প্লেটে পরিবেশন করার আগ পর্যন্ত। ক্রেতাদের চাহিদামতো জ্যান্ত কাঁকড়া নিয়ে আসা হয় তার আকৃতি ঠিক আছে কি না, দেখানোর জন্য। এখানে প্রায় দশ আকারের কাঁকড়া পাওয়া যায়। ছোটটা আধা কেজি আর বড়টা দুই কেজি ওজনের। তারা প্রায় পাঁচ রকমভাবে কাঁকড়া রান্না করতে পারে। এর মধ্যে পিপার ক্র্যাব অসম্ভব জনপ্রিয়।
আমরা পিপার ক্র্যাব অর্ডার করেছিলাম, সঙ্গে ছিল ক্র্যাব লিভার পাটে, এপেটাইজারে। ছোট্ট একটি বিস্কুটের ওপর এই ক্র্যাব লিভার পেস্ট জেলির মতো লাগিয়ে তার ওপরে ম্যাপেল সিরাপ দিয়ে কুট্টুস করে কামড় দিয়ে খেতে হয়। দুই কেজির বিশাল পিপার ক্র্যাব খাবার জন্য ঘাম ঝরানো জরুরি। রীতিমতো ছেনি-বাটাল নিয়ে ভাঙতে হয় ক্র্যাবের শক্ত খোল। তারপর বের হয় কাঙ্ক্ষিত সাদা মাংস। পিপার সসে ডুবিয়ে সেই মাংস মুখে পুরে অনায়াসে ভুলে যাওয়া যায় জগৎ-সংসার। ডেজার্টে ছিল নারকেলের খোলে তৈরি ফ্রেঞ্চ ক্রিম ব্রুলে। এবার ঘুম।
আজ ঘুম ভাঙল বৃষ্টির শব্দে। সে কী বৃষ্টি! গতকালের ভেজা কাপড়গুলো শুকাতে দেওয়া হয়েছিল টেরেসে। সেগুলো আবার ভিজে গেল। রুমের দরজা খুলে টেরেসে গিয়ে নতুন রঙের আভা দেখলাম। সবুজ সমুদ্র আরও সবুজ দেখা যাচ্ছে আর ওপরে কালো আকাশ। সে অপরূপ ব্যাপার! সমুদ্র ভয়ংকর হতে লাগল। বাড়তে লাগল বৃষ্টির তেজ। মালদ্বীপের বৃষ্টি নাকি ভয়ংকর—একবার শুরু হলে এক সপ্তাহ। মন খারাপ হয়ে গেল। আরও দুই দিন যে থাকতে হবে! কিন্তু কিছুক্ষণ পরই মেঘ কেটে গিয়ে চমৎকার এক সূর্যের দেখা পেলাম। পুরো পরিবার নিয়ে রিফে নেমে গেলাম। গতকাল নাকি এক বিশাল মান্তা রে ঢুকেছে রিফে।
এই প্রাণীটা বেশ মজার। এরা নাকি তেইশ ফুট পর্যন্ত চওড়া হতে পারে! অদ্ভুত দর্শনের জন্য এদের মানুষ প্রাচীনকাল থেকে ভীষণ ভয় পেত। প্রাচীনকালে নাবিকেরা বিশ্বাস করতেন যে, তারা মানুষের জন্য বিপজ্জনক এবং নোঙরে টান দিয়ে নৌকা ডোবাতে পারে। পরে যখন ডাইভিং জনপ্রিয় হয়, তখন মানুষ বুঝতে শেখে, এরা নিরীহ গোছের প্রাণী আর শুরু করে তাদের ওপর অত্যাচার। তাদের ফুলকা চায়নিজ ওষুধের এক দুর্মূল্য উপাদান। এই ফুলকার জন্য হাজার হাজার মান্তা রে প্রতি বছর মারা হয়। সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে যাওয়ায় গত বছরই তাদের বিপদাপন্ন প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
দুপুরে যখন আমরা পানি থেকে উঠে খাবার খাচ্ছিলাম, তখনই দেখা মিলল সেই বিশাল কালো মান্তা রের। প্রবল দাপটে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে রিফে। মাছেদের খেলা দেখতে দেখতে বিকেল নামল। বেগুনি হয়ে উঠল আকাশ। রিফের সেই আকাশি পানি তখনো আকাশি। তবে কিছুটা কালচে। চমৎকার বেগুনি আকাশের নিচে কালচে আকাশি সমুদ্র ঠিক যেন মনভোলা এক চিত্রকরের হাতে আঁকা ছবি। প্রকৃতির এমন রূপ দেখে যেকোনো শিল্পীর মনে হতে বাধ্য, এখানে বাকি জীবন কাটালে মন্দ হতো না। সারা দিন শুধু ছবি আঁকব, ফিরব না আর যান্ত্রিক নগরে। সত্যি সত্যি এমন পাগলামি কিন্তু একজন করেছিলেন—তাঁর নাম পল গগাঁ। ফরাসি এই শিল্পী তাহিতি নামের এক দ্বীপে গিয়ে তার প্রেমে পড়ে যান। তারপর সবকিছু ছেড়েছুড়ে আমৃত্যু বসবাস করতে থাকেন সেই দ্বীপে।
মালদ্বীপের এই তটে বসে গগাঁর মনের অবস্থা টের পাচ্ছিলাম। এই ক্ষুদ্র জীবনে খুব বেশি কিছু কি দরকার? তবু ফিরে যেতে হবে কাল। মন খারাপ হয়ে গেল। আকাশে তখন তারা ফুটে উঠছে। বেগুনি থেকে গাঢ় নীল হচ্ছে পৃথিবী।
পৃথিবী এত সুন্দর কেন?
সাবমেরিনের পেটে বসে নীল সাগরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সাবমেরিনটা হেলেদুলে ঠিক যেন পালকির মতো চলছিল। আমি ছোটবেলায় চলে গেলাম। একসময় পড়ার বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে খুব জুলভার্ন পড়তাম। তখনকার পড়া ‘টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগ আন্ডার দ্য সি’ যেন চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। মনে হচ্ছিল, আমি নোটিলাসে বসে আছি, ক্যাপ্টেন নিমোর পাশে। হালকা থেকে গাঢ় হতে থাকল নীল। অদ্ভুত রং-বেরঙের নাম না জানা মাছ ছুটে বেড়াচ্ছে কোরাল বাগানে। চোখধাঁধানো রঙের সেই বাগান। কী সুন্দর, কী রহস্যময়! একসময় সাবমেরিন কোরাল রিফের শেষ প্রান্তে এসে পড়ল, তার নিচে গভীর খাদ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। আমাদের হলুদ সাবমেরিন কচুরিপানার মতো বিশাল সমুদ্রে ভাসতে লাগল। এভারেস্টের নিচে দাঁড়িয়ে যেমন গভীর শূন্যতা অনুভব করেছিলাম, এখানেও তা-ই হলো। গভীর ঘোর লেগে গেল। ছেলে ধাক্কা দিয়ে ঘোর ভাঙাল। ‘বাবা, এই মাছের নাম কী?’ আমি ফ্যালফ্যাল করে বললাম, ‘সি ফিশ!’ আজ আমাদের মালদ্বীপের দ্বিতীয় দিন।
প্লেনের ককপিটে যখন ক্যাপ্টেন বললেন, ‘আমরা আর কিছুক্ষণের মধ্যে মালদ্বীপে ল্যান্ড করব’, তখন জানালা দিয়ে তাকিয়ে এক অপার্থিব সৌন্দর্য দেখলাম। গাঢ় নীল একটি আর্টিস্ট প্লেটের মধ্যে যেন আকাশি, ফিরোজা, সাদা আর সবুজের রঙের প্রলেপ। এ রকম ছোট-বড় হাজার হাজার রঙের প্রলেপ প্লেটজুড়ে। এগুলো একেকটা দ্বীপ। ঠিক যেন রঙের মালা। কিছু কিছু পণ্ডিত মনে করেন, মালদ্বীপ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘মালা দ্বীপ’ থেকে, যার অর্থ ফুলের মালার দ্বীপ। তবে প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে এই দ্বীপকে বলা হয়েছে ‘লাক্ষাদ্বীপ’ বা শত হাজার দ্বীপ। তবে মালদ্বীপে হাজারের বেশি দ্বীপ থাকলেও ১ লাখ দ্বীপ নেই। বর্তমান মালদ্বীপে ১ হাজার ১৮৪টি দ্বীপ ও ২৮টি প্রাকৃতিক অ্যাটল আছে। এর মধ্যে মাত্র ১৮৭টি দ্বীপ বসবাসের উপযোগী।
আমাদের রিসোর্টটি ছিল এমনই এক দ্বীপে। রিসোর্টের নাম হার্ড রক হোটেল মালদ্বীপ। সাউথ মালে এটলে এটি অবস্থিত। এটল হচ্ছে দীর্ঘ বৃত্তাকার প্রবালপ্রাচীর। প্রবালপ্রাচীরের পার ঘেঁষে রিসোর্টগুলো গড়ে উঠেছে। মালে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে ২০ মিনিটে স্পিডবোটে করে রিসোর্টে পৌঁছানো যায়।
মালদ্বীপের ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টটা বেশ মজার। অন্য দেশের মতো নয়। অন্য যেকোনো দেশে আমরা এয়ারপোর্টে নেমে রাস্তা মাপি আর মালদ্বীপে মাপতে হয় সমুদ্র। এয়ারপোর্টে নেমেই বিশাল সমুদ্র। রিসোর্টে যেতে চাইলে উঠে পড়তে হয় স্পিডবোটে অথবা সি প্লেনে। আমাদের রিসোর্টের সদা হাস্যোজ্জ্বল ভুবন আমাদের রিসিভ করার জন্য এসেছিল। চমৎকার ইংরেজিতে বলল, ‘ওয়েলকাম টু দ্য হ্যাভেন।’ ছোট্ট এই লাইন জীবনতৃষ্ণা আরও বাড়িয়ে তুলল। কী চমৎকার মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি! প্লেনের চার ঘণ্টার বিরক্তিকর ভ্রমণ শেষে গাঢ় নীল সমুদ্র যেন ইফতারের শরবতের গ্লাস। নোনা বাতাসে ঝরঝরে লাগল শরীর, নোনা স্বাদও যেন পেল জিহ্বা। স্পিডবোট চলতে শুরু করল।
ছেলের চোখে আনন্দ আর মেয়ের চোখে উৎকণ্ঠা। কারণ, ততক্ষণে বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল আমাদের স্পিডবোটে। সেটি বাম্প করতে লাগল রোলার কোস্টারের মতো। ২০ মিনিট পর শান্ত হলো স্পিডবোট। আমরা ততক্ষণে গভীর সমুদ্র থেকে রিফে পৌঁছে গেছি। ধীরে ধীরে ল্যান্ডিং জেটি চোখে পড়ল। গাঢ় নীলের পর পান্না সবুজ পানি, তার ওপর সাদা দ্বীপ। জেটি সামনে আসতেই চোখে পড়ল, রিসোর্টের সাতজন স্টাফ হাত নেড়ে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। তাদের দলপতি স্বর্ণকেশী রাশিয়ান আলিশা। চমৎকার হেসে সম্ভাষণ জানাল আর বলল, ‘মইন ফ্যামিলিকে পেয়ে আমরা আনন্দিত।’ মনে হচ্ছিল কত দিনের চেনা।
রিসেপশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো কাঙ্ক্ষিত ওয়াটার বাংলোতে। আমাদের বাংলোটি স্বচ্ছ নীল পানির ওপর দুই রুমের কুঁড়েঘর। একটি মাস্টার বেডরুম আর একটি ড্রেসিং রুম। মাস্টার বেডরুমের সঙ্গে লাগোয়া একটি টেরেস। টেরেসের এক পাশে আছে সিঁড়ি, যা দিয়ে সরাসরি রিফে নেমে পড়া যায়। আর টেরেসের আরেক পাশে মোটা সাদা দড়ি দিয়ে বানানো হয়েছে বিশাল ট্রাম্পোলিন এবং তার ঠিক নিচে সমুদ্র। বাচ্চারা লাফালাফি শুরু করল ট্রাম্পোলিনে। আমরাও যোগ দিলাম তাদের সঙ্গে। আহা সে কী আনন্দ!
আসলে নামে কুঁড়েঘর হলেও আধুনিক বসবাসের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা মেলে এই বাংলোগুলোতে। স্টার রেটিং ভেদে বাড়তে থাকে সুযোগ-সুবিধার পরিধি। কিন্তু কিছু ম্যাজিক স্টার রেটিং মানে না। এই ম্যাজিকের ম্যাজিশিয়ান হলো রিফের বাসিন্দা বেবি সার্ক, স্টিং রে, সি টার্টল আর অসংখ্য নাম না জানা রংবেরঙের মাছ। তারা ম্যাজিক দেখাতে হঠাৎ হঠাৎ চলে আসে বাংলোগুলোর ঠিক নিচে। ওপর থেকে বসে তাদের খেলাধুলা দেখতে বেশ লাগে। সহজ-স্বাভাবিকভাবে তারা ঘুরে বেড়ায় বাংলোর আশপাশে। যেন আমাদের মতো তারাও ঘুরতে এসেছে মালদ্বীপে। এ রকম মানুষের সঙ্গে প্রাণীদের সহাবস্থান দেখতে আমার বেশ লাগে। নিজেদের সর্বশ্রেষ্ঠ তকমা লাগিয়ে অহংকার করা আমার মোটেও ভালো লাগে না। পুরো ইকোসিস্টেমে সবাই সমান গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতি থেকে ক্ষুদ্র মৌমাছিকে বাদ দিলে কয়েক বছরের মধ্যে বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়বে সবুজ পৃথিবী। তখন কী হবে চিন্তা করা যায়?
আমরা মালদ্বীপে গিয়েছিলাম ৭ জানুয়ারি। তখন মাত্র ক্রিসমাস শেষ হয়েছে। কিন্তু রিসোর্টজুড়ে ছিল ক্রিসমাসের সাজসজ্জা আর আমেজ। গোলাপি আলোয় আলোকিত পুরো রিসোর্ট। সেদিনই ছিল তাদের ক্রিসমাস ডিনারের শেষ আয়োজন। সমুদ্রতটের সাদা বালুর ওপর বিছানো হয়েছে টেবিল। তার ওপর মোমবাতি। সাগরের মৃদুমন্দ হাওয়া তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্রাজিলিয়ান এক ব্যান্ড দল বাজিয়ে চলেছে ‘আভা মারিয়া’। করুণ আভা মারিয়া কেন যেন যিশুর লাস্ট সাপারের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। জীবনের শেষ নৈশভোজে বসেছেন যিশু তাঁর বারোজন শিষ্য নিয়ে। ভীষণ শান্ত স্বরে যিশু বললেন, ‘কাল তোমাদের মধ্যেই একজন আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে, ধরিয়ে দেবে আমাকে।’ যিশুর মুখে এই কথা শুনে বারোজনের কারও মুখে ভয়, কারও আগ্রহ, কারও সন্দেহ, কারও মুখে কৌতূহল, করো মুখে ঘৃণা, কারও মুখে উদ্বেগ ফুটে উঠেছিল। কী অদ্ভুত!
এ নিয়ে একটি বিখ্যাত চিত্র আছে লেওনার্দ দ্য ভিঞ্চির, নাম ‘দ্য লাস্ট সাপার’। আঁকা হয়েছিল মিলানের সান্তা মারিয়া দেল্লে গ্র্যাছে। একবার এই ছবি দেখতে গিয়েছিলাম; কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি পনেরো মিনিটের জন্য। গির্জায় ঢোকার শেষ সময় ছয়টা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। আমাদের পৌঁছাতে পৌঁছাতে সাতটা বেজে গিয়েছিল। সেই আফসোস আমার আজও গেল না!
ক্রিসমাসের শেষ ডিনারের আয়োজনটা ছিল হুলুস্থুল রকমের। শুরুতেই এক গ্লাস শ্যাম্পেইন হাতে ধরিয়ে দিয়ে রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার অনিত বলল, ‘আজ ডায়েটের কথা ভুলে যাও। যা মন চায়, খাও।’ নাম না জানা অসংখ্য খাবারে পরিপূর্ণ ব্যুফে, কমলা আলাস্কান ক্র্যাব লেগ, খরগোশের নরম মাংসের ফ্রেঞ্চ টেরিন, সদ্য তোলা নীল রিফের ওয়েস্টার, চিজ হুইলে মাখানো গরম-গরম পাস্তা—আরও কত কী! অনিতের সঙ্গে খেতে খেতে গল্প হচ্ছিল, মালদ্বীপের প্রথম দিকের জনবসতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল তামিলরা, যারা প্রাচীন তামিলকাম থেকে এসেছিল। এই তামিলকামই বর্তমানে ভারতের তামিলনাড়ু। সেই সময় যেসব পর্যটক মালদ্বীপ ভ্রমণ করেছিল, তারা সবাই রানিশাসিত এই রাজ্যের কথা উল্লেখ করেছে। শ্রীলঙ্কার প্রাচীন সাহিত্য ‘মহাবংশ’-এ মালদ্বীপকে বলা হয়েছে ‘মহিলাদ্বীপ’ বা নারীদের দ্বীপ। তার মানে বোঝা যায়, মাতৃতান্ত্রিক এক সমাজব্যবস্থা ছিল এই মালদ্বীপে। লুইস মরগানের একটি চমৎকার বই আছে, নাম ‘অ্যানশায়েন্ট সোসাইটি’। সেখানে লেখকের দাবি, আদিমকালে সব গোষ্ঠী নাকি ছিল মাতৃতান্ত্রিক। কী মজার একটা ব্যাপার, মায়েদের চোখরাঙানি খেয়ে বাবারা চুপ করে বসে থাকত! এরপর সম্রাট অশোকের সময় বুদ্ধ ভিক্ষুরা গিয়ে মালদ্বীপে বসবাস শুরু করেন। তখনই বৌদ্ধধর্ম প্রসার পায়। এখনো তার প্রচুর নিদর্শন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অনেক দ্বীপে। বারো শতকের দিকে মুসলিম বণিকেরা ব্যবসা করতে ভারত সাগরে এসে ঘাঁটি গাড়ে মালদ্বীপে। শুরু হয় দীর্ঘ ইসলামি যুগের।
গল্প শেষে বিদায় নিয়ে চলে এলাম স্বপ্নের সেই কুটিরে। বাচ্চারা কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাদের বিছানায় রেখে আমরা শুয়ে রইলাম নেটের তৈরি টেরেসের সেই ট্রাম্পোলিনে। আকাশে তখন অনন্ত নক্ষত্রবীথি। তারায় পরিপূর্ণ আকাশ। এমন আকাশের দিকে তাকিয়ে অনন্ত জীবন বেঁচে থাকার লোভ জাগে। তখন ঠিক বারোটা। ঠিক সেই মুহূর্তেই আমাদের বিয়ের বারো বছর পূর্ণ হলো।
সকালে ঘুম ভাঙল মৃদু ঠকঠক শব্দে। উঠে দেখি ঘরে বেড়াতে এসেছে দুটো সাদা ড্রিল। ড্রিল হচ্ছে ছোট সাদা শামুক। হাঁটার সময় টালির সঙ্গে শক্ত খোলসের ঠক্করে শব্দ হচ্ছিল ঠকঠক। কিছুক্ষণ বাচ্চাদের নিয়ে শামুকদের সঙ্গে খেলে বললাম তাদের রিফে ফিরিয়ে দিতে। মালদ্বীপসহ প্রাচীন পৃথিবীর বেশ কিছু অঞ্চলের মুদ্রা ছিল একধরনের শামুক, যা আমরা কড়ি নামে চিনি। ১৩৪৪ সালে ইবনে বতুতা মালদ্বীপে এসে দেখেছিলেন, প্রতিবছর মালদ্বীপ ৪০ জাহাজ কড়ি রপ্তানি করত। প্রশ্ন জাগে, কেমন ছিল সেই কড়ির আর্থিক মান? তখন ৪ লাখ কড়ি দিয়ে একটি সোনার দিনার পাওয়া যেত।
এবার রিফে নামার পালা। রুমের সামনে টেরেসের সিঁড়ি দিয়ে নেমে পড়লাম স্বচ্ছ পানিতে। পানির তাপমাত্রা চমৎকার আরামদায়ক। কোমর পর্যন্ত পানিতে অনায়াসে হাঁটা যায় অনেক দূর পর্যন্ত। লাইফ জ্যাকেট পরে নিলাম। নরম বালিতে কিছুক্ষণ হাঁটার পর শরীর ভাসিয়ে দিলাম পানিতে। সাদা বালির ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য কোরাল। তার মাঝে মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছে ছোট ছোট রংবেরঙের মাছ। হাত দিয়ে ধরতে গেলে তারা দৌড়ে পালায়। ততক্ষণে ছেলে কোরাল সংগ্রহে নেমে পড়েছে। রংবেরঙের কোরাল সংগ্রহ করে পকেটে পুরে রাখছে। ছেলে শুনে অবাক হলো, এই কোরলগুলোরও একসময় প্রাণ ছিল। পরে বুড়ো হয়ে মরে গিয়ে তারা জমতে শুরু করে সাগরের তলদেশে। মরে যাওয়ার পর তাদের দেহের চারপাশে ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের একটি পাথুরে স্তর তৈরি হয়। সেটাকেই আমরা প্রবাল বলি। এই প্রবালগুলো এভাবে লাখ লাখ বছর জমে একেকটি পাথরের আকৃতি নেয়। আর কোটি কোটি বছর জমে একটি দ্বীপ সৃষ্টি করে। কী অদ্ভুত প্রকৃতির খেয়াল!
ছেলেকে বললাম, ‘কোটি কোটি বছর পুরোনো এই পাথরবাগান কোনোভাবেই নষ্ট করা উচিত নয়। এরা খুবই দুর্লভ। পৃথিবীতে অল্প কিছু আছে, যার মধ্যে একটি আছে আমাদের দেশে। যাকে আমরা সেন্ট মার্টিন বলে জানি।’ সেন্ট মার্টিনের কথা বলতে বলতে মন খারাপ হয়ে গেল। দেশে এত সুন্দর একটা দ্বীপ আছে, যাকে ইচ্ছে করলেই এমন মালদ্বীপের মতো করা যেত। কিন্তু আমরা চরম অবহেলায় ফেলে রেখেছি। গুনগুন করে গাইতে লাগলাম—
জনম গেল বৃথা কাজে
আমি কাটানু দিন ঘরের মাঝে
তুমি বৃথা আমায় শক্তি দিলে, শক্তিদাতা
ও আমার দেশের মাটি, তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা।
রিফে সাঁতার কাটতে কাটতে আমরা সাবমেরিনের প্রোগ্রাম করলাম। রিসোর্টে একটি ছোট সাবমেরিন আছে। সেটা ঠিক সাবমেরিন নয়। সাবমেরিন আকৃতির নৌকা বলা যায়। নিচের দিকে ফাঁকা একটি জায়গায় ছয়-সাতজন বসতে পারে, চারদিক স্বচ্ছ জানালা দিয়ে ঘেরা। রিফের অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে এই সাবমেরিনের জুড়ি নেই। স্নোরকেলিং করে অল্প একটু জায়গা ঘুরে দেখা যেতে পারে। ভালো ডাইভিংয়ের জন্য দরকার ট্রেনিং। এই দুটোর মাঝে সাবমেরিনে ভ্রমণ ভালো সুযোগ হতে পারে। সাবমেরিনের বর্ণনা প্রথমেই একটু বলেছিলাম। কিন্তু তার সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশের শব্দ আমার অভিধানে নেই।
আমাদের রিসোর্টে ছোট-বড় মিলিয়ে মোট পনেরোটি রেস্টুরেন্ট ছিল। তার মধ্যে কিছু ইন্টারন্যাশনাল চেইন রেস্টুরেন্ট। মিনিস্ট্রি অব ক্র্যাব তেমনি এক রেস্টুরেন্ট। আজ ডিনারের জন্য আমরা সেই রেস্টুরেন্টে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম। এই মিনিস্ট্রি অব ক্র্যাব এশিয়ার ছয়টি দেশে তাদের রেস্টুরেন্ট খুলে বসেছে। ওয়ার্ল্ডস ফিফটি বেস্ট রেস্টুরেন্টের তালিকায় তাদের অবস্থান পঁচিশ। বড় বড় কাঁকড়াই তাদের প্রধান আকর্ষণ। তাদের প্রধান নীতি হলো, তারা হিমায়িত খাবার পরিবেশন করে না। এ জন্য তাদের বিশাল ঝামেলা পোহাতে হয়। মালদ্বীপের এই রেস্টুরেন্টে তাদের কাঁকড়াগুলো আসে প্রাইভেট প্লেনে করে, শ্রীলঙ্কা থেকে। তারপর তাদের বসবাস উপযোগী একটি চৌবাচ্চায় জ্যান্ত সংরক্ষণ করা হয় প্লেটে পরিবেশন করার আগ পর্যন্ত। ক্রেতাদের চাহিদামতো জ্যান্ত কাঁকড়া নিয়ে আসা হয় তার আকৃতি ঠিক আছে কি না, দেখানোর জন্য। এখানে প্রায় দশ আকারের কাঁকড়া পাওয়া যায়। ছোটটা আধা কেজি আর বড়টা দুই কেজি ওজনের। তারা প্রায় পাঁচ রকমভাবে কাঁকড়া রান্না করতে পারে। এর মধ্যে পিপার ক্র্যাব অসম্ভব জনপ্রিয়।
আমরা পিপার ক্র্যাব অর্ডার করেছিলাম, সঙ্গে ছিল ক্র্যাব লিভার পাটে, এপেটাইজারে। ছোট্ট একটি বিস্কুটের ওপর এই ক্র্যাব লিভার পেস্ট জেলির মতো লাগিয়ে তার ওপরে ম্যাপেল সিরাপ দিয়ে কুট্টুস করে কামড় দিয়ে খেতে হয়। দুই কেজির বিশাল পিপার ক্র্যাব খাবার জন্য ঘাম ঝরানো জরুরি। রীতিমতো ছেনি-বাটাল নিয়ে ভাঙতে হয় ক্র্যাবের শক্ত খোল। তারপর বের হয় কাঙ্ক্ষিত সাদা মাংস। পিপার সসে ডুবিয়ে সেই মাংস মুখে পুরে অনায়াসে ভুলে যাওয়া যায় জগৎ-সংসার। ডেজার্টে ছিল নারকেলের খোলে তৈরি ফ্রেঞ্চ ক্রিম ব্রুলে। এবার ঘুম।
আজ ঘুম ভাঙল বৃষ্টির শব্দে। সে কী বৃষ্টি! গতকালের ভেজা কাপড়গুলো শুকাতে দেওয়া হয়েছিল টেরেসে। সেগুলো আবার ভিজে গেল। রুমের দরজা খুলে টেরেসে গিয়ে নতুন রঙের আভা দেখলাম। সবুজ সমুদ্র আরও সবুজ দেখা যাচ্ছে আর ওপরে কালো আকাশ। সে অপরূপ ব্যাপার! সমুদ্র ভয়ংকর হতে লাগল। বাড়তে লাগল বৃষ্টির তেজ। মালদ্বীপের বৃষ্টি নাকি ভয়ংকর—একবার শুরু হলে এক সপ্তাহ। মন খারাপ হয়ে গেল। আরও দুই দিন যে থাকতে হবে! কিন্তু কিছুক্ষণ পরই মেঘ কেটে গিয়ে চমৎকার এক সূর্যের দেখা পেলাম। পুরো পরিবার নিয়ে রিফে নেমে গেলাম। গতকাল নাকি এক বিশাল মান্তা রে ঢুকেছে রিফে।
এই প্রাণীটা বেশ মজার। এরা নাকি তেইশ ফুট পর্যন্ত চওড়া হতে পারে! অদ্ভুত দর্শনের জন্য এদের মানুষ প্রাচীনকাল থেকে ভীষণ ভয় পেত। প্রাচীনকালে নাবিকেরা বিশ্বাস করতেন যে, তারা মানুষের জন্য বিপজ্জনক এবং নোঙরে টান দিয়ে নৌকা ডোবাতে পারে। পরে যখন ডাইভিং জনপ্রিয় হয়, তখন মানুষ বুঝতে শেখে, এরা নিরীহ গোছের প্রাণী আর শুরু করে তাদের ওপর অত্যাচার। তাদের ফুলকা চায়নিজ ওষুধের এক দুর্মূল্য উপাদান। এই ফুলকার জন্য হাজার হাজার মান্তা রে প্রতি বছর মারা হয়। সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে যাওয়ায় গত বছরই তাদের বিপদাপন্ন প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
দুপুরে যখন আমরা পানি থেকে উঠে খাবার খাচ্ছিলাম, তখনই দেখা মিলল সেই বিশাল কালো মান্তা রের। প্রবল দাপটে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে রিফে। মাছেদের খেলা দেখতে দেখতে বিকেল নামল। বেগুনি হয়ে উঠল আকাশ। রিফের সেই আকাশি পানি তখনো আকাশি। তবে কিছুটা কালচে। চমৎকার বেগুনি আকাশের নিচে কালচে আকাশি সমুদ্র ঠিক যেন মনভোলা এক চিত্রকরের হাতে আঁকা ছবি। প্রকৃতির এমন রূপ দেখে যেকোনো শিল্পীর মনে হতে বাধ্য, এখানে বাকি জীবন কাটালে মন্দ হতো না। সারা দিন শুধু ছবি আঁকব, ফিরব না আর যান্ত্রিক নগরে। সত্যি সত্যি এমন পাগলামি কিন্তু একজন করেছিলেন—তাঁর নাম পল গগাঁ। ফরাসি এই শিল্পী তাহিতি নামের এক দ্বীপে গিয়ে তার প্রেমে পড়ে যান। তারপর সবকিছু ছেড়েছুড়ে আমৃত্যু বসবাস করতে থাকেন সেই দ্বীপে।
মালদ্বীপের এই তটে বসে গগাঁর মনের অবস্থা টের পাচ্ছিলাম। এই ক্ষুদ্র জীবনে খুব বেশি কিছু কি দরকার? তবু ফিরে যেতে হবে কাল। মন খারাপ হয়ে গেল। আকাশে তখন তারা ফুটে উঠছে। বেগুনি থেকে গাঢ় নীল হচ্ছে পৃথিবী।
পৃথিবী এত সুন্দর কেন?
তরুণদের মধ্যে যাদের জন্ম ১৯৯৭ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে তাদের বলা হচ্ছে জেন জি বা জেনারেশন জেড। একাডেমিক পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে করোনা চলাকালীন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ শুরু করে এই প্রজন্ম। কিন্তু তাদের নিয়ে সবার যে প্রত্যাশা এরই মধ্যে তাতে ধুলো পড়তে শুরু করেছে।
২ দিন আগেআমন্ত্রণ নয়, রাজশাহী আপনাকে নিমন্ত্রণ জানাচ্ছে। ছাতিমের সুগন্ধ ছাড়িয়ে রাজশাহী এখন ম-ম করছে হাঁসের মাংস ভুনার সুগন্ধে। সাদা ভাত আর গরম-গরম মাংস ভুনা। বিকেলে বাটার মোড়ের জিলাপির সঙ্গে নিমকি দিয়ে হালকা নাশতা। আলোর শহর রাজশাহী ঘুরে দেখার পর সন্ধ্যায় সিঅ্যান্ডবি মোড়ে গরম-গরম রসগোল্লার সঙ্গে পুরি।
৩ দিন আগেশুধু কলাপাড়া বললে অনেকে হয়তো জায়গাটা চিনবেন না। কিন্তু কুয়াকাটার কথা বললে চিনবেন প্রায় সবাই। কুয়াকাটা সৈকতের জন্য কলাপাড়া এখন সুপরিচিত। এখানে আছে এক বিখ্যাত খাবার। জগার মিষ্টি।
৩ দিন আগেঢাকা শহরের গলিগুলো এখন খাবারের ঘ্রাণে উতলা থাকে। এদিক-ওদিক তাকালেই দেখবেন, কোথাও না কোথাও একটি লাইভ বেকারি। এতে বেক করা হচ্ছে পাউরুটি, বিভিন্ন ধরনের কেক-বিস্কুট কিংবা বাটার বান। কৌতূহল নিয়ে এক পিস কিনে মুখে পুরে দিতে পারেন। এগুলোর দামও যে খুব আহামরি, তা কিন্তু নয়।
৩ দিন আগে