জাহাঙ্গীর আলম
শ্রাবণ মাসে (নানী–দাদিরা বলতেন সোনার শাওন মাস) আব্বার জন্য মাঠে দৈনিক পান্তা ভাত নিয়ে যেতে হতো। মাঝারি সাইজের গামলায় পান্তাভাত, সঙ্গে ধানের খড় দিয়ে জ্বালানো চুলার আগুনে পোড়া শুকনো মরিচ, এক কামড়ে চোখে জল আনা দেশি পেঁয়াজ। আরেক বাটিতে শুকনো পোড়া মরিচ আর সরিষার তেলে বানানো আলু ভর্তা, গত রাতের বেঁচে যাওয়া বাসি তরকারি। বাঁকের (এক ফালি বাঁশ) দুই পাশে দুই শিকার একটিতে অ্যালুমিনিয়ামের জগে টিউবওয়েলের পানি আর আরেকটিতে পান্তাভাত। আমার শৈশব–কৈশোর জুড়েই এই স্মৃতি।
আমাদের গ্রীষ্ম আর বর্ষাকালের সকালবেলার সাধারণ খাবার ছিল এটি। রাজধানীতে পড়তে এসে শুনি এখানে পয়লা বৈশাখে খাওয়া হয় পান্তা–ইলিশ, শিকড়ের কাছে সংস্কৃতির দায় মেটাতে গিয়ে অনেকে বাঁধিয়ে ফেলেন ডায়রিয়া! গ্রামের গরিব কৃষকের সাধারণ খাদ্য (প্রয়োজনও বটে) শহুরে মধ্যবিত্তের কাছে এসে আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়ে যখন আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির মর্যাদা লাভ করে, তখন তো তার কিছুটা ‘বিকৃতি’ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠেই!
এই যে পয়লা বৈশাখের সকালে পান্তা–ইলিশের চল, এটা কখনো গ্রামে দেখিনি। অন্তত আমার গ্রামে তো বটেই, উত্তরবঙ্গেও নয়। আমরা তো ইলিশ খেতাম বছরে দু–একবার। আমন ধান কাটার পর আব্বা এক মণ পাইজাম ধান বেচে একটা ইলিশ আনত। তখন কেজির নিচে ইলিশ পাওয়া যেত না। হয়তো মানুষের এতটা শহরমুখী না হওয়া এবং রেফ্রিজারেটর সুলভ না হওয়ার কারণে তখনো জাটকা খাওয়ার কথা মানুষ ভাবতে পারেনি!
পান্তার সঙ্গে আর যা যা পদ যুক্ত হতো, তার মধ্যে লাল মরিচ দিয়ে আলুর ভর্তা, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, সরিষার তেল, শুঁটকি ভর্তা, নারকেল কোরা, বাসি তরকারি, আর কোরবানির সময় অবধারিতভাবে গরুর মাংস।
এই কারণেই পান্তাকে ‘জাতে’ তুলে ঐতিহ্য বাঁচানোর এই কোশেশের আড়ালে অনেকে হীনম্মন্যতার লক্ষণও দেখতে পান। কিশোয়ার চৌধুরী কি সেই হীনম্মন্যতা থেকে কিছুটা হলেও উদ্ধার করে আত্মবিশ্বাস ফেরাতে পারবেন?
সে যাই হোক, পান্তা–আলু ভর্তা এখন আন্তর্জাতিক মঞ্চে। এ নিয়ে আদিখ্যেতার বান বয়ে যাচ্ছে। আহ্লাদিত হওয়ার মতো ব্যাপারই বটে! মাস্টার শেফ অস্ট্রেলিয়ার মতো মঞ্চে পান্তা ভাতেই বাজিমাত করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কিশোয়ার চৌধুরী। এই মেন্যু দিয়েই চূড়ান্ত পর্বে দ্বিতীয় রানার আপ হয়েছেন তিনি। এই আহ্লাদ শুধু বাংলাদেশিদের জন্য নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ভেতো মানুষের জন্য এক আনন্দের ও ইজ্জতের ব্যাপার!
ভারতীয় সাংবাদিক পূজা পিল্লাই এক নিবন্ধে চমৎকারভাবে বিষয়টি তুলে এনেছেন।
ফাইনাল রাউন্ডে মেন্যু হিসেবে পান্তা ভাতকেই বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে কিশোয়ার বলেছিলেন, ‘এটা এমন এক খাবার যা আপনি কোনো রেস্তোরাঁয় পাবেন না।’ বিচারকেরা এটা পছন্দ করেছিলেন। যদিও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দর্শকের কাছে কিশোয়ারের পছন্দটি বিস্ময়কর, বিভ্রান্তিকর ও সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হলো অনেকের কাছে হাস্যকরও ছিল।
কারণটা কী? পান্তা ভাত, একেবারেই সাধারণ মানুষের খাবার। রান্না করা ভাতে পানি যোগ করে লবণ মিশিয়ে খাওয়া হয়। কখনো রাতভর ভিজিয়ে রাখা হয়, তাতে কিছুটা গাঁজন আসে। এর পর কাঁচা মরিচ, কোরা নারকেল, পেঁয়াজ, কুচি করে কাটা কচি পেঁয়াজ, আদা, দই, কাঁচা সরিষার তেল, লেবুর রস ইত্যাদি দিয়ে খাওয়া হয়। এটি আসলে জলো ভাত, যা অনেক সময় খাওয়ার পর বেঁচে যাওয়া ভাত। অনেকে পেট ঠান্ডা রাখতে খান। আবার কেউ খান এর বেশি জোগাড় করার সামর্থ্য নেই বলে। এমন সাধারণ পদ যখন টেলিভিশন শো বা দামি রেস্তোরাঁয় স্থান করে স্পটলাইটে চলে আসে, তখন সেটিকে আর হেলা করা যায় না—এমন একটা মনোভাব আমাদের রয়েছে।
কিশোয়ার নিজেই কিন্তু প্রথমে এই পদ বেছে নেননি। তিনি হাঁসের মাংসের একটি পদ করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু বিচারকেরা এমন কিছু চাইছিলেন, যেটিতে কিশোয়ারকে খুঁজে পাওয়া যাবে। সে ক্ষেত্রে পান্তা ভাতের মতো একটি পদ বেছে নেওয়া নিঃসন্দেহে দুঃসাহসের ব্যাপার!
প্রশ্ন উঠতেই পারে, পান্তা ভাত কেন মাস্টারশেফের বিচারকদের সামনে পরিবেশন করা যাবে না বা এটি কেনই–বা উপভোগ্য কোনো পদ হতে পারে না? চাটনি, খেসারি বা মসুর ডালের বড়ি, ভাজা শাকসবজি বা মাছ, শুকনো চিংড়ি ইত্যাদি সহযোগে পান্তা ভাত আরও স্বাদযুক্ত এবং এতে আকর্ষণীয় টেক্সচার আনা যেতে পারে। এমনকি পান্তা ভাত কয়লার আগুনে স্মোকডও হতে পারে, যেমনটি কিশোয়ার করে দেখিয়েছেন। অর্থাৎ, পান্তা ভাতকে কিন্তু নানাভাবেই ভদ্রলোকদের খাবারে পরিণত করা যেতে পারে। এই বিষয়গুলোই যে মাস্টারশেফের শোতে বড় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, এমনটি নাও হতে পারে। তবে এসব ছাড়াও পান্তা ভাত আসলেই একটি উপাদেয় ও উপকারী খাবার।
২০১৯ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বার্ক) পুষ্টি বিভাগের একটি গবেষণায় পান্তা ভাতের গুন প্রমাণিত। বারি-২৮, পরি, মিনিকেট, আমন ও বালাম—এই পাঁচ জাতের চালের ভাতের চেয়ে পান্তা ভাতে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের উপস্থিতি বেশি থাকে। দীর্ঘ সময় চাল পানিতে ভিজিয়ে রাখলে ক্যালসিয়াম, আয়রন, পটাশিয়াম ও সোডিয়ামের পরিমাণ অনেক গুণ বেড়ে যায়।
২০১৬ সালে এশিয়ান জার্নাল অব কেমিস্ট্রিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় একই ধরনের ফলাফল দেখানো হয়। গবেষণাটি করেছেন আসাম এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির এগ্রিকালচারাল বায়োটেকনোলজি বিভাগের তিন শিক্ষক। তাঁরা দেখিয়েছেন, ভাত পানিতে ভিজিয়ে রাখলে পিএইচের মাত্রা কমতে থাকে। লৌহ, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম ও জিংকের পরিমাণ বাড়ে। পান্তা ভাতে খনিজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি থাকে ম্যাগনেশিয়াম। এরপরই ক্যালসিয়াম। অর্থাৎ পান্তা ভাতে শুধু পুষ্টি হ্রাসকারী উপাদান কম থাকে তা নয়, এটি ভাতের চেয়ে অনেক বেশি খনিজের উৎস।
চূড়ান্ত পর্বে কিশোয়ারের পছন্দ নিয়ে বাঙালি ও দক্ষিণ এশীয় ভেতো মানুষদের যে প্রতিক্রিয়া এবং শেষ পর্যন্ত জিতে যাওয়ার পর আহ্লাদে আটখানা হওয়ার হাস্যকর দৃশ্য দেখা গেল, সেটির মনো-সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা আছে। এই ধরনের প্রতিক্রিয়া কীভাবে নির্ধারিত ও চালিত হয়, সেটির ব্যাখ্যায় এটি তত্ত্ব দিয়েছেন খাদ্য গবেষক কৃষ্ণেন্দু রায়। ‘দ্য রেস্টুরেন্টের’ বইয়ে তিনি দেখিয়েছেন, খাবারের বৈশ্বিক মর্যাদার ক্রম বিচারের আদ্যোপান্ত। বইয়ে দেখানো হয়েছে কীভাবে প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব রন্ধনশিল্পের মর্যাদা নির্ধারক হয়ে ওঠে।
অধিকতর ক্ষমতাবান গোষ্ঠী বা দেশের রন্ধনশিল্প সাধারণত শীর্ষে থাকে। স্বল্প পুঁজির (অর্থনৈতিক ও আর্থসামাজিক) জাতিগোষ্ঠীর খাদ্য স্থান পায় তলানিতে। মার্কিন রেস্তোরাঁগুলোর চর্চা ও প্রবণতা অধ্যয়ন করে এই তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন কৃষ্ণেন্দু। দেখেছেন, যেই দেশ সাংস্কৃতিক বা অর্থনৈতিকভাবে যত বেশি শক্তিশালী, তাদের খাদ্য তত বেশি মর্যাদাপূর্ণ এবং পদগুলোও ব্যয়বহুল। তাই রেস্তোরাঁ ও খাবারে অভিনব অভিজ্ঞতা নিতে মানুষ যায় জাপানি বা ফ্রেঞ্চ রেস্তোরাঁয়। বা অন্য কোথাও গেলেও ওই দুই দেশের খাবার বেছে নেয়। আবার দ্রুত প্রস্তুত করা যায় এবং সস্তায় পাওয়া যায়—এমন খাবার চাইলে সেটি ম্যাক্সিকান, চীনা, ভারতীয় বা থাই হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
ভারতেও একইভাবে খাবারে মর্যাদা নির্ধারিত হয়ে আছে। একটি খাবারের আঞ্চলিক এবং বর্ণগত উৎসই নির্ধারণ করে দেয় তা মর্যাদাপূর্ণ বা রেস্তোরাঁয় তোলার যোগ্য কি-না। এখানে ইউরোপীয় বা আমেরিকান খাবারের কদর বেশি। সেটি যদি ওই খাবারের প্রায় কাছাকাছি হয়, তবুও মর্যাদায় হেরফের হয় না।
এ ছাড়া ভারতীয় রন্ধনশিল্পের মধ্যে দক্ষিণের রাজ্যগুলোর, বিশেষত কেরালা ও তামিলনাড়ুর খাবারের গ্রহণযোগ্যতা বিহার বা ওডিশার খাবারের চেয়ে অনেক বেশি।
ঐতিহাসিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাবারগুলো কখনো টেবিলে ওঠেনি। ফলে একটি রন্ধনশিল্প কীভাবে গড়ে ওঠে, সে নিয়ে জাতীয় কোনো ধারণা নেই। ভারতীয় (বাংলাদেশসহ) খাবারগুলোর মধ্যে রেস্তোরাঁয় তোলার জন্য সবচেয়ে যোগ্য খাবারটি বলা যেতে পারে—মোগলাই। এটিই কেবল রেস্তোরাঁর খাবার। বাটার চিকেন ও পনির মাখনওয়ালার মতো পছন্দনীয় মোগলাই খাবার। এসব পদ তৈরিই হয়েছে রেস্তোরাঁয়। এগুলোর সঙ্গে আঞ্চলিক বা বর্ণ উৎসের কোনো যোগ নেই।
অবশ্য কখনো কখনো যে এই মর্যাদার ক্রমতে অখ্যাত কেউ এসে যে বড় ধাক্কা দেন না—এমন নয়। তিন বছর আগে পান্তা ভাতের একটি পদ নিয়ে আলোচনায় এসেছিল ভারতের মুম্বাই শহরের পুরস্কার বিজয়ী রেস্তোরাঁ দ্য বোম্বে ক্যানটিন। ওড়িয়া খাবার পাখালা ভাতের (পান্তা ভাতের স্থানীয় নাম) সঙ্গে কাখারু ফুলা ভাজা (মিষ্টি কুমড়ার ফুলের চপ) দিয়ে একটি মেন্যু যুক্ত করেছিল তারা। সেই মেন্যুর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছিলেন রেস্টুরেন্টের তখনকার প্রধান শেফ থমাস জাকারিয়া। তখন ওডিশা তো বটেই সারা ভারত থেকে দারুণ সাড়া পড়েছিল। ওডিশার মানুষ এ নিয়ে গর্ব করে পোস্টের নিচে মন্তব্য করেন।
কিশোয়ারের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, সংবাদমাধ্যম বাঁধ ভাঙা আবেগ নিয়ে কিশোয়ারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। এমন একটি মঞ্চে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী খাবার তুলে ধরার জন্য কিশোয়ারের প্রতি সবাই কৃতজ্ঞ। এর প্রধান কারণ, বৈশ্বিক ভোজন সংস্কৃতিতে খাবারের যে মর্যাদার ক্রম নির্ধারণের এক শ্রেণিবৈষম্যের অভেদ্য দেয়াল দাঁড়িয়ে গেছে, কিশোয়ার সেই দেয়াল টপকে অভিজাত টেবিলে ছোট করে হলেও পুরো একটি জাতির প্রতিনিধিত্বমূলক একটি ‘অতি তুচ্ছ’ পদ উচ্চে তুলে ধরেছেন! এ ঘটনা আগামী দিনে অনেকের আত্মবিশ্বাসের ভিত হয়ে থাকবে।
শ্রাবণ মাসে (নানী–দাদিরা বলতেন সোনার শাওন মাস) আব্বার জন্য মাঠে দৈনিক পান্তা ভাত নিয়ে যেতে হতো। মাঝারি সাইজের গামলায় পান্তাভাত, সঙ্গে ধানের খড় দিয়ে জ্বালানো চুলার আগুনে পোড়া শুকনো মরিচ, এক কামড়ে চোখে জল আনা দেশি পেঁয়াজ। আরেক বাটিতে শুকনো পোড়া মরিচ আর সরিষার তেলে বানানো আলু ভর্তা, গত রাতের বেঁচে যাওয়া বাসি তরকারি। বাঁকের (এক ফালি বাঁশ) দুই পাশে দুই শিকার একটিতে অ্যালুমিনিয়ামের জগে টিউবওয়েলের পানি আর আরেকটিতে পান্তাভাত। আমার শৈশব–কৈশোর জুড়েই এই স্মৃতি।
আমাদের গ্রীষ্ম আর বর্ষাকালের সকালবেলার সাধারণ খাবার ছিল এটি। রাজধানীতে পড়তে এসে শুনি এখানে পয়লা বৈশাখে খাওয়া হয় পান্তা–ইলিশ, শিকড়ের কাছে সংস্কৃতির দায় মেটাতে গিয়ে অনেকে বাঁধিয়ে ফেলেন ডায়রিয়া! গ্রামের গরিব কৃষকের সাধারণ খাদ্য (প্রয়োজনও বটে) শহুরে মধ্যবিত্তের কাছে এসে আনুষ্ঠানিকতায় পর্যবসিত হয়ে যখন আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির মর্যাদা লাভ করে, তখন তো তার কিছুটা ‘বিকৃতি’ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠেই!
এই যে পয়লা বৈশাখের সকালে পান্তা–ইলিশের চল, এটা কখনো গ্রামে দেখিনি। অন্তত আমার গ্রামে তো বটেই, উত্তরবঙ্গেও নয়। আমরা তো ইলিশ খেতাম বছরে দু–একবার। আমন ধান কাটার পর আব্বা এক মণ পাইজাম ধান বেচে একটা ইলিশ আনত। তখন কেজির নিচে ইলিশ পাওয়া যেত না। হয়তো মানুষের এতটা শহরমুখী না হওয়া এবং রেফ্রিজারেটর সুলভ না হওয়ার কারণে তখনো জাটকা খাওয়ার কথা মানুষ ভাবতে পারেনি!
পান্তার সঙ্গে আর যা যা পদ যুক্ত হতো, তার মধ্যে লাল মরিচ দিয়ে আলুর ভর্তা, কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ, সরিষার তেল, শুঁটকি ভর্তা, নারকেল কোরা, বাসি তরকারি, আর কোরবানির সময় অবধারিতভাবে গরুর মাংস।
এই কারণেই পান্তাকে ‘জাতে’ তুলে ঐতিহ্য বাঁচানোর এই কোশেশের আড়ালে অনেকে হীনম্মন্যতার লক্ষণও দেখতে পান। কিশোয়ার চৌধুরী কি সেই হীনম্মন্যতা থেকে কিছুটা হলেও উদ্ধার করে আত্মবিশ্বাস ফেরাতে পারবেন?
সে যাই হোক, পান্তা–আলু ভর্তা এখন আন্তর্জাতিক মঞ্চে। এ নিয়ে আদিখ্যেতার বান বয়ে যাচ্ছে। আহ্লাদিত হওয়ার মতো ব্যাপারই বটে! মাস্টার শেফ অস্ট্রেলিয়ার মতো মঞ্চে পান্তা ভাতেই বাজিমাত করেছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কিশোয়ার চৌধুরী। এই মেন্যু দিয়েই চূড়ান্ত পর্বে দ্বিতীয় রানার আপ হয়েছেন তিনি। এই আহ্লাদ শুধু বাংলাদেশিদের জন্য নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ভেতো মানুষের জন্য এক আনন্দের ও ইজ্জতের ব্যাপার!
ভারতীয় সাংবাদিক পূজা পিল্লাই এক নিবন্ধে চমৎকারভাবে বিষয়টি তুলে এনেছেন।
ফাইনাল রাউন্ডে মেন্যু হিসেবে পান্তা ভাতকেই বেছে নেওয়ার কারণ হিসেবে কিশোয়ার বলেছিলেন, ‘এটা এমন এক খাবার যা আপনি কোনো রেস্তোরাঁয় পাবেন না।’ বিচারকেরা এটা পছন্দ করেছিলেন। যদিও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দর্শকের কাছে কিশোয়ারের পছন্দটি বিস্ময়কর, বিভ্রান্তিকর ও সবচেয়ে মর্মান্তিক বিষয় হলো অনেকের কাছে হাস্যকরও ছিল।
কারণটা কী? পান্তা ভাত, একেবারেই সাধারণ মানুষের খাবার। রান্না করা ভাতে পানি যোগ করে লবণ মিশিয়ে খাওয়া হয়। কখনো রাতভর ভিজিয়ে রাখা হয়, তাতে কিছুটা গাঁজন আসে। এর পর কাঁচা মরিচ, কোরা নারকেল, পেঁয়াজ, কুচি করে কাটা কচি পেঁয়াজ, আদা, দই, কাঁচা সরিষার তেল, লেবুর রস ইত্যাদি দিয়ে খাওয়া হয়। এটি আসলে জলো ভাত, যা অনেক সময় খাওয়ার পর বেঁচে যাওয়া ভাত। অনেকে পেট ঠান্ডা রাখতে খান। আবার কেউ খান এর বেশি জোগাড় করার সামর্থ্য নেই বলে। এমন সাধারণ পদ যখন টেলিভিশন শো বা দামি রেস্তোরাঁয় স্থান করে স্পটলাইটে চলে আসে, তখন সেটিকে আর হেলা করা যায় না—এমন একটা মনোভাব আমাদের রয়েছে।
কিশোয়ার নিজেই কিন্তু প্রথমে এই পদ বেছে নেননি। তিনি হাঁসের মাংসের একটি পদ করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু বিচারকেরা এমন কিছু চাইছিলেন, যেটিতে কিশোয়ারকে খুঁজে পাওয়া যাবে। সে ক্ষেত্রে পান্তা ভাতের মতো একটি পদ বেছে নেওয়া নিঃসন্দেহে দুঃসাহসের ব্যাপার!
প্রশ্ন উঠতেই পারে, পান্তা ভাত কেন মাস্টারশেফের বিচারকদের সামনে পরিবেশন করা যাবে না বা এটি কেনই–বা উপভোগ্য কোনো পদ হতে পারে না? চাটনি, খেসারি বা মসুর ডালের বড়ি, ভাজা শাকসবজি বা মাছ, শুকনো চিংড়ি ইত্যাদি সহযোগে পান্তা ভাত আরও স্বাদযুক্ত এবং এতে আকর্ষণীয় টেক্সচার আনা যেতে পারে। এমনকি পান্তা ভাত কয়লার আগুনে স্মোকডও হতে পারে, যেমনটি কিশোয়ার করে দেখিয়েছেন। অর্থাৎ, পান্তা ভাতকে কিন্তু নানাভাবেই ভদ্রলোকদের খাবারে পরিণত করা যেতে পারে। এই বিষয়গুলোই যে মাস্টারশেফের শোতে বড় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল, এমনটি নাও হতে পারে। তবে এসব ছাড়াও পান্তা ভাত আসলেই একটি উপাদেয় ও উপকারী খাবার।
২০১৯ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বার্ক) পুষ্টি বিভাগের একটি গবেষণায় পান্তা ভাতের গুন প্রমাণিত। বারি-২৮, পরি, মিনিকেট, আমন ও বালাম—এই পাঁচ জাতের চালের ভাতের চেয়ে পান্তা ভাতে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের উপস্থিতি বেশি থাকে। দীর্ঘ সময় চাল পানিতে ভিজিয়ে রাখলে ক্যালসিয়াম, আয়রন, পটাশিয়াম ও সোডিয়ামের পরিমাণ অনেক গুণ বেড়ে যায়।
২০১৬ সালে এশিয়ান জার্নাল অব কেমিস্ট্রিতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় একই ধরনের ফলাফল দেখানো হয়। গবেষণাটি করেছেন আসাম এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির এগ্রিকালচারাল বায়োটেকনোলজি বিভাগের তিন শিক্ষক। তাঁরা দেখিয়েছেন, ভাত পানিতে ভিজিয়ে রাখলে পিএইচের মাত্রা কমতে থাকে। লৌহ, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম ও জিংকের পরিমাণ বাড়ে। পান্তা ভাতে খনিজের মধ্যে সবচেয়ে বেশি থাকে ম্যাগনেশিয়াম। এরপরই ক্যালসিয়াম। অর্থাৎ পান্তা ভাতে শুধু পুষ্টি হ্রাসকারী উপাদান কম থাকে তা নয়, এটি ভাতের চেয়ে অনেক বেশি খনিজের উৎস।
চূড়ান্ত পর্বে কিশোয়ারের পছন্দ নিয়ে বাঙালি ও দক্ষিণ এশীয় ভেতো মানুষদের যে প্রতিক্রিয়া এবং শেষ পর্যন্ত জিতে যাওয়ার পর আহ্লাদে আটখানা হওয়ার হাস্যকর দৃশ্য দেখা গেল, সেটির মনো-সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা আছে। এই ধরনের প্রতিক্রিয়া কীভাবে নির্ধারিত ও চালিত হয়, সেটির ব্যাখ্যায় এটি তত্ত্ব দিয়েছেন খাদ্য গবেষক কৃষ্ণেন্দু রায়। ‘দ্য রেস্টুরেন্টের’ বইয়ে তিনি দেখিয়েছেন, খাবারের বৈশ্বিক মর্যাদার ক্রম বিচারের আদ্যোপান্ত। বইয়ে দেখানো হয়েছে কীভাবে প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব রন্ধনশিল্পের মর্যাদা নির্ধারক হয়ে ওঠে।
অধিকতর ক্ষমতাবান গোষ্ঠী বা দেশের রন্ধনশিল্প সাধারণত শীর্ষে থাকে। স্বল্প পুঁজির (অর্থনৈতিক ও আর্থসামাজিক) জাতিগোষ্ঠীর খাদ্য স্থান পায় তলানিতে। মার্কিন রেস্তোরাঁগুলোর চর্চা ও প্রবণতা অধ্যয়ন করে এই তত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন কৃষ্ণেন্দু। দেখেছেন, যেই দেশ সাংস্কৃতিক বা অর্থনৈতিকভাবে যত বেশি শক্তিশালী, তাদের খাদ্য তত বেশি মর্যাদাপূর্ণ এবং পদগুলোও ব্যয়বহুল। তাই রেস্তোরাঁ ও খাবারে অভিনব অভিজ্ঞতা নিতে মানুষ যায় জাপানি বা ফ্রেঞ্চ রেস্তোরাঁয়। বা অন্য কোথাও গেলেও ওই দুই দেশের খাবার বেছে নেয়। আবার দ্রুত প্রস্তুত করা যায় এবং সস্তায় পাওয়া যায়—এমন খাবার চাইলে সেটি ম্যাক্সিকান, চীনা, ভারতীয় বা থাই হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
ভারতেও একইভাবে খাবারে মর্যাদা নির্ধারিত হয়ে আছে। একটি খাবারের আঞ্চলিক এবং বর্ণগত উৎসই নির্ধারণ করে দেয় তা মর্যাদাপূর্ণ বা রেস্তোরাঁয় তোলার যোগ্য কি-না। এখানে ইউরোপীয় বা আমেরিকান খাবারের কদর বেশি। সেটি যদি ওই খাবারের প্রায় কাছাকাছি হয়, তবুও মর্যাদায় হেরফের হয় না।
এ ছাড়া ভারতীয় রন্ধনশিল্পের মধ্যে দক্ষিণের রাজ্যগুলোর, বিশেষত কেরালা ও তামিলনাড়ুর খাবারের গ্রহণযোগ্যতা বিহার বা ওডিশার খাবারের চেয়ে অনেক বেশি।
ঐতিহাসিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাবারগুলো কখনো টেবিলে ওঠেনি। ফলে একটি রন্ধনশিল্প কীভাবে গড়ে ওঠে, সে নিয়ে জাতীয় কোনো ধারণা নেই। ভারতীয় (বাংলাদেশসহ) খাবারগুলোর মধ্যে রেস্তোরাঁয় তোলার জন্য সবচেয়ে যোগ্য খাবারটি বলা যেতে পারে—মোগলাই। এটিই কেবল রেস্তোরাঁর খাবার। বাটার চিকেন ও পনির মাখনওয়ালার মতো পছন্দনীয় মোগলাই খাবার। এসব পদ তৈরিই হয়েছে রেস্তোরাঁয়। এগুলোর সঙ্গে আঞ্চলিক বা বর্ণ উৎসের কোনো যোগ নেই।
অবশ্য কখনো কখনো যে এই মর্যাদার ক্রমতে অখ্যাত কেউ এসে যে বড় ধাক্কা দেন না—এমন নয়। তিন বছর আগে পান্তা ভাতের একটি পদ নিয়ে আলোচনায় এসেছিল ভারতের মুম্বাই শহরের পুরস্কার বিজয়ী রেস্তোরাঁ দ্য বোম্বে ক্যানটিন। ওড়িয়া খাবার পাখালা ভাতের (পান্তা ভাতের স্থানীয় নাম) সঙ্গে কাখারু ফুলা ভাজা (মিষ্টি কুমড়ার ফুলের চপ) দিয়ে একটি মেন্যু যুক্ত করেছিল তারা। সেই মেন্যুর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছিলেন রেস্টুরেন্টের তখনকার প্রধান শেফ থমাস জাকারিয়া। তখন ওডিশা তো বটেই সারা ভারত থেকে দারুণ সাড়া পড়েছিল। ওডিশার মানুষ এ নিয়ে গর্ব করে পোস্টের নিচে মন্তব্য করেন।
কিশোয়ারের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, সংবাদমাধ্যম বাঁধ ভাঙা আবেগ নিয়ে কিশোয়ারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। এমন একটি মঞ্চে নিজেদের ঐতিহ্যবাহী খাবার তুলে ধরার জন্য কিশোয়ারের প্রতি সবাই কৃতজ্ঞ। এর প্রধান কারণ, বৈশ্বিক ভোজন সংস্কৃতিতে খাবারের যে মর্যাদার ক্রম নির্ধারণের এক শ্রেণিবৈষম্যের অভেদ্য দেয়াল দাঁড়িয়ে গেছে, কিশোয়ার সেই দেয়াল টপকে অভিজাত টেবিলে ছোট করে হলেও পুরো একটি জাতির প্রতিনিধিত্বমূলক একটি ‘অতি তুচ্ছ’ পদ উচ্চে তুলে ধরেছেন! এ ঘটনা আগামী দিনে অনেকের আত্মবিশ্বাসের ভিত হয়ে থাকবে।
১৯৫১ সাল। ইরানের রাজা রেজা শাহ পাহলভি এলেন পৃথিমপাশা জমিদারবাড়িতে। সে এক হুলুস্থুল ব্যাপার! এ বাড়ির পূর্বপুরুষেরা ইরান থেকে এসেছিলেন বলে জানা যায়।
১ দিন আগেশীতে কাপড় ভালো রাখতে সেগুলোকে যেমন রোদে মেলে দিতে হয়, সম্পর্ক উন্নয়নে মাঝেমধ্যে তেমনি ভ্রমণেও যেতে হয়। শীত চলে এসেছে। ভ্রমণপ্রেমীরা হয়ে উঠেছেন সরব।
১ দিন আগেপর্যটন বন্ধে কারফিউ! হ্যাঁ, তেমনটিই ঘটেছে দক্ষিণ কোরিয়ায়। গ্রামের নাম বুকচন হ্যানোক। দক্ষিণ কোরিয়ার জংনো জেলায় এর অবস্থান। বুকচন হ্যানোক দেশটির ‘মাস্ট ভিজিট’ পর্যটন গন্তব্য।
১ দিন আগেভ্রমণের স্বাদ একবার রক্তে ঢুকলে, তা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। এক অদৃশ্য তাড়না কাজ করতে থাকে ভেতরে-ভেতরে।
১ দিন আগে