ইশতিয়াক হাসান
বর্ষা পেরিয়ে এখন চলছে শরৎ। এ সময় পাহাড়ের রং থাকে সবুজ। কোথাও কোথাও এখনো দেখতে পাবেন জুমের ফসল তোলার দৃশ্য। ঝরনা-ঝিরিতেও যথেষ্ট পানি আছে। এদিকে বৃষ্টি কমে আসায় জঙ্গল-পাহাড় ভ্রমণে বিপত্তিতে পড়ার সুযোগ কম। কাজেই সবুজ পাহাড়-বনানী, পাহাড়ি নদী, ঝিরি ভ্রমণের জন্য সময়টা আদর্শ। আপনার জন্য বাড়তি পাওয়া শরতের নীল আকাশ। আজ বিশ্ব পর্যটন দিবসে থাকছে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের পাহাড়, অরণ্যময় দশটি জায়গার গল্প।
সাঙ্গু নদী ধরে রেমাক্রি
বান্দরবানের থানচির সাঙ্গু নদী থেকে শুরু করবেন আশ্চর্য এই নৌকা ভ্রমণ। মিনিট পনেরো-কুড়ি পরেই এমন এক জায়গায় চলে আসবেন যেখানে মনে হবে পানি ফুটছে। নৌকাটা যখন তীব্র গতিতে জায়গাটি পেরোতে থাকবে তখন কেমন ভয় ভয় করবে, তার চেয়েও বেশি যেটা অনুভব করবেন সেটা রোমাঞ্চ। রেমাক্রি পর্যন্ত এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবেন বারবার। নদীটা চড়াই-উতরাই পথে বয়ে যাওয়া ও নিচের ছোট ছোট পাথরের কারণে এ কাণ্ড। এখানটায় স্রোতও বেশি।
শুরু থেকেই দুই পাশের গাছ-গাছালিতে ঠাসা সবুজ পাহাড় মন কেড়ে নেবে আপনার। ভাগ্য ভালো থাকলে হয়তো পাহাড়ের দেয়াল বেয়ে উঠতে দেখবেন কোনো বন ছাগলকে। অথবা হঠাৎ এক পলকের জন্য দেখবেন সবুজের মাঝখানে লাল একটা শরীর, মায়া হরিণ।
তিন্দু ছাড়ানোর একটু পরেই ছোট ও মাঝারি আকারের প্রচুর পাথর দেখবেন নদীতে। তারপরই চলে আসবেন আশ্চর্য সুন্দর এক জগতে। রাজা পাথর, বড় পাথর এমনই নানা নামের বিশাল সব পাথর যেখানে নদীর দখল নিতে মহাব্যস্ত। চারপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে এক সময় পৌঁছে যাবেন রেমাক্রিতে। শুরুতেই রেমাক্রি ঝরনায় মুগ্ধ হবেন। তারপর রেমাক্রি বাজারের আশপাশে স্থানীয়দের কোনো একটি হোটেলে উঠে পড়বেন রাত কাটানোর জন্য। সেখান থেকেই সাঙ্গু নদী আর চারপাশের পাহাড় দেখেও কাটিয়ে দিতে পারবেন অনেকটা সময়। রেমাক্রি পর্যন্ত ঘুরে আসতে পারবেন পরিবার নিয়েই।
পর্যটকদের প্রিয় সাজেক
পর্যটকদের প্রিয় ভ্রমণ গন্তব্যের লিস্টিতে সাজেক কয়েক বছর ধরেই আছে ওপরের দিকে। পুরোনো সেই সাজেকের সঙ্গে এখন আর হোটেল-মোটেল-রিসোর্টে গিজগিজ করা সাজেককে মেলাতে পারি না আর। আগের সেই বুনো সৌন্দর্যের অভাব অনুভব করলেও এখনো সাজেকে পর্যটকের মন কেড়ে নেওয়ার মতো অনেক কিছুই আছে। হোটেল কিংবা রিসোর্টের বারান্দায় দাঁড়ালে মনে হবে যেন অন্য এক পৃথিবীর দুয়ার খুলে গিয়েছে। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ পাহাড়। সাদা মেঘেরা যখন পাহাড়ের সবুজ শরীর ঢেকে দেয় তখন জন্ম হয় অন্য রকম এক সৌন্দর্যের।
কখনো কখনো রুইলুই পাড়ার পাকা সড়কটি ধরে হাঁটার সময়ও আশপাশে ওড়াউড়ি করতে দেখবেন মেঘেদের। রাঙামাটি জেলায় পড়লেও সাজেক যাওয়াটা সহজ খাগড়াছড়ি থেকেই। বাঘাইহাট থেকে সেনা সদস্যদের এসকর্ট নিয়ে যখন চান্দের গাড়িটা পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথে চলা শুরু করবে রোমাঞ্চে গা কাটা দেবে আপনার। পাহাড়ি সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এক সময় পৌঁছে যাবেন সাজেকে। রুইলুই পাড়ার হেলিপ্যাড, লুসাই জাদুঘর কিংবা কংলাক পাহাড়ে তো যাবেনই। যদি ভিড়-বাট্টা বেশি মনে হয় তবে পাহাড়ের কোনো পাকদণ্ডী ধরে একাকী বেশ কতকটা হাঁটতে পারেন।
রেমা-কালেঙ্গার অরণ্যে
মৌলভীবাজার জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের অবস্থান। চুপচাপ থেকে বনপথ ধরে কিছুটা সময় হাঁটলেই ভাগ্য ভালো থাকলে মুখপোড়া কিংবা চশমা হনুমানদের দেখা পেয়ে যাবেন। খুব ভোরে যদি বেরোতে পারেন তাহলে হয়তো মায়া হরিণেরও দেখা মিলে যেতে পারে। রাতে আবার দেখা মিলতে পারে লাজুক স্বভাবের লজ্জাবতী বানরদের।
বনের রেমা বিটে শকুনদের একটি দলের আবাস। রেমার আশপাশে কয়েকটি চা বাগান আছে। বনের পাশাপাশি এসব চা-বাগানেও কখনো কখনো বন মোরগের দেখা মেলে। রেমার বনের পাহাড়ি ছড়াগুলোর ওপরের সিঁকো পেরিয়ে যেতেও অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ অনুভব করবেন। কালেঙ্গার লেকটির আশপাশে ভাগ্য ভালো থাকলে দেখা পেয়ে যেতে পারেন ভোঁদড়দের।
প্রাকৃতিক বন, বন্যপ্রাণী, চা বাগান, পাহাড়ি ছড়া সবকিছু মিলিয়ে প্রকৃতিপ্রেমিকদের জন্য চমৎকার এক জায়গা রেমা-কালেঙ্গা। তবে অরণ্যপথে হাঁটার সময় জোঁক ও সাপের ব্যাপারে সতর্ক থাকাটা জরুরি।
অপরূপ লোভাছড়া
সিলেট জেলার কানাইঘাটের ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা এক এলাকা লোভাছড়া। লোভাছড়া যাওয়া যায় দুইভাবে—একটি হলো নদী ধরে, অপরটি সড়কপথে। তবে লোভাছড়ায় যাওয়ার রাস্তাটার অবস্থা সুবিধের নয়, তাই সুরমা নদীর ঘাট থেকে একটি নৌকা ভাড়া করে তাতে চেপে বসাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এক জায়গায় এসে দেখবেন হঠাৎ অনেক চওড়া হয়ে গেল নদী। একটু খেয়াল করতেই বুঝবেন তিন নদী এক হয়েছে এখানে। সুরমা ছাড়া বাকি দুটি নদী হলো বরাক আর লোভাছড়া।
লোভাছড়া নাম হলেও এটি আসলে নদী। নদী থেকে সীমান্তের ওপাশের খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড় থেকে চোখ সরাতে পারবেন না। এক সময় চলে আসবেন নদীর ঘাঁটে। তারপর ঘুরে দেখবেন লোভাছড়ার চা-বাগান। চা বাগানের সীমানায় ব্রিটিশ আমলে বানানো ঝুলন্ত সেতুটা দেখবেন। লোভাছাড়া বাগানের খরে ছাওয়া বিশাল বাংলোটাও মুগ্ধ করবে আপনাকে। বাগানের কোনো চা বাগান শ্রমিক হয়তো আপনাকে শুনাবে বছর কয়েক আগে ওপাশের পাহাড় থেকে বাগানে চিতা বাঘ নামার গল্প। লোভাছড়া নদীতে ফিরে এসে স্বচ্ছ জলের তলে নানা আকারের পাথর দেখবেন।
বন্যপ্রাণী দেখতে কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে
কর্ণফুলী নদীর এক পাশে সীতা পাহাড়, অপর পাশে রাম পাহাড়। নদীর কিনারা থেকে ওঠে যাওয়া সীতা পাহাড়ের দিকে তাকালে কিছু কিছু অংশে এখনো গহিন বনের দেখা পাবেন। উঁচু সব বৃক্ষ, নানা ধরনের লতা মিলিয়ে আদিম কোনো জঙ্গলের কথাই মনে করিয়ে দেবে। নিচ থেকে পাহাড়চূড়ায় গাছের ডালে ডালে ঘুরে বেড়ানো বানরদের দেখাবে লিলিপুটদের মতো।
ওপাশে রাম পাহাড়ে গিয়ে শুনবেন গাছ বাওয়ায় দক্ষ লতা বাঘ বা মেঘলা চিতাদের গল্প। রাম পাহাড়ের ঝিরির শীতল জলে পা ভিজিয়েও অনেক আনন্দ পাবেন। কর্ণফুলী বিট বা কাপ্তাই মুখ খালের জঙ্গলে গেলে দেখা মিলতে পারে বুনো হাতিদের। আবার রাঙামাটি থেকে কাপ্তাই লেকের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া পথেও বুনো হাতিদের সাক্ষাৎ মিলে যেতে পারে। ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে কাপ্তাই যাওয়া যায়, তেমনি যেতে পারেন রাঙামাটি হয়েও। কাপ্তাই থেকে হ্রদ ধরে বিলাইছড়ি যাওয়ার পথটাও ভারি সুন্দর।
ছোট্ট বন সাতছড়ি
হবিগঞ্জ জেলার ছোট্ট এক বন সাতছড়ি। ঢাকা-সিলেটর পুরোনো মহাসড়কটি ধরে গেলে দেখা মিলবে চুনারুঘাটের সাতছড়ি বনের। বনে পৌঁছাবার আগেই সুরমা আর সাতছড়ি চা বাগান মনটা আনন্দে ভরিয়ে দেবে। ছোট্ট বন হলে কী হবে ভালুক ও বন্য কুকুরের মতো প্রাণীদেরও দেখা মেলে এখানে। বালুময় বনপথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার পথে দেখবেন মায়া হরিণ কিংবা বুনো শূকরের পায়ের ছাপ। বিশাল চাপালিশ গাছগুলো থেকে পড়া ফলগুলো দেখে ভাববেন আরে কাঁঠালের মিনি সংস্করণ নাকি!
সাতছড়ির চমৎকার ওয়াচ টাওয়ার থেকে চারপাশের বন ছাড়াও নানা জাতের পাখিদের দেখা পাওয়া সহজ। বন বিভাগের অফিসের সামনের বনে নিয়মিতই দেখা মেলে হনুমানদের। এদিকে পাম বাগানে মেলা বসে বানরদের। বাসে গেলে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ নেমে সহজেই পৌঁছে যেতে পারবেন বনটিতে। ট্রেনে গেলে নামতে পারেন নয়াপাড়া স্টেশনে।
নদী আর চা বাগানের লালা খাল
লালাখাল পড়েছে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায়। নৌকায় চেপে যখন লালাখাল ভ্রমণ করতে করতে খালের এমন একটি জায়গায় পৌঁছে যাবেন যেখানে আর এগোনোর সুযোগ নেই। কারণ তারপর থেকেই পাশের দেশ ভারতের সীমানা। তবে খালের স্বচ্ছ জল আর ওপাশের উঁচু পাহাড়গুলোর দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবে যে সন্দেহ নেই।
নৌকা থেকে নেমে বাংলাদেশের সীমানায় পাবেন ছোট পাহাড় আর চমৎকার কয়েকটি চা বাগান। পাহাড়ের ওপর থেকে খালসহ চারপাশের দৃশ্য দেখে ভুলে যাবেন উঁচু পাহাড়গুলোর বেশি কাছে যেতে না পারার দুঃখ।
চলো যাই চন্দ্রনাথ পাহাড়ে
সীতাকুণ্ড-মিরসরাইয়ের উঁচু পাহাড়গুলো দেখে হঠাৎ মনে হতে পারে পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমানায় চলে এলাম নাকি! আর পর্যটকদের কাছে এই এলাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ভ্রমণগন্তব্যগুলোর একটি চন্দ্রনাথ পাহাড়। হাজার ফুটের বেশি উঁচু পাহাড়টায় চড়া খুব কঠিন নয়। পাদদেশে পৌঁছাতেই দেখবেন দোকানে লাঠি ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে। এটা সঙ্গে নিলে পাহাড়ে ওঠাটা সহজ হবে। তবে ভ্রমণের আগে যদি বৃষ্টি হয় তবে বাড়তি সতর্কতা জরুরি।
পাহাড়ের চূড়া থেকে চারপাশের এলাকাটা দেখতে পাবেন পাখির চোখে। শিবচতুর্দশী মেলার সময় পাহাড়ের ওপরের চন্দ্রনাথ মন্দিরে পুণ্যার্থীদের ঢল নামে। ওই সময় গেলে মেলাটি উপভোগ ও পাহাড়ে চড়া দুটোই হয়। তবে তখন ভিড়টা বেশি থাকে। শুক্র কিংবা শনিবার এড়িয়ে গেলে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারবেন মন ভরে।
জলের বন রাতারগুল
জলের রাজ্যে অসাধারণ এক অরণ্য রাতারগুল। বিশেষ করে বর্ষায় অরণ্যটি সবচেয়ে সুন্দর। অবশ্য শরতেও খারাপ লাগবে না। সরু খাল ধরে যখন ছোট নৌকায় চেপে যাবেন একেবারে অন্যরকম এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবেন। কখনো কখনো আশপাশের ডালের খোঁচা এড়াতে নিচু হয়ে যাবেন কখনো আবার হঠাৎ সামনে একটা ডাল আবিষ্কার করে মাথাটা নিচু করে ফেলবেন। পানি যখন কমে যায় তখন জঙ্গলের পথ ধরে হেঁটেও বেড়ানো যায়।
জঙ্গলটিতে চমৎকার একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে। সেখান থেকে চারপাশের জল এবং জঙ্গলের রাজ্য ধরা দেবে মোহনীয় রূপে। বনে বানর আছে বেশ। নৌকা থেকে হঠাৎই হয়তো দেখবেন পাশের গাছটা ডালে বসে ভেংচি কাটছে এদের কোনো একটি। নানা ধরনের পাখিরও দেখা মেলে। তবে সাপের ব্যাপারে একটু সাবধান থাকতে হবে রাতারগুল ভ্রমণে। সিলেট শহর থেকে খুব দূরে নয় বনটি। সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে পৌঁছে যেতে পারবেন ঘাটে। তারপর বন বিভাগের নির্দিষ্ট ফি পরিশোধ করে ডিঙি নৌকা ভাড়া করে প্রবেশ করবেন মনোমুগ্ধকর এক রাজ্যে।
চলার পথে ডিম পাহাড়
থানচি থেকে আলীকদম যাওয়ার পথটা এমন যে একবার গেলে শুধুমাত্র ওই পথে ভ্রমণ করতেই সেখানে বারবার ছুটে যেতে ইচ্ছা করবে আপনার। এই পথ দিয়ে মোটরসাইকেল কিংবা অন্য কোনো যানবাহনে চেপে যাওয়ার সময় দেখা পাবেন ডিম পাহাড়ের। কখনো কখনো আপনার পথ আগলে দাঁড়াবে মেঘে। বর্ষায় কোনো কোনো সময় আশপাশের পাহাড়গুলোর এত ঘন সাদা মেঘে ঢেকে যায় যে আপনার মনে হবে এগুলোর ওপর কিছু পড়লে আটকে যাবে।
হঠাৎ পথটা অনেকটা খাঁড়া ওপরের দিকে ওঠে গেছে, কখনো আবার নেমে গেছে। চারপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে এমন একটা রোমাঞ্চকর পথে ভ্রমণের চেয়ে আনন্দদায়ক আর কী হতে পারে বলেন!
বর্ষা পেরিয়ে এখন চলছে শরৎ। এ সময় পাহাড়ের রং থাকে সবুজ। কোথাও কোথাও এখনো দেখতে পাবেন জুমের ফসল তোলার দৃশ্য। ঝরনা-ঝিরিতেও যথেষ্ট পানি আছে। এদিকে বৃষ্টি কমে আসায় জঙ্গল-পাহাড় ভ্রমণে বিপত্তিতে পড়ার সুযোগ কম। কাজেই সবুজ পাহাড়-বনানী, পাহাড়ি নদী, ঝিরি ভ্রমণের জন্য সময়টা আদর্শ। আপনার জন্য বাড়তি পাওয়া শরতের নীল আকাশ। আজ বিশ্ব পর্যটন দিবসে থাকছে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের পাহাড়, অরণ্যময় দশটি জায়গার গল্প।
সাঙ্গু নদী ধরে রেমাক্রি
বান্দরবানের থানচির সাঙ্গু নদী থেকে শুরু করবেন আশ্চর্য এই নৌকা ভ্রমণ। মিনিট পনেরো-কুড়ি পরেই এমন এক জায়গায় চলে আসবেন যেখানে মনে হবে পানি ফুটছে। নৌকাটা যখন তীব্র গতিতে জায়গাটি পেরোতে থাকবে তখন কেমন ভয় ভয় করবে, তার চেয়েও বেশি যেটা অনুভব করবেন সেটা রোমাঞ্চ। রেমাক্রি পর্যন্ত এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবেন বারবার। নদীটা চড়াই-উতরাই পথে বয়ে যাওয়া ও নিচের ছোট ছোট পাথরের কারণে এ কাণ্ড। এখানটায় স্রোতও বেশি।
শুরু থেকেই দুই পাশের গাছ-গাছালিতে ঠাসা সবুজ পাহাড় মন কেড়ে নেবে আপনার। ভাগ্য ভালো থাকলে হয়তো পাহাড়ের দেয়াল বেয়ে উঠতে দেখবেন কোনো বন ছাগলকে। অথবা হঠাৎ এক পলকের জন্য দেখবেন সবুজের মাঝখানে লাল একটা শরীর, মায়া হরিণ।
তিন্দু ছাড়ানোর একটু পরেই ছোট ও মাঝারি আকারের প্রচুর পাথর দেখবেন নদীতে। তারপরই চলে আসবেন আশ্চর্য সুন্দর এক জগতে। রাজা পাথর, বড় পাথর এমনই নানা নামের বিশাল সব পাথর যেখানে নদীর দখল নিতে মহাব্যস্ত। চারপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে এক সময় পৌঁছে যাবেন রেমাক্রিতে। শুরুতেই রেমাক্রি ঝরনায় মুগ্ধ হবেন। তারপর রেমাক্রি বাজারের আশপাশে স্থানীয়দের কোনো একটি হোটেলে উঠে পড়বেন রাত কাটানোর জন্য। সেখান থেকেই সাঙ্গু নদী আর চারপাশের পাহাড় দেখেও কাটিয়ে দিতে পারবেন অনেকটা সময়। রেমাক্রি পর্যন্ত ঘুরে আসতে পারবেন পরিবার নিয়েই।
পর্যটকদের প্রিয় সাজেক
পর্যটকদের প্রিয় ভ্রমণ গন্তব্যের লিস্টিতে সাজেক কয়েক বছর ধরেই আছে ওপরের দিকে। পুরোনো সেই সাজেকের সঙ্গে এখন আর হোটেল-মোটেল-রিসোর্টে গিজগিজ করা সাজেককে মেলাতে পারি না আর। আগের সেই বুনো সৌন্দর্যের অভাব অনুভব করলেও এখনো সাজেকে পর্যটকের মন কেড়ে নেওয়ার মতো অনেক কিছুই আছে। হোটেল কিংবা রিসোর্টের বারান্দায় দাঁড়ালে মনে হবে যেন অন্য এক পৃথিবীর দুয়ার খুলে গিয়েছে। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ পাহাড়। সাদা মেঘেরা যখন পাহাড়ের সবুজ শরীর ঢেকে দেয় তখন জন্ম হয় অন্য রকম এক সৌন্দর্যের।
কখনো কখনো রুইলুই পাড়ার পাকা সড়কটি ধরে হাঁটার সময়ও আশপাশে ওড়াউড়ি করতে দেখবেন মেঘেদের। রাঙামাটি জেলায় পড়লেও সাজেক যাওয়াটা সহজ খাগড়াছড়ি থেকেই। বাঘাইহাট থেকে সেনা সদস্যদের এসকর্ট নিয়ে যখন চান্দের গাড়িটা পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথে চলা শুরু করবে রোমাঞ্চে গা কাটা দেবে আপনার। পাহাড়ি সৌন্দর্য দেখতে দেখতে এক সময় পৌঁছে যাবেন সাজেকে। রুইলুই পাড়ার হেলিপ্যাড, লুসাই জাদুঘর কিংবা কংলাক পাহাড়ে তো যাবেনই। যদি ভিড়-বাট্টা বেশি মনে হয় তবে পাহাড়ের কোনো পাকদণ্ডী ধরে একাকী বেশ কতকটা হাঁটতে পারেন।
রেমা-কালেঙ্গার অরণ্যে
মৌলভীবাজার জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের অবস্থান। চুপচাপ থেকে বনপথ ধরে কিছুটা সময় হাঁটলেই ভাগ্য ভালো থাকলে মুখপোড়া কিংবা চশমা হনুমানদের দেখা পেয়ে যাবেন। খুব ভোরে যদি বেরোতে পারেন তাহলে হয়তো মায়া হরিণেরও দেখা মিলে যেতে পারে। রাতে আবার দেখা মিলতে পারে লাজুক স্বভাবের লজ্জাবতী বানরদের।
বনের রেমা বিটে শকুনদের একটি দলের আবাস। রেমার আশপাশে কয়েকটি চা বাগান আছে। বনের পাশাপাশি এসব চা-বাগানেও কখনো কখনো বন মোরগের দেখা মেলে। রেমার বনের পাহাড়ি ছড়াগুলোর ওপরের সিঁকো পেরিয়ে যেতেও অদ্ভুত এক রোমাঞ্চ অনুভব করবেন। কালেঙ্গার লেকটির আশপাশে ভাগ্য ভালো থাকলে দেখা পেয়ে যেতে পারেন ভোঁদড়দের।
প্রাকৃতিক বন, বন্যপ্রাণী, চা বাগান, পাহাড়ি ছড়া সবকিছু মিলিয়ে প্রকৃতিপ্রেমিকদের জন্য চমৎকার এক জায়গা রেমা-কালেঙ্গা। তবে অরণ্যপথে হাঁটার সময় জোঁক ও সাপের ব্যাপারে সতর্ক থাকাটা জরুরি।
অপরূপ লোভাছড়া
সিলেট জেলার কানাইঘাটের ভারতীয় সীমান্তঘেঁষা এক এলাকা লোভাছড়া। লোভাছড়া যাওয়া যায় দুইভাবে—একটি হলো নদী ধরে, অপরটি সড়কপথে। তবে লোভাছড়ায় যাওয়ার রাস্তাটার অবস্থা সুবিধের নয়, তাই সুরমা নদীর ঘাট থেকে একটি নৌকা ভাড়া করে তাতে চেপে বসাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এক জায়গায় এসে দেখবেন হঠাৎ অনেক চওড়া হয়ে গেল নদী। একটু খেয়াল করতেই বুঝবেন তিন নদী এক হয়েছে এখানে। সুরমা ছাড়া বাকি দুটি নদী হলো বরাক আর লোভাছড়া।
লোভাছড়া নাম হলেও এটি আসলে নদী। নদী থেকে সীমান্তের ওপাশের খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড় থেকে চোখ সরাতে পারবেন না। এক সময় চলে আসবেন নদীর ঘাঁটে। তারপর ঘুরে দেখবেন লোভাছড়ার চা-বাগান। চা বাগানের সীমানায় ব্রিটিশ আমলে বানানো ঝুলন্ত সেতুটা দেখবেন। লোভাছাড়া বাগানের খরে ছাওয়া বিশাল বাংলোটাও মুগ্ধ করবে আপনাকে। বাগানের কোনো চা বাগান শ্রমিক হয়তো আপনাকে শুনাবে বছর কয়েক আগে ওপাশের পাহাড় থেকে বাগানে চিতা বাঘ নামার গল্প। লোভাছড়া নদীতে ফিরে এসে স্বচ্ছ জলের তলে নানা আকারের পাথর দেখবেন।
বন্যপ্রাণী দেখতে কাপ্তাই জাতীয় উদ্যানে
কর্ণফুলী নদীর এক পাশে সীতা পাহাড়, অপর পাশে রাম পাহাড়। নদীর কিনারা থেকে ওঠে যাওয়া সীতা পাহাড়ের দিকে তাকালে কিছু কিছু অংশে এখনো গহিন বনের দেখা পাবেন। উঁচু সব বৃক্ষ, নানা ধরনের লতা মিলিয়ে আদিম কোনো জঙ্গলের কথাই মনে করিয়ে দেবে। নিচ থেকে পাহাড়চূড়ায় গাছের ডালে ডালে ঘুরে বেড়ানো বানরদের দেখাবে লিলিপুটদের মতো।
ওপাশে রাম পাহাড়ে গিয়ে শুনবেন গাছ বাওয়ায় দক্ষ লতা বাঘ বা মেঘলা চিতাদের গল্প। রাম পাহাড়ের ঝিরির শীতল জলে পা ভিজিয়েও অনেক আনন্দ পাবেন। কর্ণফুলী বিট বা কাপ্তাই মুখ খালের জঙ্গলে গেলে দেখা মিলতে পারে বুনো হাতিদের। আবার রাঙামাটি থেকে কাপ্তাই লেকের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া পথেও বুনো হাতিদের সাক্ষাৎ মিলে যেতে পারে। ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে কাপ্তাই যাওয়া যায়, তেমনি যেতে পারেন রাঙামাটি হয়েও। কাপ্তাই থেকে হ্রদ ধরে বিলাইছড়ি যাওয়ার পথটাও ভারি সুন্দর।
ছোট্ট বন সাতছড়ি
হবিগঞ্জ জেলার ছোট্ট এক বন সাতছড়ি। ঢাকা-সিলেটর পুরোনো মহাসড়কটি ধরে গেলে দেখা মিলবে চুনারুঘাটের সাতছড়ি বনের। বনে পৌঁছাবার আগেই সুরমা আর সাতছড়ি চা বাগান মনটা আনন্দে ভরিয়ে দেবে। ছোট্ট বন হলে কী হবে ভালুক ও বন্য কুকুরের মতো প্রাণীদেরও দেখা মেলে এখানে। বালুময় বনপথ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার পথে দেখবেন মায়া হরিণ কিংবা বুনো শূকরের পায়ের ছাপ। বিশাল চাপালিশ গাছগুলো থেকে পড়া ফলগুলো দেখে ভাববেন আরে কাঁঠালের মিনি সংস্করণ নাকি!
সাতছড়ির চমৎকার ওয়াচ টাওয়ার থেকে চারপাশের বন ছাড়াও নানা জাতের পাখিদের দেখা পাওয়া সহজ। বন বিভাগের অফিসের সামনের বনে নিয়মিতই দেখা মেলে হনুমানদের। এদিকে পাম বাগানে মেলা বসে বানরদের। বাসে গেলে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ নেমে সহজেই পৌঁছে যেতে পারবেন বনটিতে। ট্রেনে গেলে নামতে পারেন নয়াপাড়া স্টেশনে।
নদী আর চা বাগানের লালা খাল
লালাখাল পড়েছে সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলায়। নৌকায় চেপে যখন লালাখাল ভ্রমণ করতে করতে খালের এমন একটি জায়গায় পৌঁছে যাবেন যেখানে আর এগোনোর সুযোগ নেই। কারণ তারপর থেকেই পাশের দেশ ভারতের সীমানা। তবে খালের স্বচ্ছ জল আর ওপাশের উঁচু পাহাড়গুলোর দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবে যে সন্দেহ নেই।
নৌকা থেকে নেমে বাংলাদেশের সীমানায় পাবেন ছোট পাহাড় আর চমৎকার কয়েকটি চা বাগান। পাহাড়ের ওপর থেকে খালসহ চারপাশের দৃশ্য দেখে ভুলে যাবেন উঁচু পাহাড়গুলোর বেশি কাছে যেতে না পারার দুঃখ।
চলো যাই চন্দ্রনাথ পাহাড়ে
সীতাকুণ্ড-মিরসরাইয়ের উঁচু পাহাড়গুলো দেখে হঠাৎ মনে হতে পারে পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমানায় চলে এলাম নাকি! আর পর্যটকদের কাছে এই এলাকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ভ্রমণগন্তব্যগুলোর একটি চন্দ্রনাথ পাহাড়। হাজার ফুটের বেশি উঁচু পাহাড়টায় চড়া খুব কঠিন নয়। পাদদেশে পৌঁছাতেই দেখবেন দোকানে লাঠি ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে। এটা সঙ্গে নিলে পাহাড়ে ওঠাটা সহজ হবে। তবে ভ্রমণের আগে যদি বৃষ্টি হয় তবে বাড়তি সতর্কতা জরুরি।
পাহাড়ের চূড়া থেকে চারপাশের এলাকাটা দেখতে পাবেন পাখির চোখে। শিবচতুর্দশী মেলার সময় পাহাড়ের ওপরের চন্দ্রনাথ মন্দিরে পুণ্যার্থীদের ঢল নামে। ওই সময় গেলে মেলাটি উপভোগ ও পাহাড়ে চড়া দুটোই হয়। তবে তখন ভিড়টা বেশি থাকে। শুক্র কিংবা শনিবার এড়িয়ে গেলে পাহাড়ের সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারবেন মন ভরে।
জলের বন রাতারগুল
জলের রাজ্যে অসাধারণ এক অরণ্য রাতারগুল। বিশেষ করে বর্ষায় অরণ্যটি সবচেয়ে সুন্দর। অবশ্য শরতেও খারাপ লাগবে না। সরু খাল ধরে যখন ছোট নৌকায় চেপে যাবেন একেবারে অন্যরকম এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবেন। কখনো কখনো আশপাশের ডালের খোঁচা এড়াতে নিচু হয়ে যাবেন কখনো আবার হঠাৎ সামনে একটা ডাল আবিষ্কার করে মাথাটা নিচু করে ফেলবেন। পানি যখন কমে যায় তখন জঙ্গলের পথ ধরে হেঁটেও বেড়ানো যায়।
জঙ্গলটিতে চমৎকার একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে। সেখান থেকে চারপাশের জল এবং জঙ্গলের রাজ্য ধরা দেবে মোহনীয় রূপে। বনে বানর আছে বেশ। নৌকা থেকে হঠাৎই হয়তো দেখবেন পাশের গাছটা ডালে বসে ভেংচি কাটছে এদের কোনো একটি। নানা ধরনের পাখিরও দেখা মেলে। তবে সাপের ব্যাপারে একটু সাবধান থাকতে হবে রাতারগুল ভ্রমণে। সিলেট শহর থেকে খুব দূরে নয় বনটি। সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে পৌঁছে যেতে পারবেন ঘাটে। তারপর বন বিভাগের নির্দিষ্ট ফি পরিশোধ করে ডিঙি নৌকা ভাড়া করে প্রবেশ করবেন মনোমুগ্ধকর এক রাজ্যে।
চলার পথে ডিম পাহাড়
থানচি থেকে আলীকদম যাওয়ার পথটা এমন যে একবার গেলে শুধুমাত্র ওই পথে ভ্রমণ করতেই সেখানে বারবার ছুটে যেতে ইচ্ছা করবে আপনার। এই পথ দিয়ে মোটরসাইকেল কিংবা অন্য কোনো যানবাহনে চেপে যাওয়ার সময় দেখা পাবেন ডিম পাহাড়ের। কখনো কখনো আপনার পথ আগলে দাঁড়াবে মেঘে। বর্ষায় কোনো কোনো সময় আশপাশের পাহাড়গুলোর এত ঘন সাদা মেঘে ঢেকে যায় যে আপনার মনে হবে এগুলোর ওপর কিছু পড়লে আটকে যাবে।
হঠাৎ পথটা অনেকটা খাঁড়া ওপরের দিকে ওঠে গেছে, কখনো আবার নেমে গেছে। চারপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে এমন একটা রোমাঞ্চকর পথে ভ্রমণের চেয়ে আনন্দদায়ক আর কী হতে পারে বলেন!
দিগন্তবিস্তৃত ধানখেতের মাথার ওপর নীল আকাশে উঁকি দেবে সাদা মেঘ। শরৎকাল বলে ভুল হতে পারে। ভুল ভাঙলে দেখতে পাবেন, মেঘের ভেলা সূর্যের আলোয় ক্ষণে ক্ষণে রং বদলে হয়ে উঠছে গোলাপি কিংবা লাল। বুঝবেন, আপনি শরতের সাদা মেঘ নয়, দেখছেন তুষারে ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘা।
২ দিন আগেকোনো কিছু ওপর থেকে নিচে পড়ে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে। স্কুলের পদার্থবিজ্ঞান বইয়ে আমরা সবাই এ বিষয়ে পড়েছি। কিন্তু এমন কিছু জায়গা আছে, যেগুলোতে স্যার আইজ্যাক নিউটনের সূত্র কাজ করে না। অর্থাৎ সেসব জায়গায় কোনো মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নেই। যেতে চান সেই সব জায়গায়?
২ দিন আগেশীত, বসন্ত আর বর্ষায় বাংলার নীল নদ সারির রূপ বদলে ফেলে। বর্ষায় পাহাড়ি ঢল নামলে দক্ষ মাঝিরাও ভয়ে ভয়ে বইঠা চালান। আর শীতে সারি নদীর নীল পানি দেয় অপার্থিব জগতের খোঁজ। নদীটি ধরে কিছুদূর উজান বাইলেই পাওয়া যাবে লালাখাল জিরো পয়েন্ট।
২ দিন আগেভ্রমণকালে রোগবালাই থেকে দূরে থাকার বিকল্প নেই। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা শক্তিশালী না হলে ভ্রমণের আনন্দ মাঠে মারা যেতে পারে। ভ্রমণের সময় রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ানোর জন্য বেছে নিতে পারেন কিছু উপায়।
২ দিন আগে