নীতা আম্বানির কালো শাড়ি

রজত কান্তি রায়, ঢাকা
প্রকাশ : ০১ এপ্রিল ২০২৪, ১৯: ০৭
আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১৩: ৪৩

প্রশ্নটা হলো, নীতা আম্বানির পছন্দের রং কী? কারণ, এত বৈচিত্র্যময় রঙের পোশাক তাঁকে পরতে দেখা যায় যে সেখান থেকে তাঁর পছন্দের রং বের করা অসম্ভব বিষয়। কিন্তু এপ্রিলের পয়লা দিন টাইমস অব ইন্ডিয়া নীতার কালো শাড়ির যে বর্ণনা দিয়েছে, সেটা এপ্রিল ফুল নয়। বাস্তব। সংবাদমাধ্যমটি তাদের ইংরেজি ভাষার অনলাইন সংস্করণে লিখেছে, ‘নীতা আম্বানি স্টানস ইন এ ব্ল্যাক শাড়ি উইথ হ্যান্ড এমব্রয়ডার্ড রেশম, ক্রিস্টাল অ্যান্ড সিকুইন।’ ক্রিস্টাল ও সিকুইন বসানো রেশমের এমব্রয়ডারি করা কালো শাড়িতে মাত করেছেন নীতা—ইংরেজি লাইনের এমন এক বাংলা করা যায়। ‘মাত’ করেছেন না লিখে মুগ্ধ করেছেনও লেখা যায় বটে। তাতে বিষয়টার গুরুত্ব কমে যায়।

শাড়ির প্রতি নীতা আম্বানির পক্ষপাতমূলক আকর্ষণ তাঁর লাইফস্টাইলের দারুণ দিক। ব্যবসায়ী এই নারী তাঁর ব্যবসায়িক উদ্যোগ, জনহিতকর কাজ এবং ঐতিহ্যবাহী পোশাকের প্রতি ভালোবাসার জন্য বেশ প্রশংসিত পুরো ভারতে। ঐতিহ্যবাহী পোশাক, বিশেষ করে শাড়ির প্রতি নীতার ভালোবাসা কেবল তাঁর সংস্কৃতির প্রতি দরদের কথাই বলে না, তাঁকে ফ্যাশন আইকন হিসেবেও জায়গা করে দিয়েছে বিশ্বময়।

উজ্জ্বল কালো রঙের শাড়িতে সজ্জিত নীতা আম্বানির যে ছবিগুলো টাইমস অব ইন্ডিয়া প্রকাশ করেছে, সে শাড়ি বিখ্যাত ডিজাইনার জুটি আবু জানি ও সন্দীপ খোসলার তৈরি করা। সংবাদমাধ্যমটি ছবিগুলো নিয়ে লিখেছে, এগুলোতে নীতার গ্ল্যামার ও পরিশীলিত রূপের বিকিরণ ধরা পড়েছে। সিল্ক ও রেশম সুতা দিয়ে সাবধানে হাতে এমব্রয়ডারি করা, স্ফটিক এবং সিকুইন অলংকরণে সজ্জিত নোয়ার শ্যাডো শাড়িকে বলা হচ্ছে ‘কালজয়ী কমনীয়তা ও ঐশ্বর্যের প্রতীক’।

কালো রঙের এই সূক্ষ্ম শাড়ির পরিপূরক ছিল একটি টিউল ব্লাউজ। সেটিও কালো রেশমের থ্রেড, পুঁতি আর স্ফটিক দিয়ে জটিলভাবে হাতে সুচিকর্ম করা। অনবদ্য কারুকাজ করা ব্লাউজটি শাড়ির সঙ্গে ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা নীতার পুরো সজ্জাকে দিয়েছিল পূর্ণতা। সঙ্গে একসেসরিজ হিসেবে ছিল বড় আকারের কানের দুল, একটি চকচকে হিরার ব্রেসলেট এবং একটি ঐতিহ্যবাহী বিন্দি অর্থাৎ টিপ। তাঁর মেকআপে ছিল ‘শিশিরের দীপ্তি’—লিখেছে টাইমস অব ইন্ডিয়া। সে মেকআপে ছিল স্মোকি আই ( ধোঁয়াটে চোখ বললে যা বোঝা দুষ্কর), চোখে ছিল মাসকারা, ভ্রুযুগল ছিল ধনুকের মতো আর ঠোঁটে ছিল ন্যুড লিপস্টিক। এই ন্যুড বিষয়টি ফ্যাশন দুনিয়ায় এখন চলে বহুল। এর সঙ্গে আবরণহীনতার কোনো সম্পর্ক নেই। বরং বলা চলে, আবরণহীন আবরণ। এখানে খেয়াল করার বিষয় আছে। ‘নোয়ার’ (Noir) শব্দটি ব্যবহার করা হয় ক্রাইম জনরার চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে। আর শিল্প-সাহিত্যের অন্যান্য জায়গায় ডার্ক বা কালো বিষয় বোঝাতে এই টার্মটি ব্যবহার করা হয়। এটি কিন্তু শুধুই কালো নয়। এই কালোর ভেতরে রয়েছে আরও অনেক ডার্ক উপকরণ। সেসব কী, তা নির্ভর করে আপনি বিষয়টিকে কীভাবে দেখতে চাচ্ছেন, তার ওপর। অর্থাৎ শাড়ির এই কালো রংকে আরও বিশেষায়িত করা হয়েছে।

টিওআই লিখেছে, নীতা আম্বানির সাম্প্রতিক শাড়িটি কেবল তাঁর অনবদ্য শৈলীর অনুভূতিকে ধারণ করে না, বরং ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় কারুশিল্পকে সংরক্ষণ ও প্রচারে তাঁর অটল প্রতিশ্রুতির প্রমাণ হিসেবে কাজ করে। তাঁকে আখ্যা দেওয়া হয়েছে ‘শাড়ির রানি’ হিসেবে। এবং বলা হয়েছে ফ্যাশন ও জনহিতৈষী কর্মের জগতে ‘কমনীয়তার আলোকবর্তিকা’ হিসেবে তিনি তাঁর মর্যাদাকে দৃঢ় করে হৃদয় ও মনকে মোহিত করে চলেছেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নীতা আম্বানির প্রতি এই শব্দ তোষণ কি শুধুই তাঁর অর্থ ও খ্যাতির কারণে? সম্ভবত নয়। তাঁর ‘ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় কারুশিল্পকে সংরক্ষণ ও প্রচারে অটল প্রতিশ্রুতির প্রমাণ’কে উপেক্ষা করার কোনো উপায় নেই। ভারত এভাবেই তাঁর কারুশিল্পের সংরক্ষণে এগিয়ে চলেছে। যেখানে আমরা পিছিয়ে পড়েছি যোজন যোজন মাইল। নীতা আম্বানি নিজেকে ভারতীয় কারুশিল্পের সংরক্ষণ ও প্রচারে যে আইকনিক স্তরে নিয়ে গেছেন, আমাদের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে ‘নিজের’ সংস্কৃতির প্রতি যে মমত্ববোধ দরকার, সেটা আমাদের আছে বলে মনে হয় না। আমাদের কে আছেন? একমাত্র মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

খেয়াল করলে দেখবেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর জামদানি শাড়ি বিশেষ পছন্দের। ফলে জামদানির একটা কদর আছে। এর সংরক্ষণ ও প্রচারে আমাদের প্রচেষ্টা আছে। অদ্ভুত সুন্দর মোটিফে তৈরি এসব জামদানি আমাদের, একান্ত আমাদের সম্পদ—সেই স্টেটমেন্ট প্রচার করে চলেছেন তিনি। কিন্তু টাঙ্গাইল বা পাবনা-সিরাজগঞ্জের শাড়ির ক্ষেত্রে? তেমন কেউ নেই!

সামনে ঈদ ও পয়লা বৈশাখ, পাশাপাশি। আমাদের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি হন্যে হয়ে কপি করতে ব্যস্ত। আর ক্রেতারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যস্ত শুষ্ক দেশপ্রেম প্রদর্শনে। নিট লাভ হবে কি? নিট লাভের জন্য দরকার টাঙ্গাইল শাড়ি, জামদানি, পাবনা-সিরাজগঞ্জের শাড়ি, মিরপুরের কাতান বা বেনারসি কিংবা অন্যান্য দেশি পোশাকের বিপুল বিক্রি। তাতে আমাদের বয়নশিল্পীরা অর্থনৈতিকভাবে ভালো থাকবেন। কাজে আনন্দ ও উদ্যম খুঁজে পাবেন। আর আমাদের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি নিজস্বতা খুঁজে পাবে। এই পুরো চক্রটা পূর্ণ না হলে টাঙ্গাইল শাড়ি, জামদানি কিংবা শতরঞ্জি ইত্যাদির জিআই পেটেন্ট নিয়ে আদৌ কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত